কিন্তু জানতে হবে। রবীশের মৃত্যু-ম্লান মুখচ্ছবি ববির চোখের সামনে আজও অম্লান ভেসে ওঠে। একাশি বছর বয়সেও মানুষ কতখানি সঞ্জীবিত, উদ্বুদ্ধ! কতখানি শক্ত! বিকেলের ছাইরঙা আলোয় রবীশের উপবিষ্ট মৃতদেহ তার নিজের জয়ই ঘোষণা করছিল ভারী বিনয়ের সঙ্গে।
ববি খুব ধীরে ধীরে মাথাটা তুললেন। তারপর ধীরে ধীরে, খুব ধীরে ধীরে হাতের ভর দিয়ে উঠে বসলেন। লক্ষ করলেন, এই পাষণ্ডেরা তাঁকে এখনও পুরোপুরি মারতে চায় না বলেই বোধ হয় একটা নাঙ্গা টেবিলের ওপর এক জগ জল আর একটি ঢাকা থালি রেখে গেছে।
রবি প্রথমে কাঁপা দুর্বল হাতে জগটা তুলে অনেকটা জল খেয়ে নিলেন।
পিঠ আর পায়ের চামড়া ফেটে চিরে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ফুলে আছে ক্ষতবিক্ষত শরীর। তবু ববি টের পেলেন, তার খিদে পেয়েছে। প্রচণ্ড খিদে। সম্ভবত গত ষোলো-সতেরো ঘন্টা তিনি কিছুই খাননি।
খুবই দুর্বল হাতে খাবারের ঢাকনাটা খুললেন ববি। কোনও হোটেল থেকে আনা তৃতীয় শ্রেণির থালি। দু’মুঠো ভাত, দু’খানা রুটি, দু’-তিনটে সবজি আর সামান্য দই।
ববি খুব ধীরে ধীরে খেলেন।
তারপর উঠে দুর্বল পায়ে সামান্য কয়েক পা হাঁটলেন। বুঝলেন, চোট সাংঘাতিক। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন বিদ্যুৎ-শিখার মতো তীব্র যন্ত্রণা লক লক করে উঠছে।
ববি বসে হাঁফাতে লাগলেন। জল আর খাবারের ক্রিয়া আরও কিছুক্ষণ চললে হয়তো সবল বোধ করবেন।
কাঠের পাটাতনটার ওপর ফের শুয়ে পড়লেন। এবার সংজ্ঞাহীনতা নয়, প্রগাঢ় ঘুমে চোখ আঠা হয়ে লেগে এল।
ঘুম ভাঙল সামান্য একটা শব্দে। সম্ভবত রাত গভীর হয়েছে। গুদামের মধ্যে গাঢ় অন্ধকার।
ববি উঠে বসলেন। পায়ের দিকে দরজাটা কি খুলে যাচ্ছে? কেউ ঢুকছে?
ববি তাঁর কর্তব্য স্থির করে নিলেন চোখের পলকে। এরা যদি তাকে আবার বাঁধে মুশকিল হবে। তিনি অন্ধকারেই তক্তা থেকে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে আন্দাজে এগোতে লাগলেন।
দরজাটা বেশ বড়। দুটো বিশাল কাঠের পাল্লা। একটা পাল্লা ফাঁক করে একজন লোক একটা লণ্ঠন নিয়ে ঢুকল। বিশাল গুদামঘরের অবশ্য সামান্যই আলোকিত হল তাতে। লোকটার অন্য হাতে একটা লোহার পাঞ্চ। ববি বেয়াদপি করলে পাঞ্চ চালাবে।
ঘরে ঢুকে সোজা এগিয়ে এল লোকটা তক্তার দিকে। তারপর জায়গাটা শূন্য দেখে থমকাল। চকিতে ঘুরে লণ্ঠনের আলোয় ববিকে খুঁজবার চেষ্টা করল।
তারপর কিছু বুঝে উঠবার আগেই একটা প্রবল আঘাতে লণ্ঠনসমেত চার হাত দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে নিথর হয়ে গেল।
ববির পা অত্যন্ত দুর্বল, ব্যথাতুর। তাতে একরকম ভালই হয়েছে। যে কারাটে কিকটা ববি মেরেছেন লোকটার মাথায় সেটা সবল পায়ে মারলে লোকটার মাথা ধড় থেকে আলাদা হয়ে যেতে পারত।
ববি হাতড়ে হাতড়ে লোকটার কাছে গেলেন। তাঁর নিজের পরনে শুধু একটা জাঙ্গিয়া ছাড়া কিছু নেই। এই অবস্থায় বাইরে বেরোনো বিপজ্জনক। ববি নিপুণ হাতে লোকটার গা থেকে ট্রাউজার্স আর হাওয়াই শার্ট খুলে নিলেন। পা থেকে চটিও। ববির গায়ে একটু ঢোলা হবে কিন্তু আপাতত এইটুকুই যথেষ্ট।
ট্রাউজারের পকেটে কিছু টাকা আছে। আর আছে একটা দেশলাই।
হাই মেহদি! হোয়াটস দ্য ম্যাটার?
দরজাটা খুলে সেই দৈত্যাকার যুবকটি এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে একটা তীব্র আলোর টর্চবাতি। আলোটা সোজা এসে পড়েছে মেঝেতে শয়ান লোকটার ওপর।
দরজার পাল্লার আড়াল থেকে ববি হাতটা তুললেন।
মাত্র একবারই চপ করে একটা শব্দ হল। বিশাল দৈত্য কুঠার-ছিন্ন মস্ত গাছের মতো ভেঙে পড়ল মেঝের ওপর।
ববি টর্চটা কুড়িয়ে নিলেন। কাজে লাগবে।
দৈত্যের পকেট থেকে ববি রায় এক বান্ডিল নোট পেয়ে গেলেন। বেশ কয়েক হাজার টাকা। আর দুটো জিনিসও পেলেন। গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আর গাড়ির চাবি।
বাইরে বেরিয়ে ববি চারদিকটা সতর্ক চোখে দেখলেন। জায়গাটা একটা মস্ত গো-ডাউন এলাকা। শুনশান নির্জন। রাস্তাঘাট নোংরা। প্রচুর লরি সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ফিয়াট গাড়িটা সামনেই দাঁড় করানো। দরজায় লক নেই। ববি উঠলেন। স্টার্ট দেওয়ার আগে জায়গাটা আঁচ করার চেষ্টা করলেন একটু। তারপর গাড়ি ছেড়ে দিলেন।
অন্তত মাইলখানেক দুরে আসবার পর ববি চওড়া রাস্তা পেয়ে গেলেন। যথেষ্ট চনমনে বোধ করছেন ববি। তবে সর্বাঙ্গের যন্ত্রণা ও বিষিয়ে ওঠা ক্ষতস্থান তো সহজে ভুলবার নয়।
ববি যা খুঁজছিলেন তা পেয়ে গেলেন আরও মাইল তিনেক যাওয়ার পর। একটা নার্সিং হোম।
গাড়ি নিয়ে সোজা ঢুকে পড়লেন ভিতরে।
রিসেপশনে যে ঘটনাটা বানিয়ে বললেন ববি, তা চমৎকার। তিনি জুয়ার আড্ডায় গুন্ডাদের পাল্লায় পড়েছিলেন। প্রচণ্ড মার খেয়েছেন। প্রাণ হাতে করে পালিয়ে এসেছেন। চিকিৎসা দরকার।
রিসেপশনের ক্লার্কটি সখেদে বলল, নো বেড স্যার।
ববি অত্যন্ত অবহেলায় ভাঁজ করা দুটো একশো টাকার নোেট কাউন্টারে রাখলেন, ইয়োরস। আই নিড ট্রিটমেন্ট, রেস্ট, স্লিপ… প্লিজ…।
লোকটা নরম হল।
আধঘণ্টার মধ্যেই চমৎকার ছোট্ট একটা কেবিন পেয়ে গেলেন ববি। একজন নার্স এসে তাঁর ক্ষতস্থানে ওষুধ দিল। ইনজেকশন করল। এক কাপ কড়া কফিও চাইলেন ববি। পেয়ে গেলেন। তারপর ঘুমের ওষুধ ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়লেন অক্লেশে!
খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল ববির। আরও অনেকক্ষণ তার বিশ্রাম নেওয়া উচিত, তিনি জানেন। দরকার ওষুধ এবং পথ্যেরও। কিন্তু অত সময় তার হাতে নেই।
খুব ভোরবেলা লীনার ঘুম ভাঙল টেলিফোনের শব্দে। আসলে ঘুম নয়। চটকা। লীনার ঘুম হচ্ছে না আজকাল। বার বাব দুঃস্বপ্ন দেখে, আর ঘুম ভেঙে যায়।