রীণা একটু দ্বিধা করল। তারপর খুব শক্ত হয়ে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বলল, শোন অজু, এক জায়গায় তোর কিছু টাকা আছে।
জবাবে অজু কিছুই বলল না। একটু কৌতূহলও প্রকাশ করল না। যেন শুনতেই পায়নি এমন নিস্পৃহভাবে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল। আঁচিয়ে সে যথারীতি লিভিং রুমে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে কাগজ দেখল।
চলি মা।
আয়।
একা ফাঁকা বাড়ি। এ সময়টায় খারাপ লাগে তার। মেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে ততটা লাগে না। মেয়েরও একটি সবসময়ের আয়া আছে। পরমা ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে সামান্য ভাব বিনিময় করে আয়া বাতাসীর সঙ্গে নিজের ঘরে চলে যায়। বাতাসীর সঙ্গেই তার বেশি ভাব।
শিখার সঙ্গে দেখা করার পর্বটা আজই সেরে ফেললে কেমন হয় তাই ভাবছিল রীণা। অপ্রিয় কাজ, কিন্তু অজুর মুখ চেয়ে কাজটা তাকে করতেই হবে। শিখা তাকে অপমান করবে কি? করুক। শিখার অপমানেও হয়তো তার কর্মফল–যদি তেমন কিছু থাকে–ক্ষয় হোক।
রীণা নিজের ঘরে পোশাক পরতে যাবে বলে উঠছিল, এমন সময়ে রামু কর্ডলেসটা এনে তার হাতে দিয়ে বলল, আপনার ফোন।
আবার সেদিনের লোকটা নাকি? ঠিক এরকম সময়েই তো ফোন করেছিল সেদিন।
কে বলছেন?
একটা ভারী কিন্তু ভারী আকর্ষক পুরুষের গলা বলল, আপনি কি মিসেস রীণা বসু?
এ সে নয়। রীণা খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, বলছি। বলুন।
আমি লালবাজার থেকে বলছি। আমার নাম শবর দাশগুপ্ত।
লালবাজার। কী হয়েছে বলুন তো!
কিছু হয়নি। আমি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।
কী দরকার?
কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল। রিগার্ডিং এ ডেথ।
রীণার বুক কেঁপে উঠল। বলল, ও।
আপনি কি আজ খুব ব্যস্ত আছেন?
আমি একটু বেরোচ্ছিলাম। ঠিক আছে, আসুন।
আপনার ফ্ল্যাটে পৌঁছোতে আমার বোধহয় কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট লাগবে।
ঠিক আছে।
পঁচিশটা মিনিট রীণার জীবনের যেন মন্থরতম সময়। সে কফি খেল, খবরের কাগজ বারবার ওলটাল। তারপর ঝুম হয়ে বসে রইল।
শবর দাশগুপ্ত খুব লম্বাচওড়া লোক নয়। তেমন সাজগোজও নেই। পুলিশের ইউনিফর্মের বদলে গায়ে সাদামাটা একটা ক্রিমরঙা হাওয়াই শার্ট আর কালো ট্রাউজার। চোখ দুখানা ঈগলের মতো তীক্ষ্ণ। লোকটাকে দেখলে একটু যেন অস্বস্তি হয়।
শবর প্রথমেই তার আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখাল। তারপর বসল।
চা খাবেন?
খাব। আমি খুব বেশি সময় নিচ্ছি মনে করলে নিঃসংকোচে আমাকে তাড়িয়ে দেবেন।
মৃদু একটু হাসল রীণা। রামুকে চায়ের কথা বলে এসে সোফায় বসল। বলল, এবার বলুন।
কোথায় যাচ্ছিলেন?
আমার এক বান্ধবীর বাড়ি।
বাধা দিলাম তো!
তাতে কী? পরে যাওয়া যাবে।
ম্যাডাম, আমি একটু সমস্যায় পড়ে এসেছি। আপনার কি মনে পড়ে যে, গত তেরো তারিখে সন্ধের পর আপনি কোথায় ছিলেন?
ও মা, ও আবার কী প্রশ্ন?
বিটকেল শোনাচ্ছে?
তেরো তারিখের কথা আজ কি মনে আছে। ছয় দিন তো হয়ে গেল।
আজ নিয়ে ছয় দিন। দেখুন না মনে পড়ে কি না। প্রশ্নটা অবশ্য রুটিন। তবু বলুন।
কার ডেথ-এর কথা বলছিলেন টেলিফোনে?
সেটা পরে।
হ্যাঁ, তেরো তারিখে আমি সন্ধের পর–না মনে পড়ছে না তো।
রামু চায়ের ট্রে নিয়ে এসে ট্রে-টা নিচু হয়ে সেন্টার টেবিলে রাখছিল। ওই অবস্থাতেই বলল, আপনি ছটায় বেরিয়েছিলেন।
রীণা একটু লাল হয়ে বলে, ও হ্যাঁ। ক্লাবে গিয়েছিলাম।
রামু ফের বলল, ক্লাবে নয়।
তা হলে?
সেদিন আপনার বোনঝির জন্মদিন ছিল। আপনি গিয়েছিলেন সল্টলেক-এ।
ও হ্যাঁ।
শবর হঠাৎ বলল, আপনার স্মৃতিশক্তি কি খুব খারাপ?
না তো। আচমকা জিজ্ঞেস করেছেন বলেই বোধহয় কেমন থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম।
কীসে গিয়েছিলেন, গাড়িতে?
না। আমাদের একটাই গাড়ি, সেটা আমার স্বামী ব্যবহার করেন। অফিস থেকে ফিরতে ওঁর রাত হয়। আমি ট্যাক্সিতে গিয়েছিলাম।
ক’টার সময় সল্ট লেকে পৌঁছেছিলেন?
একটু দেরি হয়েছিল। আমার উপহার কেনা ছিল না। সেটা কিনতে একটু সময় লেগেছিল। বোধহয় সাড়ে আটটা হয়ে গিয়েছিল পৌঁছোতে।
আপনার একটি মেয়ে আছে, না?
হ্যাঁ। পরমা।
জন্মদিনের নেমন্তন্নে তাকে নিয়ে যাননি?
ফের একটু থতমত খেল রীণা। তারপর বলল, না। ওর একটা ইম্পর্ট্যান্ট পরীক্ষা ছিল পরদিন। ও পড়ছিল।
আপনার স্বামী বা ছেলে?
ছেলে কোথাও যায় না। খুব লাজুক। তা ছাড়া ওরও কীসব কাজটাজ ছিল। তবে আমার হাজব্যান্ড অফিস থেকেই গিয়েছিলেন।
কত রাতে?
উনি বোধহয় আমি পৌঁছোনোর দশ-পনেরো মিনিট পরে পৌঁছোন।
উপহারটা কোথা থেকে কিনেছিলেন?
উপহার। ওঃ হ্যাঁ। গড়িয়াহাট।
কোন দোকান মনে আছে?
ফ্যান্সি স্টোর্স।
সেখান থেকেই কি আপনি সবসময়ে কেনাকাটা করেন?
ঠিক নেই। ওখানেও করি, অন্য দোকান থেকেও করি।
যতক্ষণ কেনাকাটা করছিলেন ততক্ষণ কি ট্যাক্সিটা ওয়েটিং-এ ছিল?
না। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্রেজেন্টেশন কেনার পর আবার গড়িয়াহাট থেকে ট্যাক্সি নিই।
তখন ক’টা?
ঠিক খেয়াল নেই। সাড়ে সাতটা হবে হয়তো।
আপনার চাকরটির নাম কী?
ওঃ, ওর নাম, রামু।
এখন যে কথাটা বলব সেটা ওর শোনা উচিত হবে না। আমরা কি আপনার ওই লিভিং রুমে গিয়ে বসতে পারি?
নিশ্চয়ই।
জুতো খুলে যেতে হবে নাকি?
না না, আসুন।
লিভিং রুমে আজও সকালের রোদ্দুর ঝা ঝা করছে। দক্ষিণের খোলা জানালা দিয়ে প্রাক-শরৎ ঋতুর চমৎকার একটা হাওয়া আসছে ঘরে।
আপনার একটি ছেলে আছে।
হ্যাঁ। অজাতশত্রু। রীণা চোখদুটো নত করল। এর পরের প্রশ্ন কোনদিকে যেতে পারে তা ভেবে তার বুক কেঁপে কেঁপে যাচ্ছিল।