যে শব্দটা জিবে এসে গিয়েছিল তা বস্তিবাসীর মুখের শব্দ, ভদ্রলোকের নয়। শঙ্কর আজ অবধি অত খারাপ কথা মুখে আনেনি। তার রুচিতে বাধে। তাই শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল সে। সে এটা বোঝে, ঘটনাটা নিয়ে একটা বিতর্ক হলে সে হয়তো জিতবে না। বাসুদেব তো রীণাকে বিয়েই করতে চেয়েছিল। শঙ্করকে ডিভোর্স করতে আটকাত না রীণারও। বাধা তো দিয়েছিল শঙ্করই।
আজ একটু হাঁসফাস করছে শঙ্কর।
রীণা তার কপালে হাত রেখে বলল, তোমার কষ্ট হচ্ছে। তুমি শান্ত হয়ে ঘুমোও। এটা মনে রেখো, তুমি একজন মহৎ মানুষ। আমি তোমাকে খুব শ্রদ্ধা করি। তোমার দিকে তাকিয়ে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে।
শঙ্কর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইল। তারপর তার শরীরে চাপা কান্নার থরথরানি টের পেল রীণা। নিজেকে উন্মুক্ত করল সে। তারপর জড়িয়ে ধরল শঙ্করকে। কিছুক্ষণ পর একটা সন্ধিতে এল তারা। স্বামী-স্ত্রী প্রত্যাবর্তনের অযোগ্য পয়েন্ট থেকে মাঝে মাঝে এভাবেও ফিরে আসে পরস্পরের কাছে।
পরদিন সকালে রীণা একটা সিদ্ধান্ত নিল। সে শিখার কাছে যাবে। যাওয়া ছাড়া তার আর গতি কী?
তাদের ভাব-ভালবাসার সময়ে বাসুদেব তাকে বলত, দেখো, আমার সঙ্গে বনিবনা হয় বটে, কিন্তু শিখা খুব ভাল মেয়ে। খুব সৎ, দয়ালু এবং বিশ্বাসযোগ্য।
রীণা প্রশ্ন করত, তোমার সঙ্গে বনিবনা হয় না কেন?
আমি তো একটু আউটরেজিয়াস, বড্ড বেশি লাউড অ্যান্ড অ্যাগ্রেসিভ। আমার সঙ্গে কম লোকেরই বনে। সে কথা নয়। নিরপেক্ষ বিচার করলে শিখা কিন্তু ভাল মেয়েই। তেমন সুন্দরী নয়, ছলাকলা জানে না, স্টিল শি ইজ অ্যাডোরেবল।
যখন টেলিফোনে বাসুদেব তাকে লাইফ ইনশিয়োরের কথা জানিয়েছিল তখন তার একটা বিচ্ছিরি হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। বলেছিল, অজু আমার ছেলে। তার প্রতি আমার কিছু কর্তব্য ছিল, যা আমি করিনি। আমি একটা পলিসি করেছি পাঁচ লাখ টাকার, বোনাসটোনাস নিয়ে ম্যাচুরিটিতে অনেক টাকা দাঁড়াবে। একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল, কতদিন বাঁচব কে জানে। পলিসিটা শিখার কাছে আছে। তাকে সব বলেছি। আমার কিছু হলে শিখার কাছে ওটা চেয়ে নিয়ে।
রীণা একটু অহংকারের সঙ্গে বলেছিল আমি কেন যাব? আমার কী দায়? শোনো রীণা, শিখার কিছু ত্যাগ আছে তোমার আর আমার জন্য। আমি চাই আমি মরে গেলে অন্তত একবার তোমাদের দেখা হোক। না হয় দু’জনে আমার নিন্দেই কোরো। তবু তোমাদের দেখা হোক।
আজ রীণার আর অহংকারটা নেই। অদূর ভবিষ্যৎ ভেবে ওই পাঁচ লাখ টাকা তার উদ্ধার করা দরকার। এই নাটকটা বাসুদেব কেন করতে গেল তা বুঝতে পারছে না রীণা। পলিসিটা অনায়াসে তাকেই পাঠাতে পারত বাসুদেব। না হলে কোনও অ্যাটর্নির কাছে গচ্ছিত রাখা যেত। শিখার কাছে কেন? শিখার সঙ্গে রীণাকে মুখোমুখি দাঁড় করানোরই বা কোন প্রয়োজন? এসব নাটক রীণার সহ্য হয় না। কিন্তু অজুর মুখ চেয়ে এই নাটকটা তাকে করতেও হবে।
সকাল সওয়া আটটায় অফিসে বেরিয়ে গেল শঙ্কর। অজু ফিরল আটটা চল্লিশে। মুখে ঘাম, গায়ের সাদা টি-শার্ট ভিজে সপসপ করছে। লিভিং রুম থেকে হলঘরে অজুকে দেখতে পাচ্ছিল রীণা। ও কি তার পাপের প্রতীক? পাপই বা বলবে কেন রীণা? পাপ কেন? সে একজনকে একসময়ে সত্যিকারের ভালবেসেছিল। ও তো সেই ভালবাসারই সন্তান।
অজু কিছুক্ষণ খালি গায়ে পাখার নীচে বসে থাকল। তারপর বাথরুমে গেল।
ধীর পায়ে খাওয়ার টেবিলে এল রীণা। রামু খাবার সাজিয়ে দিচ্ছে। মুখোমুখি চেয়ারে সে বসে রইল চুপচাপ।
হাই মাম্মি। আজও নিরামিষ নাকি?
রীণা একটু থতমত খেল। নিরামিষের কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। গত তিন দিন অজু নিরামিষ খাচ্ছে। কোনও প্রশ্ন করছে না। ও কি জানে? সন্দেহটা বড় কাটা কাটা লাগছে বুকের মধ্যে, না জানলেও জানবে। পলিসিটা যদি পাওয়া যায় তা হলে অজুকেই ক্লেম দাখিল করতে হবে। অজু তখন কি প্রশ্ন তুলবে না, বাসুদেব সেনগুপ্ত আমার কে?
পোশাক পরে অজু খেতে এল। একটু গোগ্রাসে খায়।
খেতে খেতে বলল, তোমার মুখটা ক’দিন যাবৎ অশোকবনে সীতার মতো হয়ে আছে কেন মা?
শরীর–
কথাটা শেষ করতে না দিয়ে অজু ধমকে উঠল, ফের শরীর। শরীর নয়, তোমার মন খারাপ।
খারাপ হলেই বা কী করবি? মন খারাপ তো খারাপ।
অজু একটু হাসল, খারাপ মনকে ভাল করে ফেললেই তো হয়। পৃথিবীর কোনও ঘটনাকেই গুরুত্ব দিয়ো না। জাস্ট ইগনোর এভরিথিং।
তা যদি পারতাম!
আমি কিন্তু পারি।
কী পারিস?
ঘটনাবলিকে উপেক্ষা করতে।
তোর আর ঘটনাবলি কীসের? একটুকু তো বয়স!
বয়সটা ফ্যাক্টর নয়। কম বয়সেই অনেকের কত ঘটনা ঘটে থাকে।
অজু, তুই কবে চাকরি পাবি?
পাবই যে এমন গ্যারান্টি নেই। হোটেল ম্যানেজমেন্টেও যা ছাত্রছাত্রীর ভিড়। তা ছাড়া কোর্সও তো শেষ হতে অনেক বাকি। কেন মা?
তুই চাকরি করলে আমার বুকটা হালকা হয়।
আমার মনে হয় আমার বেশ ব্যাবসার মাথা আছে। কিছু টাকা পেলে ব্যাবসা করতাম।
কীসের ব্যাবসা?
একটা হেলথ ক্লিনিক আর মাল্টিপল জিম।
তোর মাথায় ও ছাড়া কিছু আসে না?
যার যে লাইন। ওটা আমি ভাল বুঝি। ঢাকুরিয়া ইজ এ গুড স্পট। ওখানে করা যবে।
ঢাকুরিয়া! হঠাৎ ঢাকুরিয়ায় কেন?
ওখানে আমার একটা ঠেক আছে।
ঠেক! কীসের ঠেক? বন্ধুর বাড়ি নাকি?
হ্যাঁ।
ভাড়া নেবে না?
অজু হাসল, নাও নিতে পারে।