মিস লীনা, এটা একটা ইলেকট্রনিক দরজা। তুমি কি কোড জানো?
না। আমি আর কিছু জানি না।
জানো মিস লীনা। তুমি কয়েকটা কোড জানো। এই যে পিনহেড দেখছ এটাতে কোড ফিড করা যায়। বলো মিস লীনা।
লীনা অসহায়ভাবে চারদিকে একবার তাকাল। তারপর কে জানে কেন তার চোখ ভরে জল এল। চোখ বুজে ফেলতেই নেমে এল সেই অশ্রুর ধারা। সে চাপা স্বরে শুধু একটাই কোড উচ্চারণ করল, আই লাভ ইউ।
লোকটা দ্রুত হাতে বোতাম টিপে গেল একটার পর একটা।
আশ্চর্যের বিষয় স্টিলের দরজাটা নিঃশব্দে বলবিয়ারিং-এর খাঁজের ওপর দিয়ে সরে গেল।
এসো মিস লীনা। তুমি আরও কোড জানো। এখানে সব কোডই কাজে লাগবে।
লীনা ঘরে ঢুকল। প্রথম ঘরটায় অন্তত চারটে ভিডিয়ো ইউনিট। তার সামনে রয়েছে চাবির বোর্ড। কিন্তু কেউ নেই কোথাও।
লোকটা লীনার দিকে চেয়ে বলল, ভেরি আপটুডেট, ভেরি সফিস্টিকেটেড।
কী?
তুমি সুপার কম্পিউটারের কথা জানো?
শুনেছি।
এ সব হল তারই কাছাকাছি জিনিস। ববি ইজ এ জিনিয়াস। কিন্তু জিনিয়াস যদি বিপথগামী হয় তা হলে তার মৃত্যু অনিবার্য।
তোমরা ববিকে মারবে কেন? তোমরা নীল মঞ্জিল ভেঙে দাও, কিন্তু ওকে মারবে কেন?
ওকে মারতেই হবে মিস লীনা। ওকে মারার জন্য আমি সাত হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছি।
কিন্তু কেন?
কারণ, ববির মৃত্যু চায় পৃথিবীর কয়েকটি শক্তিমান রাষ্ট্র। আমি তাদের প্রতিনিধি মাত্র।
শোনো, ববির অনেক দোষ জানি। কিন্তু কাউকে মেরে ফেলা কি ভাল?
মিস লীনা, তুমি ববির প্রেমে পড়োনি তো?
না, না, কখনওই নয়।
বলল লীনা। তবু কেন যে তার মুখ চোখ কান সব ফের আঁ আঁ করে উঠল। কেন যে রক্তের স্রোত পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে লাগল ধমনীতে ধমনীতে।
সেগুন গাছ তুমি চেনো ইন্দ্রজিৎ?
সেগুন! সে আর শক্ত কী? চেনো? বাঃ, বলো তো ওই গাছটা কী গাছ?
অফকোর্স সেগুন।
বাঃ, তোমার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কেন জানো ইন্দ্রজিৎ? এ দেশে গাড়লেরাই উন্নতি করে, বুদ্ধিমানেরা মার খায়।
তা বটে স্যার, কিন্তু আমি তেমন নিরেট গাড়ল নই। আমার মনে হচ্ছে গাছ নিয়ে আপনার কিছু ভাব এসেছে। কবিতা লেখার পক্ষে অবশ্য সেগুন বেশ জুতসই শব্দ। বেগুন দিয়ে মেলে, লেগুন দিয়ে মেলে।
তবু এ গাছটা সেগুন নয়, শাল।
স্যার, এই অসময়ে আপনি আমাকে বটানি বোঝাচ্ছেন কেন?
বটানি নয়, স্ট্র্যাটেজি। যতদূর অনুমান, শত্রুপক্ষ নীল মঞ্জিল পেনিট্রেট করেছে এবং কয়েকটা সাব-মেশিনগান আমাদের স্বাগতম জানাতে প্রস্তুত। সুতরাং ঢোকার আগে শত্রুপক্ষের অবস্থান জেনে নেওয়া ভাল। তুমি গাছ বাইতে পারো ইন্দ্রজিৎ?
আমি স্যার, কলকাতার ছেলে, গাছ পাব কোথায় যে বাইব?
তাও বটে। তা হলে গাড়িতেই বসে থাকো। আমি ওই সেগুন গাছটায় একটু উঠব। কিন্তু গ্লাসটা দাও তো।
ববি দূরবিনটা বুকে ঝুলিয়ে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রাস্তার পাশে দাড় করানো ভোক্সওয়াগনটায় চুপ করে বসে রইল ইন্দ্রজিৎ। যেদিকে ববি গেলেন সেদিকে প্রায় নির্নিমেষ চেয়ে রইল সে।
হঠাৎ তার মনে হল ওপর থেকে ঝপ করে জঙ্গলের মধ্যে কী একটা পড়ে গেল। সম্ভবত ববির দূরবিন। ইন্দ্রজিৎ তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে জিনিসটার কাছে ছুটে গেল। ঘন বুক সমান ঘাসের মধ্যে অবশ্য কিছু দেখতে পেল না। তাই ওপর দিকে তাকিয়ে চাপা জরুরি গলায় ডাকল, স্যার! স্যার! আপনার দূরবিনটা যে পড়ে গেছে, সেটা টের পেয়েছেন?
ববিকে সে ডালপালার ফাঁক দিয়ে আবছা ভাবে দেখতেও পাচ্ছে। লোকটা ওপরে উঠছে। খুব বেশিদূর ওঠেনি। দুরবিনটা নিয়ে না গেলে লোকটা কিছুই দেখতে পাবে না ওপর থেকে।
সে আবার ডাকল, স্যার! স্যার! থামুন। আপনি ভুল করছেন।
ববি থামলেন। তারপর ডালপালার কিছু শব্দ হল। উৎকণ্ঠিত উর্ধ্বমুখ ইন্দ্রজিৎ সহসা দেখতে পেল, একটা কেঁদো মদ্দা হনুমান তার দিকে কটমট করে চেয়ে আছে।
ইন্দ্রজিৎ সভয়ে বলল, সরি স্যার। থুড়ি, শুধু সরি।
হনুমানটা একটু দাঁত খিচিয়ে আবার গাছে উঠতে লাগল। ঘাস জঙ্গলের মধ্যে একটা শুকনো ডাল খুঁজে পেল ইন্দ্রজিৎ। দুরবিন নয়, হোঁতকা হনুমানটার চাপে ডালটা ভেঙে পড়েছিল।
ইন্দ্রজিতের অনুমান ভুল হল বটে, কিন্তু খুব বেশি ভুল নয়। কারণ মদ্দা হনুমানটা জীবনে এমন প্রতিদ্বন্দ্বী আর দেখেনি। ফুট বিশেক ওপরে ওঠার পর সে পাশের সেগুন গাছে হুবহু তারই মতো দ্রুত ও অনায়াস ভঙ্গিতে আর-একজনকেও গাছ বাইতে দেখল। এবং আশ্চর্যের কথা, প্রতিদ্বন্দ্বী হনুমান নয়, মানুষ। এবং আরও আশ্চর্যের কথা, লোকটা বিড় বিড় করে বলছিল, নীচের দিকে তাকালেই মাথা ঘুরবে… ওঃ বাবা কিছুতেই তাকাব না।
বাস্তবিকই ববির প্রচণ্ড ভার্টিগো। দোতলা থেকেও ববি নীচের দিকে তাকাতে পারেন না।
দুরদর্শী রবীশ পঁচিশ ফুট ওপরে সেগুন গাছের তিনটি মজবুত ডাল জুড়ে একটি মাচান বেঁধেছিলেন। সম্পূর্ণ আড়াল করা চমৎকার ওয়াচ টাওয়ার। এখানে বসে বাড়িটা অত্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।
ভার্টিগোয় আক্রান্ত ববি প্রায় চোখ বুজে মাচানের ওপর উঠে এলেন। হাঁফটাফ তার সহজে ধরে। কিন্তু কালকের ওই অমানুষিক মারের ব্যথা এখনও দাঁত বসিয়ে আছে সর্বাঙ্গের কালশিটেয়। ববি মাচানে বসে প্রথমেই পকেট থেকে সিরিঞ্জ আর একটা পেথিডিনের অ্যাম্পুল বার করলেন। তারপর বাঁ হাতে ছুঁচ ফুটিয়ে ওষুধটা চালিয়ে দিলেন ভিতরে। এখন ব্যথাটাকে না মারলে তিনি যুঝতে পারবেন না, অবশ্য যদি লড়াইটা’ইতিমধ্যে হেরে না গিয়ে থাকেন।