ববি মাথা নাড়লেন, দুঃখিত। একজন হেভিওয়েট বক্সারকে এতটা অপমান করা আমার ঠিক হয়নি।
লোকটা মাথা নাড়ল, বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি না। এর মধ্যে কোনও একটা চালাকি আছে।
বলতে বলতে লোকটা ঠেলে রিভলভিং চেয়ারটা সরিয়ে দিল।
ববি, আমি তোমাকে খুন করতে এসেছি। আর খুন আমাকে করতেই হবে… আমি জন দি টেরর।
ববি নিষ্কম্প দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠান্ডা গলাতেই বললেন, আমি তোমাকে চিনি ডার্টি জন। মানবসমাজের পক্ষে তুমি এক নোংরা আবর্জনা। তুমি প্রতিভাবান খুনি ছাড়া আর কিছু নও।
জন খুব ধীরে এগিয়ে গেল।
ততোধিক ধীরে ববি এগোলেন। ববি জানেন, জন আর পাঁচজনের মতো নয়। শরীর ও মনের ওপর তারও নিয়ন্ত্রণ সাংঘাতিক। মানুষ তখনই লড়াই জেতে যখন শরীর ও মন দুইকেই সে একত্রিত করতে পারে। তখন নিজেই সে এক ভয়াবহ অস্ত্র। অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অজেয়। ইন আর ইয়ান। ইয়ান আর ইন।
লীনা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, শুনুন বস। প্লিজ। আপনাকে ও মেরে ফেলবে।
ক্ষুরধার নিষ্পলক চোখে ববি তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিরীক্ষণ করতে করতে বললেন, মিসেস ভট্টাচারিয়া, আপনি ঘরের বাইরে যান। ইন্দ্রজিৎ আপনাকে ওপরে নিয়ে যাবে।
আমি আপনাকে মরতে দিতে পারি না।
আমি অমর।
কিসের একটা ধাক্কা খেয়ে লীনা ছিটকে পড়ল মেঝেয়। একটু বাদে বুঝল, পরিসর তৈরি করার জন্য জন তাকে সরিয়ে দিয়েছে মাত্র।
ববি ওত পেতে অপেক্ষা করছিলেন। জন তার কারাটে কিকটি চালিয়ে দিল ববির কোমরে।
বেড়ালের মতো শুন্যে লাফিয়ে উঠলেন ববি। আর মাটিতে পড়ার আগেই পা বিদ্যুতের বেগে নেমে এল জনের মুখে।
কিন্তু জন অন্তত চার ফুট বাঁয়ে সরে গেছে ততক্ষণে। ববি মাটিতে নামার সঙ্গে সঙ্গেই সে তার হাতের কানার কোপটি বসাল ববির ঘাড়ে।
কী চমৎকার ভারসাম্য লোকটার শরীরে! ববি একটা ডিগবাজি খেয়ে চলে গেলেন পিছনে।
১৮. ক্ষতবিক্ষত শরীরে ববি
ক্ষতবিক্ষত শরীরে ববি অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে শারীরিক ও মানসিক লড়াই চালিয়েছেন। প্রতিপক্ষদের মধ্যে বিবেকহীন দৈত্য ও পেশাদার খুনির সংখ্যাই প্রবল। এতক্ষণ যে বেঁচে আছেন ববি, তা কেবল দৈবের বশে। কিন্তু আস্তে আস্তে ববির ক্ষতমুখগুলি বিষিয়ে উঠছে। কেটে যাচ্ছে ওষুধের ক্রিয়া। ববির রিফ্লেক্স ভাল কাজ করছে না। চোখে মাঝে মাঝে ঝাপসা দেখছেন।
প্রতিপক্ষ শুধু প্রবলই নয়, এ পর্যন্ত সর্বোত্তম। লড়াইটা জেতা ববির পক্ষে সাংঘাতিক প্রয়োজন। সুস্থ থাকলে কোনও সমস্যাই ছিল না। কিন্তু এখন ববির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে যেন বাড়তি জল ঢুকে পড়েছে। হাত তুলতে, পা তুলতে দেড়গুণ-দ্বিগুণ সময় লাগছে। পিঠ থেকে একটা ব্যথা উরু অবধি অবশ করে দিচ্ছে। মাথার ভিতরে প্রবল যন্ত্রণা। আর এ লড়াই লড়তে হচ্ছে শূন্যে লাফিয়ে, জমিতে পড়ে, শরীরে চুড়ান্ত ভারসাম্যের ওপর। এক চুল, এক পলের এদিক ওদিক হলেই একটি হাই পাওয়ার কিক বা কারাটে চপ খেয়ে চোখ ওলটাতে হবে।
প্রায় পনেরো মিনিট কেউ কাউকে ছুঁতে পারল না। লড়াই রইল সমান-সমান। কিন্তু আসলে সমান-সমান নয়। ববি যে আস্তে আস্তে নিজের শরীরের কাছে হার মানছেন তা তিনিও বুঝতে পারছিলেন। আর সেটা বুঝতে পারছিল তার বুদ্ধিমান প্রতিপক্ষও। ট্রাংক কল-এ সে জানতে পেবেছে ববি ওয়্যারহাউসে কী পরিমাণ পিটুনি গ্রহণ করেছেন তার শরীরে। সারা রাত ঘুম বলতে গেলে হয়নি। প্রতিপক্ষ এয়ারপোর্টের ঘটনাও জানে। সে জানে, ববিকে এই বাড়ির ভূগর্ভের ঘরে আসতে তিন-তিনটে সাব-মেশিনগানধারী গুন্ডার মোকাবিলা করতে হয়েছে। তার মধ্যে একজন হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা। সুতরাং লোকটা ববিকে যতখানি পারে পরিশ্রান্ত করে তুলছিল। লোকটার নিজের রিফ্লেক্স চমৎকার। নড়াচড়া বিদ্যুৎগতিসম্পন্ন। তাই আহত পরিশ্রান্ত ববিকে সে আক্রমণের পর আক্রমণ রচনা করতে দিয়ে নিজেকে বারবার চকিতে সরিয়ে নিচ্ছিল।
ববি বুঝলেন, এভাবে পারা যাবে না। লড়াই তাড়াতাড়ি শেষ করা দরকার। চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে ববি হঠাৎ বৃত্তটা ভেঙে এবং এ লড়াইয়ের নিয়মের তোয়াক্কা না করে আচমকাই সোজা সরল পথে লোকটার কোমর লক্ষ করে জোড়া পায়ে লাফিয়ে পড়লেন।
চমৎকার হালকা ও চকিত লাফ। স্বাভাবিক অবস্থায় এই আকস্মিক দিক পরিবর্তনের ফলে লোকটা দিশাহারা হয়ে যেত। নিশ্চিত পরাজয় লেখা ছিল তার কপালে।
কিন্তু ভাগ্য মন্দ ববির। লোকটা ববির ওই বিভীষণ আক্রমণ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিল চিতাবাঘের তৎপরতায়। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুরন্ত এক খোলা হাতের কোপ বসিয়ে দিল ববির মাথায়। হাতের কানার সেই দুর্দান্ত মার ববির মাথার খুলিতে ফেটে পড়ল। ববির চোখের সামনে সহসা ফুলঝুরির মতো আলোর বিন্দু নাচতে লাগল। অসাড় অবসন্ন দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেল।
লোকটা হাঁটু গেড়ে বসে ববিকে অনেকক্ষণ অবিশ্বাসের চোখে দেখল। তারপর মুখ তুলে লীনার দিকে চাইল। ফিসফিস করে বলল, এ লোকটা মানুষ না অতিমানুষ তা কি তুমি জানো মিস লীনা?
লীনা অরুদ্ধ স্বরে বলল, মানুষ। একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ।
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, তুমি জানো না। তুমি জানো না এ লোকটা বম্বেতে আমার গ্যাং-এর হাতে ধরা পড়ার পর যে মার খেয়েছে তা দশটা লোককে ভাগ করে দিলেও তারা বোধহয় সাতদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারত না। এ লোকটা আহত অবস্থায় আমার দু’জন অত্যন্ত শক্ত সমর্থ লোককে ঘায়েল করে পালায়। মাত্র কয়েক মিনিট আগে এ লোকটা আমার তিনজন সশস্ত্র সঙ্গীকে হারিয়ে এবং সম্ভবত অজ্ঞান বা হত্যা করে আমার পিছু নিয়েছে। তিনজনের মধ্যে একজন যে হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা তা তার চেহারা দেখে তুমি নিশ্চয়ই বুঝেছ। এর পরেও যেভাবে আমার সঙ্গে লড়ছিল তাতে যে-কোনও সময়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারত। এ লোকটা মানুষ নয়, মিস লীনা।