মিনিট দশেক পরে দু’জনে বৃষ্টির মধ্যেই মুখোমুখি বসা। মাটির ওপরেই। জলকাদা থিকথিক করছে। ভিজে কুম্পুস হয়ে যাচ্ছে দু’জন।
শবর শান্ত গলায় বলল, বল।
কী বলব? ও আমাদের কাছে আসত। বন্ধুত্ব করতে চাইত। আমরা কী করব?
বন্ধুত্ব করতে চাইত কেন?
ও চাইত যাতে আমরা ভজন আচাৰ্যর পিছনে না লাগি।
ওর ইন্টারেস্ট কী?
কী আবার। মহব্বত।
বুঝেছি। বলো।
ঘুরেফিরে আসছিল। বারবার আসত।
টাকা পয়সা দিত?
না।
তোমরা ওকে কিডন্যাপ করে বাপের কাছ থেকে টাকা আদায়ের কথা ভেবেছিলে?
না। ওটা আমাদের লাইন নয়।
বলো।
আমার ওকে ভাল লাগত। ওকে চাইতাম। পুরুষচাটা মেয়েছেলে তো।
বুঝেছি। আগে বাঢ়ো।
মদ খেলে আমার কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। সেই দিন বিকেলে ও গ্যারেজের কাছে আমাকে থাকতে বলেছিল।
কেন?
সেদিন ওর পাঁচুদার কাছে যাওয়ার কথা ছিল।
সেটাই বা কেন?
গ্যারেজ নিয়ে লোকালিটিতে ঝামেলা হচ্ছে তার একটা মিটমাটের জন্য।
সেটা কি ভজনবাবু জানতেন?
বোধহয় না। ভজনবাবু ত্যাঁদোড় লোক, অন্যের সাহায্য নেবে না। মেয়েটাকে পাত্তা দিত না, কিন্তু মেয়েটা ওর জন্য পাগল ছিল।
আগে বাঢ়ো।
আমি স্কুটার নিয়ে বিকেল পাঁচটা নাগাদ ওখানে ছিলাম। রিঙ্কু সাইকেলে এসে গ্যারেজে সাইকেলটা ঢুকিয়ে দিয়ে আমার স্কুটারে ওঠে।
কেউ তোমাদের দেখেনি?
বোধহয় না। গ্যারেজ ছাড়িয়ে পশ্চিম দিকে বাঁয়ে একটা জংলা জমি দেখেছেন তো। ওটা দিয়ে শর্টকাট হয়।
রিঙ্কুকে মদ খাওয়াল কে?
ও নিজেই খেতে চাইল। আমার কাছে ছিল একটা বোতল।
ও খেত নাকি মাঝে মাঝে?
হ্যাঁ। ইদানীং খেত।
কোথায় খেলে?
ওই জঙ্গলে বসে।
পাচুবাবুর বাড়িতে যাওনি?
পাঁচুদা সেদিন ছিলেন না। কলকাতায় গিয়েছিলেন।
সেটা রিঙ্কু জানত?
না। আমি ওকে খুব চাইছিলাম।
কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে?
ওখানেই–
রিঙ্কু বাধা দেয়নি?
হ্যাঁ। খুব চেঁচিয়ে ছিল, খিমচে দিয়েছিল। কিন্তু তখন আমি পাগল।
কখন মারলে?
প্রথমে মারিনি। ওখানে বসে বসে ঘণ্টা দুই-তিন দু’জনে ড্রিঙ্ক করি। অনেক কথা হয়।
প্রেমের কথা?
ওইরকমই সব। ও আমাকে বলছিল যে ও ভজনবাবুকে ভালবাসে, তাই কিছু করার নেই। তবে আমার কথা ওর মনে থাকবে–এইসব।
আগে বাঢ়ো। কখন রেপ করেছিলে?
রাত ন’টা সাড়ে ন’টা হবে। যখন চেঁচাল তখন মুখ চাপা দিতে হয়েছিল।
আগে বাঢ়ো।
ও বলেছিল সবকিছু বলে দেবে সবাইকে। আমি ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তখন শালা আমিও তো মাতাল। কী কথায় কী কথা হল মাথায় কীরকম রক্ত চড়ে গেল।
গলা টিপে?
তাই হবে মনে হয়। কী করেছি। খেয়াল নেই। ওখানে বসে আরও মদ খেলাম। রাত একটা নাগাদ বৃষ্টি নামল। তখন নিয়ে গিয়ে মাঠটায় ফেললাম।
লাশটা সরালে কেন?
মনে হয়েছিল ওখানে পুলিশের কুকুর আমার গন্ধ পাবে। মদের বোতলটাও অন্ধকারে কোথায় ছুড়ে ফেলেছিলাম। মনে হল, বোতল পেলে সর্বনাশ।
পুলিশের কাছে কনফেস করবে?
না করলে?
শোনো হাবু, কনফেস করলে তোমার সাজা হবে। যদি বাইচান্স তুমি ছাড়া পেয়ে যাও তা হলেও আমার হাত থেকে বাঁচবে না। আর কনফেস যদি না করো তা হলেও বাঁচবে না। আমি তোমাকে মারবই।
যদি সাজা হয়?
তা হলে আমার কিছু আর করার থাকবে না।
আমাকে রাতটা ভাবতে দিন।
শবর হাসল, পালাবে না পাঁচুবাবুর বাড়ি যাবে? যা-ই করো, আমার হাত থেকে রেহাই নেই। শুনে রাখো, আমার চেয়ে বড় গুন্ড এখনও জন্মায়নি। থানায় চলো।
এখনই।
হ্যাঁ। পাঁচুবাবু যদি তোমাকে ছাড়ানোর জন্য কাল সকালে থানায় আসে তা হলে তাকে বোলো, আমার হাতে র্তার নির্ঘাত মৃত্যু। কেউ ঠেকাতে পারবে না।
উনি আপনার কথা শুনে ভয় পাচ্ছিলেন।
খুব ভাল। চলো।
সময় দেবেন না একটু?
না। যা বললাম মনে রেখো।
৬. অন্যরকম দেখাচ্ছে
আপনাকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। কেন বলুন তো?
কীরকম?
স্যাড অ্যান্ড ক্রেস্টফলেন। মনে হচ্ছে কান্নাকাটিও করেছেন।
আপনি আমার এত বড় ক্ষতিটা কেন করলেন শবরবাবু?
ক্ষতি। সে কী! আমি কী করলাম?
মানুষটাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। দিব্যি ছিলাম। কেন আপনি আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেলেন?
ম্যাডাম, রুটিন ওয়ার্ক ছাড়া তো কিছু নয়।
ক’দিন ধরে আমি রাতে ঘুমোতে পারছি না, সবসময়ে কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।
কেন?
ওরকম মারা-খাওয়া চেহারা, ওরকম ভেঙে-পড়া, আর হাতজোড় করে ওই ক্ষমা চাওয়া–কী করে ভুলি! কতবার ইচ্ছে হয়েছে একাই গিয়ে দেখা করি, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করি, কিংবা কী যে সব মাথামুণ্ডু ভেবেছি।
এবং কেঁদেছেন!
হ্যাঁ।
কান্নার কী আছে?
বেশ করেছি। কেঁদেছি যে কেউ কাঁদবে।
শবর হাসল, আর কী হল বলুন। কোনও সিদ্ধান্তে এলেন?
কী সিদ্ধান্তে আসব? আপনাদের মামলা কতদূর?
শেষের দিকে।
তার মানে কী। চার্জশিট দেওয়া হয়ে গেছে?
চার্জশিট তৈরি হচ্ছে।
তা হলে ওর রেহাই নেই।
না। উনি রেহাই পেলেই বা আপনার কী?
তা ঠিক। কিন্তু–
কিন্তু কী?
আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
তা তো হতেই পারে। কিন্তু তা বলে তো একজন ক্রিমিন্যালকে ক্ষমা করা যায় না।
ক্ষমা না হয় না-ই করলেন। অপরাধ করে থাকলে শাস্তি হোক। কিন্তু ওরকমভাবে মারে কেউ?
মানছি মারটা একটু বেশি হয়ে গেছে। অন্য কেউ হলে হয়তো মরেই যেত। ভজন আচাৰ্য খুব শক্ত ধাতুতে গড়া। হান্ড্রেড পারসন।
স্বাস্থ্য ভাল বলে বলছেন?
না। স্বাস্থ্যের চেয়েও মজবুত ওর মন। এ কারেজিয়াস ম্যান।
কী লাভ আর তাতে?
লাভ নেই। অবশ্য।
কী পানিশমেন্ট হবে ওর বলুন তো! ফাঁসি?