দিদিমণি যে খুন হয়েছে তা কখন বুঝলে?
সাড়ে চারটে নাগাদ ভিখু এসে বলল।
কী করলে তখন?
খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আমরা গরিব মানুষ স্যার, বিশেষ লেখাপড়াও জানি না, কী থেকে কী হয় ভেবে আমরা সহজেই ভয় পাই। একবার তো ভেবেছিলাম পালিয়ে যাব। তারপর মনে হল হিতে বিপরীত হবে। তাই পুলিশে খবর দিই। পুলিশ স্যার, আমাদেরই ধরে নিয়ে গেল। তারপর অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর সতুবাবু গিয়ে ছাড়িয়ে আনেন।
দিদিমণি কীভাবে খুন হয়েছেন জানো?
কেউ গলা টিপে খুন করে গেছে। যে গলা টিপেছে তার হাতে নাকি দস্তানা ছিল।
ঠিক কথা। আর কিছু বলতে পারো?
কী বলব স্যার?
তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
না স্যার, কাকে সন্দেহ করব?
দিদিমণি খুন হওয়ার আগে এ-বাড়ির সামনে দিয়ে কোনও একজন বা দু’জন লোককে বারবার যাতায়াত করতে দেখেছ? কিংবা কোনও অচেনা লোক কি গায়ে পড়ে তোমার সঙ্গে আলাপ জমাতে চেয়েছে?
এ তো বড়লোকদের পাড়া স্যার। লোকের যাতায়াত কম, তবে আমি বেকার বসে থাকি বলে আশপাশের বাড়ির চাকর দারোয়ানরা মাঝে মাঝে এসে গল্পটল্প করে যায়।
অচেনা কেউ?
না স্যার, মনে পড়ছে না। গেটের কাছে টুলে বসে থাকলে অবশ্য অনেকে বাড়ির হদিশ চায়, এত নম্বর বাড়িটা কোনদিকে হবে এইসব।
ঠিক আছে, তুমি যেতে পারো। সতুবাবু একটু বাদেই আসবেন। তিনি এলেই সোজা আমার কাছে নিয়ে এসো।
ঠিক আছে স্যার। ভিখুকে কি আপনার জন্য চা করতে বলব স্যার?
বলতে পারো।
বলরাম চলে যাওয়ার পর শবর ঘুরে ঘুরে বাড়ির দোতলাটা দেখছিল। ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে। দারুণ সুন্দর সব রঙের কম্বিনেশন। বাথরুমে খুব আধুনিক ফিটিংস লাগানো। প্রতি ঘরেই নানারকম সাবেকি আসবাব। দুই আলমারি বোঝাই বিলিতি আর জাপানি পুতুল। পিয়ানো, অর্গান ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র রাখা প্রকাণ্ড হলঘরে। বিশাল বিশাল ঝাড়বাতি। অথচ এ বাড়িতে থাকার লোকই নেই। অন্তত বিগত চল্লিশ বছর ধরে বাড়ি ফাঁকা পড়ে আছে।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ সতুবাবু বিশাল গাড়ি করে এলেন। বছর পঁয়তাল্লিশ-ছেচল্লিশের ফরসা নাদুশনুদুশ মানুষ। মোটা গোঁফ আছে। পরনে প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট।
নমস্কার মিস্টার দাশগুপ্ত।
আসুন।
আপনার তদন্ত কতদূর?
চলছে।
আমার কাছে কী জানতে চান বলুন।
এবাড়ির ওয়ারিশান কে?
বাড়ির ওয়ারিশান এখন সুব্রত। স্বাভাবিক আইনে।
এবাড়ি কি বিক্রি হওয়ার কথা চলছিল?
হ্যাঁ, অরুর তো সেরকমই ইচ্ছে ছিল। কলকাতার পাট তুলে দেবে বলেছিল।
সুব্রতবাবুরও কি তাই ইচ্ছে?
সুব্রতর বোধহয় একটু অমত আছে।অরুণিমা বলছিল সুব্রত এরকম প্রস্তাবে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
কোনও কারণ আছে?
তা জানি না।
সুব্রতবাবুদের এখানকার বাড়ির অবস্থা কেমন?
মুখটা একটু বিকৃত করে সতুবাবু বললেন, অবস্থা আবার কেমন হবে? ছিল তো বনগাঁর রিফিউজি ক্যাম্পে। তারপর বিধানপল্লিতে কোনওরকমে টিনের ঘর করে থাকত। এখন অবশ্য পাকা ঘর হয়েছে শুনেছি, তা তারও অনেক ভাগীদার। ওর কাকা-জ্যাঠাদেরও নাকি ও বাড়ির শেয়ার আছে। সুব্রতর বাবা তো চিরকালের ভ্যাগাবন্ড। কোন একটা কো অপারেটিভে সামান্য বেতনের চাকরি করত। ভাগ্য ভাল ছেলেটা হল ব্রিলিয়ান্ট। সেই জোরেই আমেরিকা গেল। এই তো ওদের হিস্ট্রি। এখন বুঝে নিন।
অরুণিমা দেবী আর সুব্রতবাবুর কি লাভ ম্যারেজ?
হ্যাঁ মশাই, নইলে মনাকাকা কখনও এই পরিবারে মেয়ের বিয়ে দেয়? তবে সুব্রত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে বলে কাকা আপত্তি করেননি।
ওদের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন ছিল জানেন?
আগে তো ভালই ছিল। ইদানীং অরু কিছু অনুযোগ করছিল।
কীরকম অনুযোগ?
এমনিতে কংক্রিট কিছু নয়। অরু চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল। তবে নানা কথায় দু’-একটা মন্তব্য করে ফেলত।
ওঁদের সন্তানহীনতাই কি তার জন্য দায়ী?
না মশাই, সন্তানের জন্য দুঃখ সে তো থাকতেই পারে। তাতে কি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হয়?
হয়। সন্তান একটা মস্ত বড় ফ্যাক্টর।
মানছি। কিন্তু ওদের সম্পর্কটা খারাপ হয়ে থাকলে হয়েছে অন্য কারণে।
সেই কারণটা কী?
জানি না।
মিসেস বকশি আপনার খুড়তুতো বোন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনার কাকার অবস্থা তো খুবই ভাল ছিল দেখছি।
আমরা ব্যবসায়ী পরিবার। মনাকাকার তো জাহাজ ছিল। সেসব অনেক ব্যাপার।
এ বাড়িটা কি আপনার মনাকাকাই করেছিলেন?
না। আমার দাদুর তৈরি বাড়ি। চার ছেলের জন্য চার জায়গায় উনি বাড়ি করে রেখে গেছেন।
সবকটা বাড়িই এরকম ভাল?
বড়কাকার আলিপুরের বাড়িটা আরও ভাল।
এ বাড়ি কি বিক্রি ঠিক হয়ে গেছে?
সবই তো পাকা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার সব কেঁচে যাবে বলে মনে হয়। এখন তো অরু নেই, সুব্রত মালিক। সে রাজি না হলে বিক্রি আটকে যাবে।
উনি কি বিক্রি করতে রাজি নন?
আমার সঙ্গে কথা হয়নি। কিন্তু অরুর কাছে যা শুনেছি তাতে মনে হয় সুব্রত রাজি হবে না।
দারোয়ান আর চাকর দু’জনেই বলেছে যে, সুব্রতবাবু নাকি এ বাড়িতে আসতেন না।
ঠিকই বলেছে। কলকাতায় এলে সুব্রত ওদের কলোনির বাড়িতেই থাকত। অরুণিমা থাকত এ বাড়িতে। তবে ওরা কেউই এখানে এসে বেশিদিন থাকত না। বড়জোর পনেরো কুড়ি দিন।
অরুণিমা দেবীর জন্ম তো আমেরিকায়। আপনাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন কী করে?
আমাদের পরিবারের অনেকেই বিদেশে আছে। আমি নিজে বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় ছিলাম। তখন অরু ছোট। আমি ওর নিজের দাদার চেয়েও বেশি ছিলাম।