পঞ্চম প্রশ্ন: কতদূর শান্তভাবে তিনি পরিস্থিতিকে গ্রহণ করতে পারেন?
প্রশ্ন আরও আছে। অনেক প্রশ্ন। তবে সেগুলো আপাতত মুলতুবি থাকতে পারে।
তবে এক বছর আগে একদিন নিউ ইয়র্ক থেকে কনকর্ড ফ্লাইটে প্যারিসে ফিরেছেন ববি। জেট ল্যাগ এবং অন্যান্য ক্লান্তি তো ছিলই। প্যারিসে সদ্য নিজের ছোট ও উষ্ণ অ্যাপার্টমেন্টে জানুয়ারির শীতে ফায়ার প্লেসের ধারে বসে কফি খাচ্ছিলেন। এমন সময় লোকটা এল। দরজা খুলে একজন শীর্ণকায় লম্বা বৃদ্ধকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ববি অবাক। বাঙালি ভদ্রলোক শীতে কাঁপছিলেন। গায়ে প্রচুর গরম জামা সত্ত্বেও বেশ কাহিল হয়ে পড়েছেন শীতে। কথা বলতে পারছিলেন না। এমনকী নিজের পরিচয়টুকু পর্যন্ত না। ববি তাকে ধরে এনে ফায়ারপ্লেসের সামনে বসিয়ে দিলেন। সামান্য ব্র্যান্ডি মিশিয়ে একপাত্র কফিও।
ভদ্রলোক কফিটুকু সাগ্রহে পান করলেন, পকেট থেকে একটা হোমিয়োপ্যাথির শিশি বের করে কয়েকটা গুলি মুখে ফেলে পরিষ্কার ফরাসি ভাষায় বললেন, আমার নাম রবীশ ঘোষ।
রবীশ ঘোষ নামটা ববি রায়ের স্মৃতিতে কোনও তরঙ্গ তুলল না। এ নাম তিনি শোনেননি।
রবীশ বললেন, আমি ভারত সরকারের একজন প্রতিনিধি।
বলুন কী করতে পারি?
রবীশ কোটের পকেট থেকে তার পাসপোর্ট বের করে ববির হাতে দিয়ে বললেন, এছাড়া আমার একটা আইডেনটিটি কার্ডও আছে। যদি চান—
ববি পাসপোর্টটা ফিরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বয়স কত?
একাশিতে পড়েছি।
ববি ঠান্ডা গলায় বললেন, এই বয়সে কেউ মিথ্যে কথা বলে না বড় একটা। আপনাকে অবশ্য যাট-টাটের বেশি মনে হয় না।
রবীশ মাথা নেড়ে বললেন, না, একাশিই। আমি এ দেশে শেষবার এসেছি বছর পনেরো আগে। এখন চব্বিশ পরগনা বা হাওড়ার সামান্য শীতই আমার সহ্য হয় না। প্যারিসের শীত আমার মতো বৃদ্ধের কাছে কতখানি ভয়াবহ তা কল্পনা করুন। তবু আসতে হয়েছে। গত চার দিন প্যারিসে বসে আছি শুধু আপনার জন্যই। চারদিকে বরফ আর বরফ, বেরোতে পারি না।
দরকারটা কি এতটাই জরুরি?
সাংঘাতিক জরুরি।
আপনি ফরাসি ভাষায় কথা বলছেন, এখানে কখনও দীর্ঘদিন ছিলেন?
বহুদিন। একটানা পনেরো বছর।
আমি কিছুটা বাংলা জানি। আপনি বাংলাতেও বলতে পারেন।
রবীশ তৎক্ষণাৎ বাংলায় বললেন, সেটাই নিরাপদ। আপনি নিশ্চয়ই কৃত্রিম উপগ্রহগুলির কাণ্ডকারখানার কথা জানেন। আবহাওয়ার পূর্বাভাস, টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রচার, টেলিফোন লিংক ইত্যাদি ছাড়াও এরা আর একটা কাজ করে। গোয়েন্দাগিরি।
ববি বিস্মিত হয়ে বললেন, এ কথা তো আজকাল বাচ্চারাও জানে। স্যাটেলাইটরা গোয়েন্দাগিরির জন্যই আকাশে রয়েছে।
রবীশ হাসলেন, বয়সের দোষ, মায়ের কাছে মাসির গল্প করছি। আপনি জানবেন না তো কে জানবে? কথা হল, আমাদের ভারতবর্ষের মতো গরিব দেশেরও দু-একটা স্যাটেলাইট আছে। ভূসমলয় স্যাটেলাইট। অর্থাৎ
ববি হাত তুলে বললেন, বুঝতে পারছি। বলুন।
কিন্তু স্পাইং করার যোগ্যতা আমাদের দুর্বল স্যাটেলাইটের নেই। তাই আমি দীর্ঘকাল ধরে চেষ্টা করছি মার্কিন এবং রুশ উপগ্রহগুলি থেকে ইনফরমেশন সংগ্রহ করার উপায় আবিষ্কার করতে।
ববি কিছুক্ষণ খুব স্থির দৃষ্টিতে বৃদ্ধের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, তার মানে তো চুরি?
রবীশ ঘন ঘন মাথা নেড়ে বললেন, চুরি নয়। চোরের ওপর বাটপাড়ি। পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশের প্রতিটি বর্গফুট জায়গার ছবি এবং খবর রুশ ও মার্কিন উপগ্রহগুলি অবিরাম সংগ্রহ করে যাচ্ছে। এক স্যাটেলাইট থেকে আর এক স্যাটেলাইট রিলে করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছে নিজের দেশে, যেখানে বিজ্ঞানীরা বসে মনিটারিং করে চলেছেন দিনরাত। আপনি তো জানেন, ঘাসের নীচে পড়ে থাকা একটি ছুঁচের খবরও এই সব স্যাটেলাইটের কাছে গোপন থাকে না।
সে কথা ঠিক।
আমাদের উপগ্রহের সেই ক্ষমতা নেই। কিন্তু আমাদেরও কিছু ইনফরমেশন দরকার। নিতান্ত আত্মরক্ষার তাগিদেই দরকার। ওরা যখন আমাদের অজান্তেই আমাদের দেশের সব খবর গোপনে সংগ্রহ করে নিতে পারে তখন ওদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করলে তা চুরি হবে কেন? কাজটা খুব শক্ত আমি জানি। ওদের স্যাটেলাইটে এমন লকিং ডিভাইস আছে এবং এমনই ওয়েভ-লেংথে ওরা খবর পাঠায় যা ভেদ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আমাদের তো অতিকায় এবং সুপারসেনসিটিভ ডিস্ক অ্যান্টেনা নেই। মনিটারিং সিস্টেমও প্রিমিটিভ। দীর্ঘদিন ধরে আমি চেষ্টা করেছি একটা কোনও উপায় আবিষ্কার করতে। একেবারে ব্যর্থ হয়েছি বলা যায় না। কিন্তু শেষরক্ষা হয়তো হবে না। আমার বয়স একাশি, আমি দৌড় প্রায় শেষ করে এনেছি। আর তাই আপনার কাছে আসা।
আমার কাছে কেন?
রবীশ বুদ্ধের মতো প্রশান্ত হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে বললেন, আমি বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানের জগতের খবর সবই রাখি। আপনি এই বয়সে যে প্রায় অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী তা বিজ্ঞানীদের অজানা নেই। আমি আপনার মোট চারটে পাবলিশড পেপার পড়েছি। পড়ে মাথা ঘুরে গিয়েছিল। যেটুকু প্রকাশ করেছেন, তারও বেশি বিদ্যা আপনার ভিতরে আছে, আমি জানি। ইলেকট্রনিক্স আমারও বিষয়। কলকাতার কাছেই একটা গোপন জায়গায় আমি একটি মনিটরিং সেন্টার তৈরি করেছিলাম। পুরোপুরি ক্যামোফ্লেজড এরিয়া।
আপনাদের সরকার এসব জানেন?
রবীশ মাথা নেড়ে বললেন, আমরা কেউ কেউ ভারত সরকারের একান্ত বিশ্বাসভাজন। সরকার আমাদের কাজের গতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে খোঁজখবর নেন না, আমরা সেটা পছন্দ করি না বলেই। কিন্তু আমরা যা টাকা চাই তা বিনা বাক্যব্যয়ে এবং বিনা প্রশ্নে মঞ্জুর করে দেন।