আমি পারব না।
পারতেই হবে। পারতেই হবে। পারতেই—
মিস্টার রায়, আমি আপনার স্লেভ নই। আপনার আচরণ বর্বরদের মতো। আপনি–
ভেরি ইজি। কম্পিউটার ইন ফ্যাক্ট একটা ট্রেইন্ড বাঁদরেও অপারেট করতে পারে। যদিও আপনার গ্রে-ম্যাটার কম, তবু এ কাজটায় তেমন ব্রেন-ওয়ার্কের দরকারও নেই।
মিস্টার রায়—
ঠিক সাত দিন বাদে কোডটা বদলাতে হবে। খুব ইম্পর্ট্যান্ট ব্যাপার। সাত দিনের মাথায়—
মিস্টার রায়, গাড়ি থামান! আমি নেমে যাব।
এবার ববি রায় লীনার দিকে তাকালেন। ভ্রু একটু ওপরে তুলে বললেন, সামনেই ইস্টার্ন বাইপাস। এ জায়গা থেকে ফিরে যাওয়ার কোনও কনভেয়ান্স নেই।
তা হোক। কলকাতায় আমার একা চলাফেরা করে অভ্যাস আছে।
ববি রায় নীরবে গাড়িটা চালাতে লাগলেন। বিশ্রী এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা। অত্যন্ত ঘিঞ্জি বস্তি এবং ননাংরা পরিবেশের ভিতর দিয়ে প্রকাণ্ড গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে চলেছে। কিন্তু ভিতরটা শীততাপনিয়ন্ত্রিত আর গদি নরম বলে তেমন কষ্ট হচ্ছে না লীনার।
ববি রায় বেশ কিছুক্ষণ বাদে বললেন, আমি একটু বাদেই নামব। আপনি এই গাড়িটা নিয়ে ফিরে যাবেন।
লীনা চমকে উঠে বলল, গাড়ি নিয়ে?
কেন, আপনি তো গাড়ি চালাতে জানেন!
জানি, কিন্তু আমি কেন গাড়ি নিয়ে ফিরব?
এ গাড়িটা আপনার নামে অফিসের লগবুকে আজ থেকে অ্যালট করা হয়েছে।
কিন্তু কেন?
ববি রায় নির্বিকার মুখে জিজ্ঞেস করলেন, কেন, গাড়িটা পছন্দ নয়?
উঃ, আমি কি পাগল হয়ে যাব?
এটা বেশ ভাল গাড়ি মিসেস ভট্টাচারিয়া, খুব ভাল গাড়ি। তেলের খরচ কোম্পানি দেবে। চিন্তা করবেন না।
লীনার মাথা এতই তালগোল পাকিয়ে গেছে যে, সে এবার ‘মিসেস ভট্টাচারিয়া’ শুনেও আপত্তি করতে পারল না। আসলে সে কথাই বলতে পারল না।
ববি রায় ইস্টার্ন বাইপাসে গাড়ি বাঁ দিকে ঘোরালেন। চওড়া ফাঁকা মসৃণ রাস্তা। দিনান্তের ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে চারদিকের চরাচর। কুয়াশা জমে উঠেছে চারদিকে।
লীনা দরজার হাতলের দিকে হাত বাড়াল।
ববি রায় মাথা নাড়লেন, ওভাবে খোলে না। সুইচ আছে মিম ভট্টাচারিয়া। কিন্তু ওসব শিখে নিতে খুব বেশি গ্রে-ম্যাটারের দরকার হবে না। এই যে, এইখানে সুইচ, চারটে দরজার জন্য চারটে সুইচ।
ওঃ, মাই গড।
এত ভগবানকে ডাকছেন কেন বলুন তো! এখনও কিন্তু আপনি তেমন বিপদে পড়েননি।
তার মানে?
ববি রায় এবার হাসলেন। লীনা এই স্বল্প আলোতেও দেখল, এই রোগা খ্যাপাটে কালো লোকটার হাসিটা ভীষণ রকমের ভাল।
ববি রায় হাসিটা মুছে নিয়ে বললেন, তবে বিপদে পড়বেন। হয়তো বেশ মারাত্মক বিপদেই, নিজের কোনও দোষ না-থাকা সত্ত্বেও।
তার মানে?
ওঃ, আপনার আজ একটা কথাতেই পিন আটকে গেছে। তার মানে’ ছাড়া অন্য কোনও ডায়ালগ কি মাথায় আসছে না?
না। আমি এসবের মানে জানতে চাই।
অত কথা বলার যে সময় নেই আমার। আমার সময় বড্ড কম। খুন হয়ে যাওয়ার আগে আমাকে তাড়াতাড়ি আমার সব কিছু গুটিয়ে নিতে হবে।
আপনি কেবল খুন-খুন করছেন কেন?
ববি রায় একটা প্রকাণ্ড শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমি রোমান্টিক বাঙালির মতো মৃত্যুচিন্তা করি না মিসেস ভট্টাচারিয়া—
মিসেস নয়, মিস–
ইররেলেভেন্ট। বয়ফ্রেন্ড মনে থাকবে?
না থাকার কী আছে! আর ফর ইয়োর ইনফরমেশন আমি কম্পিউটারের একটা কোর্স করেছিলাম। আমার বায়োডাটায় সে কথ, লেখা ছিল।
তা হলে তো আপনার আই-কিউ বেশ হাই! অ্যাঁ!
লীনা রাগে চিড়বিড় করল। কিন্তু কিছু বলতে পারল না।
ববি রায় বললেন, এ গাড়িটা নিয়ে এখন থেকে অফিসে যাবেন। সেফ গাড়ি। কাচগুলো বুলেট-প্রুফ।
বাড়িতে কী বলব?
বলবেন, অফিস থেকে গাড়িটা আপনাকে দেওয়া হয়েছে। সেটা মিথ্যেও নয়।
আর কী করতে হবে?
ববি রায় হাসলেন, আপনি তো কবিতা লেখেন! আমার ওপর একটা এপিটাফ লিখবেন। কেমন?
০৩. ববি রায় যেখানে গাড়িটা থামালেন
ববি রায় যেখানে গাড়িটা থামালেন সে জায়গাটা লীনার চেনা। ডান ধারে ওই দেখা যাচ্ছে যুবভারতী স্টেডিয়াম, ছড়ানো-ছিটানো লোকালয়।
ববি রায় বললেন, রাস্তাঘাট তো আপনি ভালই চেনেন। গাড়ি নিয়ে একা ফিরে যেতে পারবেন তো!
পারব। কিন্তু—
কিন্তু, ৩বে, তার মানে, এই সব শব্দগুলোকে বর্জন করতে হবে। এ দেশের লোকেদের কোনও কাজই এগোতে চায় না ওই সব দ্বিধা, দ্বন্দ্ব আর ভয়ের দরুন।
লীনা ফুঁসে উঠে বলল, আপনি যে একটা ইচ্ছেমতো মিস্ত্রি তৈরি করছেন না, তা কী করে বুঝব? মিস্ত্রি তৈরি করব? কেন, ববি রায়ের কি এতই বাড়তি সময় আছে?
সেটাই বুঝতে পারছি না।
ববি রায় মাথা নেড়ে বললেন, মিষ্ট্রি হয়তো একটা তৈরি হয়েছে, তবে সেটা আমি তৈরি করিনি।
লীনা গলায় যথেষ্ট রাগ পুষে রেখে বলল, তা হলে শেষ অবধি আমাকে করতে হবে কী? একটা কোডেড ইনফরমেশন কম্পিউটার কি করা তো?
ববি রায় মাথা নাড়লেন, না। ইনফরমেশনটা কিল করতে হবে যদি আমার মৃত্যু ঘটে, তবেই।
‘তার মানে’ বলতে গিয়েও লীনা নিজেকে সামলে নিল।
ববি রায় বললেন, আমার মৃত্যু কোথায় কীভাবে হতে পারে তা তো আপনার জানার কথা নয়। আমি হাইডিং—–হাইডিং মানে কী বলুন তো?
আত্মগোপন করা।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর একটা সহজ বাংলাও আছে না! গা-ঢাকা না কী যেন!
আছে।
আমি গা-ঢাকা দিচ্ছি। অফিস পুরোপুরি আপনার হাতে। বি কেয়ারফুল।
এইটুকু বলেই ববি রায় সুইচ টিপলেন, ড্রাইভারের দিককার দরজা খুলে গেল, ববি রায় নেমে দাঁড়ালেন। দরজা বন্ধ করার আগে লীনার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে বললেন, এ গাড়ির অটোমেটিক গিয়ার। পুরোপুরি ইলেকট্রনিক। স্মদ ড্রাইভ।