চিরকুটটা সামান্য কাঁপা-হাতে খুলল লীনা। ববি রায়ের হাতের লেখা অতিশয় জঘন্য। পাঠাদ্ধার করাই মুশকিল। ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন সাধারণত এইরকম অবোধ্যভাবে লেখা হয়ে থাকে, যা কম্পাউন্ডার ছাড়া আর কেউ বোঝে না!
লীনা অতিকষ্টে প্রথম বাক্যটা পড়ল, এবং তার গা রি-রি করে উঠল রাগে। লেখা: মিসেস ভট্টাচারিয়া, ইফ ইউ আর নট অ্যান ইডিয়ট অ্যাজ আই হ্যাভ অ্যান্টিসিপেটেড দেন ইউ উইল ফাইন্ড দিস নোট উইদাউট মাচ ট্রাবল।
রাগের চোটে চিরকুটটা দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিল লীনা, তারপর মনে পড়ল, ববি বোধহয় বেঁচে নেই। যদি লোকটা মরেই গিয়ে থাকে তবে খামোখা রাগ করার মানে হয় না।
লীনা চিরকুটটা তার ব্যাগে পুরল। পিস্তল এবং গুলির ক্যাপ আবার যথাস্থানে রেখে দিল। তারপর গাড়িতে স্টার্ট দিল।
অফিসে পৌঁছে লীনা আগে সমস্ত মেসেজগুলো চেক করল। কয়েকটা চিঠিপত্র ফাইল করল। কিছুক্ষণ টাইপ করতে হল। কয়েকটা ফোনের জবাব দিয়ে দিল, তারপর ববির ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দিল সে।
চিরকুটটা বের করে আলোর নীচে ধরল সে। অনেকক্ষণ সময় লাগল বটে, কিন্তু ধীরে ধীরে সে চিরকুটটার পাঠোদ্ধার করতে পারল। ইংরিজিতে প্রথম বাক্যটার পবে লেখা; আপনি যদি কোডটা পেয়ে থাকেন তবে নীল মঞ্জিলের কথা জেনে গেছেন। যদি না পেয়ে থাকেন তবে ধরে নিতে হবে আমার বরাত খারাপ। আর, আমার বরাত যদি ততদূর ভাল হয়েই থাকে, অর্থাৎ আপনি যদি নিতান্ত আকস্মিকভাবেই কোডটা আবিষ্কার করে ফেলে থাকেন তবে বাকি কাজটাও দয়া করে করবেন। মনে রাখবেন, অপারেশন নীল মঞ্জিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আরও মনে রাখবেন, মোটেই ইয়ারকি করছি না, আমার মৃত্যুর পর আপনার বিপদ বেড়ে যাবে। যতক্ষণ আমি বেঁচে আছি ততক্ষণ আমার ওপরেই ওদের নজর থাকবে বেশি। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর… ঈশ্বর আপনার সহায় হোন। আপনার মস্তিষ্ক যথেষ্ট উন্নতমানের নয়, জানি, তবু নীল মঞ্জিলের জন্য আপনাকে বেছে নেওয়া ছাড়া আমার বিকল্প ছিল না। আপনি নির্বোধ বটে, কিন্তু সেইসঙ্গে যদি আবার ভিতুও হয়ে থাকেন, তবে ববি রায়ের আর কী করার থাকতে পারে? এই নোটটা অবিলম্বে পুড়িয়ে ফেলবেন।
লীনা চিরকুটটা পোড়াল বটে, কিন্তু তার আগে রাগে আক্রোশে সেটাকে ছিঁড়ে কুচিকুচি করল। মস্ত ছাইদানের ভিতর সেগুলোকে রেখে একজন বেয়ারার কাছ থেকে দেশলাই চেয়ে এনে তাতে আগুন দিল। আর বিড়বিড় করে বলল, গো টু হেল! গো টু হেল! আই হেট ইউ! আই হেট ইউ!
কিন্তু রাগ জিনিসটা বহুক্ষণ পুষে রাখা যায় না। তা একসময়ে প্রশমিত হয় এবং অবসাদ আসে।
নিজের চৌখুপি ঘরটায় চুপচাপ বসে থেকে লীনা রাতের অনিদ্রা আর রাগের পরবর্তী অবসাদে ঝুম হয়ে বসে রইল। নীল মঞ্জিলের জন্য ওই হামবাগটা তাকে বেছে নিয়েছে! ইস, কী আম্বা! উনি বললেই লীনাকে সব কিছু করতে হবে নাকি? লীনা কি ওঁর ক্রীতদাসী? সে দশটা-পাঁচটা চাকরি করে বটে, কিন্তু তার বেশি কিছু নয়।
রোজকার মতোই দোলন এল বিকেল পাঁচটায়, লীনা নেমে এল নীচে। দু’জনে গাড়িতে চেপে বসল।
লীনা, আজও তুমি ভীষণ গম্ভীর।
গম্ভীর থাকার কারণ ঘটেছে, দোলন।
ঘটেছে নয়, ঘটে আছে। তোমার গাম্ভীর্যটা প্রায় পার্মানেন্ট ব্যাপার হয়ে গেছে। আজকাল তোমার কাছে আসতে ভয় করে।
তাই বুঝি! ঠিক আছে, চাকরিটা আগে ছেড়ে দিই তখন দেখবে আমি কেমন হাসিখুশি।
চাকরির জনাই কি তুমি গম্ভীর? এই যে শুনলাম, তোমার রগচটা বস এখন কলকাতায় নেই!
নেই, কিন্তু না থেকেও আছে। ইন ফ্যাক্ট আমার বস হয়তো এখন ইহলোকেই নেই।
দোলন একটু চমকে উঠে বলল, বলো কী?
খবরটা এখনও অথেনটিক নয়।
উড়ো খবর। তাহলে কী হবে লীনা?
কী করে বলব?
তোমার চাকরিও কি যাবে?
তা কেন? আমি কি ববি রায়ের চাকরি করি? আমি কোম্পানির এমপ্লয়ি। পুরনো বসের জায়গায় নতুন একজন আসবে।
তাহলে তুমি গম্ভীর কেন? ববি রায় তো তোমাকে খুব অপমান করতেন শুনি, সে বিদেয় হয়ে থাকলে তো ভালই।
চুপ করো তো বুদ্ধ! গাড়ি চালাতে চালাতে বেশি কথা বলতে নেই।
তা বটে।
লীনার চোখ জ্বালা করছিল। বুকটা এখনও ভার।
নকল দাড়িগোঁফ যে এত খারাপ জিনিস তা জানা ছিল না ইন্দ্রজিতের। আঠা যত শুকোচ্ছে তত টেনে ধরছে মুখের চামড়া। চুলকোচ্ছেও ভীষণ। তা ছাড়া এইসব দাড়িগোঁফের মেটিরিয়ালও নিশ্চয়ই ভাল নয়। বিশ্রী বোটকা গন্ধ আসছে। দুর্গাচরণ বলছিল, এইসব দাড়িগোঁফ সংগ্রহ করা হয় মৃতদের দাড়িগোঁফ থেকে। দুর্গাচরণটা মহা ফক্কড়।
গোঁফের একটা চুল নাকে বারবার ঢুকে যাচ্ছে। কয়েকবার হ্যাঁচ্ছো হয়েছে ইন্দ্রজিতের। পাগড়িটা মাথায় এঁটে দিয়ে দুর্গাচরণ বলেছিল, শোন বুদ্বু, কোনও শিখ ট্যাক্সি ড্রাইভারের গাড়িতে উঠবি না। তোর ছদ্মবেশটা শিখদের মতো হলেও তুই তো আর ওদের ভাষা জানিস না, বিপদে পড়ে যাবি।
খুবই সময়োচিত উপদেশ, সন্দেহ নেই। কিন্তু কপাল খারাপ হলে আর কী করা যাবে। গোটা পাঁচেক ট্যাক্সি ট্রাই করার পর যেটা তার নির্দেশ মতো যদৃচ্ছ যেতে রাজি হল সেই ড্রাইভারটা শিখ। বেশ বুড়ো মানুষ। সাদা ধবধবে দাড়ি। সাদা পাগড়ি, চোখে চশমা।
পাঞ্জাবি ভাষায় জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে?
ইন্দ্রজিৎ ইংরেজিতে বলল, লং টুর। মেনি প্লেসেস।
ড্রাইভার কথাটা ভাল বুঝল না। শুধু বলল, অংরেজি?
এরপর আর ইন্দ্রজিতের সঙ্গে বেশি কথাবার্তা বলার চেষ্টা করেনি বুড়ো। তবে সারাক্ষণ রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে সন্দেহাকুল চোখে তার দিকে নজর রাখছিল।