উনি কখন আসেন?
সন্ধেবেলা। সতুবাবু ওঁকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসেন।
সতুবাবু ছাড়া আর কেউ ছিল না?
না সাহেব।
সুব্রতবাবু কবে আসেন?
ছোটসাহেব তো মেমসাহেব মারা যাওয়ার পরে আসেন, খবর পেয়ে।
এসে উনি কী করলেন?
উনি এ বাড়িতে ওঠেননি। কলকাতায় ওঁর বাড়ি আছে, সেখানে উঠেছিলেন।
সুব্রতবাবু কি কখনও এ বাড়িতে উঠতেন না?
বেশিরভাগ সময়ে মেমসাহেব একাই আসতেন। ছোট সাহেবকে আমি খুব একটা দেখিনি।
ঠিক আছে। তুমি যেতে পারো। গিয়ে পাঁচ মিনিট পর বলরামকে পাঠিয়ে দাও।
ভিখু চলে যাওয়ার পর টেপ রেকর্ডারটা বন্ধ করে শবর উঠল। এটাই ছিল মিসেস বকশির শোওয়ার ঘর! খাঁটি আবলুশ কাঠের বিশাল একটা খাট, যার মাথার দিকটা সিংহাসনের মতো কাজ করা। দেরাজ আলমারি সবই একই কাঠের এবং ঝকমক করছে। তাদের পালিশ।
আসবাবগুলো সেকেলে, ভারী এবং অতিশয় মূল্যবান। ঘরে ওয়াল-টু-ওয়াল কার্পেটটাও পুরনো বটে, কিন্তু বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়ির স্থাপত্যও আধুনিক নয়। পুরনো ব্রিটিশ আমলের প্যালেসের আদলে তৈরি। ঘরটা বিশাল, লাগোয়া দক্ষিণের বারান্দাটিও চমৎকার সোফাসেট দিয়ে সাজানো। আধুনিক জিনিস বলতে শুধু এয়ারকুলার লাগানো আছে ঘরে। শোওয়ার ঘরের একপাশে নিচু ক্যাবিনেটের ওপর দুটো বড় সুটকেস। আমেরিকায় তৈরি। সন্ট লাগেজ। কালচে রঙের সুটকেস দুটোই আটকে সিল করে দিয়ে গেছে পুলিশ। সুটকেস দুটো খোলার অধিকার আছে শবরের, কিন্তু সে খুলল না।
আসব স্যার?
এসো।
মধ্যবয়সি মজবুত চেহারার বলরাম শঙ্কিত মুখে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল।
তুমিই তো দারোয়ান?
হ্যাঁ স্যার।
কতদিন কাজ করছ এ বাড়িতে?
কুড়ি বছর।
বাড়ির মালিককে তো তা হলে ভালই চেনো।
মাথা নেড়ে বলরাম বলে, না স্যার। মালিকরা কেউ তো এখানে থাকতেন না। ওঁরা অনেক বছর আমেরিকায়, দিদিমণির জন্মও তো হয়েছে ওখানেই। আমি ফাঁকা বাড়ি সামলে রাখতাম।
তোমার কাজ তা হলে কী?
কাজ বলতে কিছুই নেই। শুধু বসে থাকা।
কত মাইনে পাও?
আড়াই হাজার।
মাইনে তো ভালই।
যে আজ্ঞে, আমি একা লোক, চলে যায়।
একা কেন, পরিবার কোথায়?
আমি বিয়ে করিনি স্যার। মা বাবা মারা গেছেন। কেউ বিশেষ নেইও।
তুমি এ বাড়িতেই থাকো? হ্যাঁ
স্যার। গেট-এর পাশেই আমার ঘর। চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি।
খুনের দিন সকালবেলা যে ভদ্রলোক এসেছিল তাকে মনে আছে?
হ্যাঁ স্যার। ওঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল।
দিদিমণির কি অনেক অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকত?
না। বাড়িতে বেশি লোক আসত না।
লোকটা এসে কী করল?
নাম বলল, আমি খাতা খুলে মিলিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিলাম। এক ঘণ্টা পর উনি চলে যান।
তখন তুমি কী লক্ষ করেছিলে?
বাবুর বাঁ-গাল কেটে গিয়েছিল। রুমাল চাপা দিয়ে রেখেছিলেন।
তোমার কী মনে হল তখন?
কিছু ঝামেলা হয়ে থাকবে। ভিখুকে জিগ্যেস করেছিলাম। ভিখু বলল দু’জনে ঝগড়া হয়েছিল, দিদিমণি বাবুকে খিমচে দেন।
সুব্রতবাবু কি এ-বাড়িতে আসত না?
খুব কম স্যার। দিদিমণির বিয়ে হয়েছে ষোলো-সতেরো বছর। দু-তিনবারের বেশি জামাইবাবুকে দেখিনি ভাল করে।
দিদিমণি কি প্রতি বছর নিয়ম করে দেশে আসতেন?
না স্যার। এক-দুই বছর বাদও যেত। শুনছিলাম এ বাড়ি বিক্রি করে দিদিমণি এবার আমেরিকাতেই থাকবেন, দেশের পাট চুকিয়ে। এখন যে কী হবে তা বুঝতে পারছি না। চাকরিটা তো যাবেই। বুড়ো বয়সে খুব অসুবিধেয় পড়তে হবে।
টাকাপয়সা জমাওনি?
কিছু জমিয়েছি স্যার, পোস্টঅফিসে আছে। কিন্তু সেই সামান্য টাকায় কি জীবন কাটবে? টাকার দাম তত কমে যাচ্ছে, কতদিন বাঁচব তার ঠিক কী?
তোমার শরীর তো মজবুত, এখনও খাটতে পারো।
যে আজ্ঞে। কিন্তু লোকে কাজই দিতে চায় না।
চেষ্টা করছ নাকি?
সতুবাবু কয়েকমাস আগেই বলে দিয়েছেন যে, বাড়ি বিক্রির চেষ্টা হচ্ছে, আমি যেন অন্য ব্যবস্থা দেখে নিই। তাই একটু-আধটু চেষ্টা করেছি।
খুনের সময়ে তুমি কোথায় ছিলে?
থানায়। ঝুটমুট আমাকে হয়রান করা হল স্যার। বেলা একটা হবে তখন। একজন সার্জেন্ট মোটরবাইক চেপে এসে বলল, থানার বড়বাবু নাকি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে, এখনই যেতে হবে।
কেন ডেকেছে তা বলেনি?
বলল, কেন ডেকেছে জানি না, তবে বলে দিয়েছে যেতে না চাইলে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে। বলেই চলে গেল। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দিদিমণিকে বললাম। দিদিমণি তখন বিছানায় শোয়া। হাত নেড়ে বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, যাও।
দিদিমণি কি তখন কাঁদছিলেন?
ঠিক বুঝতে পারিনি। হতেও পারে। গলাটা ভারী লাগছিল।
তারপর বলো।
থানায় গেলাম, তা সেপাই আটকাল। কিছুতেই বড়বাবুর কাছে যেতে দেবে না। তখন বললাম বড়বাবুই ডেকে পাঠিয়েছেন। অনেক তত্ত্ব তালাসের পর বড়বাবুর ঘর দেখিয়ে দিল। গিয়ে যখন নামটাম বললাম বড়বাবু কিছুই বুঝতে পারেন না। যখন বললাম সার্জেন্ট গিয়ে এত্তেলা দিয়েছে তখন বড়বাবু বললেন, তা হলে সিরিয়াস কেসই হবে। আর একজন অফিসারকে ডেকে বললেন, এর একটা স্টেটমেন্ট নিন তো, মনে হচ্ছে সিরিয়াস কেস৷ তা সেই অফিসার আমাকে আর-একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে বলল, ধুস, একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে বোধহয়। বলে নামধাম নিয়ে ছেড়ে দিল।
তখন কটা বাজে?
তা তিনটে-সাড়ে তিনটে হবে।
গেট ততক্ষণ খোলা ছিল?
তালা ছিল না। তবে ফটকে আগল দিয়ে গিয়েছিলাম।