হয়তো সম্পর্ক নেই। ইচ্ছে না হলে বলার দরকার নেই।
শচীনন্দন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, টু কাট এ লং স্টোরি শর্ট, আমার স্ত্রী শ্যামলী আর একজন লোকের প্রেমে পড়েছিল।
লোকটা কে?
শুনেছি। ওর পূর্বপ্রণয়ী। তার নাম সুজিত।
তারা এখন কোথায় থাকেন?
কানপুর।
রিঙ্কুর খবর তাঁকে দেওয়া হয়েছে কি?
হ্যাঁ। শ্যামলী তো তিন-চার দিন হল চলেও এসেছে। এই বাড়িতেই আছে।
ওঁর হাজব্যান্ডও এসেছেন কি?
না। ওর এ পক্ষের দুটো মেয়েকে নিয়ে এসেছে।
ডিভোর্সের পর উনি রিঙ্কুর কাস্টডি চাননি?
না। বোধহয় সুজিতের ইচ্ছে ছিল না।
শুনেছি আপনি রিঙ্কুর দেখাশোনা করার সময় পেতেন না।
ঠিকই শুনেছেন। আমার ব্যাবসাটা বড়। মাছের ব্যাবসা। একা মানুষ, সামাল দিতে হিমশিম খাই। তবে রিঙ্কুর দেখাশোনা আমার মা আর বাবাই করেন। ঝি-চাকরের অভাব নেই।
শ্যামলীদেবীর সঙ্গে কি আপনার বাবা-মা’র বনিবনা ছিল না?
না। আজকালকার মেয়েরা শ্বশুর-শাশুড়িকে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু মা-বাবাকে
ডিভোর্সের কারণ সেটাই নয় তো?
সেটা অপ্রধান কারণ। আমি শ্যামলীর জন্য আর একটা বাড়ি করে দিচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে তাকালে দেখতে পাবেন বাড়িটা খানিকটা হয়ে পড়ে আছে। বলেছিলাম, কাছাকাছি আলাদা থাকে, তা হলে খিটিমিটিও লাগবে না, সম্পর্কটাও ভাল থাকবে ও রাজি ছিল। কাজেই ডিভোর্সের কারণ আমার মা-বাবা হতে পারে না।
বুঝলাম। রিঙ্কু সম্পর্কে আপনি কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন?
মেয়েটা চঞ্চল ছিল। ডাকাবুকোও।
অবাধ্য ছিল কি?
একটু ছিল।
আপনাকে কেমন ভালবাসত?
খুব। বলেই শচীনন্দন দুহাতে মুখ ঢেকে রইল। কান্না চাপার চেষ্টা করতে লাগল।
শবর চুপ করে বসে রইল।
মিনিট কয়েক পরে ধাতস্থ হয়ে শচীনন্দন বলল, ওর সম্পর্কে পাড়ায় দুর্নাম শুনবেন, কিন্তু বিশ্বাস করুন, রিঙ্কু খারাপ ছিল না। আদর পেয়ে পেয়ে একটু স্বাধীনচেতা হয়ে উঠেছিল মাত্র।
এরকম হতেই পারে। আপনি কি জানেন ভজনবাবুর সঙ্গে ওর কীরকম রিলেশন ছিল?
কী করে বলব? ভজন মাঝে মাঝে আমার বাড়িতে আসত। একটু গভীর আর চুপচাপ মানুষ। আমার ওকে খারাপ লাগত না।
রিঙ্কু কি কখনও বাড়ির কাউকে জানিয়েছিল যে ও ভজনবাবুকে বিয়ে করতে চায়?
না, সেরকমভাবে কিছু জানায়নি। তবে–
তবে কী?
আমার মায়ের কাছে ও প্রায়ই ভজনবাবুর গল্প করত।
কীরকম গল্প?
ভজনকে যে ও খুব পছন্দ করে সেই কথাই বলত।
পছন্দটা হৃদয় পৰ্যন্ত পৌঁছেছিল কি না জানেন?
শচীনন্দন একটু থিতামত খেয়ে বলল, আমি মাকে ডাকছি। আপনি তাঁর সঙ্গে কথা বলুন।
শচীনন্দন গিয়ে তাঁর মাকে ডেকে আনলেন। মায়ের সঙ্গে ছেলের মুখশ্ৰীর অদ্ভুত মিল। মা অবশ্য রোগা মানুষ, বয়স মধ্য ষাট। মুখে গভীর শোক থিম ধরে আছে।
মাসিমা কিছু মনে করবেন না।
না বাবা, বিলো।
ভজনবাবুর সঙ্গে রিঙ্কুর সম্পর্ক কেমন ছিল?
কী করে বলব? খারাপ কিছু তো মনে হয়নি।
ভজনবাবুকে আপনার কেমন লোক বলে মনে হয়?
তাকেও খারাপ লাগেনি। মিশুকে ছিল না। এই যা।
রিকু কি তাকে ভালবাসত বলে মনে হয়? মানে রিঙ্কুর কথায় তেমন কিছু ধরা যেত কি?
শচীনন্দনের মা মাথা নেড়ে বললেন, বলতে পারব না বাবা। আজকালকার মেয়েদের কি অত সহজে বোঝা যায়? তা ছাড়া রিঙ্কুর বয়সটাই বা কী বলো! বুদ্ধিাশুদ্ধি তো ছিল না।
রিঙ্কু কি বোকা ছিল?
তাও নয়। লেখাপড়ায় বেশ মাথা, কথাবার্তায় চৌখস, আবার আগুপিছু না ভেবে হুটহাট এক-একটা কাজ করে বসত।
কিছু মনে করবেন না, ভজনবাবুছাড়া আর কোনও ছেলের প্রতি ওর সফটনেস ছিল কি?
ওসব জানি না বাবা। তবে ছেলেছোঁকরাদের সঙ্গে মিশত। খুব।
শচীনন্দন বলল, এসব জেনে আর কী হবে? খুনি তো ধরাই পড়ে গেছে।
সেটা ঠিক। তবে আমাদের কেস সাজাতে হলে সবরকম সম্ভাবনা খতিয়ে দেখে নিতে হবে। কোনওখানে ফাঁক থাকলে সেই রন্ধ দিয়ে দোষী পার পেয়ে যায়।
পার পেয়ে যাবে কোথায়? পুলিশ ছাড়লেও এ পাড়ার লোক ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।
মৃদু হেসে শবর বলল, হ্যাঁ, জনগণের আদালতে তো সেরকমই হয়। শচীনন্দনবাবু, ভজনবাবুর গ্যারেজে বারিকয়েক হামলা হয়েছে। কেন জানেন?
চাঁদার জন্য। ব্যাবসা করলে বেকার ভাতা না দিয়ে রেহাই নেই। সেটা নিয়েই গণ্ডগোল। ও তো মারও খেয়েছে।
কে মেরেছিল?
হাবু আর জগুর দল।
আর কারও সঙ্গে ভজনবাবুর শক্ৰতা ছিল কি?
গ্যারেজটার জন্য পাড়ার লোকেদের অসুবিধে হচ্ছিল। আরও কী কী সব যেন, অত ডিটেলসে জানি না। তবে অশান্তি ছিলই।
ভজনবাবুকি একটু মারকুট্টা একরোখা লোক?
তা বোধহয় একটু আছে।
ব্যক্তিগতভাবে আপনি কি মনে করেন যে ভজনবাবুই আপনার মেয়েকে ওরকম নৃশংসভাবে মেরেছে?
শচীনন্দন অনেকক্ষণ ভাবলা। খুব চিন্তিত। তারপর মৃদু গলায় বলল, আর কে মারবে?
সম্ভাবনার কথা বলছি।
আপনারা কি আর কাউকে সন্দেহ করছেন?
আরে না।
আমার মেয়েকে মেরে কার কী লাভ বলুন! রিঙ্কু হয়তো দুষ্ট একটু ছিল, কিন্তু এত বড় শাস্তি ওর হল কেন? মেয়েটা আমার–
শচীনন্দন হঠাৎ কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।
মা এসে ছেলেকে দুহাতে ধরে বলল, ওকে এবার রেহাই দাও বাবা। গত আটদিন ধরে ওর যে কী অবস্থা।
ঠিক আছে মাসিমা।
আপনি কি তদন্তের ব্যাপারে কথা বলবেন?
শ্যামলী নামক মহিলাটির মুখে শোক ও রাগের মাখামাখি লক্ষ করল শবর। রাগটাই বেশি। বেশ সুন্দর ঢলঢলে মুখশ্ৰীতে একটু কাঠিন্যও আছে। গভীরভাবে শবরের দিকে চেয়ে বলল, আপনাদের উচিত রিঙ্কুর বাবাকেও অ্যারেস্ট করা।