ববি চোখ চাইতেই ছেলেটা বলল, সরি।
সরি?
ছেলেটা ইংরেজিতে বলল, তুমি বিখ্যাত লোক। তবু নিজের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে দুর্দশা ডেকে এনেছ!
তোমরা আমার কাছে কী চাও?
একটা ঠিকানা। আর একটা কোড।
কেন চাও?
আমরা প্রোজেক্টটা ধ্বংস করে দেব।
কেন করবে?
ববি, আপনার এতে স্বার্থ কী? আপনি কেন এর সঙ্গে জড়াচ্ছেন নিজেকে? আপনি বলে দিন, আমরা আপনাকে সসম্মানে প্লেনে তুলে দেব। আপনি প্যারিসে চলে যাবেন।
ববি সামান্য একটু ভ্রু তুলে বললেন, এতই সহজ?
আপনার ক্ষতি করে আমাদের লাভ কী?
ববি গম্ভীরভাবে বললেন, প্রোজেক্টটা ধ্বংস করলেও যদি আমি বেঁচে থাকি তবে আবার তা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সুতরাং আমাকে ছেড়ে দেওয়া তোমাদের পক্ষে বিপজ্জনক।
ছেলেটা একটু চিন্তিতভাবে ববির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, ববি, আপনার সেক্রেটারি লীনা ভট্টাচারিয়া আমাদের নজরে রয়েছেন। আজ হোক, কাল হোক, তিনি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। আমাদের পক্ষে প্রোজেক্টটা নষ্ট করে দেওয়া শক্ত হবে না।
ববি সামান্য ক্লান্ত স্বরে বললেন, তোমরা শুধু প্রোজেক্টটা ধ্বংস করতে চাইলে এত কষ্ট স্বীকার করতে না। তোমরা ওর সিক্রেটটাও চাও।
যুবকটির মুখে কখনও হাসি দেখা যায় না। সর্বদাই যেন চিন্তান্বিত। মাথা নেড়ে বলল, আমি কোনও সিক্রেটের কথা জানি না।
তুমি ক্রীড়নক মাত্র। যারা জানবার তারা ঠিকই জানে।
যুবকটি ধীর স্বরে বলল, ববি রায়, প্রাণ বাঁচানোর একটা শেষ সুযোগ তুমি হাতছাড়া করছ। আমার পর যারা তোমাকে অনুরোধ করতে আসবে তারা ইতর লোক, প্রায় পশু।
ববি মৃদু স্বরে বলল, ওদের আসতে দাও।
যেমন তোমার ইচ্ছা।
যুবকটি চলে গেল।
ববি উপুড় হয়ে বাধ্যতামূলকভাবে শোয়া অবস্থায় বুঝতে পারছিলেন, এই রকম ল্যাবরেটরির মরা ব্যাঙের মতো পড়ে থেকে কিছুই করা সম্ভব নয়। অন্তত একটা হাতও যদি মুক্ত করা যেত।
দরজা দিয়ে দু’জন ঢুকেছে। এগিয়ে আসছে।
ববি চোখ বুজলেন! ইন আর ইয়ান। ইন আর ইয়ান। শরীর ও মন বশীভূত হও। এক হও। এ দেহ সমস্ত আঘাত সহ্য করতে পারে। জল যেমন পারে। বাতাস যেমন পারে।
ববি এক বিচিত্র ধ্বনি উচ্চারণ করে ধ্যানস্থ হলেন।
চেতনার একটা মৃদু আলো শুধু জ্বলে রইল তার ভিতরে।
রবারের হোস-এর ছোট্ট টুকরো দিয়ে ওরা মারছে। চটাস চটাস শব্দ হচ্ছে পিঠে, পায়ে, সর্বাঙ্গে। যেখানে লাগছে সেখানেই যেন আগুনের হলকা স্পর্শ করে যাচ্ছে।
জাগ্রত হও, জেন।
প্রায় পাঁচ মিনিট একনাগাড়ে ঝড় বয়ে গেল শরীরের ওপর দিয়ে।
দুটো লোক থামল।
ববি চোখ মেললেন, হয়ে গেল?
লোকদুটো অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইল ববির দিকে। তাদের অভিজ্ঞতায়, এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি। সাধারণত এরকম মারের পর লোকে গ্যাঁজলা তুলে অজ্ঞান হয়ে যায়।
বিস্ময় ক্ষণস্থায়ী হল। দুটো মজবুত চেহারার নৃশংস প্রকৃতির লোক কেসের থেকে খুলে আনল নিরেট রবারের ভারী মুগুর। যাকে ইংরেজিতে ‘কশ’ বলে।
এবার ববি নিজের শরীরের ঢাকের বাজনার শব্দ শুনতে পেলেন। দুম দুম।
কতক্ষণ সংজ্ঞা ছিল না কে বলবে? যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন ববি টেব পেলেন, তার হাত ও পায়ের বাঁধন খোলা। তবে এখনও তিনি উপুড় হয়ে পড়ে আছেন কাঠের তক্তার ওপর।
শরীরটা যেন আর তার নয়। এত অবশ, অসাড়, দুর্বল লাগছিল নিজেকে যে, চোখের পাতাটুকু খোলা পর্যন্ত কঠিন কাজ মনে হচ্ছে। কিন্তু এরা ভুল করছে। ববিকে ওরা চেনে না। শরীরই যে সব মানুষের শেষ নয়, শরীরকে ছিন্নভিন্ন করলেও যে কোনও কোনও মানুষকে ভেঙে ফেলা যায় না, সেই জ্ঞান এদের নেই।
ববি কোনও বোকামি করলেন না। হঠাৎ উঠে বসলেন না বা হাত-পা ছুড়লেন না যন্ত্রণায়। তিনি শুধু উপুড় অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে ব্যথা বুঝে কাত হয়ে শুলেন। হাত পা ও সমস্ত শরীরকে যতদূর সম্ভব শান্তভাবে ফেলে রাখলেন। যতদূর মনে হচ্ছে কোনও হাড় ভাঙেনি। ভাঙলে বমির ভাব হত, চোখে কুয়াশা দেখতেন। তবে শরীরের ওপর দিয়ে যে ঝড়টা বয়ে গেছে সেটাও হাড় ভাঙার চেয়ে কম নয়।
চমৎকার কাজ করছে তাঁর মাথা। ববি নিজেকে বিশ্রাম দিয়ে শুধু মাথাটাকে চালনা করলেন। বৃদ্ধ রবীশ ও তার দুই সহকর্মী যতদূর সম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করেও সবটা পারেননি। রবীশ বৃদ্ধ হলেও কঠিন ঝুনো মানুষ। নীল মঞ্জিল তারই মস্তিষ্কের ফসল। তার জিব টেনে ছিঁড়ে ফেললেও কোনও তথ্য বের করা সম্ভব ছিল না। তার অন্য দুই সহকর্মীকে ববি চেনেন না। সম্ভবত তাদের কেউ কোথাও অসাবধানে মুখ খুলেছিলেন।
নীল মঞ্জিলের ঠিকানা এখনও প্রতিপক্ষ জানে না জেনেও বিশেষ লাভ নেই। সেখানকার সুপার কম্পিউটার বা অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির বেড়াজাল ভেদ করে প্রকৃত তথ্য জানা খুবই কঠিন, তবু যদি কোনও বিশেষজ্ঞকে ওরা কাজে লাগায় তবে একদিন হয়তোবা নীল মঞ্জিলের রহস্য ভেদ করা অসম্ভব না-ও হতে পারে। আজ অবধি কেউ বৃহৎ শক্তির অত্যাধুনিক স্যাটেলাইটের গর্ভ থেকে তথ্য চুরি করতে পারেনি। রবীশ সেই কাজে বহুদূর এগিয়েছেন। তাঁকে আরও অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছেন ববি। এর মধ্যে ববিকে বহুবার বিদেশে যেতে হয়েছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি গোপনে আমদানি করতে। এ কাজে ববি খুবই অভ্যস্ত। কখনও নিজে, কখনও আন্তর্জাতিক চোরাই চালানদারদের মাধ্যমে জিনিস এসেছে। কিছু বেসরকারি শিপিং কোম্পানি টাকার বিনিময়ে ববিকে সাহায্য করেছে। প্রত্যেকটা পর্যায়ে কাজ বার বার বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা করে নথিবদ্ধ করার পর তা সাইফারে লিপিবদ্ধ করেছেন রবীশ। কম্পিউটারে জটিল কোডের আবছায়ায় নির্বাসিত করেছেন তাদের। সবটা ববিও জানেন না।