আপনি কি ভজনবাবুকে চেনেন?
শ্যামলী হঠাৎ স্থির চোখে চেয়ে বলল, হঠাৎ এ কথা কেন?
বলতে আপত্তি আছে কি?
ওকে কি আমার চেনার কথা?
বলা তো যায় না।
আমি আট বছর আগে চলে গেছি, ও তখন এখানে আসেনি।
সেটা জানি। যে জমিতে ভজনবাবুর গ্যারেজ তার মালিক ছিলেন সুজিতবাবুর কাকা বরুণ গুণ।
তা হতে পারে।
খবর হল, সুজিতবাবুই ভজন আচাৰ্যকে জমিটা কিনতে সাহায্য করেন।
আমি অত জানি না।
সুজিতবাবু ও ভজনবাবুর মধ্যে পুরনো বন্ধুত্ব ছিল।
আমি সেসবের খবর রাখি না।
ভজনবাবু কানপুরে আপনাদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেছেন।
শ্যামলী স্তব্ধ হয়ে রইল কিছুক্ষণ।
কিছু বলবেন না?
শ্যামলী একটুও না ঘাবড়ে তার দিকে সপাটে চেয়ে বলল, যদি তাই হয় তাতেই বা কী হল?
কী থেকে যে কী হয় কে বলতে পারে?
ভজনকে আমি চিনতাম। এবার কি ফাঁসি দেবেন আমাকে?
না। ফাঁসির দড়ি ভজনবাবুর জন্যই থাক। আপনি তো ওকে নিজের হাতে খুন করতে চেয়েছিলেন।
এখনও চাই।
যদি ভজনবাবু নির্দোষ বলে প্রমাণিত হন?
তবুও–
বলেই থমকে গেল শ্যামলী। সুর পালটে বলল, তা হলে অন্য কথা। কিন্তু ও ছাড়া আর কেউ কালপ্রিট নয়।
ঠিক জানেন?
জানি।
খুনের রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?
তার মানে?
কৌতূহল।
শ্যামলী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কলকাতায়। তিলজলায় আমাদের একটা ফ্ল্যাট আছে।
রিঙ্কুর মৃত্যুর খবর কখন কীভাবে পেলেন?
প্ৰথমে খবরের কাগজে। তারপর টেলিগ্রাম পেয়ে কানপুর থেকে সুজিতও টেলিফোন করে।
আপনি তবু দু’দিন পরে বারাসতে এলেন কেন? মেয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও কি মা দেরি করতে পারে?
পারে, যদি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় এবং অসুস্থ হয়ে পড়ে।
কোয়াইট পসিবল। এবং খুব সম্ভব। আপনি যে কলকাতায় আছেন তা শচীনবাবুকে জানাতে চাননি। আপনি ডিভোর্সি স্বামীর বাড়িতে উঠলেন কেন?
তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?
তা নয়, তবু প্রোটোকলে আটকায় হয়তো।
বারাসতে আমার ওঠার জায়গা নেই। বাপের বাড়ি বা সুজিতের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তা ছাড়া এ বাড়িটা বিরাট বড়, নীচের তলার এই পোরশনটা আমার জন্য আলাদা করে করা হয়েছিল, বাড়ির অশান্তি এড়ানোর জন্য।
বুঝেছি। একটা কথা আপনাকে জানানো দরকার।
কী বলুন তো!
রিঙ্কুর পেটে অ্যালকোহল পাওয়া গেছে।
কে বলল?
পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট। একটু ডিলেইড রিপোর্ট।
তার মানে কী? কেউ ওকে মদ খাইয়ে রেপ করেছিল?
সেরকমই অনুমান।
ও।
ভজনবাবু মদ খান না।
ওতে কিছু প্ৰমাণিত হয় না।
ভজনবাবুর ফাঁসিটা দেখছি একটা পপুলার ডিমান্ড হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কোন শালা রে? কোন শুয়োরের বাচ্চা?
পুলিশ। দরজা খোলো।
ফোট শালা পুলিশ। ফোট বাঞ্চোৎ, খানকির ছেলে।
সঙ্গে মদন নামে যে সেপাইটা ছিল সে চাপা গলায় বলল, স্যার, এ ডেনজারাস ছেলে। মদ খেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। ফোর্স না নিয়ে আসা ঠিক হয়নি। চলুন, ফোর্স নিয়ে আসি।
না। মদন। গন্ধ পেলে পাখি উড়ে যাবে।
ঘর থেকে জঘন্য খিস্তি ভেসে আসছিল।
শবর কাঠের দরজাটায় একটা লাথি মারল। তাতে বোম ফাটার মতো একটা আওয়াজ করে দরজার তলার দিককার প্যানেলটা কিছু অংশ ফেটে গেল।
বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকার রাত। শব্দ শুনে আশপাশের বাড়ি থেকে ‘কে কে’ আওয়াজ উঠল। দু-একটা দরজা খুলে টর্চ মারল কেউ কেউ।
স্যার, এ পাড়া কিন্তু খারাপ। অ্যান্টিসোশ্যালদের ডেন। সবাই ঘিরে ফেললে বিপদ
হবে।
শবর নিম্পূহ গলায় বলল, কিছু হবে না। ভয় পেয়ো না। এই সাহস নিয়ে পুলিশে চাকরি করো কী করে?
ভিতরের খিস্তি বন্ধ হয়েছে। এবার দরজার কাছ থেকে একটা মেয়ে গলা প্রশ্ন করল, কে?
দরজাটা খুলুন।
কেন খুলব?
তা হলে সরে দাড়ান। দরজা ভাঙা হবে।
হাবু বাড়ি নেই।
শবরের দ্বিতীয় লাথিতে দরজার খিল আর ছিটিকিনি উড়ে গেল। দরজাটা পটাৎ করে। খুলে হাঁ হতেই টর্চ হাতে ভিতরে ঢুকল শবর।
সামনেই একটা মেয়ে। বয়স বেশি নয়, উনিশ-কুড়ি।
তুমি কে?
আমি শেফালি, হাবুর বোন। দাদা বাড়ি নেই।
পথ ছাড়ো।
শবর তড়িৎ পায়ে দু’খানা ঘর ডিঙিয়ে উঠোনে নামল। উঠোনের পিছনে খোলা জমি। শবর মুখ ফিরিয়ে মদনকে বলল, ঘরটা সার্চ করো। ও পালিয়েছে, কিন্তু সাবধানের মার নেই।
ঠিক আছে স্যার।
শবর তার হোমওয়ার্ক করেই এসেছে। হাবুর সবরকম ঠেক তারা জানা। জমিটা পেরিয়ে সে ডান দিকের একটা কাঁচা রাস্তায় উঠে এল। রাস্তা পেরিয়ে রেললাইন। লাইন পার হয়ে সে একটা নাবালে নেমে স্বাভাবিক পদক্ষেপে হঁটিতে লাগল।
পাঁচু হালদারের বাড়িটা একতলা। সামনে ঘাসজমি আছে। সেটা পেরিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল শবর।
পাঁচু এবার পার্টির নমিনেশন পেয়েছে। ভোটে দাড়াবে। ক্ষমতাশালী লোক।
ভিতরে পাঁচুর গলা পাওয়া যাচ্ছিল, তা তুই এখানে এলি কেন?
কোথায় যাব?
বৃন্দাবনের কাছে চলে যা পিছন দিয়ে। পালা।
অত হুড়ো দিচ্ছেন কেন? যাচ্ছি। পুলিশ কি আর আপনার বাড়িতে আসবে?
যত্ত সব ঝামেলা। এখন গিয়ে গা-ঢাকা দে, কাল সকালে দেখা যাবে।
ফালতু আমার ওপর হামলা করছে পাঁচুদা।
এখন যা। কাল সকালে দেখব। যা।
একটা দরজা খোলার শব্দ হল পিছন দিকে।
পিছনে আধা জংলা পতিত জমি। কয়েকটা বড় গাছ। বৃষ্টি পড়ছিল। হাবু ছুটছিল প্ৰাণপণে। মাটি পিছিল, বিপজ্জনক, পেটে মদের গ্যাঁজলা, ঠিক ব্যালান্স নেই শরীরের।
পিছন থেকে ছায়ামূর্তিটা কখন এগিয়ে এল সে বুঝতেই পারেনি। একটা মজবুত হাত তার কাঁধের কাছে জামাটা চেপে ধরল। তারপর একটা প্ৰবল ঝাঁকুনি। আপনা থেকেই প্যান্টের পকেটে হাত চলে গিয়েছিল হাবুর। রিভলভারটা ধরেও ফেলেছিল। কিন্তু বের করতে পারল না। তার আগেই একটা বিদ্যুৎগতির ঘুসি তাকে শুইয়ে দিল।