বালিগঞ্জ ফাড়ির কাছে এই ফ্ল্যাটটা প্রমোটারই তাকে দিয়েছে। পুরনো বাড়িতে ফ্ল্যাট উঠছে শুনে ভাইপোরা ফের একজোট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তাঁর ও প্রমোটারের ওপর। ফ্ল্যাটই যখন হচ্ছে তখন আমাদেরও ফ্ল্যাট দিতে হবে। বাসুদেব গায়ে মাখেননি সেসব কথা। শুধু শিখাই মাঝে মাঝে তাকে বলত, এ কাজটা তুমি ভাল করছ না। বাড়ির ভাগ যদি না দিতে পারো, অন্তত ওদের কিছু টাকা ধরে দাও। প্রমোটার তো তোমাকে সাত লাখ টাকাও দিয়েছে।
বাসুদেব একবার যে সিদ্ধান্ত নেন তা থেকে টলেন না। মাথা নেড়ে বললেন, ওরা আমার সঙ্গে শত্রুতা করার চেষ্টা না করলে দিতাম। এখন এক পয়সাও দেব না।
তার ভাইপো গোপাল তাকে একবার গুন্ডা দিয়ে মারাবে বলে শাসিয়েছিল। সেটা তিনি ভোলননি।
শিখা বলল, ওদের অভিশাপে আমাদের ভাল হবে না।
তিনি যথারীতি শকুনের শাপ ও গোরুর মৃত্যুর কথা বলে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পাপ-পুণ্যের ভয় বাসুদেবের নেইও। কারণ ওসব তিনি মানেন না। তিনি মনে করেন জীবনের ক্ষেত্রে একটাই নিয়ম, যার দাঁত নখের জোর বেশি সে-ই টিকে থাকার অধিকারী। তার ভয়-ডর ভাবাবেগ বরাবরই কম। অহংকারী লোকদের ওসব কমই থাকে।
অহংকার কথাটার মানে কী তা বাসুদেব খুব ভাল জানেন না। অহংকার মানে কি নিজেকে ভালবাসা? তা হলে তো সবাই অহংকারী!
তবে কি নিজেকে নিয়ে গৌরববোধ? তাও অল্পবিস্তর সকলেরই আছে। তবে কি অহংকার মানে নিজেকে সর্বদা নির্ভুল এবং অভ্রান্ত মনে করা? নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা? নিজের আরাম-বিলাস-সুখ ছাড়া আর কারও আরাম-বিলাস-সুখের কথা না ভাবা?
যদি এসবই হয়ে থাকে তবে বাসুদেব অহংকারী, সন্দেহ নেই। তিনি কোনওদিনই অন্যের ব্যথা-বেদনা-দুঃখ-অভিমান নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাননি। তার দুই ছেলে এবং মেয়ের নাকি অভিমান আছে যে, বাবা তাদের কখনও ভালবাসেনি। ভালবাসেননি কথাটা ঠিক নয়, তবে ছেলেমেয়ে নিয়ে আদিখ্যেতা তার ছিল না। ওরা বায়না করলে তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটত। ছেলেমেয়েরা তাকে যমের মতো ভয় পেত বরাবর। এখনও হয়তো ঘেন্না করে। কারণ অবিরল ভয় হয়তো কখনও কখনও সমাধান না পেয়ে ঘেন্নায় পর্যবসিত হয়। বাসুদেব ছেলেমেয়ের ঘেন্নার ভাবটা একটু টের পান।
একটা তলা উঠে এলেন বাসুদেব। কোনও অসুবিধে হলনা। আস্তে আস্তে উঠলে অসুবিধে হওয়ার কথাও নয়। উঠতে উঠতে তিনি নিজের প্রবল অহংকারের কথাই ভাবছিলেন। হ্যাঁ, ঠিক বটে, তিনি অহংকারী, কিন্তু ওই অহংকারই কি তাকে বাঁচার জীবনীশক্তিটা জোগান দেয় না? অহংহীন পুরুষ তো নিবীর্য পুরুষের মতোই। তাই না?
তাঁর খেলোয়াড় জীবনের শেষ দিকে যখন ফর্ম পড়ে যাচ্ছে, যখন দম পান না, যখন ভারী পা আর আগের মতো ডজ বা কারিকুরি দেখাতে পারে না, তখন একটা দুর্মদ অহংকারই তাকে মাঠ ছাড়তে দেয়নি। অনেক গুরুতর খেলায় স্রেফ মনের জোরে তিনি মমতার চেয়ে দশগুণ বেশি দিয়েছেন। টিম থেকে তাকে বাদ দেওয়া হবে–এটা তার সহ্য হওয়ার কথা নয়। একটা সময়ে তিনিই নিজে সরে এলেন। সসম্মানে। খেলার শেষ জীবনে একটা ছেলেকে চিরকালের মতো বসিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, সেও ওই অহংকার থেকেই। শুভম মিত্র বলে ছেলেটা তখন লেফট আউটে দারুণ খেলছে। খুব নাম-ডাক। শুভমের দলের সঙ্গে যেদিন খেলা পড়ল, সেদিনকার কথা। বাসুদেব রাইট হাফ-এ। শুভম ছেলেটার পায়ে ছিল হরিণের মতো দৌড়, তেমনি সূক্ষ্ম বল প্লে, তেমনি টার্ন এবং শুটিং। কমপ্লিট প্লেয়ার যাকে বলে। প্রথম হাফে তাকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন বাসুদেব। শুভম তাকে অনায়াসে টুসকি মেরে কাটিয়ে যাচ্ছে, এবং বাসুদেব বলে যে মাঠে কেউ আছে সেটাই যেন মনে রাখছে না। অবহেলাটা সহ্য হচ্ছিল না বাসুদেবের। তিনি বুঝতে পারছিলেন, এরকম চললে সেকেন্ড হাফে তাকে বসানো হবে। তার বদলে নামবে সত্য রায়। তাই হাফটাইমের কয়েক মিনিট আগে তিনি পা-টা চালালেন–যেমনটা চালালে বিপক্ষের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। শুভম ভাল খেলোয়াড় ছিল ঠিক, কিন্তু এসব অভিজ্ঞতা ছিল না। চোরা পায়ের মার খেয়ে ছিটকে পাঁচ হাত গড়িয়ে গিয়ে ছটফট করতে লাগল। তারপর স্ট্রেচারে শুয়ে হাসপাতাল। শুভমের সেই শেষ খেলা। পায়ের হাড় এমনভাবে ভেঙেছিল যে জীবনে আর মাঠে নামতে পারেনি। এই রাফ ট্যাটি নিয়ে কাগজে বিস্তর লেখালেখি হয়েছিল তার বিরুদ্ধে। বাসুদেব কি অনুতপ্ত হয়েছিলেন? হয়তো একটু হয়েছিল অনুতাপ। কিন্তু অহংকারই তবু বরাবর তাকে চালিয়ে এনেছে।
অহংকারীরা একটু স্বার্থপর হয়েই থাকে। এবং তারা অন্যের সম্পর্কে উদাসীন। শিখা এবং আর কেউ বিশেষ করে শিখা যখন তাকে স্বার্থপর বলে তখন খুব ভুল বলে না।
এই স্বার্থপরতা আর উদাসীনতা কত নির্মম হতে পারে তার উদাহরণ রীণা আর শঙ্কর। স্বামী-স্ত্রী। এই দম্পতিকে তিনি ভাল করে দাম্পত্য জীবন যাপন করতেই দেননি।
যে-কোনও ক্ষেত্রে একটু নাম করলে ভক্ত জোটেই। তারও ভক্ত বড় কম ছিল না। ছেলেদের কথা বাদ রাখলেও মেয়ে-ভক্তেরা ছিল অনেক। তাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গেই তার দৈহিক সম্পর্ক হয়েছিল। এরকমও হয়েই থাকে। মনে রাখার মানে হয় না। কিন্তু রীণা অন্যরকম।
রীণা ছোটখাটো, রোগা, মুখখানা ভারী মিষ্টি, মায়াবী চোখ দুখানা ছিল গভীর রহস্যে ভরা। নম্র শরীর আর মাজা রং। রীণা যখন তার প্রেমে পড়ে তখন রীণার বিয়ে হয়ে গেছে, বাসুদেব শুধু বিবাহিতই নন, দুই ছেলেমেয়ের বাবাও। কিন্তু তারা দু’জনে এমনভাবে পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেলেন যেন তাদের বয়ঃসন্ধি, দেহ তো ছিলই, দেহ ছাড়িয়েও অনেক দূর গড়াল সম্পর্ক। শঙ্কর এক মস্ত ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের সেলস ইঞ্জিনিয়ার। নানা জায়গায় টুর থাকত। কিন্তু তা বলে বাসুদেব যে শঙ্করের অনুপস্থিতির সুযোগ নিতেন তা নয়। বরং রীণার সঙ্গে পরিচয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি শঙ্করকে মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন, তুমি ওকে ডিভোর্স করো, ওকে আমার চাই। রীণাও স্পষ্টভাবে ডিভোর্স চেয়েছিল শঙ্করের কাছে।