ভিডিয়ো ইউনিটে প্রাণের স্পন্দন দেখা দিল।
লীনা অবাক হয়ে দেখল, ইংরিজি অক্ষরে লেখা, বম্বে রোড ধরে ঠিক পঁচিশ মাইল চলে যাও। বাঁদিকে একটা মেটে রাস্তা। গাড়ি যায়। তিন মাইল। একটা বাড়ি। নাম নীল মঞ্জিল। খুব সাবধান। রিপিট, খুব সাবধান। কেউ যেন তোমাকে অনুসরণ না করে। এই মেসেজটা এক্ষুনি কি করে দাও, প্লিজ।
লীনা মুখস্থ করে নিয়ে, মেসেজটা কিল করে ভিডিয়ো ইউনিট বন্ধ করল।
দোলন এসেছে। রিসেপশন থেকে ফোনে জানাল।
০৮. ট্যাক্সিতে বসে ইন্দ্রজিৎ
ট্যাক্সিতে বসে ইন্দ্রজিৎ জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাচ্ছি স্যার?
মালাবার হিলসের দিকে। একটা বার কাম রেস্টুরেন্টে।
বোম্বাই প্রহিবিটেড শহর, স্যার। এখানে বার কাম রেস্টুরেন্ট নেই।
আছে। প্রাইভেটলি আছে। যেখানে যাচ্ছি সেটা খুবই প্রাইভেট জয়েন্ট। হয়তো আমাদের ঢুকতে দেবে না।
তা হলে কী করবেন?
তোমাকে প্লেন ভাড়া দিয়ে কলকাতা থেকে আনিয়েছি কেন হাঁদারাম? বুদ্ধি খাঁটিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করার জন্যই তো?
তা বটে। কিন্তু কাজের আগে ওরকম ফাঁসির খাওয়া খাওয়ালেন, এখন যে শরীর আইটাই করছে, ঘুমও পাচ্ছে।
খাওয়ালাম মানে? জোর করে খাইয়েছি নাকি? তুমিই তো এসে প্রথম কথাটাই বললে, স্যার, আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। জাহাজ পর্যন্ত খেয়ে ফেলতে পারি। বলোনি?
বলেছি। খিদেও পেয়েছিল। তখন তো স্যার জানতাম না যে খাওয়ার পর আবার কপালে দুঃখ আছে।
বেশি খাও কেন ইন্দ্রজিৎ? বাঙালিরা বড্ড বেশি খায়, তাই কাজ করতে পারে না।
ইন্দ্রজিৎ অমায়িক গলায় বলল, গরিবের তো ওটাই দোষ স্যার, মাগনা খাবার পেলেই দেদার খায়। তবে ভাববেন না স্যার, পারব। ওখানে কি মারপিট হবে? তা হলে অবশ্য…
তোমার মারপিটের ধাত নয় ইন্দ্রজিৎ। আমি জানি। কিন্তু বিপদ ঘটলে অন্তত দৌড়ে পালাতে হতে পারে।
সেটা পেরে যাব। পালানোটা আমার ধাতে খুব সয়।
ববি রায় পিছনে হেলান দিয়ে বসলেন। অনেক রাত হয়েছে। মেরিন ড্রাইভ ফাঁকা। হু হু করছে হাওয়া আর সমুদ্রের কল্লোল। গাড়ি অতি দ্রুত পাহাড়ের গা বেয়ে উঠছিল।
কত দুরে-স্যার?
বেশি দূরে নয়। নার্ভাস লাগছে না তো ইন্দ্রজিৎ?
না স্যার। তবে আপনার মোডাস অপারেন্ডিটা বুঝতে পারছি না।
আগে থেকে বুঝবার দরকার কী?
আমার ভূমিকাটা কী হবে?
তোমার ভূমিকা খুব সাধারণ। যদি কিছু হয় তা হলে তুমি পালাবে এবং যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি পুলিশে একটা খবর দেবে। মিসেস ভট্টাচারিয়াকে টেলিফোনে জানিয়ে দেবে।
উনি মিসেস নয় স্যার, মিস।
অল দি সেম।
একটু ঝুঁকে ববি ড্রাইভারকে রাস্তার নির্দেশ দিলেন। গাড়ি বাঁক নিল। একটু বাদে যেখানে ববি গাড়িটা দাঁড় করালেন সে জায়গাটা রেস্টুরেন্টের সম্মুখ নয় বটে, কিন্তু সেখান থেকে রেস্টুঘ্নেন্টটার দরজা দেখা যায়। দিনের বেলায় যেমন ঝা-চকচকে লেগেছিল এখন সেরকম লাগছে না। বাইরে আলোর কোনও খেলা নেই, উজ্জ্বলতা নেই। বরং যেন একটু বেশি অন্ধকারই লাগছিল, একটিমাত্র বালকের আলোয়।
ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে ববি রায় নামলেন।
এসো ইন্দ্রজিৎ।
দু’জনে দ্রুত পায়ে এগোল। কয়েকটা নিঝুম গাড়ি পার্ক করা রয়েছে রাস্তার দু’ধারে। গাড়ির চেয়ে সংখ্যায় দ্বিগুণ মোটরবাইক আর স্কুটার। রাস্তায় কোনও লোকই নেই।
রেস্টুরেন্টের দরজা আঁট করে বন্ধ। একজন গরিলার মতো চেহারার লোক দরজার পাশে অন্ধকারে গা মিশিয়ে দাঁড়ানো, পাথরের মূর্তির মতো।
শান্তভাবে, একটু ঝুঁকে উর্দিপরা একটা হাত বাড়িয়ে গরিলা তাদের বাধা দিল। খুবই নিম্ন, কিন্তু গম্ভীর গলায় বলল, ভিতরে যাওয়া বারণ। তোমরা কী চাও?
গরিলা ইংরিজি বলে, তবে ভাঙা ভাঙা এবং ভুলে ভরা। তবে ভঙ্গিটা বুঝিয়ে দেয় যে, ইংরেজির জন্য নয়, তাকে রাখা হয়েছে আরও গুরুতর কাজের জন্য।
ববি রায় ভারী অমায়িক হেসে বললেন, কাস্টমার। হোয়াট কাস্টমার? গো অ্যাওয়ে।
ববি রায় পকেটে হাত দিলেন। একখানা ভাঁজ করা পঞ্চাশ টাকার নোট প্রস্তুত ছিল। গরিলার হাতে সেটা চোখের পলকে চালান হয়ে গেল।
গরিলা ভ্রু কুঁচকে বলল, নো কিডিং।
দরজাটা সামান্য ফাঁক করে ধরল গরিলা। উদ্দণ্ড নাচ-গান চেঁচামেচির শব্দ তেড়ে এল ভিতর থেকে। কানের পরদায় ধাক্কা দিল উন্মত্ত ড্রামের আওয়াজ। দু’জনে টুক করে ঢুকে গেল ভিতরে।
ধোঁয়া, শব্দ, ক্যালেডিয়োস্কোপিক আলোর খেলায় যৌবনের প্রলাপ সমস্ত ঘরটাকে, যেন ভেঙেচুরে ফেলছে। পায়ের তলায় সুস্পষ্ট ভূমিকম্প। চোখ জ্বালা করে, মাথা পাগল-পাগল লাগে। অন্ধকার ও আলোর এমনই পাগলা সমন্বয় এবং দ্রুত অপস্রিয়মাণ নানা রং যে ভিতরটায় প্রকৃতই কী হচ্ছে তা বোঝা যায় না। তবে মেঝের অনেকটা পরিসর ফাঁকা করে তৈরি হয়েছে নাচের জায়গা। সেখানে ভুতুড়ে অবয়বের বহু মেয়ে আর পুরুষের শরীর বাজনার আদেশে সঞ্চালিত হচ্ছে বহু ভাঙ্গমায়।
ইন্দ্রজিৎ প্রথমটায় স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
কানে এল ববি রায়ের কঠিন স্বর, চলে এসো, সময় নেই।
কোথায় স্যার?
কাম অন। আই হ্যাভ টু ফাইন্ড দ্যাট গার্ল।
ইন্দ্রজিৎ আর শব্দ করল না। ববি রায়ের পিছু পিছু এগোতে লাগল। গাঁজা, চণ্ডু, চরস, মদ কী নেই এখানে? নেশার জগৎ যেন কোল পেতে বসে আছে।
ববি রায় নৃত্যপর নর-নারীর ভিতর দিয়ে অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। সোজ কথায়, তাঁকেও মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে নেচে নিতে হচ্ছিল। ইন্দ্রজিৎ অতটা পেরে উঠছিল না। তার আর ববি রায়ের মাঝখানে দোল-খাওয়া স্কুল-খাওয়া নানা শরীর এসে পড়ছে। কখনও মেয়ে, কখনও পুরুষ, কখনও জোড়া।