অজু লজ্জা পেয়ে চোখ নামাল। তারপর বলল, আমাকে উনি রেস্তোরাঁয় মাঝে মাঝে খাওয়াতে নিয়ে গেছেন। গল্প করেছেন।
কী গল্প?
অনেক গল্প। বেশিরভাগই ওঁর খেলার জীবনের কথা।
হ্যাঁ, খেলার কথা বলতে খুব ভালবাসতেন। আর আমাদের কথা কখনও বলতেন না?
খুব একটা নয়। তবে দাদারা যে ওঁকে পছন্দ করেন না সেটা বলেছেন।
হ্যাঁ বাবা, ছেলেরা ওঁকে পছন্দ করত না। কারণ ছেলেদের দিকে উনি ফিরেও তাকাননি কখনও। রেগে গেলে এমন মার মারতেন যে ভয়ে আমার রক্ত জল হয়ে যেত। বোধহয় বুড়ো বয়সে পুত্র-ক্ষুধা জেগেছিল। নিজের ছেলেরা হাতছাড়া হওয়ায় তোমার কাছে যেতেন।
অজু চুপ করে রইল।
শুনেছি, তোমাকেও একটা জীবন তোমার বাবার অনাদর সইতে হয়েছে!
ও কিছু নয়। বাবা ভাল লোক।
তা জানি। তোমার ওই বাবার মতো ভাল লোক পৃথিবীতে বেশি নেই। এখন তোমার আসল বাবা তো মারা গেছেন, শঙ্করের সঙ্গে এখনও কি সম্পর্কটা ওরকমই আছে?
অজু একটু হাসল, আপনি ভাবছেন কেন? সব ঠিকই আছে। আমার কোনও অসুবিধে হয় না।
বুঝেছি। এখনও হয়নি। হবেই বা কী করে? ওরও তো কষ্ট কম নয়। আমি এক পাষাণের ঘর করেছি বটে, কিন্তু ভাবতে ভাল লাগছে যে, সেই পাষাণও স্নেহের কাঙাল হয়ে একদিন তোমার কাছে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। মনুষ্যত্ব বোধহয় একেই বলে।
আমার বাবা আমার জন্য অনেক করেছেন। তাকে আমার কখনও খারাপ লাগেনি। হি ওয়াজ ভেরি গুড টু মি।
দোহাই বাবা, ইংরেজিতে বোলো না। আমি বুঝতে পারি না। সেকেলে মানুষ তো। বাংলা করে বলল।
উনি আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতেন।
ওঁকে বাবা বলে বলছ। কত ভাল লাগল শুনে!
অজু হাসল, উনি তো আমার বাবাই। বাবা ছাড়া কী বলব?
তাই তো!
রীণা চুপ করে একটা হাতরুমালে চোখ ঢেকে সোফার এক কোণে বসে ছিল। ধীরে জল ভরা চোখ তুলে বলল, আমার বড় পাপের ভয় হচ্ছে। কী যে করলাম জীবনটা নিয়ে।
শিখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসলেন, একটা জ্বালা-পোড়া তো আছেই ভাই। জ্বালা পোড়া ছাড়া কি শুদ্ধ হওয়া যায়? তবে তুমি ভাগ্যবতী, অমন স্বামী পেয়েছ।
রীণা মাথা নেড়ে বলল, শুদ্ধ হওয়া কাকে বলে তাই তো জানি না। এই ছেলেটাকে বুকে আগলে শুধু ভয়ে ভয়ে দিন কেটে গেছে। এখন আর কী হবে শুদ্ধ হয়ে? ছেলের কাছেই তো কিছু গোপন রইল না। ওর চোখে কি আমি আর মায়ের মতো মা?
ওসব ভেবো না। তোমার ছেলে তোমাকে আঁকড়েই তো বেঁচে থেকেছে। জীবনে যেটুকু পেয়েছ তাই নিয়ে থাকো। যা হয়নি তার কথা ভেবে কী হবে? তোমাকে বলি, তোমার স্বামীকে কিন্তু আমি চিনি। সাহস করে একবার তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম।
রীণা চমকে উঠে বলল, সে কী! কবে?
শিখা একটু হাসলেন। বললেন, তখন আমরা সদ্য এ ফ্ল্যাটে এসেছি। উনি তখন হার্ট অ্যাটাক হয়ে হাসপাতালে।
কেন ডেকে এনেছিলেন দিদি?
মানুষটা একটা জীবন বড় কষ্ট পেয়েছেন। আমার তাই ওঁকে খুব দেখার ইচ্ছে ছিল। তোমার ভয় নেই। শঙ্করবাবু আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করেছিলেন।
উনি আমাকে বলেননি তো!
বলার মতো ঘটনা নয়। আমি ওঁকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বলেছিলাম, দুনিয়ার কোনও পাপেরই শাস্তি বাকি থাকে না। ফল পেতেই হয়। শঙ্করবাবু বড্ড ভাল মানুষ। উনি কেঁদে ফেলেছিলেন। তার পরেও কয়েকবার এসেছেন।
আমাকে কখনও বলেননি তো উনি!
পলিসিটার গতি হল?
হ্যাঁ। ওরা আমাদের ক্লেম অ্যাকসেপ্ট করেছে। প্রসেসিং চলছে। একটু সময় লাগবে।
যাক! ওটা নিয়ে আমার চিন্তা ছিল। তোমার ছেলেটা যে বঞ্চিত হল না এটাই একটা মস্ত সান্ত্বনা।
কিন্তু আপনার ছেলেরা তো খুশি হয়নি দিদি।
শিখা ফের একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার স্বামীর বিষয়সম্পত্তির নেশা ছিল। রোজগার কম করেননি। বাপের টাকা, এই ফ্ল্যাট এসব তো ওরাই পাবে। ওদের অখুশির কারণ দেখি না। তবু যদি খুশি না হয় তা হলে সে ওদের স্বভাবের দোষ। তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না। ওদের তো অজুর মতো কষ্টের জীবন নয়। অজুর মানসিক কষ্ট যে অনেক বেশি। ওর জন্য এটুকু করে উনি মনুষ্যত্বেরই পরিচয় দিয়েছিলেন।
আপনি রক্তমাংসের মানুষ নন দিদি। আপনি যেন আকাশ থেকে আলো হয়ে নেমে এসেছেন।
শিখ মৃদু হাসলেন, অত বলতে নেই। পরে যদি ওসব কথা ফেরত নিতে হয়?
কী যে বলেন।
দু’জনেই তাকে প্রণাম করে বিদায় নিয়েছিল। ওই একটা তৃপ্তি পেয়েছিলেন শিখা। কারও ভাগে কম পড়লে তার কষ্ট হয়।
গত কিছুদিনে শিখা ছোটখাটো আরও কয়েকটা তৃপ্তি পেয়েছেন। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা এসেছিল। সামান্য কিছু টাকা খুব বিনীতভাবে চেয়েছিল তারা। আগের রুদ্রমূর্তি নেই।
শিখা তাদের বললেন, এটুকু আমি পারব। আগে যা চেয়েছিলে তা পারতাম না। আমার যে অত টাকা নেই।
সেই ছেলেরা মাঝে মাঝে তার খোঁজ নিয়ে যায়।
ঢাকুরিয়ার অপোগণ্ডগুলোও আসে। সবাই নয়। যারা একটু চালাকচতুর, যারা একটু সাহসী তারা এসে লিফটে করে আটতলায় ওঠে। বসে সুখদুঃখের কত কথা কয়ে যায়। আজও ওরা তার বন্ধু, তাঁর বড় আপনজন। কাউকে নিজের গয়না বেচে দোকান করে দিয়েছেন, কাউকে পাইয়ে দিয়েছেন ব্যাঙ্ক লোন, একে ওকে কতজনের চাকরি করে দিয়েছেন। রোগে শোকে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। কতটুকু আর পারেন শিখা?
যেটুকু পেরেছেন তাতেই কত লোক কেনা হয়ে আছে তার কাছে।
আজ কি একটু মেঘলা করেছে? শরৎকাল শেষ হয়ে এল। এরপর হেমন্ত। কুয়াশা হবে। একটু একটু করে শীত পড়বে। কতকাল পৃথিবীর এই ঋতুচক্র দেখবেন শিখা?