দুরবিনটা চোখে দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন ববি। তার অত্যন্ত শক্তিশালী দুরবীক্ষণেও শুধু একটা মস্ত পন্টিয়াক গাড়ি ছাড়া আর কিছুই আবিষ্কার করতে পারল না। ববি তাড়াহুড়ো করলেন না। ওত পেতে বসে রইলেন। যদিও সময় বয়ে যাচ্ছে তবু অন্য উপায় নেই।
কিছুক্ষণ পর একটা ঝোপের আড়াল থেকে একজনকে বেরিয়ে আর-একটা ঝোপের আড়ালে যেতে দেখতে পেলেন ববি। তারপর একটা পেয়ারা গাছের ডালে আর একজনকে আবিষ্কার করা গেল। ছাদের রেলিং-এর আড়ালে আর-একজন। চতুর্থজন ফটকের পাশে গা-ঢাকা দিয়ে দাঁড়ানো। প্রত্যেকের হাতেই উজি সাব-মেশিনগান। আর কাউকে দেখা গেল না। একটা পন্টিয়াক গাড়িতে এর বেশি লোক আনা সম্ভবও নয়। পঞ্চম জন নিশ্চয়ই লীনাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেছে।
ববি প্রায় চোখ বুজে নেমে এলেন।
ইন্দ্রজিৎ!
স্যার, এসে গেছেন তা হলে? আমি ভাবছিলাম আপনি টারজানের মতো লতা ধরে ঝুল খেয়ে অলরেডি ভিতরে পৌঁছে গেলেন বুঝি!
শোনো ইন্দ্রজিৎ, চার-চারটে সাব-মেশিনগানকে এড়ানো বিশেষ রকমের শক্ত কাজ।
ইন্দ্রজিৎ বিবর্ণ হয়ে গিয়ে বলল, বিশেষ বিপজ্জনকও।
আমাদের গাড়িটা অবশ্য সম্পূর্ণ বুলেটপ্রুফ। আমরা ইচ্ছে করলে ওদের অগ্রাহ্য করে ঢুকে যেতে পারি। কিন্তু ওরা গুলি চালালে যে লোকটা লীনাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকেছে সে সতর্ক হয়ে যাবে। সে লীনাকে তখন ব্যবহার করবে হোস্টেজ হিসেবে।
তা হলে কী করবেন স্যার?
আমি ভাবছি, কী করে শব্দটা এড়ানো যায়। একটিও গুলির শব্দ হলে চলবে না।
না স্যার, গুলি জিনিসটা ভালও নয়।
তুমি টারজানের কথা বলছিলে না?
বলেছিলাম স্যার, তবে উইথড্র করে নিচ্ছি।
উঁহু, উইথড্র করার কিছু নেই। টারজানের মতো ঢুকে লাভ নেই। আমাদের ঢুকতে হবে ইঁদুরের মতো। বাড়ির পিছন দিকে একটা নালা আছে। বড় নর্দমা, এসো, ওটা দিয়েই ঢুকতে হবে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইন্দ্রজিৎ গাড়ি থেকে নামল। বলল, আপনার সঙ্গে কাজকারবার করা মানেই প্রাণ হাতে করে চলা। আমার বউ থাকলে আজই বিধবা হত।
না, ইন্দ্রজিৎ তোমার বউ চিরকুমারীই থেকে যাবে। এসো। নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই।
নর্দমা দিয়ে যে আমি কখনও কোথাও ঢুকিনি স্যার।
প্রয়োজনে ডিটেকটিভদের ছুঁচের ফুটো দিয়েও ঢুকতে হয়। গর্দভ, এটা নোংরা নর্দমা নয়।
কথা বলতে বলতে দু’জনে হাঁটছিল। বাড়ির পিছন দিকটায় অসমান জংলা জমি। কাঁটাঝোপ। বিছুটি বন। ভারী নির্জন। গাঁয়ের গোৰুৱাও এদিকে চরতে আসে না।
বাড়ির পিছন দিকে এসে একটা বুক সমান ঘাসজঙ্গলে ঢুকলেন ববি। পিছনে ইন্দ্রজিৎ। নর্দমার মুখটা জঙ্গলে একরকম ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। ববি হিপ পকেট থেকে একটা ভাজকরা ছুরি বের করে ঝপাঝপ কিছু ঘাস কেটে মুখটা পরিষ্কার করলেন।
ইন্দ্রজিৎ বলল, কিন্তু স্যার, নর্দমার মুখে যে শিক লাগান। ঢুকবেন কী করে?
ববি এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কোটের পকেট থেকে ছোট্ট প্লায়ারের মতো একটা যন্ত্র বের করলেন। জং ধরা শিক সেই যন্ত্রের দাঁতে চোখের পলকে কুড়ুক ফড়ুক করে কেটে গেল। হামাগুড়ি দিয়ে ববি ভিতরে ঢুকলেন। পিছনে ইন্দ্রজিৎ।
সামনে বিস্তর ঝোপঝাড়ের দুর্ভেদ্য আড়াল। ববি তারই ফাঁক দিয়ে সামনেটা নিরীক্ষণ করে নিলেন! চাপা গলায় বললেন, ইন্দ্রজিৎ, পিছনের দিকে দু’ধারে দু’জন পাহারা দিচ্ছে। একজনকে আমি কাবু করতে পারব। অন্যজনকে তুমি পারবে?
না স্যার। এমন ঠান্ডা মাথায় কথাগুলো বলছেন, যেন কাজটা একেবারে জলভাত।
তুমি কি কাওয়ার্ড ইন্দ্রজিৎ?
আজ্ঞে হ্যাঁ। সাব-মেশিনগানওয়ালা লোকের সঙ্গে খালি হাতে পাল্লা টানতে গেলে আমি চূড়ান্ত কাওয়ার্ড।
ববি সামান্য ভাবলেন। ভাবতে ভাবতে লোকদুটোকে ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে তীক্ষভাবে নজরে রাখছিলেন।
ইন্দ্রজিৎ, এই সুযোগ। একজন রাউন্ড দিতে আড়ালে গেল।
দেখতে পাচ্ছি স্যার। কিন্তু–
ববি ব্যস্ত গলায় বললেন, শোনো ইন্দ্রজিৎ, এই বাগানে ইলেকট্রনিক বার্গলার অ্যালার্মের তার পাতা আছে। কোনও তার ছুঁয়ো না। সাবধান।
ববি ঘাসজঙ্গলে ড়ুব দিলেন। আর তারপর ইন্দ্রজিৎ শুধু বাতাসের হিলিবিলির মতো একটা ঢেউ দেখতে পেল তৃণভূমিতে। তারপর একটা ঝোপের আড়ালে উঠে দাঁড়ালেন ববি। লোকটার এই অন্যায্য সাহস দেখে ইন্দ্রজিৎ আত্মবিস্মৃত হয়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই অস্ত্রধারী লোকটা তার দিকে তাকাল।
ইন্দ্রজিৎ নড়বার আগেই কুইক-ফায়ার অস্ত্রটিতে ঝাঝরা ও দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেতে পারত। লোকটা সাব-মেশিনগানটা তুলেও ছিল। কিন্তু তারও আগে ঝোপের আড়াল থেকে একটা বাজপাখি যেন উড়ে গেল লোকটার দিকে।
কী হল, তা বুঝতেও পারল না ইন্দ্রজিৎ। শুধু দেখল, অস্ত্রধারী চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে এবং ববি তাকে টেনে ঘাসজঙ্গলের দিকে নিয়ে আসছেন।
দ্বিতীয় পাহারাদারকে ববি নিলেন অত্যন্ত গাঁইয়ার মতো। লোকটা রাউন্ড সেরে ফিরে আসছিল। ববি ঝোপের আড়াল থেকে হাত তুললেন। হাতে একখানা আধলা ইট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিভীষিকা ফাস্ট বোলারের মতোই ইটখানাকে ছুড়লেন ববি। লোকটার কপালটা কেটে হাঁ হয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগল। মাটিতে পড়ে কিছুক্ষণ ছটফট করে শান্ত হয়ে গেল লোকটা। ববি তাকেও ঘাসজঙ্গলে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতছানি দিয়ে ইন্দ্রজিৎকে ডাকলেন। ‘
আপনি স্যার, অমিতাভ বচ্চন ধর্মেন্দ্র আর মিঠুনের ককটেল।
তারা কারা?
আমাদের ন্যাশানাল হিরো।