লীনার অফিসের সামনে বেলা সাড়ে চারটে থেকে ট্যাক্সি দাড় করিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল ইন্দ্রজিৎ। সেই ফাঁকে বুড়ো স্টিয়ারিং হুইলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে নিল খানিক। বাঁচোয়া।
ইন্দ্রজিৎ একবার ভাবল, ববি যদি মরেই গিয়ে থাকেন তাহলে আর এইসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার দরকার কী? তারপর ভাবল ববি রায় তাকে এই কাজের জন্য কঁড়িখানেক টাকা দিয়েছেন। গত ছ’ মাস ধরে ওই লোকটার দৌলতেই সে খেয়ে পরে বেঁচে আছে। মরে গিয়ে থাকলেও লোকটার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা কবাটা তার উচিত হবে না।
পাঁচটার পর লীনা গাড়ি নিয়ে বেরোতেই ইন্দ্রজিৎ বুড়োকে জাগিয়ে দিয়ে বলল, ফলো দ্যাট কার।
বুড়ো অবাক হয়ে বলল, কেন?
আঃ ডোন্ট টক।
বুড়ো বেশ অসন্তুষ্ট হয়েই গাড়ি ছাড়ল। আপনমনেই বকবক করতে লাগল।
ইন্দ্রজিৎ যতটুকু বুঝল, বুড়ো বলছে, অন্য ছোকরার সঙ্গে ছোকরির মহব্বত আছে তো তোমার কী বাপু? দুনিয়াতে কি ছোকরির অভাব? আর ও গাড়িওয়ালি ছোকরি তোমাকে পাত্তা দেবেই বা কেন?
ইন্দ্রজিতের কান লাল হয়ে গেল।
কলকাতা শহরে কোনও গাড়ির পিছু নেওয়া যে কী ঝামেলার কাজ, তা আর বলার নয়। জ্যামে গাড়ি আটকাচ্ছে, ঠেলাগাড়ি, রিকশা উজবুক মানুষ এসে ক্ষণে ক্ষণে গতি ব্যাহত করছে। বুড়োটা তেমন গা করছে না। সব মিলিয়ে একটা কেলো। তদুপরি লীনার গাড়িটা অতিশয় মসৃণ দ্রুতগতির গাড়ি।
তবু শেষ পর্যন্ত লেগে রইল ইন্দ্রজিৎ।
ওরা গঙ্গার ঘাটে নেমে ঘাসের ওপর বসল। ইন্দ্রজিতের ইচ্ছে ছিল, ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তার মধ্যে বসে থেকে ওদের ওপর নজর রাখা।
কিন্তু বুড়োটা এ রকম অনিশ্চয় সওয়ারির হাতে আত্মসমর্পণ করতে নারাজ। রীতিমতো খিচিয়ে উঠে বলল, ভাড়া মিটিয়ে দাও, তারপর মোকরির পিছা করো। আমি বাহাত্তুরে বুড়ো এইসব চ্যাংড়ামিব মধ্যে নেই।
অগত্যা ভাড়া মিটিয়ে ইন্দ্রজিৎ গাড়লের মতো নেমে পড়ল।
ববি রায় তার ওপর লীনার রক্ষণাবেক্ষণের ভারই শুধু দেননি, এমন কথাও বলেছেন যে, সে ইচ্ছে করলে লীনার সঙ্গে প্রেম করতে পারে।
মেয়েটা দেখতে আগুন। কিন্তু বাধা হল, ওই ছোকরাটা। নিতান্তই অনুপযুক্ত সঙ্গী। কিন্তু মেয়েরা যখন একবার কাউকে পছন্দ করে বসে তখন তাদের গোঁ হয় সাংঘাতিক।
একটু দূরত্ব রেখে ইন্দ্রজিৎও ঘাসের ওপর বসল। তার পরনে স্যুট। বসতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তার ওপর ঠান্ডা পড়ায় ঘাসে একটু ভেজা ভাব। অন্ধকার নামছে। কুয়াশা ঘনিয়ে উঠেছে। এই ওয়েদারে গঙ্গার ঘাটে প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো উন্মত্তরা ছাড়া আর কে বসে থাকবে?
ইন্দ্রজিতের যথেষ্ট পরিশ্রম গেছে আজ। ভোরবেলা প্লেন ধরতে সেই রাত থাকতে উঠতে হয়েছে। কলকাতায় পৌঁছতে যথেষ্ট বেলা হয়েছে, প্লেন লেট করায়। কুয়াশা ছিল বলে সময়মতো প্লেন নামতে পারেনি। ফলে, এখন ইন্দ্রজিতের একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে।
লোকটাকে দেখেছ লীনা?
দেখেছি।
কী মতলব বলো তো!
বুঝতে পারছি না। তবে ওর দিকে তাকিয়ো না।
লোকটা কি বিপজ্জনক?
হতে পারে। তুমি বোসো। আমি আসছি।
কোথায় যাচ্ছ লীনা?
গাড়ি থেকে একটা জিনিস নিয়ে আসছি।
লীনা দ্রুত পায়ে গিয়ে গাড়িতে ঢুকল। তারপর গ্লাভস কম্পার্টমেন্ট খুলে পিস্তলটা বের করে আনল। আঁচলে ঢাকা দিয়ে পিস্তলটা নিয়ে এসে দোলনের পাশে বসে পড়ে বলল, এবার তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
লোকটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করো, ও এখানে কী করছে।
তার মানে?
যাও না। ভয় নেই। আমার কাছে পিওল আছে।
পিস্তল!— বলে করে রইল দোলন।
ঠিক এই সময়ে একজন লম্বা ভদ্র চেহারার তরুণ কোথা থেকে এসে গেল। লীনার দিকে তাকিয়ে বলল, এনি ট্রাবল ম্যাডাম? আই অ্যাম হিয়ার টু হেলপ ইউ।
১১. পরাজয় স্বীকার
ববি রায় জানেন কখন, ঠিক কখন পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়। ইন্দ্রজিৎকে পালানোর সময় দেওয়ার জন্য যে ডাইভারশনের দরকার ছিল তার চেয়ে অনেকটাই বেশি হয়ে গেল। বস-এর গোড়ালিতে হাতের কানা দিয়ে যে ক্যারাটে চপ বসিয়েছিলেন ববি রায় তাতে যে লোকটার পায়ের হাড় ভেঙে যাবে তা কে জানত!
বস যখন জান্তব একটা চিৎকার করতে করতে সারা ঘর এক পায়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে ঠিক সেই সময়ে তার বুন্ধু অ্যাসিস্ট্যান্ট খুবই বশংবদ পায়ে এগিয়ে এল। হয়তো বা বস-এর এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে ববি রায়কে ছিঁড়ে ফেলবার সদিচ্ছা নিয়েই।
হাতে রিভলভার থাকা সত্ত্বেও তা চালানো বারণ বলে লোকটা রিভলভারটা উলটে নিয়ে বাঁট দিয়ে মারল মাথায়। লাগলে ববি রায়ের খুলি চৌচির হত। কিন্তু ববি কার্পেটে শোয়া অবস্থাতেই লোকটার হাতে অনায়াসে লাথি চালিয়ে রিভলভারটা উড়িয়ে দিলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন।
ভারতীয় গুন্ডারা আজ অবধি সত্যিকারের পেশাদার হল না। শুধু মোটা দাগের কাজ ছাড়া তারা কিছুই জানে না। বস-এর এই সহকারীটি আড়েদিঘে ববির দেড়া, গায়ে যথেষ্ট পেশী এবং মোটা হাড়ের সমাবেশ। রীতিমতো ভীতি উৎপাদক চেহারা। ঘুসিটুসি নিশ্চয়ই ভাল চালায়।
ববি পর পর তার তিনটে ঘুসি কাটিয়ে দিলেন শুধুমাত্র মাথাটা এদিক সেদিক চটপট সরিয়ে। যে-কোনও শিক্ষিত মুষ্টিযোদ্ধাই জানে যে, প্রতিপক্ষের ঘুসি কাটাতে হয় একেবারে শেষ মুহূর্তে, এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভগ্নাংশ সময়ে, চোখের পলকে। পর পর তিনটে ঘুসি হাওয়ায় ভেসে যাওয়ায় লোকটা এমন বেসামাল ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ল যে ববি তাকে উলটে মায়াভরে মাত্র একটি ঘুসি মারলেন। লোকটা পাহাড় ভাঙার শব্দ করে, মেঝে কঁপিয়ে, চেয়ার টেবিল নিয়ে মেঝেয় গড়িয়ে পড়ল। আর তখন বস নিজের গোড়ালি চেপে ধরে হাঁটু গেড়ে বসে অবিশ্বাসের চোখে ববিকে দেখছে।