বৈষ্ণবী চলে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের চোখে চিঠিটার দিকে চেয়ে রইল লীনা। বোম্বের শীলমোহর অস্পষ্ট বোঝা যায়। কিন্তু হস্তাক্ষর কার তা তো লীনা জানে।
বিবশ হাতে খামের মুখটা ছিড়ল সে। একটা ডায়েরির ছেড়া পাতায় সম্বােধনহীন কয়েকটা লাইন। প্রায় অবোধ্য। তবু হাতের লেখাটা খানিকটা চেনা বলে কষ্ট করেও পড়ে ফেলল লীনা।
ইংরেজিতে লেখা : হয়তো এটাই আপনার সঙ্গে আমার শেষ যোগাযোগ। নীল মঞ্জিলে আপনি আবার সমস্যার মুখোমুখি হকেন। কিন্তু ঘাবড়াবেন না। তেমন বিপদ বুঝলে লাল বোতামটা টিপে দেবেন। মাত্র তিন মিনিট সময় থাকবে হাতে। মাত্র তিন মিনিট, অন্তত তিনশো মিটার দূরে সরে যেতে হবে ওর মধ্যে। পারবেন?
কোনও মানেই হয় না এই বার্তাটির। কিন্তু কাগজটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে লীনার চোখ হঠাৎ জ্বালা করে জল এল।
গভীর রাত অবধি আজকাল তার ঘুম আসে না। কিন্তু হাতের কাছে ঘুমের ওষুধ থাকা সত্ত্বেও সে কখনও তা খায় না।
আজও সে জেগে থেকে শুনতে পেল গাড়ির শব্দ। ফটক খোলার আওয়াজ। তার মা আর বাবা সামান্য বেসামাল অবস্থায় ফিরল। সিঁড়িতে দু’জনে উঠল তর্ক করতে করতে।
তার বাবা রীতিমতো চেঁচিয়ে বলল, সুব্রত ইজ আ নাইস গাই।
তার মা বলল, ওঃ নোঃ! হি ইজ আ স্কাউন্ড্রেল।
লীনা ব্যাপারটা জানে। সুব্রত নামে একটি সফল মানুষের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে বাবা আগ্রহী। সুব্রত নিজেও আগ্রহী লীনাকে বিয়ে করতে। বহুবার এ বাড়িতে হানা দিয়েছে লোকটা। খারাপ নয়, কিন্তু এত বেশি ড্রিংক করে যে, তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়াই মুশকিল।
আজ সুব্রতর কথা ভাবতে হাসি পেল লীনার। সুব্রত বড়লোক বাপের ছেলে। হাইলি কানেকটেড। তাদের সঙ্গে একটা কলাবোরেশনের চেষ্টায় আছে লীনার বাবা। বিয়ে হলে কাজটা সহজ হয়ে যায়।
কিন্তু লীনা সুব্রতকে বিয়ে করবে কেন? তার তো কখনও আগ্রহই হয়নি।
লীনা দোলনের কথা ভাবতে লাগল। দোলন একদিন মস্ত বড় মানুষ হবে, এটা লীনার স্থির বিশ্বাস। তার চেয়েও বড় কথা, দোলন হবে তার বশংবদ। ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ তাদের মধ্যে কখনওই হবে না। লীনাকে দোলন এখন থেকেই ভয় পায়।
অস্থির হয়ে লীনা উঠল। তার বাবা আর মায়ের আলাদা আলাদা ঘর নিঝুম হয়ে গেছে। সারা বাড়িটাই এখন ঘুমন্ত, নিস্তব্ধ।
লীনা বারান্দার রেলিং ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
আজও রাস্তায় কয়েকটা গাড়ি। লীনা চেয়ে রইল, যদি কোনও গাড়িতে আজও সিগারেটের আগুন দেখা যায়!
সিগারেটের আগুন দেখা গেল না বটে, কিন্তু লীনার হঠাৎ মনে হল, একটা ছোট গাড়ির মধ্যে যেন সামান্য নড়াচড়া। কেউ আছে এবং জেগে বসে আছে।
লীনা সামান্য কাঁপা বুক নিয়ে ঘরে চলে এল।
তাকে অকারণে কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে দিয়েছেন ববি। হয়তো ঘটনাগুলি ক্রমে বিপদের আকার ধারণ করবে। কিন্তু লীনা কিছুতেই আজ ববির ওপর রাগ করতে পারল না।
শুয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভাবল সে। এই নিরাপদ নিস্তরঙ্গ জীবনের মধ্যে সে কি সুখী? এর চেয়ে একটু বিপদের মধ্যে নেমে পড়া যে অনেক বেশি কাম্য।
সে নীল মঞ্জিল রহস্য ভেদ করতে যাবে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই ঘুমিয়ে পড়ল লীনা।
পরদিন অফিসে যথাসময়ে পৌঁছে লীনা অবাক হয়ে দেখল, তার জন্য রিসেপশনে সেই লম্বা চেহারার ছিপছিপে সাদা পোশাকের পুলিশ ছোকরাটি অপেক্ষা করছে।
তাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি।
লীনা বুঝতে না পেরে বলল, কেন বলুন তো?
আমি জানতে এসেছিলাম যে, সেই লোকটা আর আপনার পিছু নিয়েছে কি না। আপনি ইনসিকিওরড ফিল করছেন না তো?
লীনা মাথা নেড়ে বলল, না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আপনি আমার অফিসের ঠিকানা পেলেন কী করে?
ছোকরা মৃদু হেসে বলল, আমি পুলিশে কাজ করি, ভুলে যাচ্ছেন কেন? পুলিশকে সব খবরই রাখতে হয়।
লীনা একটু কঠিন গলায় বলল, একটা সামান্য ঘটনার জন্য আপনার এতটা কষ্ট স্বীকার করারও দরকার ছিল না। পুলিশের কি আর কাজ নেই?
ছোকরা তবু দমল না। হাসিটা দিব্যি মুখে ঝুলিয়ে রেখে বলল, এটাও তো কাজ।
লীনা বলল, ধন্যবাদ। আমাকে কেউ আর ফলো করছে না। নিজের নিরাপত্তা আমি নিজেই দেখতে পারি।
এই বলে লীনা কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল লিফটের দিকে। ভ্রু কোঁচকানো, মাথায় দুশ্চিন্তা।
ছোকরাটা এগিয়ে এসে ডাকল, মিস ভট্টাচার্য, একটা কথা।
আবার কী কথা?
কিছু মনে কববেন না, গতকাল আপনার হাতে একটা পিস্তল দেখতে পেয়েছিলাম।
লীনা সাদা হয়ে গেল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, না তো।
আপনি জিনিসটাকে আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন।
লীনা নিজেকে সামলে নিতে পারল। বলল, আঁচলের আড়ালে কী ছিল তা বোঝা অত সহজ নয়। আপনি ভুল দেখেছেন।
ছেলেটা খুব অমায়িক গলায় বলল, আমি কোনও অভিযোগ নিয়ে আসিনি। শুধু জানতে এসেছি ওই পিস্তলটার জন্য আপনার লাইসেন্স আছে কি না। ফায়ার আর্মসের ব্যাপারে আমরা একটু বেশি সেনসিটিভ।
আমার কাছে কোনও পিস্তল ছিল না।
ছেলেটা বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলল, মিস ভট্টাচার্য, পিস্তলটা আপনি আঁচলের আড়াল থেকে অত্যন্ত কৌশলে আপনার হাতব্যাগে ভরে ফেলেছিলেন। সেটা হয়তো এখনও আপনার হাতব্যাগেই আছে।
লীনা জানে, আছে। ব্যাগটা কাঁধ থেকে ঝুলছে। অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক বেশি ভারী। ব্যাগটা অবহেলায় একটু দুলিয়ে লীনা মধুর করে হেসে বলল, থাকলে আছে। আপনার আর কিছু বলার না থাকলে এবার আমি আমার ঘরে যাব; আমার দেরি হয়ে গেছে।