ননসেন্স! ওকে গুলি করবে কেন গাড়লেরা? ওকে মারলে তো সবই গন্ডগোল হয়ে যাবে।
আগেই বলেছি স্যার, আমি একটু দূরে ছিলাম। খুব স্পষ্ট করে দেখিনি। তবে মনে হল মেয়েটা উল্ডেড। গুন্ডারা গিয়ে ওকে ধরে গাড়িতে তুলে হাওয়া।
কোনদিকে গেল তারা?
আমি ফলো করিনি স্যার। দোলন নামে সেই ছোকরাকে গুন্ডারা ঘুসি মেরে অজ্ঞান করে ফেলে গিয়েছিল। আমি দোলনকে রেসকিউ করি। কিন্তু তার কাছ থেকে তেমন কোনও ইনফরমেশন পাইনি। ছোকরাটা আমার চেয়েও কাওয়ার্ড।
হুঁ। তোমার চেয়ে বোকা এবং তোমার চেয়েও কাওয়ার্ড যে আছে তা আমার জানা ছিল না। এনিওয়ে লীনাকে কোথায় নিয়ে গেছে তার খানিকটা আন্দাজ আমার আছে। গাড়িতে ওঠো। ইউ আর গোয়িং ফর এ রাইড।
স্যার, একটা কথা।
কী কথা?
গোলাগুলি চলবে নাকি?
চলতে পারে।
তা হলে আমার হাতেও একটা অস্ত্র থাকা দরকার।
না, বুন্ধু! তোমার হাতে অস্ত্র দেওয়া মানে আমার নিজের বিপদ ডেকে আনা।
আমি কোনওদিন বন্দুক পিস্তল হাতে পর্যন্ত নিতে পারিনি।
ভালই করেছ।
ববি গাড়ি ছাড়লেন। সল্টলেকের রাস্তায় গাড়িটা বিদ্যুৎবেগে ছুটতে লাগল।
স্যার।
বলো।
গাড়িটা মাটির দু’ইঞ্চি ওপর দিয়ে যাচ্ছে। টের পাচ্ছেন?
চুপ করে বসে থাকো।
এ গাড়িতে সিটবেল্ট থাকা উচিত ছিল।
আছে, লাগিয়ে নাও।
ইন্দ্রজিৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজে বলল, আমি নাস্তিক ছিলাম। কিন্তু এখন আর নই। মা কালী বাবা মহাদেব, রক্ষা করো!
ববি ঘুরপথ নিলেন না। সহজ এবং সবচেয়ে শর্টকাট ধরে তীব্রগতিতে এগোতে লাগলেন। ক্রমে বিবেকানন্দ সেতু পার হয়ে বোম্বে রোডে এসে পড়লেন।
স্যার।
বলো।
আপনি কি–?
কী? বললে আপনি রেগে যাবেন না তো স্যার?
তা হলে বোলো না।
বলছিলাম আপনি কি বাই এনি চান্স ওই মেয়েটিকে একটু পছন্দ করেন?
ববি দু-দুটো লরিকে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে কাটিয়ে এগিয়ে গেলেন। ইন্দ্রজিৎ টালমাটাল হয়ে আবার সামলে নিয়ে বলল, গুলিতে নয় আমরা মরব অ্যাকসিডেন্টে। স্যার একটু সামলে—
তুমি কিছু বলছিলে ইন্দ্রজিৎ?
বললেও তা উথড্র করে নিচ্ছি, স্যার।
শোনো, গার্লস আর ইডিয়টস। এই মেয়েটি যদি পর্বতপ্রমাণ বোকা না হত তা হলে আমাদের এইভাবে আজ নাকাল হতে হত না। মেয়েটা হয়তো মরবে, কিন্তু তার আগে একটা মস্ত সর্বনাশ করে দিয়ে যাবে।
ইন্দ্রজিৎ একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনি অত্যন্ত পাষাণ-হৃদয়ের লোক, স্যার।
হ্যাঁ। আমার কোনও সেন্টিমেন্ট নেই।
তাই দেখছি।
সেই ছোকরাটার কী হল? দোলন না কে যেন।
হোপলেস কেস স্যার। ছোকরাকে আমি এসপ্লানেড অবধি একটা লিফট দিয়েছিলাম। ছোকরাটা এত ঘাবড়ে গিয়েছিল যে আমাকে একটা থ্যাংক ইউ অবধি বলল না।
সেটাই স্বাভাবিক, ইন্দ্রজিৎ। বাঙালিদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ভীষণ কমে যাচ্ছে। একদিন হয়তো দেখা যাবে বাঙালি মাত্রই মেয়েছেলে। কেউ শাড়ি পরে, কেউ বা প্যান্ট শার্ট বা ধুতি পাঞ্জাবি। বাট বেসিক্যালি সবাই স্বভাবে চরিত্রে মেয়েছেলে।
আপনি উত্তেজিত হবেন না স্যার, সামনে একটা পেট্রলট্যাংকার… ওরে বাবা…
ইন্দ্রজিৎ চোখ বুজে ফেলল। একটা প্রবল বাতাসের ঝাপটা আর গাড়িতে একটা ভীষণ ঝাঁকুনি টের পেল সে। তারপর চোখ খুলে দেখল, পরিষ্কার রাস্তায় গাড়ি মসৃণ ছুটছে।
আপনি কি মোটরকার জাম্পিং জানেন স্যার? ট্যাংকারটাকে কাটালেন কী করে?
কাটালাম দু’চাকায় ভর করে। পিছনের ডানদিকের চাকা রাস্তায় ছিল না।
মা কালী দুর্গা দুর্গতিনাশিনী!
আচমকাই বড় রাস্তা ছেড়ে একটা ডাইভারশনে ঢুকে পড়লেন। রাস্তাটা এক সময় পাকা ছিল, এখন খানাখন্দে ভরা।
ইন্দ্রজিৎ।
স্যার।
বাতাসে পেট্রলের গন্ধ পাচ্ছ?
ইন্দ্রজিৎ বাতাস কে বলল, না।
আমি পাচ্ছি। ওরা এই পথেই গেছে।
লীনাকে যেখানে আনা হল সেই জায়গাটা লীনা চিনতে পারল না। তবে নিশ্চয়ই খিদিরপুর ডক-এর কাছাকাছি কোনও অঞ্চল। লীনা জাহাজের ভো শুনতে পেল একবার।
ঘিঞ্জি একটা নোংরা বসতি ছাড়িয়ে গিয়ে গাড়িটা একটা মস্ত পুরনো বাড়ির বাগানে ঢুকে পড়ল। নিশ্চয়ই এককালে জমিদারবাড়ি ছিল। এখনও পাথরের পরি আর ফোয়ারা রয়েছে। বাগানে প্রচুরডালিয়া ফুটে আছে।
গাড়িবারান্দার তলায় গাড়িটা দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একজন লোক এসে দরজা খুলে দিল।
ছদ্ম-পুলিশ যুবকটি বলল, এরপর থেকে আর আমাদের কিছুই করার থাকল না মিস ভট্টাচার্য।
তার মানে?
১৭. নীল মঞ্জিলের ঠিকানা
আপনি যদি আমাদের নীল মঞ্জিলের ঠিকানা দিয়ে দিতেন তা হলে আমরা আপনাকে রিলিজ করে দিতে পারতাম। কিন্তু খামোখা জেদ ধরে থেকে আপনি নিজের বিপদ ডেকে আনলেন।
লোকটা নেমে দাঁড়াল। একটা রূঢ় পুরুষালি হাত এসে লীনাকে প্রায় এ্যাচকা টানে নামিয়ে নিল গাড়ি থেকে। লীনা নিজেকে সামলাতে পারল না। গাড়ির দরজায় হোঁচট খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ল রাস্তার পাথরে। হাঁটুর মালাইচাকি ভেঙে গেল কি না কে জানে! লীনা ব্যথায় কাতরে উঠল, উঃ মাগো!
কিন্তু সেই আর্তনাদে কান দেওয়ার মতো কেউ তো ছিল না। পুরুষালি হাতটাই তার বাহু সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে হ্যাঁচকা টানে ফের দাড় করাল। এবার লোকটাকে দেখতে পেল লীনা। যাঁড়ের মতো মোটা ঘাড় আর মাঠের মতো চওড়া বুকওয়ালা এক বিদেশি। গায়ে একটা লাল টকটকে টি-শার্ট, পরনে কালচে ট্রাউজার্স। তার হাতে জাহাজের ছবিওয়ালা উল্কি।
লোকটা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, কাম অন, মিট ডেভিড।
লোকটা কি জাহাজি? হলেও হতে পারে। লীনা জাহাজি বিশেষ দেখেনি। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল, রাসক্যাল, মেয়েদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানো না?