ছেলেটা সামান্য গম্ভীর হয়ে বলল, মিস ভট্টাচার্য, আমি যদি আপনি হতাম তা হলে পিস্তলটা পুলিশকে হ্যান্ডওভার করে দিতাম। একটা পিস্তলের জন্য আপনাকে বিস্তর ঝামেলা পোয়াতে হতে পারে।
লীনা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঘড়ি দেখে বলল, আমার অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি।
অটোমেটিক লিফটে ঢুকে সুইচ টিপে দিল লীনা। ছোকরার মুখের ওপর দরজাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল।
ওপরে এসে নিজের ঘরে ঢুকে লীনা ব্যাগ খুলে পিস্তলটা বের করল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। একেবারে নতুন ঝকঝকে পিস্তলটা দেখতেও ভারী সুন্দর। এই বিপজ্জনক জিনিসটা ববি কেন তাকে দিয়ে গেলেন তাও বুঝতে পারছিল না লীনা। এতই কি বিপদ ঘটবে তার?
ববির নামে এক পাহাড় চিঠি এসেছে। সেগুলো খুলে যথাযথ ফাইল করতে লাগল লীনা। ফোন আসতে লাগল একের পর এক। ব্যস্ততার মধ্যে লীনার অনেকটা সময় কেটে গেল।
দুপুরে লাঞ্চ ব্রেক-এর সময় আবার ফোন এল।
হ্যাল্লো।
মিস ভট্টাচার্য?
হ্যাঁ।
আমি মহেন্দ্র সিং।
কে মহেন্দ্র সিং?
আমি ববি রায়ের সেই বন্ধু যে আপনাকে বোম্বে থেকে ফোন করেছিল। মনে আছে?
লীনা দাঁতে ঠোঁট টিপে ধরল। ববির বন্ধু। তারপর বলল, হ্যাঁ, মনে আছে। মহেন্দ্র সিং আপনার ছদ্মনাম।
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি খুবই বিপন্ন।
তার মানে?
বলছি। কি কথাটা ফোনে বলা যায় না। আপনার সঙ্গে কি একা দেখা করা সম্ভব?
লীনা সতর্ক হয়ে বলল, আপনি কি কোথাও আমার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে চাইছেন?
যদি বলি তাই?
তা সম্ভব নয়।
আমি খুব নিরীহ লোক।
আপনি কেমন তা জেনে আমার লাভ নেই। দেখা করতে হলে আপনি আমার অফিসে আসতে পারেন বা বাড়িতে। অন্য কোথাও নয়।
মহেন্দ্র সিং যেন একটু হতাশ হল। স্তিমিত গলায় বলল, তাহলে আপনাকে ফোনেই একটু সাবধান করে দিই। আপনার অফিসে যে ছোকরাটি আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল সে খুব সুবিধের লোক নয়।
এ কথায় লীনা অবাক হল। তারপর রেগে গেল। বলল, তার মানে কি আপনি আমার ওপর নজর রাখছেন
রাগ করবেন না মিস ভট্টাচার্য, আপনার ওপর নজর রাখতে স্বৰ্গত বরি রায় আমাকে আদেশ দিয়ে গেছেন। অণ্ডত আরও দিন সাতেক কাজটা আমাকে করতেই হবে। তারপর অবশ্য চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। স্বৰ্গত ববি রায় তো আর পেমেন্ট করতে পারবেন না, ফলে আমার কাজও শেষ হয়ে যাবে।
ববি রায় কি সত্যিই মারা গেছেন?
আমি তার লাশ দেখিনি। কিন্তু যাদের খপ্পরে পড়েছেন তাদের হাত থেকে সুপারম্যানদেরও রেহাই নেই।
লীনা কথা বলতে পারল না, আজ তার সত্যিই ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল বুকের মধ্যে। কষ্টটা কিসের তা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল না সে।
মিস ভট্টাচার্য।
বলুন।
ববি রায় অতিশয় খারাপ লোক।
আপনি তার কেমন বন্ধু?
নামমাত্র।
আমার তো মনে হয় আপনিও খুব খারাপ।
যে আজ্ঞে। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?
পারেন।
ওই ছোকরা আপনার কাছে কী চায়?
তা জেনে আপনার কী হবে?
ছোকরাকে একটু জরিপ করা দরকার।
লীনা একটু ভেবে নিয়ে বলল, ছেলেটা বলছে যে ও পুলিশে চাকরি করে।
মোটেই বিশ্বাস করবেন না যেন।
করছি না। আমি তত বোকা নই।
আর কী চায়?
জানি না, তবে মনে হয় আপনার মতো এই ছোকরাও আমার ওপর নজর রাখছে। আমার ওপর। নজর রাখার লোকের অভাব নেই দেখছি।
মিস ভট্টাচার্য, আপনি একটু সাবধান হবেন।
ধন্যবাদ। আমি যথেষ্ট সাবধানি।
আমি অবশ্য পিছনে আছি।
না থাকলেও ক্ষতি নেই।
লীনা ফোন রেখে দিল।
নীল মঞ্জিলে অভিযান করতে হলে এইসব নজরদারদের এড়ানো ভীষণ দরকার। লীনা ভাবতে বসল।
কাল শনিবার অফিস ছুটি। লীনা কালই নীল মঞ্জিলে যাবে।
১৩. গভীর সুষুপ্তি থেকে জেগে ওঠা
গভীর সুষুপ্তি থেকে জেগে ওঠা অনেকটা গভীর জল থেকে উঠে আসার মতো। অপ্রাকৃত এক ছায়া থেকে ধীরে ধীরে প্রকৃতিস্থতার ঘোরলাগা আলো। ববি সংজ্ঞাহীনতা থেকে যখন সচেতনতায় ফিরছিলেন তখনও তার ভিতরে আরও একজন কেউ যেন সতর্ক প্রহরায় ছিল। না হলে
সংজ্ঞাহীনতার মধ্যেও তিনি নিজেকে টের পাচ্ছিলেন কেমন করে?
যে জেগে ছিল সেই কি তার বিকল্প সত্তা, যাকে তিনি বহুবার অনুভব করেছেন তার প্রথাসিদ্ধ জেন মেডিটেশনের সময়? ষষ্ঠ ডান ব্ল্যাকবেল্ট ববি যখনই তাঁর ইন বা সহনশীলতার অভ্যাস করেছেন, যখনই ইয়ান বা দেহ ও মনের সমগ্র শক্তিকে করতে চেয়েছেন একীভূত, তখনই কি বারবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েননি নিজের দেহ থেকে? যে-দেহ আঘাত পায় তার থেকে ভিন্ন হয়ে নির্বিকার থাকার অভ্যাসই তাকে দিয়েছে এক দার্শনিক সদাসঙ্গীকে। সে তাঁরই ওই বিকল্প সত্তা। ইন মানেই নম্রতা, জলের চেয়েও কমনীয় হওয়া, সমস্ত কঠিন আঘাতকে গ্রহণ করা নিজের গভীর সহনশীলতায়। শেষ অবধি কোনও আঘাতই আর আহত করে না। গায়ে ছুঁচ ফোটালেও নিচ্ছিদ্র থেকে যায় ত্বক। বড় অল্প দিনের অল্পায়াস সাধনা তো নয়। ইন আর ইয়ান-এর সেই সমম্বয় বহুদিন ধরে, গভীর অধ্যবসায়ে অধিগত করতে হয়েছে ষষ্ঠ ডান ব্ল্যাকবেল্টকে।
ববির জ্ঞান ফিরল। টান টান হয়ে উঠল তার চেতনা। প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়ল সেই চেতনার আলো। ববি নিঃঝুম হয়ে পড়ে থেকে তাঁর ইয়ানকে খুঁচিয়ে তুললেন। দেহ ও মন। দেহ আর মনের সমস্ত শক্তিকে জড়ো করতে লাগলেন একটি জায়গায়, মস্তিষ্কে।
প্রথম প্রশ্ন: তিনি কোথায়?
দ্বিতীয় প্রশ্ন: তিনি কতটা আহত?
তৃতীয় প্রশ্ন: তার পরিস্থিতি কতটা খারাপ?
চতুর্থ প্রশ্ন: কতদূর এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানো যায়?