বাতাসী!
বাতাসী সামনে এসে দাঁড়াল।
ক্লান্ত গলায় শিখা বললেন, আজ আমার শরীরটা ভাল নেই। একটু শোব। আমাকে ডাকিস না। তুই খেয়ে নিস।
তোমার তো রোজ শরীর খারাপ হচ্ছে। ডাক্তারকে খবর দেব?
ডাক্তার জানে। সব জানে। দরকার হলে বলব।
শিখা সামনের ঘর থেকে ভিতরের ঘরে যাবেন বলে উঠতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় কলিংবেল বাজল। ফের বসে পড়ে বললেন, দেখ তো, কে এল!
বাতাসী দরজা খুলতেই দরজার ফ্রেমে শবর দাশগুপ্তকে দেখা গেল।
মাসিমা, আমি।
এসো বাবা, এসো। তোমার জন্য কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি!
শবর ধীর পায়ে ঘরে এল। মুখোমুখি সোফায় বসল। বলল, কেন মাসিমা, আমার জন্য অপেক্ষা করছেন কেন?
তোমাকে বকব বলে। কেন মানুষজনকে ভয় দেখাচ্ছ? এসব করে আর কী লাভ? এবার ওদের একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
শবর মৃদু একটু বিষণ্ণ হাসি হেসে বলল, শুধু এ জন্যই?
হ্যাঁ।
শবর মাথাটা একটু নামিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, আমার কাজটা তত ভাল নয় মাসিমা, কত মানুষের অভিশম্পাত কুড়োতেও হয়। কত প্যাটার্ন, কত ছক, কত সম্পর্ক, কত ভালবাসা অবধি ভেঙে দিতে হয়।
জানি বাপু। কী খাবে বলল। একটু কফি করুক?
ঠিক আছে।
বাতাসীকে ডেকে কফির কথা বলে দিয়ে শিখা শবরের চোখে চোখ রাখলেন, পৃথিবীর সব ছক কি উলটে দিতে পারবে বাবা?
তা বলছি না। আমি আর কতটুকু পারি? পুলিশেরই বা কতটুকু সাধ্য বলুন! পুলিশের ফাইলে কত কেস জমা আছে যেগুলোর মীমাংসা হয়নি। আনসলভড মিস্টরিজ।
ইংরিজি বোলো না। জানোই তো আমি ইংরিজি বুঝি না।
শবর হাসল, বুঝবার দরকারটাই বা কী? ইংরিজি না বুঝেও তো এত কাল চলে গেল।
তা ঠিক। এবার বলল তো, এত তদন্ত করে খেটেখুটে কী হল? কিছু পেলে খুঁজে?
শবর মাথা নেড়ে বলল, না। অনেক প্রশ্ন রয়ে গেল যার কোনও উত্তর নেই।
যেমন?
শবর মাথা নাড়ল, গোটা ব্যাপারটারই কোনও মানে হয় না। এত মানুষের রাগ ছিল বাসুদেব সেনগুপ্তর ওপর, অথচ কাউকেই আমার হত্যাকারী বলে কেন মনে হচ্ছে না বলুন তো। অ্যালিবাই নেই, তবু কেন ক্র্যাকডাউন করা যাচ্ছে না? মাসিমা, পুলিশের চাকরি করতে করতে একটা জিনিস হয়, অন্তত আমার হয়, অপরাধীর মুখোমুখি হলে ভিতরে যেন একটা কিছু টিকটিক করে। এবার তা হল না। কেন মাসিমা?
আমি তার কী জানি বাবা?
বাতাসী কফি নিয়ে এল। শবর একটা চুমুক দিয়ে শিখার দিকে তাকাল। শিখার মুখে একটু দুষ্টু হাসি। চোখে একটু চিকিমিকি।
শিখা হঠাৎ বাতাসীকে ডেকে বললেন, এই মুখপুড়ি, আমি নিরামিষ পিন্ডি গিলছি বলে তুইও কি মাছ খাওয়া ছাড়লি নাকি?
বাতাসী একটু অবাক হয়ে বলে, আমার মাছ লাগে নাকি?
লাগবে না কেন? লাগালেই লাগে। যা গিয়ে বাজার থেকে একটু মাছ নিয়ে এসে ভাল করে বেঁধে খা।
কী যে বলো তার ঠিক নেই।
শোন মা, আমি ভোররাতে স্বপ্ন দেখেছি, তুই আমার সামনে বসে মাছ-ভাত খাচ্ছিস। এসব স্বপ্ন কিন্তু সাংঘাতিক। যা মা একটু মাছ নিয়ে আয়। গড়িয়াহাটে যা, ওই সঙ্গে আমার ওষুধও নিয়ে আসিস। শোয়ার ঘরে প্রেসক্রিপশনটা আছে। নিয়ে যা।
বাতাসী একটু সময় নিল। মিনিট দশেক বাদে সে একটু ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর শিখা বললেন, এবার বলল বাবা।
শবর মৃদু মৃদু হেসে বলল, কী বলব ভেবে পাচ্ছি না।
তুমি আমাকে জেরা করবে না?
না। শুধু একটা কথা।
বলো।
তেরো তারিখে সন্ধেবেলা বাতাসী কোথায় ছিল?
বাঃ, এই তো জেরা করেছ। বাতাসীকে সেদিন আমি ছুটি দিয়েছিলাম। সেদিন সকালেই ও ওর বাড়ি গোসাবায় গিয়েছিল। চোদ্দো তারিখে ফিরে আসে।
ওঃ।
আর কিছু?
না মাসিমা।
কেন ছুটি দিয়েছিলাম জানতে চাইলে না?
না।
কেন জানতে চাও না?
প্রয়োজন নেই বলে।
তেরো তারিখে দুটো লোক লিফট সারানোর নাম করে লিফটটা আটকে রেখেছিল। তাদের কি খুঁজে পেয়েছ?
না মাসিমা। মনে হয় তাদেরও খোঁজার আর দরকার নেই।
শিখা একটু পিছনে হেলে চোখ বুজে রইলেন। সেই অবস্থাতেই বললেন, তুমি কি তদন্ত থেকে সরে দাঁড়াচ্ছ শবর?
হ্যাঁ মাসিমা।
ভাল। মানুষকে আর কষ্ট দিয়ো না। মানুষের এমনিতেই কত কষ্ট!
ঠিক কথা। আমি সেই কষ্টের কথা শুনতেই আজ আপনার কাছে এসেছি।
ক্লান্ত শিখা, শরীরের অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণায় কাতর শিখা আধবোজা চোখে শবরকে দেখছিলেন। তারপর ধীরস্বরে বললেন, জানো, আমার প্রথম ছেলে অর্ক কীভাবে হয়? উনি বাইরে কোথায় খেলে সেদিন সন্ধেবেলাতে ফিরলেন। আমার তখন পেইন শুরু হয়েছে। ওঁকে বললাম। উনি বললেন, আমার একটা ফাংশন আছে, যেতেই হবে। তুমি পাড়ার কাউকে নিয়ে হাসপাতালে চলে যাও। উনি বেরিয়ে গেলেন। আমি একা অভিমান নিয়ে বসে রইলাম। কিন্তু অভিমান কার ওপর বলো! ব্যথা বেড়ে যাচ্ছিল। শেষে নিজেই একটা রিকশা নিয়ে একা হাসপাতালে যাই। ভরতি হই। ছেলেও হয়। ছেলে হওয়ার আনন্দ সেদিন আর কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারিনি। এ কি কষ্টের কাহিনি শবর?
সরি মাসিমা। আপনি সত্যিই সাফার করেছেন।
ও কথা বোলো না। সব কষ্টই মানুষ হাসিমুখে সইতে পারে যদি তা ভালবাসার জনের জন্য হয়। কষ্টকে তখন কষ্ট বলেই মনে হয় না। আর ভালবাসার জন্য যদি না হয় তা হলে ছুঁচটা তুলতেও যেন পাহাড় তোলার পরিশ্রম।
শবর মাথা নিচু করে রইল।
আমার ছেলেরা ভাগভিন্ন হয়ে গেছে, মেয়েও বড় একটা এমুখো হয় না। তারাও তো কিছু কম কষ্ট পায়নি। কষ্ট পাচ্ছিল শঙ্কর বসু, রীণা, আমার ভাশুর আর ভাশুরপোরা। আমি জানতাম এসব দুঃখ কষ্ট সহজে দূর করা যাবে না। আমি সামান্য মেয়েমানুষ, আমার সাধ্য কী বলল তো! অন্যায়ভাবে ঢাকুরিয়ার বাড়িটা উনি দখল করেছিলেন, অন্যায়ভাবে তা প্রমোটারকে দিয়েছিলেন।