বুঝেছি। তারপর বলুন।
মুশকিল হল, এতকাল আমার দু’জন সহকর্মী ছিল। আমাদের কোনও সিকিউরিটি গার্ড ছিল না। শুধু ইলেকট্রনিক ওয়ার্নিং সিস্টেম রয়েছে। ইচ্ছে করেই আমরা এমন ব্যবস্থা করেছি যাতে লোকের চোখ না আকৃষ্ট হয়। আমরা তিনজন ছাড়া কেউ ছিল না ওখানে। এক-একজন আট ঘণ্টা করে রাউন্ড দি ক্লক কাজ চালু রাখতাম। কেউ অ্যাবসেন্ট হলে অবশ্য কাজ বন্ধ রাখতে হত। একদিন এক সহকর্মীকে কলকাতায় তার ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল। মাথায় গুলি, হাতে ধরা নিজের রিভলভার, পরিষ্কার আত্মহত্যা। অথচ আত্মহত্যা করার কোনও স্পষ্ট কারণ ছিল না। সুখী মানুষ, বউ আর একটা ফুটফুটে ছেলে নিয়ে সংসার। তবে তার স্ত্রী বলল, মাঝে মাঝে টেলিফোনে কে যেন শাসাত যে, কথামতো না চললে তার ছেলেকে চুরি করে নিয়ে মেরে ফেলা হবে। ওই টেনশন সম্ভবত লোকটা সহ্য করতে পারেনি। তাই নিজে মরে ছেলেকে চিরকালের মতো নিরাপদ করে দিয়ে গেল।
আর আপনার দ্বিতীয় সহকর্মী?
সে তার দেশের বাড়িতে ফিরে গেছে গত মাসে। স্পষ্ট করে কিছু বলেনি, কিন্তু আমার সন্দেহ, সেও ওরকমই কোনও বিপদে পড়েছিল। তার ছেলেমেয়ে আছে।
আর আপনি?
আমার কেউ নেই। ব্যাচেলর।
আপনাকে কেউ ভয় দেখায়নি?
বৃদ্ধ আবার হাসলেন, সেইজন্যেই আপনার কাছে আসা। মরতে আমার ভয় নেই। শুধু ভয় আমার মৃত্যুর পর প্রোজেক্টটা নষ্ট হয়ে যাবে। যাতে আর কারও হাতে না পড়ে তার জন্য প্রোজেক্টটা ধ্বংস করে দেওয়ার ব্যবস্থাও আমি রেখেছি। কিন্তু সেটা তো চরম ব্যবস্থা।
আপনার প্রস্তাবটা কী?
যদি দয়া করে আমাদের অসম্পূর্ণতা এবং ঘাটতিটুকু আপনি পূরণ করে দেন। হয়তো বছরখানেক লাগবে। তারপর আপনি আবার আপনার স্বক্ষেত্রে ফিরে আসতে পারবেন। আপনার জন্য আমাদের অফার স্কাই হাই নয়। আমাদের দেশ গরিব। আপনি যদিও বিদেশের নাগরিক, তবু ভারতবর্ষ আপনার মাতৃভূমি, আপনি বাঙালিও। আমি শুধু আপনাকে এই অনুরোধটুকু করতে এই বয়সে এতদুর ছুটে এসেছি।
ববি রায় রাজি হননি। বৃদ্ধকে একরকম ফিরিয়েই দিলেন। কিন্তু বৃদ্ধ আবার এলেন। আবার। আর একাশি বছর বয়স্ক তদগতচিত্ত এই সৌম্যদর্শন বৃদ্ধের ভিতরে কোনও চালাকি আর ছলচাতুরি নেই বলে ববি রায়ের লোকটার প্রতি সহানুভূতি হতে লাগল।
তারপর একদিন রাজি হলেন। দেখাই যাক অনুন্নত ভারতবর্ষে এই বৃদ্ধ কী এমন কলকবজা তৈরি করেছেন যা উন্নত উপগ্রহের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করছে।
কৃত্রিম উপগ্রহগুলির লকিং ডিভাইস ববির অজানা নয়। তার ধুরন্ধর মস্তিষ্ক এই সব রহস্যকে জলের মতো পরিষ্কার করে নিতে পারে। কিন্তু মাথা দিয়েই সব হয় না। চাই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি। চাই নো-হাউ। চাই সহকারী।
রবীশ তাকে অনুরোধ করেছিলেন অন্য কোনও চাকরি বা কাজের ছুতোয় যেন তিনি ভারতবর্ষে আসেন। সেটা কোনও সমস্যাই হল না। কলকাতায় শাখা আছে এমন একটি মাল্টিন্যাশনালে ববি চাকরি নিলেন। ববির মতো তোক চাকরি চাওয়ায় কোম্পানি চমৎকৃত হল, বর্তে গেল। তাকে স্থাপন করা হল কোম্পানির প্রায় মাথায়।
রবীশ তাকে দমদমে রিসিভ করেননি। স্বাভাবিক সতর্কতা, দেখা করেছিলেন সাত দিন পর। টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, একটা বর্ধমানগামী লোকাল ট্রেনের দুনম্বর কোচে। দ্বিতীয় অ্যাপয়েন্টমেন্ট আরও সাত দিন পর, বালি-দুর্গাপুরের এক বাড়িতে। তারপর একদিন নানা ঘোরালো পথে, নানা আঘাটা ঘুরে, সম্ভাব্য অনুসরণকারীদের চোখে ধূলো দেওয়ার নানা বিচিত্র পদ্ধতি অবলম্বন করে, রবীশ তাকে নিয়ে হাজির করলেন নীল মঞ্জিলে।
বিশাল বাগান ঘেরা একটা নিঃঝুম বাড়ি। ধারে কাছে লোকালয় নামমাত্র। বাগানের মধ্যে গাছের চেয়ে আগাছাই বেশি। চারদিকে উঁচু দেওয়ালে ইলেকট্রিক ফেনসিং। ফটকে অটো লক। গাছপালা ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে বিদ্যুৎবাহী সরু তার পেতে বখা। আছে বিচিত্র অ্যালার্ম এবং মিনি-মাইন। আছে বুবি ট্র্যাপ। কয়েকবার হয়তো চেষ্টা করেছিল চোর ডাকাতেরা, বিচিত্র কাণ্ড কারখানা দেখে ভয় খেয়ে আর কেউ এ মুখো হয় না।
এ সবই রবীশের কাছে শুনল ববি রায়।
নীল মঞ্জিল এক পুরনো বাড়ি। সম্ভবত কোনও ধনবান ব্যক্তির বাগানবাড়ি ছিল। ছাদে নানা রকমের অ্যান্টেনা। ভূগর্ভের ঘরে মনিটরিং সেন্টার।
ববি সবই দেখলেন। অতিশয় মনোযোগ দিয়ে। খুব খুশি হলেন, এমন বলা যায় না। তবে এই বৃদ্ধ যে এতকাল ধরে ধীরে ধীরে একটা লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছেন তাতে সন্দেহ নেই।
মিস্টার ঘোষ, আমি অতিমানব নই, আমার অতিমস্তিষ্কও নেই। তবে আপনার কাজ দেখে মনে ইচ্ছে আপনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। এমন হতেও পারে, কিছুদিন চিন্তাভাবনা করলে আমি আপনার এইসব ডিভাইসকে খানিকটা ইমপ্রুভও করতে পারি। বিদেশি উপগ্রহকে পেনিট্রেট করা হয়তোবা সম্ভবও হবে। কিন্তু আপনি কীরকম ইনফরমেশন চান?
সবরকম। তবে সবচেয়ে বেশি যেটা চাই তা হল, কার অস্ত্রভাণ্ডারে কত রকম অস্ত্র জমা হচ্ছে। বিশেষ করে পরমাণু বোমা।
ববি হেসেছিলেন, জেনে কী হবে?
রবীশ তাঁর সেই অসামান্য হাসিটি হেসে বললেন, ববি, আমি আপনার সম্পর্কে অনেক জানি।
কী জানেন?
আমি জানি আপনি ক্রাইটন নো-হাউ জানেন। ক্রাইটন এমনই ডিভাইস যা যে-কোনও পরমাণু ওয়ারহেডকে অ্যাক্টিভেট করতে পারে। যদি এ দেশের পক্ষে বিপজ্জনক কোনও পরমাণু বোমা কোথাও উদ্যত হয়ে থাকে তবে ক্রাইটন তা বিস্ফোরিত করে দিতে পারে তার বেস-এ।