বললাম তো, মায়া। মায়া থেকে স্নায়ুদৌর্বল্য। স্নায়ুদৌর্বল্য থেকে ত্রাস। ত্রাস থেকে কর্মনাশ।
দু’জনেই হাসল।
শবর বলল, এখন কী মনে হচ্ছে?
নিজেকে সবসময়েই বলছি, ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্বিষ্ঠ পরন্তপ।
আপনার ছেলেটা আপনার খুব ন্যাওটা, না?
হ্যাঁ। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। ভাবছি, আমার ছেলে বলি বটে, কিন্তু ও তো আমার ক্রিয়েশন নয়। আমার ভিতর দিয়ে সৃষ্ট হয়েছে মাত্র, আমি সৃষ্টি করিনি। আসলে ও কার
ছেলে শবরবাবু? আমরা কার ছেলে?
শবর হাসল, গীতা পড়ে তো বিপদ করলেন মশাই! এ যে তীব্র বৈরাগ্য। ঘোষাল মাথা নেড়ে বলল, সিরিয়াসলি বলছি, বড্ড মায়ায় মাখামাখি হয়ে আছি যে। সত্যটা কী বলুন তো!
৯. এমনিতেই রাতে ঘুম হয় না শিখার
এমনিতেই রাতে ঘুম হয় না শিখার। শরীরে বড় কষ্ট। খোলসটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না, ভিতরে কতটা ফোপরা হয়ে গেছে। সয়ে যেতে হবে। আর ক’টাই বা দিন! কষ্টটা কি খারাপ লাগে শিখার? কষ্ট খারাপ ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যেও কি পরিশোধনের কাজ হয় না? হয় বলেই শিখা কষ্টের কথা কাউকে বলেন না। মনের কষ্টও কি কম? যতদিন বেঁচে থাকা ততদিন কত আপনজন পর হয়ে যাবে, কত বিশ্বাসী ভেঙে দেবে বিশ্বাস, কত স্নেহের ধন ধরবে রুদ্রমূর্তি, কত চেনা হয়ে যাবে অচেনা। এসব কি মেনেই নেননি শিখা। ঘর করেছেন এক ভৈরবের। কত খোঁচা, কত উন্মাদ রাগ, কত লাঞ্ছনা আর অপমান সইতে হয়েছে জীবনে। ছেলেরা পালিয়ে বাঁচল, মেয়ে বাঁচল বরের ঘরে গিয়ে। তার তো পথ ছিল না পালানোর। যেন বাঘের খাঁচায় নিরস্ত্র বাস করতে হল। বাঘের ছায়াটুকু সম্বল করে। এখনকার মেয়েরা নারীমুক্তির কথাটথা গলা ছেড়ে বলে। তারা পড়েনি তো কখনও এরকম মানুষের পাল্লায়। মনের কষ্টের শেষও নেই। গতকাল দুই ছেলে এসে তুমুল ঝগড়া করে গেছে তার সঙ্গে। ঝগড়া বলা ভুল, ওদের ছিল একতরফা আক্রমণ। শিখা এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তার অপরাধ, লাইফ ইনশিয়োরেন্স পলিসিটা তিনি রীণাকে দিয়ে দিয়েছেন। ঢাকুরিয়ার বাড়ির প্রমোটারের দেওয়া সাত লাখ টাকার সবটাই তিনি ভাশুরদের হাতে তুলে দিয়েছেন। ছেলেদের তাই নিয়ে আক্রোশ। শিখা ওদের কী করে বোঝাবেন যে, দুনিয়ার সম্পদ দু’হাতে কেড়ে নিলেই হয় না। মানুষের শাপ লাগে। শিখা জানেন, ছেলেরা আর সহজে এমুখো হবে না। বাপের শ্রাদ্ধ করল না, শিখা মারা গেলে হয়তো শিখার শ্রাদ্ধও করবে না। তা না করে না করুক। শিখা কি তা বলে পারেন এত বড় বঞ্চনাকে মেনে নিতে?
সব খারাপের মধ্যে একটাই ভাল খবর। দিন দশেক আগে বাসুদেবের শ্রাদ্ধের দিন সন্ধেবেলায় শিখা বাইরে গিয়ে রীণাকে টেলিফোন করেছিলেন।
রীণা খুব খুশি হয়েছিল ফোন পেয়ে। বলল, দিদি, আপনি যা বলেছেন তাই করেছি।
কী করেছ?
অজুকে দিয়ে এ ক’দিন প্রায় অশৌচের মতোই পালন করিয়েছি, পুরোটা পারিনি। ধড়া বা হবিষ্যিটা হয়ে না উঠলেও নিরামিষ খেয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ড, কাল ঘাট কাজের দিন নিজেই গিয়ে কালীঘাটে ন্যাড়া হয়ে এসেছে। আজ কালীঘাটে গিয়ে শ্রাদ্ধও করেছে। আমি সঙ্গে গিয়েছিলাম।
বাঁচালে। জানি না বাপু শ্রাদ্ধ করলে বা না করলে কী হয়, কিন্তু মনটা বড় খচখচ করছিল। কী বলে যে তোমাকে আশীর্বাদ জানাব ভেবে পাচ্ছি না।
আপনি কি জানেন দিদি, আপনার মতো ভাল মানুষ আমি জীবনে কমই দেখেছি।
পাগল! আমি ভাল কি না তা আমিই জানি। বরাবর হয়তো তোমার এ ধারণা থাকবে না।
থাকবে দিদি। আমাদের সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে। পুলিশের লোক এসে ভীষণ অশান্তি করছে কিছুদিন ধরে। আমি আর আমার স্বামী একটুও শান্তিতে নেই। দেখা হলে সব বলব।
পুলিশ কেন যে এরকম করছে জানি না। কী লাভ হবে ওদের। শবর দাশগুপ্তই কি এসব করছে?
হ্যাঁ দিদি, উনিই। আপনি চেনেন ওঁকে?
চিনি। আমার বউমার সম্পর্কে দাদা। শবর খুব বুদ্ধিমান।
হ্যাঁ, সেটা স্বীকার করতেই হয়। কিন্তু এমন সব প্রশ্ন করেন যে—
বুঝেছি। ওরা ওরকমই। দেখা হলে ওকে আমি বলে দেব।
না, শবরের সঙ্গে দেখা হয়নি শিখার। তিনি ওর কোনও খবর জানেন না, ঠিক কোন দফতরে কাজ করে তাও জানা নেই। দেখা হলে তিনি বলতেন, ওদের আর যন্ত্রণা দিয়ো না। এবার ওদের একটু শান্তিতে থাকতে দাও। পাপ করেছে বটে, কিন্তু তার শাস্তিও তো মেয়েটা কম পায়নি।
এসেছিল গোপালও। সেও বলেছে শবর দাশগুপ্ত তাকে জেরায় জেরায় জেরবার করে ছেড়েছে। এখনও জেরা চলছে। থানায় ডেকে নিয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে, একজন হুমকি দিচ্ছে। শিখার তাই মন ভাল নেই। শবরকে সে নিরস্ত করতে চায়। এসব করে আর লাভ কী?
দিন চারেক আগে রীণা তার ছেলেকে নিয়ে এসেছিল এক সকালে। ছেলেটার ন্যাড়া মাথা দেখে শিখার বুক জুড়োল। হোক অবৈধ, তবু এই একটা ছেলেই তো বাসুদেবকে স্বীকার করল বাবা বলে!
শিখা তাদের বলেন, খাওয়ালেন। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওঁর কাজ করতে তোমার কোনও কষ্ট হয়নি তো বাবা? অনিচ্ছেয় অভক্তি নিয়ে করোনি তো!
ছেলেটা অকপটে মাথা নেড়ে বলল, না। ওঁর প্রতি আমার তো একটা কর্তব্য ছিল।
ওঁকে তুমি বোধহয় চিনতে! না?
হ্যাঁ। উনি মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতেন।
শুনে আমার চোখে জল আসছে। ছেলেমেয়ের প্রতি উনি সারাজীবন তেমন কোনও কর্তব্য করেননি। তোমার সঙ্গে দেখা করতেন শুনে কত ভাল লাগছে! একটু বলবে ওঁর কথা?