বেচারা শঙ্কর। সে এমনই হদ্দমু ভালবাসত রীণাকে যে প্রস্তাব শুনে প্রথমটায় রেগে গেল। তারপর যখন বুঝল ওদের আটকানোর উপায় নেই, তখন পাগলের মতো হয়ে গেল। তখন সে বাধ্য হয়েই রীণাকে বলেছিল, যা খুশি করো, কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি বাসুদেবদার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক মেনে নিচ্ছি। শুধু কথা দাও, আমাকে ছেড়ে যাবে না।
পৌরুষের এমন অভাব বাসুদেব কদাচিৎ কোনও পুরুষের মধ্যে দেখেছেন। কেউ এরকমভাবে স্ত্রীর জারকে মেনে নিতে পারে? শঙ্করের অহং বলতে কি কিছু ছিল না। শিখা যদি এরকম করত বাসুদেব তো খুন করে ফেলতেন শিখাকে।
বাসুদেব একদিন রীণাকে বলেছিলেন, শঙ্করের তো উচিত ছিল পিস্তল দিয়ে আমাকে খুন করা।
রীণা অবাক হয়ে তার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, খুন করবে কেন?
কেন করবে না? ওর পৌরুষ নেই?
পৌরুষ কী জিনিস জানি না। কিন্তু জানি ও আমাকে ভীষণ ভালবাসে। আমি আঘাত পাই এমন কাজ ও করবে না।
বাসুদেব তত্ত্বটা বোঝেননি। ভালবাসে বলেই তো প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরিয়ে দেবে। না হলে কেমন ভালবাসা?
না, শঙ্কর কখনও আর অস্ফুট প্রতিবাদও করেনি। এমনকী রীণা তার সঙ্গে চুক্তি করে নিয়েছিল, তার প্রথম সন্তানটি হবে বাসুদেবের। শঙ্কর মেনে নেয়। মেড়া আর কাকে বলে?
বাসুদেব আর রীণার সন্তান হল অজাতশত্রু। না, অজাতশত্রু জানে না যে, বাসুদেবই তার বাবা। তার বৈধ বাবা শঙ্কর।
বাসুদেব চারতলায় উঠে দেখলেন, একটি পরিবার, স্বামী স্ত্রী এবং দুটি বাচ্চা লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে সুইচ টেপাটেপি করছে। স্বামী-স্ত্রীর বয়স ত্রিশের কিছু ওপরে।
বাসুদেব বললেন, লিফট খারাপ। সার্ভিসিং হচ্ছে।
তাই নাকি? বলে ভদ্রলোক তাকালেন বাসুদেবের দিকে। তারপর স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন, চলো তা হলে সিঁড়ি দিয়ে নামি।
কথা বলতে গিয়েই বাসুদেব টের পেলেন, তার হাঁফ ধরে যাচ্ছে, বড় হাঁফ, জিরোতে হবে।
বাসুদেব জানেন, এ সময়ে হাঁ করে শ্বাস নিতে হয়। তাতে বেশি অক্সিজেন যায় শরীরে। দেয়ালে একটু ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ঘাম হচ্ছে। বরাবরই তিনি খাওয়ার ব্যাপারে কিছু তমোগুণী। ঝাল মশলাদার খাদ্য, বিশেষ করে মাংস তার এখনও প্রিয়। ইদানীং পাঠা খাসি বাদ দিয়ে মুরগি খেতে হচ্ছে ডাক্তারের নির্দেশে। রাত্রিবেলা প্রতি দিনই রুটির সঙ্গে মাংস থাকে। থাকে কাঁচা পেঁয়াজ, লঙ্কা। বেশি মাংস খাওয়াটা কি খারাপ হচ্ছে? ছেষট্টি বছর বয়সের পাকযন্ত্রকে কি অতিরিক্ত খাটাচ্ছেন তিনি। মনে পড়ল, আজ দুপুরে তিনি শুটকি মাছ খেয়েছেন। সেটা বেশ ঝাল আর গরগরে মশলাদার ছিল। খেয়েছেন পাবদা এবং পোনা মাছের আরও দু’রকম পদ। পেটে গ্যাস হয়ে এত ঘাম হচ্ছে নাকি?
মিনিট পাঁচেক নির্জন সিঁড়ির চাতালটায় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। আস্তে আস্তে হাঁফ ধরা ভাবটা কমে গেল। কমল, কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হল না ফুসফুস। শ্বাসের মৃদু একটু কষ্ট রয়েই গেল। রাতে আজ আর কিছু না খেলেই হল। খেতে তিনি ভালবাসেন। অনেক দিন আগেই ডাক্তাররা তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল, খাওয়া যেন মাত্রাছাড়া না হয়। মাত্রা একটু আধটু না ছাড়ালে বেঁচে থাকার আনন্দটাই বা কোথায়?
আরও চারটে তলা বাকি। বাসুদেব খুব ধীরে ধীরে সিঁড়ি ভাঙতে লাগলেন। পারবেন। এর চেয়ে অনেক কঠিন কাজ তো তিনি করেছেন। মাত্র আটতলা উঠতে পারবেন না, তাই কি হয়। বয়স? বয়সটা একটা ধারণা মাত্র। ছেষট্টি বছর বয়সেও তিনি তো এক সক্ষম পুরুষ।
ঠিক কথা, এখন রীণার সঙ্গে তাঁর আর সম্পর্ক নেই। থাকার কথাও নয়। অজাতশত্রুর পর রীণার আরও একটি সন্তান হয়েছে। একটি মেয়ে। নাম পরমা। মেয়েটি শঙ্করের। বছর দশেক আগে এই মেয়েটি জন্মানোর পর থেকেই রীণা সরে যেতে লাগল। বাসুদেবকে ঠিক আগের মতো কাছে টানা বন্ধ করে দিল। একদিন সন্ধেবেলা ব্যালকনিতে পাশাপাশি বসে রীণা বলল, ছেলে আজকাল তোমাকে নিয়ে নানা প্রশ্ন করে। আমার মনে হয় আমাদের সম্পর্ক এখানেই শেষ হওয়া দরকার।
বাসুদেবের তাতে খুব একটা আপত্তি হল না। কারণ বেশ দীর্ঘদিনই তিনি রীণাকে ভোগ করেছেন। তবু বললেন, এখনই?
হ্যাঁ। শঙ্করকেও তো কিছু দিতে হবে। অন্তত অর্ধেক জীবনটা। এত ভালবাসে আমাকে ও যে, তোমাকে অবধি মেনে নিয়েছে। এখন ওর এই ত্যাগের মূল্যটা আমাদের দেওয়া উচিত।
বাসুদেবের বয়স তখন মধ্য পঞ্চাশ। ভোগ যথেষ্ট হয়েছে। আপত্তির কারণ ছিল না। তিনি সামান্য একটু অপমানও বোধ করলেন। অহং ফণা তুলেছিল। তিনি উঠে নিঃশব্দেই চলে এলেন। আর কখনও যাননি।
পাঁচতলা পেরোবার আগেই বাসুদেবকে আবার থামতে হল। ফের খাসটায় টান পড়ছে। বড্ড ঘাম। সারা গায়ে কেঁচোর মতো ঘামের ধারা নামছে। পাঞ্জাবির নীচে গেঞ্জি ভিজে যাচ্ছে ঘামে।
বাসুদেব দাঁড়ালেন, হাঁপ ছাড়তে লাগলেন, চোখটায় কি একটু ঘোলাটে দেখছেন?
এবার হাঁপটা সামলাতে বেশ সময় লাগল, ধীরে ধীরে বুকের কষ্টটা কমল বটে, কিন্তু শরীরটা দুর্বল লাগছে। বেশ দুর্বল। পায়ে একটা মৃদু থরথরানি।
কিন্তু আধিব্যাধির অনেকটাই মানসিক ব্যাধির ভয়ই অনেক সময় ব্যাধিকে ডেকে আনে। মনের জোর থাকলে অনেক ব্যাধিকেই ঠেকানো যায়। বাসুদেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল আর ঘাড় মুছলেন। রুমালটা ভিজে নেতিয়ে গেল। নিংড়োলে জল পড়বে।