শচীনন্দন? ও কি একটা মানুষ? সারাদিন তো চিংড়ির ভেড়িতেই পড়ে থাকত। সংসার ভেসে গেলেও খেয়াল করত না। একটু সাবধান হলে মেয়েটা বাঁচত।
রিঙ্কুর সাইকেলটা খুনের পরদিনও গ্যারেজে ছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
আপনি কি আগের দিন জানতে পেরেছিলেন যে রিঙ্কুকে পাওয়া যাচ্ছে না?
না। আমার কানে আসেনি।
পাড়ার ছেলেরা যখন জানতই যে রিঙ্কু প্রায়ই ভজনবাবুর গ্যারেজে আসে তখন তারা গ্যারেজে রিঙ্কুর খোঁজ করল না কেন বলুন তো!
জানি না মশাই। ওখানেই তো আগে খোঁজা উচিত ছিল।
রিঙ্কু কি কখনও আপনার বাড়িতে আসত?
না। এ বাড়িতে তার সমবয়সি তো কেউ নেই, কেন আসবে?
ওদের পরিবারকে আপনি কতটা চেনেন?
ভালই চিনি। আমরা কয়েকজন প্রথম এ জায়গায় বাড়িঘর পত্তন করি। শচীনন্দন আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তবু ভালই আলাপ আছে।
যাতায়াত আছে?
কালেভদ্রে। যে যার ধান্ধায় ব্যস্ত, সময়টা কোথায়? শচী তো থাকেও না। এখানে। মাছের ভেড়িতে পড়ে থাকে।
সেই রাতে অস্বাভাবিক কোনও চিৎকার বা শব্দ শোনেননি তো!
না মশাই, মনে তো পড়ছে না।
ভাল করে ভেবে দেখুন তো, রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে কোনও সময়ে খুব কুকুর ডাকছিল কি?
সনাতন মল্লিক ক্ৰ কুঁচকে একটু ভেবে সোৎসাহে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এগারোটার পরে কিছু কুকুর খুব ডাকছিল বটে। তবে তারা কিন্তু রোজই ডাকে। সেদিন হয়তো একটু বেশি ডাকছিল।
আর কোনও অস্বাভাবিক শব্দ?
না, মনে পড়ছে না।
রিঙ্কুর কোনও বিশেষ ছেলেবন্ধু ছিল কি?
সে আমি কী করে জানিব? পাড়ার ছেলেছোঁকরাদের জিজ্ঞেস করুন। ওরা হয়তো বলতে
পারবে।
আপনার কি মনে হয় ভজনবাবু খুন করতে পারেন?
না পারার কী আছে? ও লোক সব পারে।
আপনার স্ত্রীর অসুখটা কি জটিল?
হার্ট প্রবলেম। অ্যানজাইনা।
আপনার শাশুড়ি তো সারা রাত জেগে থাকেন।
হ্যাঁ।
তিনি মধ্যরাতে কোনও শব্দ শুনেছেন কি?
না। পুলিশ তাকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সেই ভয়ে তিনি মধ্যমগ্রামে তীর বড়মেয়ের বাড়িতে গিয়ে আছেন।
আপনার স্ত্রী বাড়িতে আছেন?
আছেন।
তীকে ডাকুন।
তাকেও জেরা করা হয়েছে।
জানি। আমার দু-একটা প্রশ্ন মাত্র।
ডাকছি।
সনাতনবাবু ভিতরে গিয়ে স্ত্রীকে ডেকে আনলেন। মধ্যবয়স্কা সাধারণ চেহারার ভদ্রমহিলা। মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে।
মাপ করবেন, আপনি অসুস্থ, তবু বিরক্ত করছি।
অসুস্থতা তেমন কিছু নয়। প্রশ্ন করতে পারেন।
ভজনবাবু কেমন লোক?
ভাল নয়। গ্যারেজটার জন্য আমাদের খুব অসুবিধে হচ্ছে। ওঁকে বলছি বাড়ি বিক্রি করে অন্য জায়গায় বাড়ি করতে।
গ্যারেজের শব্দে আপনার অসুবিধে হত, সে তো বুঝলাম। ভজনবাবুকে কতটা চিনতেন?
চিনতাম একটু-আধটু। দেখতাম প্রায়ই।
দেখে কী মনে হত?
মনে আবার কী হবে। চেহারাটা ভাল। একটা মারুতি গাড়ি করে আসা-যাওয়া করত। ইদানীং তো থাকতই এখানে।
কখনও আলাপ হয়নি?
তা হবে না কেন?
কী সূত্রে আলাপ?
আমরা বছর চারেক হল এ বাড়ি করেছি। ভজনবাবু তার বছরখানেক আগে এখানে গ্যারেজ করেন। বাড়ি করার মেটেরিয়াল আমরা ওঁর গ্যারেজেই রাখতাম। তখন ওঁর ব্যাবসা বড় হয়নি।
ওর ক্লায়েন্টরা কীরকম?
ইদানীং তো দেখতাম বেশ বড়লোক মাড়োয়ারিরা আসছে। শুনেছি। ওঁর খদেররা। বেশিরভাগই বড়লোক।
ঘটনার দিনের কথা মনে আছে?
থাকবে না কেন? তবে আমরা কিছু দেখিওনি, শুনিওনি।
রিঙ্কুকে যে সন্ধেবেলা থেকে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ খবর কি জানতেন?
না। আমাদের কেউ বলেনি। রিঙ্কুরা একটু তফাতে থাকে। মাঠের ওপাশে। পাড়াটা আলাদা।
রিকুকে তো চিনতেন!
হ্যাঁ। ছোট থেকে দেখছি। ওর মা যখন এখানে থাকত তখন কয়েকবার গেছি। ওদের বাড়িতে। ওর মা-ও আসত।
মা কেমন মহিলা?
খারাপ তো তেমন কিছু দেখিনি। দেখতে সুন্দর ছিল, আর উগ্ৰ সাজগোজ করত।
আর কিছু?
না। আর কী বলুন!
ভজনবাবু সম্পর্কে আর কিছু বলতে পারেন?
না।
রিঙ্কু মেয়েটা কেমন ছিল?
ভাল নয়। বড্ড উড়নচণ্ডী।
সে কি খুব ঘনঘন ভজনবাবুর কাছে আসত?
হ্যাঁ। রোজ। দুজনের তো খুব ভাব ছিল দেখেছি।
কীরকম ভাব?
মাখামাখি ছিল বেশ।
কোনও অস্বাভাবিক কিছু দেখেছেন?
দু’জনে গাড়ির সিটে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে গাড়ি চালাত দেখেছি।
রিঙ্কুর অনেক ছেলেবন্ধু ছিল কি?
ও বাবা, সে অনেক ছিল।
তারা ভজনবাবুকে হিংসে করত না?
করত বোধহয়। গ্যারেজে তো কতবার বোমা পড়ল, হামলা হল। কেন হাঙ্গামা হত কে জানে বাবা!
সেই হামলার লিডারশিপ কে দিত বলতে পারেন?
না। হাঙ্গামা হলে আমরা জানালা দরজা বন্ধ করে দিই। গ্যারেজটার জন্য আমাদের খুব অশান্তি হচ্ছে।
গ্যারেজটা উঠে গেলে কি আপনাদের সুবিধে হয়?
হবে না? খুব হয়। দিন না উঠিয়ে।
ভজনবাবু কনভিকটেড হলে গ্যারেজ উঠেও যেতে পারে।
তাই হোক বাবা। ক’দিন গ্যারেজটা বন্ধ বলে খুব শান্তিতে আছি।
শচীনন্দনবাবু, আপনার শোকটা যে কতখানি তা বুঝতে পারছি। এ সময়ে আপনাকে ডিস্টার্ব করা হয়তো উচিত নয়। আপনার অস্বস্তি হলে আমি আপনাকে প্রশ্ন করবও না।
শচীনন্দনের বয়স মাত্ৰ বিয়াল্লিশ হলেও শরীরে অতিরিক্ত চর্বির জন্য বয়স্ক বলে মনে হয়। মাথায় টাকা। প্রচুর কেঁদেছেন বলে চোখ দুটো এখনও রক্তিম। মুখে গভীর শোকের ছাপ। দৃষ্টিতে শূন্যতা। মাথা নেড়ে শচীনন্দন বলল, না, কোনও অসুবিধে হবে না। কী জানতে চান বলুন।
আপনার ডিভোর্স কতদিন হয়েছে?
বছর সাত-আট।
ডিভোর্সের কারণটা কী?
আমার মেয়ের মৃত্যুর সঙ্গে এ ব্যাপারের কী সম্পর্ক?