আপনি অভয় দিলে বলি, ছেলেটির জন্মবৃত্তান্ত আমি জানি। আপনার অহেতুক সংকোচের কারণ নেই।
বলুন।
ছেলেটি যে বাসুদেব সেনগুপ্তর সেটা কি আপনার হাজব্যান্ড জানেন?
নতমুখে রীণা বলল, জানেন।
তার সঙ্গে ছেলের সম্পর্ক কীরকম?
ভালই।
নরম্যাল বলছেন। বাপ আর ছেলের মতোই সম্পর্ক?
হ্যাঁ।
স্কুলকলেজে ছেলের বাবার পরিচয় কি আপনার হাজব্যান্ডের নামেই?
হ্যাঁ।
কিন্তু ইনহেরিটেন্সের ব্যাপারটা? উনি কি আপনার ছেলেকে বিষয়-সম্পত্তির ভাগও দেবেন?
সেটা নিয়ে কথা হয়নি।
কখনও নয়?
না।
বাসুদেব সেনগুপ্ত কি কখনও আপনাকে জানিয়েছিলেন যে, ওঁর একটা মোটা টাকার লাইফ পলিসির নমিনি আপনার ছেলে?
হ্যাঁ।
পলিসিটা বা প্রিমিয়ামের রসিদ বোধহয় আপনার কাছে নেই?
না। ওঁর স্ত্রীর কাছে আছে।
আপনার ছেলে কি খবরটা জানে?
না তো!
ঢাকুরিয়ায় বাসুদেববাবুর একটা পুরনো বাড়ি ছিল, জানেন? মস্ত বাড়ি, অনেকটা জমি নিয়ে।
জানি।
সেই বাড়িটা ভেঙে প্রমোটার ফ্ল্যাট তুলছে, জানেন কি?
শুনেছিলাম।
সেই বাড়ির দোতলায় একটা তেরোশো স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাট অজাতশত্রু বসু নামে কাউকে অ্যালট করা আছে। জানতেন?
রীণা অবাক হয়ে মুখ তুলে বলে, জানতাম না তো!
অজাতশত্ৰু বসু এখন বেশ সচ্ছল একটি যুবক। অবশ্য যদি এলআইসির টাকাটা আদৌ সে পায়।
রীণা উদ্বিগ্ন গলায় বলে, পাবে না কেন?
পাবে না বলিনি। তবে পাওয়ার ব্যাপারে বাধা আছে। বাসুদেব সেনগুপ্তের ছেলেরা তো ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখছে না। তা ছাড়া পলিসির আসল নমিনি শিখাদেবী, অজাতশত্রু প্রাপক, যদি শিখা তাকে দেন।
রীণা হঠাৎ খুব করুণ গলায় বলল, দেখুন, আমার তো কলঙ্কিত জীবন, সবাই জানে। আজ আমার লুকোবারও কিছুই নেই। আমার জন্য অজু কেন বঞ্চিত হবে?
বঞ্চনার কথা কেন বলছেন? অজাতশত্রু তো সুখেই আছে এখানে।
রীণা চোখের জল লুকোনোর চেষ্টা করল না। মাথা নেড়ে বলল, নেই, নেই, সুখে নেই।
কেন বলুন তো!
শঙ্কর ওকে দু’চোখে দেখতে পারে না। শঙ্কর পরিষ্কার বলে দিয়েছে ওর একটা পয়সাও অজু কখনও পাবে না। অজুকে শঙ্কর ডিজওন করতে চায়।
শবর কিছুক্ষণ রীণার আবেগ প্রশমিত হতে দিল। তারপর বলল, আপনার ছেলে কি জানে?
কী জানার কথা বলছেন?
ও যে বাসুদেব সেনগুপ্তর ছেলে!
না। আমি ওকে কখনও বলিনি।
আপনি না বললেও বলার লোকের তো অভাব ছিল না।
আমি জানি না ও জানে কি না।
ও কি বাসুদেব সেনগুপ্তর পলিসি বা ঢাকুরিয়ার ফ্ল্যাটের কথা জানে?
না তো। ফ্ল্যাটের কথা আমিও এই প্রথম শুনলাম।
আপনার ছেলে কখন বাড়িতে থাকে?
একটু আগেই তো বেরোল। সকালে বেরোয়, রাতে ফেরে।
ক’টার সময় ফেরে?
ন’টা-দশটা।
আপনার স্বামী?
উনি খুবই ব্যস্ত মানুষ। উনি আরও সকালে বেরোন, আরও রাতে ফেরেন।
ছুটির দিনে?
ছুটির দিনেও আমার স্বামীর আউটিং থাকে।
আপনার ছেলে?
ওরও আউটিং থাকে। আচ্ছা, একটা কথা বলবেন? আপনি এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? কী হয়েছে?
বাসুদেব সেনগুপ্তর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয় বলে ওঁর আত্মীয়রা সন্দেহ করেছেন। একটা অফিশিয়াল এনকোয়ারি লোকাল থানা থেকে হচ্ছে। আমি কাজটা আন অফিশিয়ালি একটু এগিয়ে রাখছি।
রীণা শবরের দিকে শুকনো মুখ করে চেয়ে রইল। তার বুকের ভিতরে ঘনিয়ে উঠছে ভয় আর ভয়। গলাটা তার খুবই শুকিয়ে গেছে। একটু গলা খাকারি দিয়ে সে স্তিমিত গলায় বলল, কয়েকদিন আগে–বাসুদেব যেদিন মারা যায় তার পরদিন সকালের দিকে একজন আমাকে ফোন করে এ কথাটাই বলেছিল। সে তার নাম বলেনি।
অ্যাননিমাস কল?
হ্যাঁ।
লোকটা একজাক্টলি কী বলেছিল মনে আছে?
একটু ইয়ারকির ভাব ছিল। বলছিল বাসুদেব নরম্যালি মারা যায়নি। তাকে খুন করা হয়েছে।
লোকটা হয়তো সত্যি কথাই বলেছে।
রীণা চোখ বুজল। তারপর ধরা গলায় বলল, আপনি কি কাউকে সন্দেহ করছেন?
সন্দেহই আমাদের ধর্ম ম্যাডাম।
কাকে সন্দেহ করছেন?
সবাইকেই। কনসার্নড কেউই সন্দেহের বাইরে নয়। তেরো তারিখে আপনি সল্টলেক থেকে আপনার স্বামীর গাড়িতেই তো ফিরে আসেন?
হ্যাঁ।
গাড়ি কে চালাচ্ছিল, ড্রাইভার?
না। সেদিন ড্রাইভার ছিল না। শঙ্কর গাড়ি চালাচ্ছিল।
উনি কি স্টেডি ছিলেন?
কেন থাকবেন না?
শবর একটু হাসল, চলি ম্যাডাম। আবার দেখা হতে পারে।
৬. মৃত্যুর মুখ থেকে ঘোষাল ফিরল
মৃত্যুর মুখ থেকে ঘোষাল ফিরল। ফিরত না, যদি না শবর ঝাঁপিয়ে পড়ত ডাক্তার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ওপর। সামান্য অবহেলা, সামান্য দেখভাল এবং সময়োচিত ব্যবস্থার নড়চড় হলেই মারা পড়ত ঘোষাল। শবর সেটা হতে দেয়নি।
তিনদিন বাদে ঘোষালের বেডের পাশে সকালে দাঁড়িয়ে ছিল শবর।
কীরকম আছেন?
দুর্বল গলায় নিস্তেজ ঘোষাল বলল, বাঁচাটা বাঁচার মতো না হলে বেঁচে কী লাভ?
বেঁচে থাকাটাই লাভ। আপনি মরলে যে আরও দুটি প্রাণী ভেসে যায়।
সে আর কী করা যাবে। আমি বেঁচে থাকতেও কি যাবে না?
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্বিষ্ট পরন্তপঃ।
ঘোষাল মৃদু একটু হাসার চেষ্টা করল, গীতা?
নয় কেন? আমি রোজ পড়ি।
তাতে জোর পান?
পাই। খুব পাই। গীতা আমার চোখ খুলে দেয়, মাথা থেকে অনেক চিন্তার ভূত তাড়িয়ে দেয়।
আগে পড়েছি কয়েকবার। আজকাল আর হয়ে ওঠে না।
রোজ গীতা পড়ুন ঘোষালবাবু, ইট উইল হেল্প। হতো বা প্রান্স্যসি স্বর্গং জিহ্বা বা ভোক্ষসে মহীম। তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়।