বোম্বে শহরে ট্যাক্সি পাওয়া সহজ। ববি ট্যাক্সি নিলেন। কোথায় যাবেন তা কিছু ঠিক করতে পারলেন না, চক্কর দিতে দিতে অবশেষে মেবিন ড্রাইভে এসে ট্যাক্সি ছেড়ে নামলেন। সমুদ্র তার চিরকালের প্রিয়। সমুদ্র তাঁর মাথাকে পরিষ্কার করে দেয়, তাকে চনমনে করে তোলে।
ফুটপাথ থেকে লাফ দিয়ে বাঁধের ওপর উঠে পড়লেন ববি রায়। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে সমুদ্রের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ভূখণ্ড। সেই আক্রোশে সমুদ্র ফুঁসে উঠে লক্ষ ফণায় ছছাবল মারছে অবিরাম। তলায় রাশি-রাশি কংক্রিটের টুকরো ফেলে সামাল দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। প্রবল তাড়নায় সমুদ্রের আছড়ে পড়া জল তীক্ষধার লক্ষ বিন্দু হয়ে ছুটে আসছে ওপরে। খরশান ফোয়ারার মতো, বাত্যাতাড়িত বৃষ্টির মতো ভিজিয়ে দিচ্ছে পথচারীকে।
ববি রায় সামান্য ভিজে গেলেন। জল ঘুরছে, দোল খাচ্ছে, ফেনিল হয়ে যাচ্ছে অবিরল পরিশ্রমে। তবু বিশ্রাম নেই, ক্লান্তি নেই, শ্রান্তি নেই।
বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে চারপাশে। ববি রায় যতদূর লক্ষ করলেন, তার পিছু নেয়নি কেউ। কিন্তু ববি রায় জানেন, নজর ঠিকই রাখা হয়েছে তার ওপর।
হাঁটতে হাঁটতে বাঁধ শেষ হয়ে গেল। সামনেই চমৎকার একটি সি-বিচ। এই অবেলাতেও কত লোক স্নান করছে। বড় বড় ছেলেরা নির্লজ্জ ল্যাংটো হয়ে ঢেউয়ের মধ্যে দৌড়োচ্ছে। উড়ছে রঙিন বল। বড় বড় বর্ণালি ছাতার তলায় ঠান্ডা পানীয় নিয়ে বসে আছে মেয়ে এবং পুরুষ।
ববি রায় একটা খালি চেয়ার পেয়ে বসলেন। একটা ঠান্ডা পানীয় নিলেন। তারপর সমুদ্রের দিকে চেয়ে প্রায় সব কিছুই ভুলে গেলেন।
পানীয়টি শেষ হয়ে গেল এক সময়ে। ববি রায় ঘড়ি দেখলেন। তাড়া নেই। উঠলেন।
চড়া রোদ এবং তপ্ত বালিয়াড়ি থেকে উঠে আসা কম্পমান তাপে একটু ঝাপসা লাগল। তবু ববি রায় চোখের কোণ দিয়ে লক্ষ করলেন একটু দুরে আর-একটা ছাতার তলা থেকে দু’জন লোক উঠে পড়ল। এরা সেই দু’জন নয়, তবু এরাও মৃত্যুর প্রতিনিধি। ববি রায় জানেন।
পিছনের টেবিলে আরও একজন উঠে দাঁড়িয়েছে। ববি রায় তাকে লক্ষ করেননি। একটি মিষ্টি মেয়েলি কণ্ঠ বলে উঠল, হিঃ, নিড এ কম্প্যানিয়ন?
ববি রায় ফিরে মেয়েটিকে দেখলেন। নিম্নাঙ্গে একটা সাদা হাফপ্যান্ট গোছের, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা টিশার্ট, নীল সাদা আড়াআড়ি স্ট্রাইপের। দুটি উন্নত স্তন গেঞ্জি ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। মেয়েটি ফরসা, বোধহীন লোল হাসি তার মুখে, চোখে লোভ। নইলে এক ধরনের সৌন্দর্যও ছিল। দেখতে তেমন খারাপ নয়। কোমরের চওড়া বেল্টে একটা পেতলের অক্ষর নজরে পড়ল ববির, সি। বয়কাট চুল হাওয়ায় আলুথালু।
ববি একটু শিস দিলেন, তারপর বললেন, কাম অন।
সব মানুষই কি নয় কম্পিউটারের মতো? কিছু ডাটা ফিড করা থাকে। সেই মতো চলে, যেমন ওই ভাড়াটে খুনিরা, তেমনি এই কলগার্লটি।
তিনি নিজে?
কে জানে, তিনি নিজেও হয়তো তাই।
বাড়ানো হাতে কোমরটা পেয়ে গেলেন ববি। শরীরটা যথেষ্ট নমনীয়, যথেষ্ট শক্তি রাখে। বয়সটাও ওর ফেবারে। কিছুতেই কুড়ির ওপর নয়।
তৃষ্ণার্ত গলায় মেয়েটি বলল, লেট আস হ্যাভ এ ড্রিংক ফাস্ট, আই অ্যাম থার্স্টি।
আই নো।
মালাবার হিলসের দিকে অনির্দেশ্য হাত তুলে মেয়েটি বলল, আই হ্যাভ এ জয়েন্ট ওভার দেয়ার। হেইল এ ক্যাব।
ববি রায় এসবই জানেন, কোনও বার-এ যাবে। খদ্দেরের পয়সায় মদ খাবে। ডিনার খেতে চাইবে। নিয়ে যাবে নিজস্ব ঘরে। পকেট ফাঁকা করে ছেড়ে দেবে। রুটিন।
ববি এসবে অভ্যস্ত নন, কিন্তু মেয়েটাকে কভার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। অন্তত একটা ডাইভারশন।
ট্যাক্সি সামনেই ছিল, দু’জনে উঠতেই মেয়েটি ঝুঁকে চাপা স্বরে ড্রাইভারকে একটা নির্দেশ দিল। ববি রায় সেটা চেষ্টা করেও শুনতে পেলেন না। সমুদ্র গজরাচ্ছে, হুড়হুড়িয়ে বইছে হাওয়া।
ববি হেলান দিয়ে আরাম করেই বসলেন। সর্বদাই তাঁকে বেঁচে থাকতে হয় বর্তমান নিয়ে। তার ভাবাবেগ বলে কোনও বস্তু নেই, ভয় তাঁর ভিতরে তেমনভাবে কাজ করে না, তাঁর ভিতরে কাজ করে অঞ্চ এবং কেবলমাত্র অঙ্ক।
ছোট কিয়াট গাড়িটা যখন গুড়গুড় করে চলছে তখন মেয়েটা ববির একটা হাত মুঠো করে ধরল। ববি বাধা দিলেন না দিতে ইচ্ছে হল না বলেই, তবে হাতখানার ভাষা অনুভূতির ভিতর দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করতে লাগলেন। নরম ও উষ্ণ হাতখানা কি আগ্রহী? না কি ভীত? দ্বিধাগ্রস্ত?
তোমার নাম কী?
চিকা।
নামটা তো বেশ ভালই।
তোমার নাম?
ববি।
হাতটাকে আরও একটু নিবিড়ভাবে চেপে ধরলেন ববি! হাতটা কি তাকে কোনও তথ্য দিচ্ছে? দেওয়ারই কথা। পৃথিবীর সব জিনিসই সর্বদা কিছু না কিছু তথ্য দেবেই। শুধু সূক্ষাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি দিয়ে তা বুঝে ওঠাই যা শক্ত।
গাড়িটা মালাবার হিলস বেয়ে উঠছে। অতি চমৎকার দৃশ্য চারদিকে। অত্যন্ত অভিজাত, নিরিবিলি, খোলামেলা।
ববি চিকার দিকে ঘুরে তাকালেন, এসব কাজের পক্ষে তোমার বয়স বড্ড কম। চিকা সামান্য চমকে উঠল কি? বলির দিকে চেয়ে অকপট বিস্ময়ে বলল, কোন সব কাজ?
ববি স্বগতোক্তির মতো বললেন, মেয়েদের যে কতভাবে ব্যবহার করে মানুষ! শুধু জন্মানোর দোযে মেয়েদের কত না কষ্ট!
বড্ড এলোমেলো হাওয়া, ঢেউয়ের শব্দ। চিকা বোধহয় ববির কথা ভাল শুনতে পেল না। কিন্তু ববির দুঃখিত মুখের দিকে চেয়ে কিছু অনুমান করে নিল। ঝুঁকে প্রায় ববির গালে শাস ফেলে বলল, তুমি কি দুঃখী মায়? বউ ছেড়ে, বুঝি? রাহা, বড় ছেড়ে গেলে প্রথম-প্রথম বড় কষ্ট হয়।