ইন্দ্রজিৎ দেখল, সেই বুড়ো ট্যাক্সিওয়ালা। স্বজাতি এক শিখ যুবকের এরকম হেনস্তা দেখে বীরের জাত সর্দারজির ক্ষোভ হয়ে থাকবে। সিটের তলা থেকে একটা কৃপাণ বের করে বুড়ো নেমে এল। বয়স সত্তর হলে কী হয়, তেজ যুবকের চেয়ে বেশি।
কিন্তু ততক্ষণে লীনা, দোলন আর যুবকটি গাড়িতে উঠে পড়েছে।
ইন্দ্রজিৎ চট করে ট্যাক্সিতে উঠে পড়ল।
বুড়ো সর্দারজি মুক্ত কৃপাণটি পাশে রেখে ড্রাইভারের সিটে উঠে বসে বলল, পিছা করু?
হাঁ।
সর্দারজি তার নিজস্ব ভাষায় যা বলল, তার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ছুকরির তো বহুত এলেম দেখছি। এক ছুকরির পিছনে তিন-তিনজন বেওকুফ! আরে গবেট, মেয়েমানুষের মধ্যে আছেটা কী? মাংসের ডেলা ছাড়া আর কী পাও তোমরা?
এই দার্শনিক মন্তব্যসমূহে মাথা নেড়ে এবং হু হাঁ করে সায় দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কীই-বা করার আছে ইন্দ্রজিতের?
প্রশ্ন হল, ছোকরাটা কে? হঠাৎ তার আবির্ভাব ঘটলই বা কেন?
***
অন্য গাড়িতে লীনা, দোলন আর ছেলেটা পাশাপাশি বসে।
লীনা জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
সাদা পোশাকের পুলিশ। আমরা কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় মোতায়েন থাকি।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। লোকটা আমাদের পিছু নিয়েছিল।
কেন নিয়েছিল তা বলতে পারেন?
না। তবে—
তবে?
না, তেমন কিছু নয়।
আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি ম্যাডাম। পুলিশকে লোকে বিশ্বাস করতে চায় না ঠিকই, কিন্তু পুলিশ কতটা হেল্পফুল তা তারা জানে না বলেই।
লীনা অমায়িক হেসে বলল, বোধহয় লোকটা আমার প্রেমে পড়েছে।
চৌরঙ্গীতে ছেলেটা নেমে গেল।
১২. একটা সিদ্ধান্ত
লীনা আজ রাত্রে একটা সিদ্ধান্তে আসবার চেষ্টা করছিল। প্রথম কথায় নীল মঞ্জিল বলে আর একটা বিপজ্জনক কানামাছি খেলায় সে নামবে কি না। নামলেও তার ভূমিকা কী হবে?
দ্বিতীয় চিন্তা হল, ববি রায় আদৌ মরেছেন কি না। মহেন্দ্র সিং লোকটাই বা আসলে কে? কম্পিউটারের কোড হিসেবে কতগুলো ভুল কথা তাকে কেন শিখিয়ে গিয়েছিলেন ববি? রিভলভারটা সত্যিই তার কাজে লাগবে কি না। গঙ্গার ঘাটে হঠাৎ-আবির্ভূত সেই যুবক সত্যিই কি সাদা পোশাকের পুলিশ?
প্রশ্ন অনেক। কিন্তু একটারও সদুত্তর পাওয়ার কোনও উপায় তার নেই। ববি রায়ের বাড়িতে সে অনেকবার টেলিফোন করেছে। কেউ ধরেনি। অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ববি রায়ের বাড়িতে কেউ থাকে না। তার কোনও পরিবার পরিজন নেই। দু’জন দারোয়ান আছে, তারা ফোন ধরে না, বাড়ি তালাবন্ধ বলে। অফিস থেকে সে আরও জেনেছে, ববি ট্যুরে গেছেন, এর চেয়ে বেশি অফিস আর কিছু জানে না।
বাড়িতে লীনার কোনও আপনজন নেই। দাদা খানিকটা ছিল, এখন দাদাও ভয়ংকর রকমের পর।
তবু দাদাকেও ফোন করেছিল লীনা। তার দাদা দীর্ঘদিন পশ্চিম এশিয়া সফর করে সদ্য ফিরেছে। কিন্তু সন্ধের পর দাদা আর স্বাভাবিক থাকে না। সম্পূর্ণ মাতাল গলায় কথা বলতে শুরু করায় বিরক্ত লীনা ফোনটা রেখে দিল। আজকাল সন্ধের পর সফল পুরুষদের প্রায় কাউকেই স্বাভাবিক অবস্থায় পাওয়া যায় না। এত মদ খেয়ে কী যে হয়।
আজ বিকেলে গঙ্গার ঘাট থেকে পালিয়ে আসার পর সে আর দোলন কিছুক্ষণ একটা রেস্তোরাঁয় বসে আড্ডা মেরেছে। তখন লীনা নীল মঞ্জিলের কথা তুলেছিল। দোলন অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলেছে, তোমার বস যদি মারা গিয়েই থাকেন তবে কেন একটা ডেড ইস্যুকে খুঁচিয়ে তুলতে চাইছ?
আমার মন কী বলছে জানো? ববি মারা যাননি।
কী করে বুঝলে? সিক্সথ সেন্স?
বলতে পারো।
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে কিছু নেই।
কিন্তু একটা অ্যাডভেঞ্চার তো হবে।
তা অবশ্য হতে পারে। কিন্তু রিস্ক কতটা?
কী করে জানব?
তা হলে ওটা ভুলে যাও লীনা।
তুমি কি ভিতু দোলন?
অবশ্যই। নীল মঞ্জিল হয়তো তোমার বস-এর বাগানবাড়ি। তোমাকে সেখানে টেনে নিয়ে গিয়ে…
ছিঃ দোলন। ববি পাগল ঠিকই, কিন্তু ওরকম নন। তোমাকে তো অনেকবার বলেছি, ববি মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকান না। কথায় কথায় অপমানও করেন। লোকটাকে সেইজন্যই আমি এত অপছন্দ করি।
আচ্ছা, আচ্ছা, মানছি তোমার বস খুব সাধু ব্রহ্মচারী মানুষ। কিন্তু তা বলে নীল মঞ্জিল যে খুব নিরাপদ জায়গা এটা মনে করারও কারণ নেই।
লীনা দোলনের কথাটা চুপ করে মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তার মনে সেই থেকে একটা অস্বস্তি কাটার মতো বিঁধে আছে। অফিসের বাইরে কোনও কাজ করতেই ববি তাকে বাধ্য করতে পারেন না। কিন্তু লোকটার স্পর্ধিত নির্দেশের মধ্যেও যেন একটা অসহায় আর্তি আছে।
তার মা আর বাবার পার্টি থাকায় আজ একাই ডিনার খেল লীনা। ডিনার সে প্রায় কিছুই খায় না। একটুখানি সুইট কর্ন-সুপ আর আধখানা রুটি। হাসিহীন বৈষ্ণবী খাবারের তদারকি করছিল।
এই নিরানন্দ বাড়ি মাঝে মাঝে লীনার হাঁফ ধরিয়ে দেয়। তার বিপুল স্বাধীনতা আছে, সেকথা ঠিক, কিন্তু এত অনাদর এবং এত ঠান্ডা সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে থাকা যে কী যন্ত্রণার।
ঘরে এসে স্টিরিয়ো চালিয়ে দিল লীনা। কিছুক্ষণ ঋইঝমাঝম বাজনার সঙ্গে একা একা নাচল ঘরময়।
তবু কেন যে মনটায় এত অস্বস্তি, এত জ্বালা, কোথায় যেন একটা ভুল হচ্ছে তার। কী যেন একটা গোলমাল হচ্ছে।
হঠাৎ বৈষ্ণবী এসে দরজার কাছ থেকে ডাকল, দিদিমণি।
লীনা ঈষৎ কঠিন হয়ে বলল, কী বলছ?
তোমার একটা চিঠি এসেছিল আজ। টেলিফোনের টেবিলে রাখা ছিল। দেখলাম তুমি নাওনি। এই নাও।
লীনা চিঠিটা নিল। খামের ওপর অতিশয় জঘন্য হস্তাক্ষরে লেখা ঠিকানা। কিন্তু হাতের লেখাটা দেখেই কেঁপে উঠল লীনা। সর্বাঙ্গে একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ।