- বইয়ের নামঃ প্ৰজাপতির মৃত্যু ও পুনর্জন্ম
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. ভীষণ ভীষণ ঘেন্না
লোকটাকে আমি ভীষণ ভীষণ ঘেন্না করি।
কেন?
লোকটা একটা নরপশু।
ধারণাটা হল কেন?
কেন আবার! অভিজ্ঞতা থেকে জানি।
আপনার সঙ্গে ওর বিবাহিত জীবন কতদিনের?
মাত্র সাত দিনের।
মাত্ৰ সাত দিন বাদেই আপনি চলে আসেন?
বিয়ের, মানে ফুলশয্যার পরদিন সকালেই চলে আসার কথা। আসিনি। লোকলজ্জা বাধা হয়েছিল।
লোকটা আপনার ওপর ফিজিক্যাল টর্চার করেছিল কি?
মানে মারধর?
হ্যাঁ।
মারধরের চেয়ে অনেক বেশি।
আপনি কি বলতে চান লোকটার সেক্স একটু বেশি?
একটু বেশি? একটু বেশি বললে কিছুই বলা হয় না।
তা হলে খুব বেশি?
আমি আর কিছু বলতে চাই না। লজ্জার কথা এভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে লোকটা নরপশু, জেনে রাখুন।
বুঝলাম, আপনি তার দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন।
হ্যাঁ। আমাকে পালিয়ে আসতে হয়েছিল।
এটা কতদিন আগেকার ঘটনা?
দেড় বছর।
এই দেড় বছরের মধ্যে আর কোনও যোগাযোগ হয়নি?
ওর সঙ্গে নয়। তবে ওর বাড়ির কেউ কেউ আমার কাছে আজও আসে, খোঁজখবর নেয়। তারা আমার জন্য দুঃখিত।
লোকটির সঙ্গে আপনার শেষ দেখা তা হলে দেড় বছর আগে?
হ্যাঁ।
আপনি ডিভোর্সের মামলা করেননি?
না।
কেন?
ডিভোর্স করেই বা কী হবে বলুন। আমি তো আর বিয়ে করতে যাচ্ছি না।
তাই বা কেন?
একবারের অভিজ্ঞতায় আমি এত আতঙ্কিত যে আর ও কথা ভাবতেও ইচ্ছে করে না।
আপনি কি ভজনবাবুর কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পান?
হ্যাঁ পাই। ওর বাড়ির লোকেরা খারাপ নয়, তারাই একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মাসে মাসে টাকা দিয়ে যায়।
ভজনবাবু নিজেই আসেন টাকা দিতে?
না না। তার অত সাহস নেই। আসে ওর ছোটভাই পূজন।।
আপনি তো চাকরি করেন।
করি।
কোথায়?
আলফা নেটওয়ার্ক-এর মার্কেটিং ডিভিশনে।
সেটা কেমন চাকরি?
ভালই। আমি একজন একজিকিউটিভ।
তা হলে ভজনবাবুর সাহায্য না হলেও চলে?
কেন চলবে না?
আপনার বাপের বাড়ির অবস্থাও তো ভালই দেখছি।
খারাপ নয়। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার, সুরেন্কা ইন্ডাস্ট্রিজের ওয়ার্কস ডিরেক্টর। আমার দাদা আমেরিকায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
ভজনবাবুর সাহায্য তবু আপনি নেন?
কেন নেব না? সে আমার জীবনটাকে নষ্ট করেছে। তার কিছু ক্ষতিপূরণ তো ওকে করতে হবে।
তা তো বটেই। এবার একটা ডেলিকেট প্রশ্ন।
বলুন।
ইজ হি ক্যাপেবল অফ মার্ডার?
তা কী করে বলব? আমার সঙ্গে পরিচয় তো সামান্য।
আপনি তো ওকে নরপশু বললেন।
তা তো বলেইছি।
আপনার কি মনে হয় লোকটা খুব হিংস্ৰ?
অন্তত একটা ব্যাপারে তো তাই।
একটা ব্যাপার থেকেও তো কিছু আন্দাজ করা যায়।
এবার আমাকে একটু মুশকিলে ফেলেছেন।
কেন বলুন তো।
লোকটাকে কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে খুব নিরীহ মনে হয়।
সেটা কেমন?
এমনিতে চুপচাপ, মাথা নিচু করে থাকে।
তাতে কি নিরীহ বলে প্ৰমাণ হয়?
না। তা হয় না।
তা হলে?
ফুলশয্যার পরদিন সকালে আমার অবস্থা দেখে ওর এক বোন সব কথা বাড়ির লোককে বলে দেয়। ওর বাড়ির লোক ওকে খুব বকাঝকা করেছিল। লোকটা খুব যেন অপরাধবোধে কাতর হয়েছিল। তবে সেটা অভিনয়ও হতে পারে।
আমার জানা দরকার লোকটা খুনটুন করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে কি না।
তা জানি না।
এবার একটা কথা বলি।
বলুন।
খুন সবাই করতে পারে না। খুন করার জন্য একটু আলাদা এলেম দরকার হয়। এক ধরনের মানসিকতার।
তা হবে।
এ লোকটার সেই মানসিকতা আছে কি না। আমি সেইটে জানার চেষ্টা করছি।
বলেছি তো, লোকটাকে আমি ভাল করে চিনি না।
একটা কথা।
বলুন।
আপনি একজন শিক্ষিতা মহিলা, আপনার পরিবারও বেশ কালচার্ড। আপনি ভজনবাবুর মতো একজন গ্যারেজ মালিককে বিয়ে করলেন কেন?
গ্যারেজ মালিক হলেও ভজন অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। একসময়ে ভাল মোটর তৈরির কারখানায় কাজ করত। তারপর নিজে স্বাধীনভাবে ব্যাবসা শুরু করে। শুনেছি। ওর গ্যারেজে নতুন ডিজাইনের দু-তিনটে গাড়ি তৈরি করে চড়া দামে বিক্রি করেছে।
শুধু সেই কারণ?
আমার বাবা স্বাধীনচিত্ত পুরুষকে খুব পছন্দ করেন।
শুধু প্রফেশনের দিকটা ছাড়া আপনারা আর কিছু দেখেননি?
এটা নেগোসিয়েটেড ম্যারেজ ছিল। আমি বাবার মতে মত দিয়েছিলাম মাত্র। লোকটার যেসব বিবরণ পেয়েছিলাম তাতে খারাপ লাগেনি।
বিয়ের আগে আপনারা পরস্পরকে দেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
আপনার পছন্দ হয়েছিল?
চেহারাটা খারাপ লাগেনি। বিনয়ী ভাবাটাও তো ভালই মনে হয়েছিল।
ওঁর বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ উঠেছে সে তো জানেন।…
হ্যাঁ।
আপনি ওঁর মোটর গ্যারেজে কখনও গেছেন?
না। যাওয়ার মতো সময় তো পাইনি। বিয়ের পরই তো চলে এলাম।
কারখানাটা কোথায় তা জানেন?
শুনেছি, কলকাতার বাইরে বারাসাতের কাছে কোথায় যেন।
হ্যাঁ। খুনের ডিটেলসটা জানেন কি?
না। শুনেছি। একটি মেয়ে খুন হয়েছে।
হ্যাঁ। তার আগে একটা প্রশ্ন।
বলুন।
আপনি শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসার পর পুলিশে ভজনবাবুর বিরুদ্ধে একটা ডায়েরি করেন।
হ্যাঁ, রাগের মাথায় করেছিলাম।
তাতে কি ওর সেক্সচুয়াল ব্রুটালিটির উল্লেখ ছিল?
ছিল। কিন্তু রাগে অন্ধ হয়ে ডায়েরি করেছিলাম। পরে কেলেঙ্কারির ভয়ে উইথড্র করি।
হ্যাঁ, আমরা তা জানি। পুলিশ ভজনবাবুকে ধরেও আপনার বাবার অনুরোধে এক রাত্তির পরেই ছেড়ে দেয়।
আমরা পারিবারিক দুর্নামের ভয়ে এটা করি।
এই খুনের ঘটনার পর কি আপনার শ্বশুরবাড়ি থেকে কেউ আপনার কাছে এসেছিল?