কথাটা আপনি বিশ্বাস করেছিলেন?
না। কারণ ছেলেবেলা থেকেই আমার সন্দেহ ছিল, উনি আমার মায়ের সঙ্গে ইনভলভজ্ঞ। আরও আশ্চর্যের কথা, উনি বলার আগে থেকেই কিন্তু আমার প্রায়ই এ সন্দেহও হয়েছে। যে, আমি ওঁরই সন্তান।
কীভাবে সন্দেহটা হল?
আমার বাবা অর্থাৎ শঙ্কর বসুর আমার প্রতি আচরণ থেকে। তা ছাড়া আমি ওঁদের কথাবার্তা কিছু কিছু ওভারহিয়ারও করতাম। সোজা কথা ব্যাপারটা আমার কাছে গোপন ছিল না। তাই উনি যখন কথাটা বললেন তখন আমি একটুও অবাক হইনি।
তারপর কী হল?
উনি মাঝেমধ্যেই আমার সঙ্গে দেখা করতেন। আমি খেলাধুলোয় ভাল বলে উনি নানাভাবে আমাকে ইন্সপায়ার করেছেন। ক্লাবে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারেও সাহায্য করেছেন।
যতদূর শুনেছি উনি ঠিক এরকম স্নেহপ্রবণ মানুষ ছিলেন না। নিজের পুত্র-কন্যাদের প্রতি ওঁর আচরণ ছিল জঘন্য। কাজেই আপনার প্রতি উনি এত নরম হলেন কেন?
তা ঠিক বলতে পারব না। উনি যে রাগী আর মেজাজি মানুষ ছিলেন তা আমি খানিকটা জানি। মনে হয় আমার পরিবারে আমি খানিকটা আনওয়ান্টেড বলেই উনি একটু সিমপ্যাথেটিক হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে আমার বাবা শঙ্কর বসু আমাকে একদমই পছন্দ করেন না। তাই আমি ছেলেবেলা থেকেই পারতপক্ষে ওঁর মুখোমুখি হই না। এটা উনি জানতেন।
শবর চিন্তিতভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, হতেও পারে।
উনিই আমাকে বলেছিলেন, ওঁর একটা পাঁচ লাখ টাকার পলিসি আছে যার নমিনি আমি।
কিন্তু উনি পলিসিটা আপনার বা আপনার মা’র হাতে না দিয়ে সেটা নিজের স্ত্রীর কাছে জমা রাখলেন কেন?
মাথা নেড়ে অজু বলল, তা জানি না। তবে আরও দু’বছর পর পলিসিটা ম্যাচিওর করত। উনি এত তাড়াতাড়ি মারা যাবেন বলে হয়তো ভাবেননি।
এই পলিসিটা উদ্ধার করার জন্য আপনি কিছু করেননি?
না। তবে আমার মা হয়তো শিখাদেবীর কাছে যাবে।
আপনার কথা কি শিখাদেবী জানতেন?
হ্যাঁ।
কী করে বুঝলেন?
বাবা–অর্থাৎ বাসুদেব সেনগুপ্তই আমাকে সেকথা বলেছিলেন।
আপনি কি বাসুদেববাবুকে বাবা বলেই ডাকতেন?
অজু হাসল, ডাকে কী আসে যায়?
জাস্ট কৌতূহল।
না। উনিও চাননি সেটা।
তবে কী বলে ডাকতেন?
ডাকার দরকার হত না। মুখোমুখি কথা হত আমাদের। তাও মাঝে মাঝে। না, ওঁকে বাবা বলে ডাকার কোনও প্রয়োজন হয়নি।
বাবা বলে ভাবতেন কি?
তা ভাবতাম। যা সত্য তাকে অস্বীকার করে লাভ কী? তা ছাড়া উনি তো আমার বেনিফ্যাক্টর ছিলেন।
শবর অন্যমনস্কভাবে বলল, ওঁর মৃত্যুতে আপনি প্রচুর লাভবান হয়েছেন।
৭. আমি রীণা
আমি রীণা।
শিখা বিহ্বল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, বাঃ, তুমি দেখতে বেশ সুন্দর তো! এখনও আর একবার বিয়ে দিয়ে আনা যায়।
আপনি কি কিছু কম সুন্দর! লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মুখ। আমি কি আপনাকে একটা প্রণাম করতে পারি?
তুমি কেন এসেছ তা জানি। প্রণাম করতে হবে না।
বোসো। রীণা বসল। মাথাটা উদ্ভ্রান্ত। বুকের ভিতরে একটু গুড়গুড়। হয়তো অপমানিত হতে হবে। হয়তো উনি বের করে দেবেন।
শিখা প্রায় নিষ্পলক চোখে তাকে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, লজ্জা পাচ্ছ?
রীণা মুখ নত করে বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে বলল, উনি আপনার খুব প্রশংসা করতেন।
শিখা মৃদু একটু হেসে বললেন, তাই নাকি? আমার আবার কীসের প্রশংসা? লেখাপড়া তেমন শিখিনি, গুণও বিশেষ কিছু নেই। সেইজন্যই তো–
বলে কথাটা আর শেষ করলেন না শিখা।
গরিব-দুঃখী-পঙ্গু-আতুরদের ওপর আপনার খুব মায়া, শুনেছি।
ও কিছু নয়। যখন ঢাকুরিয়ার বাড়িতে ছিলাম তখন অনেক গরিব-দুঃখী আসত বটে। তেমন কিছুই করে উঠতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, কাউকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়েও দিতাম না। এলে দু’দণ্ড জিরোতে দিতাম, সুখ-দুঃখের কথাও বলতাম। জানো তো, অনেক দুঃখী আছে যারা ঠিক টাকাপয়সা বা ভিক্ষের জন্য আসে না, দুটো মনের কথা বলে জুড়োতে আসে।
রীণা শিখার দিকে একটু অবাক চোখে চেয়ে থাকে। ইনি কি একজন সত্যিকারের মহীয়সী মহিলা?
শিখা একটা সুস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আটতলার ফ্ল্যাটে এসে দেখো কেমন বাক্সবন্দি হয়ে গেছি। কোনও দুঃখী আতুর কি এখানে আসতে পারে? আমার একদম ইচ্ছে ছিল না, উনি জোর করে এলেন। সারাদিন আমার যে কী একা লাগে তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। সারাদিন লোকজন না দেখে হাঁফিয়ে পড়ি।
রীণার বিস্ময় বাড়ছে। সে এঁরই স্বামীকে একদা কেড়ে নিয়েছিল প্রায়। গর্ভে ধারণ করেছিল তার সন্তান। সে এসেছে পাঁচ লাখ টাকার দাবি নিয়ে। তবু এই মহিলা তার সঙ্গে এমন বন্ধুর মতো কথা বলছেন কী করে?
শিখা বললেন, আমি তো নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। এবার তোমার কথা বলো।
রীণা মাথা নিচু করে বলল, আমার তো বলার কিছু নেই। আমি শুধু আপনাকে দেখতে এসেছি।
আমাকে দেখতে এসেছ! আমাকে দেখার কিছু নেই। তোমার কথা বলো।
আমার তো আপনার মতো কোনও গুণ নেই। বরং আমার অনেক দোষ অনেক পাপ। শিখা একটু চুপ করে রইলেন। তারপর খুব ধীর স্বরে চাপা গলায় বললেন, তুমি আমার সতিন হলে এক কথা ছিল। কিন্তু এ তো তা নয় ভাই। জানি এ যুগে মেয়েরা কিছু মানতে চায় না। কিন্তু সেটা কি ভাল?
এখন মনে হয়, ভাল নয়।
এখন মনে মনে কত কষ্ট পাচ্ছ তুমি। তোমার জন্য আমার মায়া হচ্ছে। মনের কষ্টের মতো কষ্ট নেই।
এইসব মায়াভরা কথায় রীণার চোখে জল আসছিল। সে মুখ তুলে শিখার দিকে চাইতে পারছিল না।