ঝগড়া-কাজিয়া তেমন কিছু হয়নি। বেড়াল-অন্ত প্রাণ গন্ধ, কুকুর তার ভারী আদরের। বউ তাদের বেশি কিছু নয়। বিয়ে করলেই আবার একটা বউ হয়। কিন্তু গন্ধ বখেরায় যায়নি। একই সংসারে একটু আলাদা হয়ে থেকে গেছে। সেই বউ-ই এখনও ভাত বেড়ে দেয়, বাতের ব্যথায় রসুন-তেল গরম করে দেয়, বকাঝকাও করে। ওদিকে বহেরুর সন্তান ধারণ করে। কিন্তু সিঁদুর পরে গন্ধর নামে।
এরকম যে একটা গোলমেলে সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে গন্ধ, তাকে দেখলে মনে হয় না। বৈরাগীর মতো বসে আছে। মুখময় বিজবিজে দাড়ি। ছানি কাটা হয়নি, দু-চোখে স্পষ্ট মুসুরির ডালের মতো ছানি দুটো দেখা যায়। শীতে কাহিল হয়ে একটা কাঁথা জড়িয়ে বসে, গায়ে বহু পুরনো মিলিটারি পুলওভার, নিম্নাঙ্গে ময়লা ধুতি। ধুতিতে ঢাকা আছে ফুটবলের সাইজের হাইড্রোসিল। চলাফেরায় ভারী কষ্ট তার। এই নিয়ে কত হাসাহাসি করেছে সোমেন।
সামনে সামনে বসতেই বেড়ালগুলো মিটমিটে চোখে একটু চেয়েই চোখের ফসফরাস ঢেকে ফেলল। কুকুরগুলো একটু গর-র শব্দ করে শুয়ে-শুয়েই লেজ নাড়ে।
—গন্ধ, চিনতে পারো?
গন্ধ স্থবিরতা থেকে একটু জাগে। রোদ থেকে হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে বলে—কিছু দেখি না।
—আমি সোমেন, ব্ৰজকর্তার ছেলে।
—বড়জন?
—না। ছোট।
হাসে গন্ধ। বুঝদারের হাসি। হাত তুলে একটা মাপ দেখিয়ে বলে—এইটুকুন ছিলেন। আসেন না তো! বাপের জন্য প্রাণ টানে না?
—কলকাতা ছেড়ে আসা হয় না।
একটা শ্বাস ছাড়ে গন্ধ, বলে—সবাই তাই কয়।
—কী কয়?
—কলকাতা ছেড়ে আসা যায় না। সিগারেট নাই?
—আছে। খাবে?
—খাই।
হাত বাড়ায় গন্ধ। সোমেন সিগারেট দেয়। দন্তহীন মুখে সিগারেট বসিয়ে বড় আগ্রহে টানে গন্ধ। কাশে।
—কাশছ তো, খেয়ো না। সোমেন বলে।
হাঁপির টান তুলে কাশে গন্ধ, চোখে জল এসে যায়। হাতের উলটো পিঠে চোখের জল মুছে বলে—যত কষ্ট তত আরাম। এ কাশি আরামের। কতকাল খাই না কেউ দেয় না।
সিগারেটের গোড়া লালায় ভিজে গেছে। থুঃ করে জিভ থেকে তামাকের আঁশ ছিটিয়ে গন্ধ চোখ বুজে টানে। ঝপাস করে ধানের ওপর নেমে আসে কাক। গন্ধ হাত তুলে তাড়ায়—হেঃ ই।
—কেমন আছ গন্ধ?
—ভালই। বহেরু কষ্ট দেয় না।
—চোখটা কাটাও না কেন?
—দেখার কিছু নাই। কাটায়ে হবেটা কী? হাতায়ে হাতায়ে সব বুঝতে পারি। বেলাও ঠাহর পাই ধুয়া ধুয়া। খামোখা কাটায়ে হবেটা কী? খরচ।
—বিনা পয়সায়ও কাটে। সোমেন বলে—ক্যাম্প করে কাটে।
—ঝাঞ্ঝাট।
সিগারেটে প্রাণভরে টান মারে গন্ধ। কাশে। বড় আরাম পায়। সামলে নিয়ে বলে—বহেরুর খুব বাড়বাড়ন্ত দেখলেন সব?
—হুঁ।
—হাতের গুণ। গাছ ওরে ভালবাসে। আমারে ভালবাসে কুত্তা বিড়াল।
বহেরুর মেয়ে বিন্দু পেয়ালা-পিরিচে চা নিয়ে আসে। পিরিচে চা চলকে পড়েছিল, সেটুকু ঢেলে ফেলে দিয়ে পেয়ালা বসিয়ে যত্নে চা দিল। দুটো বিস্কুট।
শব্দে ঠাহর পেয়ে গন্ধ চেয়ে বলে, বিন্দু নাকি? কী দিলি ব্রজকর্তার ছেলেরে? চা?
—কেন? তুমি খাবা?
—খাই।
—দেব।
—ব্রজকর্তার ছেলেরে একটু রস খাওয়াবি না?
—ও রস তো শীতে হিম হয়ে আছে, খেলে ঠান্ডা লাগবে না!
—একটু আমারে দে।
—দেবো।
বলে বিন্দু চলে যায়। আর আসে না।
সোমেনের চা যখন শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, তখন গন্ধ বলে, তলানি থাকলে একটু দিবেন।
—এঁটো খাবে?
—সব খাই।
সংকোচের সঙ্গে কাপটা একটু চা সুদ্ধ এগিয়ে দেয় সোমেন। বড় শীত। গন্ধ কাপটা গালে চেপে ধরে তাপটা নেয়। আস্তে আস্তে টুকে টুকে খায়। বলে—বহেরু কষ্ট দেয় না। এরা দেয়। মাগিগুলি বজ্জাত। সব মাগি বজ্জাত। দেবে বলে কিছু দেয় না। উপোস থাকি।
বলে নিবিষ্ট মনে চা খায় গন্ধ। অল্প একটু তলানি, টপ করে ফুরিয়ে যায়। গন্ধ আঙুল দিয়ে কাপের তলার তলানির চিনি খোঁজে। গাঁ ঘরের চা, চিনি একটু বেশিই দেয় ওরা। সবটা গলে না। গন্ধ আঙুলের ডগায় ভেজা চিনি তুলে এনে আঙুল চোষে। একটা বেড়াল নির্দ্বিধায় তার কোলে উঠে আসে, কাপটা শোঁকে। মুখ থেকে আঙুলটা বের করে বেড়ালের মুখে ধরে গন্ধ। বেড়ালটা দু-একবার চাটন দেয়। তারপর নির্জীব হয়ে কোলেই বসে ঘুমোয়।
—ব্রজকর্তার খোঁজে আলেন নাকি?
—হ্যাঁ। কিন্তু বাবা তো নেই।
গন্ধ চুপ করে থাকে একটু। মাঝে মাঝে মাথাটা বোধ হয় ঝিম মেরে যায়। ধানের ওপর শালিখের হুড়াহুড়ি শুনে হাত বাড়িয়ে লগিটা নেয়। বলে—হেঃ ই।
তারপর বলে—আসে যাবেন যে-কোনও দিন। ব্ৰজকর্তার পায়ের নীচে সুপারি, আছেন ক’দিন?
—আজই চলে যাব। বাড়িতে ভাববে।
—বহেরুর কাণ্ডকারখানা দেখে যাবেন না? কত জমি জোত, ধান-পান, বিশ-তিরিশ মুনিশ খাটে। বহুত পয়সা বহেরুর।
—জানি।
গন্ধ হাত বাড়িয়ে বলে—দেন একটা।
—কী?
গন্ধ হাসে, চোখ ছোট করে বলে—সাদা কাঠি।
সোমেন বুঝতে পেরে একটা সিগারেট দেয়।
গন্ধ সিগারেটটা নাকের কাছে নিয়ে কাঁচা সিগারেটের গন্ধ নেয়। হাত বাড়িয়ে বলে—দেশলাইটা রেখে যান, পরে খাব।
সোমেন দেশলাই দিয়ে দেয়। খালি কাপটা নিয়ে বেড়ালের খেলা শুরু হয়ে গেছে। শক্ত ঝুনো উঠোনে টঙাস করে কাপটা ঢলে পড়ে। গন্ধ মুখ তুলে বলে—ব্রজকর্তারে বুঝয়ে-সুঝায়ে নিয়ে যান বাড়ি। বুড়ো বয়সে কখন কী হয়।
সোমেন চুপ করে থাকে। মনে পড়ে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।
গন্ধ নিচু গলায় বলে—এখানে সব শালা পাজি। বহেরু ভাল। কষ্ট দিতে চায় না। কিন্তু মাগিগুলো—এগারো হাতে কাছা নাই যার—ওই গুলান খচ্চর।