শিখা খুব নরম গলায় বলল, উনি মারা যাওয়ার পর তুমি কি তোমার ছেলেটাকে অশৌচ পালন করিয়েছ?
রীণা মাথা নেড়ে মৃদুস্বরে বলল, না। ও তো সম্পর্কটা জানত না তাই সাহস পাইনি। তবে কয়েকদিন নিরামিষ খেয়েছিল।
আমি কিন্তু ওসব খুব মানি। আমার বয়স উনষাট। তুমি বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোট। তা ছাড়া শুনেছি তুমি বড়লোকের বউ। তুমি কি আর অত আচার বিচার মানতে পারো? তবু তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। বলব?
বলুন।
উনি তোমার ছেলের নামে যে লাইফ ইনশিয়োরেন্স পলিসিটা রেখে গেছেন সেটার কথা জেনে আমার দুই ছেলে খেপে গেছে। এতটাই খেপেছে যে তারা ঠিক করেছে বাপের শ্রাদ্ধ করবে না। অনেক বুঝিয়েছি, চোখের জল ফেলেছি, কাজ হয়নি। ওদের ধনুক ভাঙা পণ। একেই তো বাপকে বিশেষ পছন্দ করত না, তার ওপর আবার এই ব্যাপার। ওরা না করলেও শ্রাদ্ধটা হয়তো আমিই করব। কিন্তু কী মনে হয় জানো, শ্রাদ্ধাধিকারী তো বড় ছেলে। নিদেন ছোট ছেলেও করতে পারে। তোমার ছেলেকে দিয়ে ওঁর শ্রাদ্ধটা করাবে?
আপনি যদি বলেন, করাব।
বেশি আয়োজন করতে হবে না। লোকজন নেমন্তন্ন করার তো কথাই ওঠে না। যদি কালীঘাটে নিয়ে করাও তা হলেও হবে। একটা ছেলের হাতের জলটুকু যদি পান তা হলেই অনেক।
ঠিক আছে। করাব।
পলিসিটা তুমি নিয়ে যাও। কিন্তু টাকা আদায় করা খুব সহজ হবে না। ডেথ সার্টিফিকেটের কপি আর আরও কীসব লাগবে যেন। সেসব ওই অফিস থেকেই বলে দেবে। শুনেছি অনেক ঝামেলা।
আমিও শুনেছি।
শিখা উঠে ভিতরের ঘরে গেলেন। একটু বাদেই পলিসিটা এনে রীণার হাতে দিয়ে বললেন, উনি এটা আমাকে কেন দিয়েছিলেন জানো? যাতে তুমি একদিন আমার কাছে আসতে বাধ্য হও। উনি একটু অদ্ভুত মানুষ ছিলেন, তা তো জানোই!
জানি।
টাকাটা আদায় করো, তারপর ছেলেটাকে ভালভাবে মানুষ করো। কেমন হয়েছে তোমার ছেলেটা?
চুপচাপ থাকে। খেলাধুলো নিয়েই থাকে বেশি।
বাপের মতোই।
আমি কিন্তু এবার আপনাকে একটা প্রণাম করব।
কেন, এখনই চলে যাবে? কিছু মুখে দেবে না? অন্তত একটু চা বা শরবত?
না থাক। আপনাকে আর উঠতে হবে না।
আমার কাজের লোক আছে, ভয় নেই।
শিখা একজন মাঝবয়সি কাজের মেয়েকে ডাকলেন। সে এসে দাঁড়ালে বললেন, রোদে তেতেপুড়ে এসেছে ওকে একটু ঘোলের শরবত দে। রীণা, তুমি ঠান্ডা খাও তো!
খাই।
তা হলে বরফ দিস বাতাসী। একটুকরো।
রীণা পলিসির সার্টিফিকেটটা তার ব্যাগে পুরল। কৃতজ্ঞতায় তার মনটা ভরে যাচ্ছিল।
শিখা নরম গলায় বললেন, সম্পর্কটা শেষ করে দিয়ো না। মাঝে মাঝে এসো। আমি তো একা থাকি।
আসব দিদি।
ঘোলের শরবত এল ঝকঝকে কাঁচের গেলাসে। ঘোলের ওপর সবুজ লেবুপাতার টুকরো ভেসে আছে, আর বরফের কুচি। চমৎকার স্বাদ।
শিখা হঠাৎ বললেন, আমি শুনেছি তোমার বর তোমাকে খুব ভালবাসেন!
রীণা মাথাটা নোয়াল।
লজ্জা কীসের? স্বামীর ভালবাসা যে পাচ্ছ সেটা ভগবানের দয়া বলে মনে কোরো। তোমার বর খুবই ভাল লোক বলতে হবে।
হ্যাঁ, উনি ভীষণ ভাল।
আমার স্বামী ভালবাসতে জানতেন না। বরং অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেতেন। এ ধরনের লোককে বোধহয় স্যাডিস্ট বলে, না?
তাই হয়তো হবে।
সেজন্যই ওঁর সত্যিকারের নিজের লোক কেউ হল না। ছেলেরা নয়, মেয়ে নয়, কেউ নয়। শুধু আমি ছিলাম। কষ্ট আমাকেও কিছু কম দেননি। কিন্তু আমার তো উপায় ছিল না।
রীণা মুখ তুলতে পারছে না। ভয় হচ্ছিল, পুরনো কথা যদি উঠে পড়ে।
শিখা উদাস গলায় বললেন, এখন তো শুনছি ওঁর মৃত্যুটাও এমনি হয়নি। পুলিশ নানারকম সন্দেহ করছে। কী জানি বাপু, সত্যিকারের কী হয়েছিল।
ঘরের আবহাওয়াটা একটু ভারী হয়ে যাচ্ছিল। রীণা আর বসে থাকতে পারছে না। সে উসখুস করছিল।
শিখা বললেন, উঠবে? এসো তা হলে। ওঁর ডেথ সার্টিফিকেটটার কপি দরকার হলে আমাকে জানিয়ো। জেরক্স করিয়ে রাখব।
রীণা ঘাড় হেলিয়ে উঠে পড়ল। এত সহজে এবং অল্প আয়াসে কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে বলে সে ভাবেনি। সে সত্যিকারের শ্রদ্ধার সঙ্গে শিখাকে একটা প্রণাম করে বেরিয়ে এল। বাসুদেব ভুল বলেনি। শিখা সত্যিই খুব ভাল মহিলা।
বাড়ি ফিরতে বেলা একটা হয়ে গেল। রীণা এসি চালিয়ে বাইরের ঘরে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল।
পরমা এসে বলল, কোথায় গিয়েছিলে মা? তোমার একটা ফোন এসেছিল।
কার ফোন?
চিনি না। মোটা গলা। আমাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করছিল।
কী কথা?
তোমার কথা।
কী কথা?
প্রথমে জিজ্ঞেস করল তুমি কোথায় গেছ। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমি তোমাকে ভালবাসি কিনা, বাপির সঙ্গে তোমার ঝগড়া হচ্ছে কিনা, তুমি কেমন মানুষ।
ও মা! এসব আবার কী কথা! কে লোকটা?
নাম বলেনি। তবে দেড়টার সময়ে আবার ফোন করবে।
ঠিক আছে। তুমি স্নান করতে যাও।
সামান্য নার্ভাস লাগছিল রীণার। এ হয়তো সেই লোকটাই যে আরও একদিন ফোন করেছিল। যে-ই হোক, লোকটা অনেক খবর রাখে।
দেড়টা নয়, লোকটা ফোন করল দুটোর পর। সেই ভারী, মোটা গলা।
মিসেস বোস?
হ্যাঁ।
আপনার মতো লাকি উওম্যান আমি আর দেখিনি। কংগ্রাচুলেশনস।
তার মানে?
এটা যে কলিযুগ তা আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। কলিযুগে যারা পাপটাপ করে তাদেরই রবরবা। আপনি এত কিছু করেও দিব্যি সুখে আছেন। শুনছি আপনার ছেলেটির জন্য নাকি বাসুদেব সেনগুপ্ত পাঁচ লাখ টাকা আর একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থাও করে গেছে। মিসেস বোস, একেই বলে গাছের খাওয়া আর তলার কুড়োনো।