- বইয়ের নামঃ লাল নীল মানুষ
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-৪. কুঞ্জনাথকে খুন
০১.
কুঞ্জনাথকে খুন করবে বলে তিনটে লোক মাঠের মধ্যে বসে ছিল। পটল, রেবন্ত আর কালিদাস।
কুঞ্জনাথ এ পথেই বোজ আসে। আজও আসবে।
রাত তেমন কিছু হয়নি। তবে নিশুত দেখাচ্ছে বটে। মাঘের এই মাঝামাঝি সময়টায় এইদিকে ডাহা শীত। তবে ইদানীং যেমন সব কিছু পাল্টে যাচ্ছে তেমনি হাওয়া বাতাসও। শীত নেই যে তা নয়, বরং শরীরে কালশিরে ফেলে দেওয়ার জোগাড়। এমন ঠাণ্ডা যে মনে হয় চারপাশের বাতাস দেয়ালের মতো জমে গেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আজ বিকেল থেকে এক ঝোড়ো হাওয়া কোত্থেকে নোংরা কাগজ উড়িয়ে আনার মতো একখানা মেঘ এনে ফেলল। সেই মেঘের ছোট টুকরোটাকেই বেলুনের মতো ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে অ্যাত্তো বড় করে এখন আকাশ ঢেকে ফেলেছে। খুব কালো হয়েছে চারধার। ভেজা মাটির গন্ধ আসছে।
তিনজনই আকাশে চেয়ে দেখে বার বার। জল এলে এই খোলা মাঠে বসে থাকা যাবে না। দৌড়ে গিয়ে কোথাও উঠতেই হবে। কুঞ্জনাথও দুর্যোগে খাল পেরিয়ে মাঠের পথে আসবে না। পিচ রাস্তায় ঘুরে যাবে। যদি তাই হয় তো কুঞ্জনাথের আরও এক দিনের আয়ু আছে, তা খণ্ডাবে কে? কিন্তু এ সব কাজ ফেলে রাখলে পরে আলিস্যি আসে, ধর্মভয়ও এসে যেতে পারে। রাত মোটে নটা। কুঞ্জনাথ স্টেশনে নামবে ছটা দশের গাড়িতে। সাড়ে ছটার পর আসবার বাস নেই। সুতরাং ওই সাড়ে ছটার বাসেই তাকে চাপতে হবে। বাজারে এসে নামতে নামতে সাড়ে সাতটা। কুঞ্জনাথ এখানে না নেমে আগের গাঁ শ্যামপুরেও নামতে পারে। তার কত কাজ চারদিকে! তা হলেও গড়িয়ে গড়িয়ে এখন সময় যা হয়েছে তাতে কুঞ্জনাথের এই বেলা আসার কথা। এখন কুঞ্জনাথই আগে আসে, না জল ঝড়ই আগে আসে সেটাই ভাবনা।
ছাতা নিয়ে বড় একটা কেউ খুন করতে বেরোয় না। এই তিনজনও বেরোয়নি। জল এলে ভরসা এক কাছেপিঠে হাবুর বাড়ি। তা সেও বড় হাতের নাগালে নয়। পুকুরপাড় ধরে ছুটে দু-দুটো বাগান পেরিয়ে তবে। তা করতে ভিজে জাম্বুবান হয়ে যাবে তারা।
পটলের হাতে একখানা ভারী কষাই-ছুরি আছে। এটাই কাজ সারার অস্ত্র। কুঞ্জনাথ যাতে আবার জোড়া-তাড়া দিয়ে না উঠতে পারে তার জন্য এবার ঠিক হয়েছে মুণ্ডু আর ধড় আলাদা করে দুটো কম করে দশ হাত তফাতে রেখে ভাল করে টর্চ মেরে দেখে নিতে হবে কাজটা সমাধা হয়েছে কি না। এর আগে কুঞ্জনাথ দুবার জোড়া দিয়ে উঠেছে।
কালিদাসের ধারণা কুঞ্জনাথের পকেটে হোমিওপ্যাথির একটা ওষুধ থাকে। মরার সময়ে টপ করে এক ফাঁকে খেয়ে নেয়। তাইতে জীয়নকাঠি ছোঁয়ার মতো ওর প্রাণটা ধুক ধুক করতে থাকে নাগাড়ে। ফলে শেষ পর্যন্ত ডাক্তাররা সেলাই-টেলাই করে দিলে বেঁচেও যায়। কুঞ্জর বাপ হরিনাথ মস্ত হোমিও ডাক্তার ছিলেন। মরা মানুষ আকছার বাঁচাতেন। তিনি থাকতে এ অঞ্চলের লোকে সাপের বিষকে জল বলে ভাবত। কলেরাকে দাস্তর বেশি কিছু মনে করত না। এমনকী এত বিশ্বাস ছিল লোকের যে, মড়া শ্মশানে নেওয়ার পথেও হরি ডাক্তারকে একবার দেখিয়ে নিয়ে যেত। যদি বাঁচে।
মানুষের এমনি বাঁচার আকাঙ্ক্ষা! ভাবতে ভাবতে কালিদাস মনের ভুলে হাতের টর্চটা জ্বেলে ফেলল। ফটফটে আলো ফুটে ওঠে ঝোপঝাড়ে, রাস্তার সাদা মাটিতে। আলো জ্বালার কথা ছিল না। রেবন্ত হেঃ ই করে উঠতেই কালিদাস কল টিপে আলো নেভায়।
পটল জানে আসল কাজটা তাকেই করতে হবে। রেবন্তর হাতে একটা মোটা লাঠি আছে, কালিদাসের কাছে টর্চ ছাড়াও একটা হালকা পলকা ছুরি আছে। কিন্তু কাজের সময় যত দায় তারই! লোকে জানে, তার হল পাকা হাত। তবু ঠিক কাজের সময়টায় পটল ভেতরে ভেতরে কেমন থম ধরে থাকে। একটু বেখাপ্পা কিছু শব্দ সাড়া বা স্পর্শ ঘটলে সে তিন হাত লাফিয়ে ওঠে। টর্চের আলোতেও সে তেমনি চমকে গেল। একবার শুধু দাঁত কিড়মিড় করে। পটল টের পাচ্ছে, তার হাঁফির টানটা ঠাণ্ডায় কিছু তেজি হয়েছে। বুকে শব্দ হচ্ছে। মুখ দিয়ে রাশি রাশি বাতাস টানতে হচ্ছে। সাবধানে কিছু কেশে সে গয়ের ফেলল। এই রোগেই কি একদিন সে মরবে?
রেবন্ত হাতের আড়াল করে সিগারেট টানছে। সব ব্যাপারেই তার মাথা ঠাণ্ডা। অন্তত দেখায় তাই। কিন্তু আসলে সে তার কিশোরী শালী বনাকে ভাবছে। সবসময়েই আজকাল সে বনাকে ভাবে। সে যে ভাবে তা দুনিয়ার আর কেউ টের পায় না। বনাও না। যদি অন্তর্যামী কেউ থাকেন তো তিনি জানেন। আর কারও জানার উপায় নেই। বনাকে ভাবে, কারণ তাকে কোনওদিন পাবে না রেবন্ত। বনা স্বপ্নেও জানে না কখনও যে, তাকে রেবন্ত ভাবে। কিন্তু ওই একটুই রেবন্তর জীবনের আনন্দ। দুঃখ, বিষাদ, উৎসব, আমোদ, আতঙ্ক যাই ঘটুক জীবনে রেবন্ত তৎক্ষণাৎ বনাকে ভাবতে শুরু করে। আর তখন চোখের সামনের ঘটনাটা আর তাকে স্পর্শ করে না। সে একদম বনাময় হয়ে যায়। এখনও তাই হয়ে আছে সে। একটু বাদেই রক্ত ছিটকোবে, হাড় মাসে ইস্পাতের শব্দ উঠবে, গোঙানি, চেঁচানি কত কী ঘটতে থাকবে। এ সময়েও বনার চিন্তা তাকে অন্যমনস্ক রেখেছে। সব সময়ে রাখে। তাই তাকে ভারী ঠাণ্ডা আর ধীর স্থির দেখায়।
কুঞ্জর সঙ্গে রবি থাকবে। আর সেইটেই কালিদাসের চিন্তা। কুঞ্জকে মারার করা, রবিকে নয়। কালিদাসের ক্ষুদ্র বুদ্ধি। সে বোঝে, রবির বেঁচে থাকা মানে সাক্ষী রইল। রবি অবশ্য পালাবে। তা পালালেও কিছু না কিছু তো তার নজরে পড়বেই! সাক্ষীর শেষ রাখাটা ঠিক হচ্ছে কিনা তা সে ভেবে পায় না। যাই হোক, কুঞ্জর যে আজ আর শেষ রাখা হবে না তা কালিদাস খুব জানে। মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, কুঞ্জ প্রথম জখমে মুখ থুবড়ে পড়লেই সে গিয়ে তার পকেট হাতড়ে হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশিটা সরিয়ে ফেলবে। এর আগের বার গলার নলি কাটা পড়েও কুঞ্জ বেঁচে যায়। তারও আগে বল্লম খেয়ে বুক এফোঁড় ওফোঁড় হয়েছিল। কুঞ্জ মরেনি। হোমিওপ্যাথি ছাড়া আর কী হতে পারে? কালিদাস অনেকক্ষণ ধরেই টের পাচ্ছে যে, পটলের হাঁফির টান উঠেছে। কাশছে মাঝে মাঝে।
খালের ওধারে সরু পিচের রাস্তা কল্যাণী কটন মিল অবধি গেছে। সেই রাস্তা থেকে আবার একটা পিচরাস্তা বাঁ ধারে ধনুকের মতো বেঁকে হাইস্কুলের বাহারি বাড়িটার গা ঘেঁষে তেঁতুলতলায় ঢুকেছে। তেঁতুলতলায় গা ঘেঁষাঘেঁষি লোকবসতি। বাইরের লোকজন নয়, তেঁতুলতলায় কল্যাণী কটন মিলের মালিক ভঞ্জদের বাস। তারাই একশো ঘর। জ্ঞাতিগুষ্টি দূরে যারা ছিল তারাও কিছু এসে গেড়ে বসেছে। ভঞ্জদের জামাই বংশও আছে কয়েক ঘর। কুঞ্জনাথের বাবা হরিনাথও ছিল এদের জামাই।
পিচ রাস্তা দিয়ে গুড় গুড় করে একটা স্কুটার গেল। খুব জোর যাচ্ছে। ধনুকের মতো বাঁকা পথে সেটা ঢুকতেই আলো দেখা গেল। রেবন্ত বহু দূরের আলোটা দেখে। গিরিধারী ভঞ্জই হবে। ললিতমোহনের এই একটি ছেলেই কিছু শৌখিন। স্টেশনের কাছে চায়ের দোকানে স্কুটার জমা রেখে রোজ ট্রেন ধরে কলকাতায় ফুর্তি করতে যায়। এতক্ষণে ফিরছে। তবে কুঞ্জর আসারও আর দেরি নেই।
কিন্তু বৃষ্টিও আসছে। ঠেকানো গেল না। বহু দূরের মাঠে বৃষ্টির ঝিন ঝিন শব্দ।
.
০২.
বাজারের মধ্যে ব্রজেশ্বরী গ্রন্থাগার। আসলে পুরোটাই এক মুদিখানা। একধারে হলদি কাঠের একটা মাঝারি আলমারিতে শ দুয়েক বই। আলমারির পাশে একটা চৌকি। তাতে মাদুর পাতা। চৌকির মাঝামাঝি একটা জানালা। ওপাশে খাল। গাছপালার ডগা জানলায় উঁকি মারে।
চৌকিতে বসে জানালার বাইরে ঘরের বিজলি বাতির আভায় যতটুকু দেখা যায় ততটুকু অন্ধকারে মাখা একটু সবুজ দেখছিল রাজু। খুব মন দিয়ে দেখছিল।
গ্রন্থাগার আর মুদির দোকান একসঙ্গে চালায় তেজেন। তার একটু লেখালেখির বাতিক আছে। রাজু এর আগে আরও কয়েকবার এসেছিল, তখন তেজেন তাকে গল্প, কবিতা আর প্রবন্ধ শুনিয়েছে। রাজু হাঁ হকিছুবলেনি। লেখা যেমনই হোক তেজেন লোকটা ভারী সরল। বি এ পাশ করে বসে বসে এইসব করে। প্রায়ই বলে আমার কিছু হবে না, না রাজুবাবু?
গ্লাসের চা শেষ হয়ে গেছে। তেজেন পান আনাল। কুঞ্জ এক ভদ্রলোকের সঙ্গে বৈষয়িক কথাবার্তা বলছে।
রাজুর হাতে পান দিয়ে তেজেন বলে–আপনি কিন্তু খুব রোগা হয়ে গেছেন।
রাজুকে এ কথাটা ভীষণ চমকে দেয়। বুকে ঘুলিয়ে ওঠে একটা ভয়। মাথা দপ দপ করতে থাকে। কুঞ্জ তেজেনের দিকে চেয়ে চোখ টিপল। তারপর পানের পিক ফেলে–তোর মাথা। এই শীতে সকলেরই শরীরের রস কষ কিছু টেনে যায়।
না। কিন্তু– তেজেন আরও কী বলতে যায়। কুঞ্জর ইঙ্গিতটা সে ধরতে পারেনি।
কুঞ্জ টপ করে বলে রাজুর ঝোলায় দুটো বই আছে। চাইলেই রাজু তোর লাইব্রেরিতে দিয়ে দেবে।
রাজুর দিকে চেয়ে তেজেন সোৎসাহে বলে কী বই?
রাজুর মুখটা সাদা দেখাচ্ছিল। চোখে একটা জ্বলজ্বলে চাউনি। শ্বাস জোরে চলছে। তেজেনের চোখেও ব্যাপারটা ধরা পড়ল।
মুখ নামিয়ে রাজু তার শান্তিনিকেতনি ঝোলায় হাত পুরে দুটো বই বের করে দেয়। একটা নভেম্বর মাসের রিডারস ডাইজেস্ট আর একটা ইউ এস আই এস থেকে পাওয়া সল বেলোর উপন্যাস। তেজেনের লাইব্রেরির সভ্যরা ছোঁবেও না। তবু তেজেন খুশি হয়ে বলে–যদি দেন তো দু লাইন উপহার বলে লিখে দেবেন।
রাজু একটু হেসে বলে দিলাম। লেখা-টেখার দরকার নেই।
এই তেজেনের দিকে চেয়েই রাজুর বুকের ভয়টা একটু থিতিয়ে পড়ে। বই-পাগল সাহিত্য-পাগল এই ছেলেটা কী ব্যর্থ চেষ্টায় লাইব্রেরি বানানোর কাজে লেগে আছে। ছোট থেকে এখন কেউ বড় হয় না। সে যুগ আর নেই। তেজেনের দিকে চেয়ে রাজু ওর ব্যর্থতাকে দেখতে পায়। ভারী মায়া হয় তার।
রবি কোথায় গিয়েছিল। একটা থলে হাতে দরজায় উদয় হয়ে বলল-জল আসছে কুঞ্জদা।
চল। কুঞ্জ বলে-ওঠ রে রাজু।
তেজেন জিজ্ঞেস করে–আছেন তো কয়েকদিন?
রাজু মাথা নাড়েনা, কাল পরশুই ফিরব।
–থাকুন না কদিন। একদিন সবাই মিলে বসি একসঙ্গে। এদিকে তো সাহিত্য নিয়ে কথা বলার লোক নেই।
–আবার আসব।
রাজু উঠে পড়ে।
রাস্তায় নেমে এসে যে তারা হন হন করে হাঁটা দেবে তার জো নেই। দুপা এগোতে এগোতেই কেউ না কেউ কুঞ্জকে ডাকবেই। ও কুঞ্জদা! কুঞ্জবাবু নাকি? এই কুঞ্জ।
সেবার কুঞ্জ ভোটে দাঁড়িয়ে খুব অল্পের জন্য হেরে যায়। তখন পুরনো কংগ্রেসে ছিল। তারপর হাওয়া বুঝে নতুন কংগ্রেসে নাম লেখাল। কিন্তু নমিনেশন পেল না। এখন রাজনীতির হাওয়া এত উল্টোপাল্টা যে, কোন দলে নাম লেখাবে তা বুঝতে পারছে না। তবে হাল ছাড়েনি। বাপ কিছু টাকা বোধ হয় রেখে গেছে, জমি আছে, বুড়ি দিদিমাও নাকি মরার সময় কিছু লিখে-টিখে দিতে পারে। তবে ভাগীদারও অনেক। ভাইরা আছে, তিন তিনটে বোন বিয়ের বাকি। কুঞ্জর সবচেয়ে বড় মূলধন তার মুখের মিষ্টি কথা। শরীরে রাগ নেই। কাউকে অবহেলা করে না। ওই আকাট বোকা রবি যে রবি সেও কুঞ্জর কাছে যথেষ্ট মূল্য পায়। তাই আঠা হয়ে লেগে থাকে। দু-দুবার কুঞ্জ মরতে মরতে বেঁচেছে। ঘাড়ের জখমের জন্য এখনও বাঁ দিকে মুখ ঘোরাতে পারে না ভাল করে। ঠাণ্ডা লাগলে ডান দিকের ফুসফুসে জল জমে যাওয়ার ভয় থাকে। তবু সে থেমে নেই। তার এই অসম্ভব কাজে ব্যস্ত জীবনটাকে রাজু তেমন পছন্দ করে না। কিন্তু কুঞ্জকে সে যে ভালবাসে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
রাস্তায় তিন-চারজন লোক জুটল সঙ্গে। হাঁটার গতি কমে গেল। টর্চ জ্বেলে রবি পথ দেখাচ্ছে। চারদিকে নিকষ্যি অন্ধকার। আঁধারে রাজুর হাঁফ ধরে। সে কখনও আলো ভালবাসে, কখনও অন্ধকার, কখনও অনেক লোকজনের সঙ্গ তার পছন্দ, কখনও নির্জনতা। আজকাল তার এ সব হয়েছে। সেই যে একদিন সেই ভয়াবহ স্বপ্নটা দেখেছিল, তারপর থেকে…
রবি বাঁ ধারে টর্চ ফেলে দাঁড়িয়ে। বড় রাস্তা থেকে পায়ের পথ নেমে গেছে। খালের ওপর কাঠের সাঁকো। সাঁকো পেরিয়ে মেঠো পথে গেলে পথ অর্ধেক। রাজু অনেকবার গেছে।
লোকজন বিদায় নিল এখান থেকে। কুঞ্জ ডাকল রাজু, আয় রে।
রাজু সামনের গাছপালায় ঘন হয়ে ওঠা পাথুরে অন্ধকারের দিকে চেয়ে চাপা স্বরে বলে সাপ খোপ নেই তো!
বলেই রাজুর খেয়াল হয়, এ তার শহুরে ভয়। এখন শীতকাল, সাপ বড় বেরোয় না।
সাপের কথায় রবি টর্চের মুখ ঘুরিয়ে পিছনে ফেলে বলে–নেই আবার! মেলা আস্তিক। এই পোলের ধারেই তো কদমকে ঠুকেছিল। ইয়া চিতি! ওঝা ডাকার সময়ও দেয়নি।
কুঞ্জ বলল–ধুঃ! আয় তো। রোজ যাচ্ছি। রবিটার মাথায় কিছু নেই। কদমকে কামড়েছিল বদরুদের বেড়ার ধারে, সে কি এখানে?
পোলের ওপর উঠে রবি টর্চ মেরে জল দেখে খুব বিজ্ঞের মতো বলে দ্যাখো কুঞ্জদা, চিত্ত জানা ডিজেলে কেমন জল টানছে। এরপর কিন্তু কাদা ছাড়া খালে কিছু থাকবে না।
–তোর মাথা। চল, বৃষ্টি আসছে। কুঞ্জ সস্নেহে ধমক দেয়।
রাজু জানে, রবি একটা আস্ত ছাগল। বোধবুদ্ধি নেই, পেটে কথা রাখতে পারে না, রাস্তায় বেরোলেই লোকে পিছু লাগে, খ্যাপায়। অতিরিক্ত কথা কয় আর হাবিজাবি বকে বলে তিন মিনিটে লোকে ওকে বুঝে ফেলে, সঙ্গ এড়াতে চায়। কিন্তু ভোটপ্রার্থী কুঞ্জ হচ্ছে আলাদা ধাতের লোক। কারও ওপর না চটা, কাউকে এড়িয়ে না চলা, কাউকে অবহেলা বা অবজ্ঞা না করার একরকম অভ্যাস গজিয়ে গেছে তার। দিনের পর দিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এই বোকা রবি ছায়া হয়ে ঘুরছে তার সঙ্গে, তবু কুঞ্জর মাথা এখনও বিগডোয়নি।
রবিকে একটু আগু হতে দিয়ে কুঞ্জ আর রাজু পিছিয়ে পড়ল। কুঞ্জ নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে তনু চিঠিপত্র দিয়েছে?
–দেবে না কেন? প্রায়ই দেয়।
–সব ভাল তো?
রাজু মনে মনে একটু কষ্ট পায়। এই একটা ব্যাপারে কুঞ্জ বোধ হয় বোকা।
রবি সামনে এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন দিকে টর্চ ঘুরিয়ে বলে–পা চালাও কুঞ্জদা। এসে গেল জল।
কুঞ্জ বলে–তুই এগো। আমরা কথা কইতে কইতে যাচ্ছি।
রবি এগোয়।
কুঞ্জ আগে, রাজু পিছনে হাঁটে। রাস্তা অন্ধকার বটে, তবে ঘন ঘন আকাশের ঝিলিকে পথ বেশ দেখা যাচ্ছে।
রাজু জানে কুঞ্জ আর একটু কিছু শুনতে চায়। কিন্তু বলার কিছুই নেই। তনু স্বামীর ঘরে সুখেই আছে। কিন্তু সে কথা কি শুনতে চায় কুঞ্জ? বরং ওর ইচ্ছে, এখনও তনু ওর কথা ভেবে স্বামীর ঘর করতে করতেও একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলুক। প্রতি চিঠিতে কুঞ্জর কুশল জানতে চাক। সেই মধ্যযুগীয় ব্যাপার আর কী!
আর এই একটা জায়গাতেই কুঞ্জ বোকা।
একটু চুপ থেকে কুঞ্জ বলে সিতাংশুবাবুর এখন গ্রেড কত রে?
রাজু মৃদু স্বরে বলে-ইঞ্জিনিয়ারদের গ্রেড কে জানে বাবা? তবে শুনেছি, হাজার দেড়েকের ওপরে পায়।
–গাড়িও তো আছে?
এ সবই ভাল করে জানে কুঞ্জ। তবু প্রতিবার জিজ্ঞেস করে। এখনও কি নিজের সঙ্গে সিতাংশুকে মনে মনে মিলিয়ে দেখে কুঞ্জ? সিতাংশুর চেহারা মোটাসোটা, কালো, মাঝারি লম্বা। রাজপুত্তুর নয় বটে, কিন্তু সিতাংশু বিরাট বড়লোকের ছেলে, বিলেত-টিলেত ঘুরে এসেছে।
একমাত্র কুঞ্জই জানে না, তনু জীবনে কাউকে সত্যিকারের ভালটাল বাসেনি। খুবই চালাকচতুর ছিল তবু, ছিল কেন, এখনও আছে। খুবই পাকা বিষয়বুদ্ধি তার। স্কুল কলেজে পড়ার সময় রাজ্যের ছেলেকে প্রশ্রয় দিত, নিজের বাপ-ভাই ছাড়া আর বড় বাছবিচার করত না। তা বলে তনু গলেও পড়েনি কারও জন্য। নিজের বোনের জন্য রাজুর লজ্জা বরাবর। কিন্তু তনু যে আগুপিছু না ভেবে কাজ করবে না, হুট করে শরীরঘটিত কেলেঙ্কারি বাঁধাবেনা, এ বিষয়ে মা-বাবার মতো রাজুও নিশ্চিন্ত ছিল। শেষ পর্যন্ত তনু খুবই স্থিরবুদ্ধিতে কাজ করেছে। এম. এ পাশ করার পর বেছেগুছে নিজের পুরুষ সঙ্গীদের ভিতর থেকে সবচেয়ে সফল আর যোগ্য লোকটিকে বেছে নিয়ে বিয়ে করেছে। বিয়ের পর তনু হয়ে গেছে একেবারে অন্য মানুষ। ঘর-সংসার, টাকা জমানো, স্বামী শাসন, শ্বশুর-শাশুড়িকে হাত করা ইত্যাদি খুবই কৃতিত্বের সঙ্গে করছে। কে বলবে, এ বিয়ের আগেকার সেই বারমুখী মেয়েটা!
তনু যখন কিশোরী তখন থেকে কুঞ্জর যাতায়াত। অন্যদের মতো তনু হয়তো কুঞ্জকেও প্রশ্রয় দিয়েছে। খুব ভালভাবে জানে না রাজু। তবে কুঞ্জর ভাব-সাব দেখে সন্দেহ হত। তনুর কোনও ভাবান্তর ছিল না, সে কুঞ্জকে যদি প্রশ্রয় দিয়েই থাকে তবে তা নিতান্তই অভ্যাসবশে দিয়েছে। তখন কুঞ্জর চেহারা খারাপ ছিল না, কিন্তু চেহারায় পটবার মেয়ে কি তনু? সুপুরুষ দেদার সঙ্গী তার চারদিকে গ্রহমণ্ডলের মতো লেগে থাকত। তনুর সঙ্গী ছেলে ছোকরারাও জানত, তনুকে নিয়ে ফুর্তি দুদিনের। চিড়িয়া একদিন ভাগবে। শুধু কুঞ্জই তা জানত না। আজও তাই জানতে চায়, তনুর স্মৃতিতে সে এখনও একটুখানিও আছে কি না! কুঞ্জ এখনও বিয়ে করেনি, করবে কি না বোঝাও যাচ্ছে না। তবে রাজু বোঝে কুঞ্জ খুব প্রাণপণে বড় হতে চাইছে। বড় কিছু হওয়ার, নামডাকওয়ালা হওয়ার ভীষণ আকাঙ্ক্ষা।
কুঞ্জ মৃদুস্বরে বলল-তনুর বিয়েটা ভালই হয়েছে, কী বল রাজু?
রাজু সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করেই বলল–ভাল হয়েছে বুঝব কী করে? আজকাল বড় চাকরি বা গাড়ি বাড়ি থাকলেই লোকে সেটা সাকসেস বলে ধরে নেয়। যেন ও ছাড়া জীবনে আর মহৎ কিছু নেই। আমি তো মনে করি, ওর চেয়ে সৎ, চরিত্রবান, নিষ্ঠাবান, পরোপকারী লোককেই আসলে সাকসেসফুল লোক বলা উচিত।
খুশি হয়ে কুঞ্জ খুব আবেগের গলায় বলে–সে বড় ঠিক কথা। কিন্তু মেয়েরা এ সব বুঝতে চায় না কেন রে? বড় বোকা মেয়েমানুষ জাতটা।
মনে মনে রাজু বলে–কিংবা খুব চালাক।
পুকুরধার, বাগান, নারকোলকুঞ্জের ভিতর দিয়ে পথটা পাক খেতে খেতে গেছে। তারপরই মাঠ। রবি মাঠের ধারে পৌঁছে পিছনে টর্চ মেরে বলে–এসে গেল গো! ভেজা মাটির গন্ধ পাচ্ছি।
গাছের আড়াল সরে যেতেই হাওয়ার ঢল এসে লাগল বুকে। কী শীত! বাতাসে জলের হিম। এত হাওয়ায় স্বাসকষ্ট হতে থাকে রাজুর। কান কনকন করতে থাকে, নাকের ডগায় জ্বালা। তবু এই মাঠখানা রাজুর বরাবর ভাল লাগে। তেপান্তরের মতো পড়ে আছে উজবুক একটা মাঠ। এখানে সেখানে চাষ হয় বটে, কিন্তু বেশির ভাগটাই এখনও সবুজ। একটা দুটো নৈর্ব্যক্তিক পুকুর আছে, মাঝে মাঝে গাড়লের মতো গজিয়েছে তাল বা নারকোল গাছ। মেঠো পথের ধারে ধারে ঝোপঝাড়ও আছে রহস্যের গন্ধ মেখে। জ্যোৎস্না ফুটলে এ মাঠে বিস্তর পরী নেমে আসবে বলে মনে হয়।
কয়েক কদম আগে আগে কুঞ্জ ভারী আনমনা হয়ে হাঁটছে। ওর মাথা ভর্তি এখন তনুর স্মৃতি। কত জ্যান্ত আর শরীরী হয়ে তনু ওর মনে হানা দেয় এখনও! ভেবে রাজুর কষ্ট হয়। কুঞ্জর সঙ্গে তনুর অসম্ভব বিয়েটা যদি ঘটনাচক্রে ঘটতই তা হলে কি রাজু খুশি হত? না, কিছুতেই না! তনু ঠিক লোককেই বিয়ে করেছে, এমনকী জাত বর্ণ পর্যন্ত মিলিয়ে। এখন এই বিরহে কাতর কুঞ্জটার জন্য তবে কেন কষ্ট রাজুর? মুখ ফুটে কোনওদিন তনুকে ভালবাসার কথা রাজুকে বলেনি কুঞ্জ, শুধু বরাবর আভাস দিয়েছে।
রবি এদিক ওদিক টর্চ ফেলছে। উল্টোপাল্টা হাওয়ায় মাঝে মাঝে তার গানের শব্দ আসছে। এই বিশাল মাঠে, ঢলানি হাওয়ায়, অন্ধকারে তারা তিনজন যেন বহু দূর-দূর হয়ে গেছে। যেন কেউ কারও নয়। যেই এই একা হওয়ার বোধ এল অমনি রাজুর বুক খামচে ধরল সেই ভয়। সকলের অজান্তে কে এক মৃত্যুর জাল ছুঁড়ে দিচ্ছে অকে ধরার জন্য!
রাজুর হাঁফ ধরে যায়। গলার কাছে কী যেন পুঁটুলি পাকিয়ে উঠে ঠেলা দেয়। শরীরের কিছুই তার বশে থাকে না।
গভীর কালো একটা পাথুরে আকাশে নীলাভ উজ্জ্বল এক রথ কোনাকুনি ধীর গতিতে উঠে যাচ্ছে– এই স্বপ্ন এক রাতে দেখেছিল সে। আর কিছু নয়, শুধু এক তারা চাঁদ সূর্যহীন নিকষ আকাশ, আর ওই ভুতুড়ে রথ। ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়েছিল তার। শব্দহীন তলহীন ওই কালো আকাশ কখনও দেখেনি সে জীবনে। আর সেই নীল আলোয় মাখা রথই বা এল কোথা থেকে? যতবার সে রাতে ঘুমোত গেল ততবার দেখল। হুবহু এক স্বপ্ন। কেউ কি দেখে এরকম। শেষ রাতটুকু জেগেই কাটাল। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত মাস তিনেক ধরে প্রতি রাত প্রায় জেগেই কাটে তার।
রথযাত্রায় ছাড়া সারা জীবনে রাজু আর রথ দেখল কই? তা ছাড়া ওরকম নীলাভ সুন্দর রথের ছবিটাই বা সে পেল কোথায়? আকাশটাই বা কালো কেন? কেন ধীরগতিতে রথ উপরে উঠে যাচ্ছে? অনেক যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে এই স্বপ্নের সামাজিক বাস্তব ব্যাখ্যা খুঁজে দেখেছে রাজু। কিছু পায়নি। কিন্তু উড়িয়েও দিতে পারেনি কিছুতেই। কেবলই মনে হয়, এই যৌবনের চৌকাঠেই বুঝি মৃত্যুদূত পরোয়ানা নিয়ে এল! কাউকেই স্বপ্নের কথা বলেনি সে। কিন্তু মনে মনে ভেবে দেখেছে, এ স্বপ্ন মৃত্যুর ইঙ্গিত ছাড়া কিছুই নয়। গত তিন মাসে তার শরীর গেছে অর্ধেক হয়ে। খায় না ভাল করে, ঘুম নেই। সারাদিন একটা দূরের অস্পষ্ট সংকেত টের পায়। রাতে সেটা গাঢ় হয় আরও। মৃত্যু আসছে। আসছে।
এই মাঠের মধ্যে ঠিক তেমনি মনে হল। বড় দামাল হাওয়া, বড় খোলামেলা মাঠ, অনেক দূর হয়ে গেছে লোকজন।
কাতরস্বরে রাজু ডাকে– কুঞ্জ।
কিন্তু কুঞ্জ শোনে না। রাজুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মুছে ফেলে দেয় বাতাস।
সামনে, কিছু দূরে তখন হঠাৎ রবির হাতের টর্চটা ছিটকে পড়েছে মাঠে। পড়ে লাশের মতো স্থির হয়ে একদিকে আলোর চোখ মেলে চেয়ে আছে। সেই আলোয় বিশাল প্রেতের ছায়া নড়ছে। কয়েকটা পা, লাঠি।
রবি কি একবার চেঁচাল? বোঝা গেল না, তবে সে টর্চটা কুড়িয়ে নেয়নি তা বোঝা যাচ্ছিল।
কুঞ্জ হেঁকে বলল-রাজু! ডাইনে নেমে যা।
কাঁপা গলায় রাজু বলে-কেন?
সে কথা কানে গেল না কুঞ্জর। দু হাত ওপরে তুলে পাগলের মতো সামনের দিকে ছুটতে ছুটতে সে চেঁচাতে লাগল-খুন! খুন! খুন!
রাজু খুনের মতো কিছু তেমন দেখতে পায়নি। কুঞ্জর মতো তার চোখ অত আঁধার-সওয়া নয়। বিজলি বাতি ছাড়া শহুরে রাজু ভারী অসহায়। কিন্তু কুঞ্জ যখন দেখেছে তখন ঠিকই দেখেছে।
রাজুর বুকে এমন ওলট পালট হচ্ছিল যে দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। সে ডানদিকে মাঠের মধ্যে ছুটতে গিয়ে দেখে, পা চলে না। শরীরে খিল ধরে আসছে।
কুঞ্জ চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটছে সামনে। কিন্তু এই বিশাল মাঠে হাওয়ার ঢল ঠেলে সেই চিৎকার কোথাও যাচ্ছে না। দুরে ভঞ্জদের পাড়ায় নিওন বাতি জ্বলছে, রাস্তায় আলোর সারি। লোকজন রয়েছে। কিন্তু অত দূর পর্যন্ত কোনও সংবাদই পৌঁছচ্ছে না।
মাঠের মধ্যে বুন্ধুর মতো দাঁড়িয়ে রাজু সিদ্ধান্ত নিল, কুঞ্জটা মরতে যাচ্ছে, মরবেই।
এটা ভাবতেই তার মাথা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কুঞ্জকে কি মরতে দেওয়া যায়? যার বুকে অত ভালবাসা? যে কখনও কাউকে অবহেলা বা অবজ্ঞা করে না? কুঞ্জর মতো ভাল কজন?
রাজু অন্ধকারে পথের ঠাহর না পেয়ে সামনের দিকে জোর কদমে এগোতে থাকে। কয়েক কদম হেঁটে আচমকা দৌড় শুরু করে। ফুসফুস ফেটে যাচ্ছে পরিশ্রমে। হাতে পায়ে খিল ধরছে, কুঁচকিতে খিচ। তবু প্রাণপণে দৌড়োয় রাজু।
ভঞ্জদের এলাকার উজ্জ্বল আলোর পর্দায় সে কয়েকটা কালো মানুষকে ভুইফোড় গজিয়ে উঠতে দেখে সামনে। ওদের হাতে লাঠি বা ওই জাতীয় সব অস্ত্র। মুখে কথা নেই।
এর পর থেকে রাজু সঙ্গে ছোরা রাখবে। খুব আফসোসের সঙ্গে সে উবু হয়ে বসে চারদিক খামচে ঢেলা খুঁজতে গিয়ে একটা ভারী মতো কী পেয়ে গেল। পাল্লাটা খুব দূরের নয়। মরিয়ার মতো চেঁচিয়ে উঠল–খবরদার! শালা, খুন করে ফেলব! বলেই সে হাতের ভারী বস্তুটা ছোড়ে।
কারও লাগেনি, রাজু জানে। কিন্তু আততায়ীরা বোধ হয় তৃতীয় কোনও লোককে প্রত্যাশা করেনি। চেঁচানি আর ঢিল ছোঁড়া দেখে হতভম্ব হয়েই বোধ হয় হঠাৎ অন্ধকারে তারা নেই হয়ে গেল।
রাজু পথে বসে হাঁফাতে থাকে। বুক অসম্ভব কাঁপছে গলা চিরে গেছে।
কুঞ্জ খুবই স্বাভাবিকভাবে মাঠে নেমে জ্বলন্ত টর্চটা কুড়িয়ে চারদিকে ফেলে। তারপর নরম স্বরে বলে-ব্যাটা ভেগেছে।
–কে? রাজু জিজ্ঞেস করে।
রবি। বলে খুব হাসে কুঞ্জ।
হাসছিস?
–হাসিই আসে রে! বিপদে আজ পর্যন্ত সঙ্গী পেলাম না। আজ শুধু তুই ছিলি। এই দ্যাখ না, রবিকে তো সবাই আমার ছায়া ভাবে। দ্যাখ, শালা লোক দেখেই টর্চ ফেলে আমাকে রেখে হাওয়া।
ওরা কারা?
-কে বলবে? তবে ঠাকুরের ইচ্ছেয় শত্রুর তো অভাব নেই। উঠতে পারবি এখন? শরীর খারাপ লাগছে না তো?
রাজু ওঠে। পা দুর্বল, শরীরে থরোথরো কাঁপুনি।
কুঞ্জ শান্ত গলায় বলে–চ, বৃষ্টি এল বলে।
ভারী নির্বিকার কুঞ্জ। যেন এরকম ঘটনা নিত্য ঘটছে। দেখে রাজুর রক্ত গরম হয়ে যায়। কুঞ্জর ঠাণ্ডা রক্ত তার একদম পছন্দ নয়। বলে–লোকগুলো কোথায় গেল দেখবি তো! পথে যদি আবার অ্যাটাক করে?
কুঞ্জ নিভু নিভু টর্চটা হাতের তেলোয় ঠুকে তেজ বাড়ানোর অক্ষম চেষ্টা করতে করতে বলল–আর মনে হয়, চেষ্টা করবে না। তোকে দেখে ভয় খেয়েছে। ঠাহর পায়নি তো তুই কে বা কেমন ধারা।
–চিনতে পারিনি?
–না। রবি হয়তো দেখেছে।
রাজু খুবই রেগে যায় মনে মনে। কিন্তু ওঠেও। টের পায়, ঘটনাটা আচমকা ঘটায় তার কিছু উপকার হয়েছে। মনের স্যাঁতসেঁতে ছিচকাঁদুনে ভাবটা আর নেই। ঝরঝরে লাগছে।
.
০৩.
বনশ্রীর চেহারা ঠিক তার নামের মতোই, তাকে দেখলে যে কোনও পুরুষেরই গাছের ছায়া বা দীঘির গভীর জলের কথা মনে পড়তে পারে। বনশ্রী নিজেও জানে তার চেহারায় তাপ নেই, তীক্ষ্ণতা নেই, আছে স্নিগ্ধ লাবণ্য। তাকে কেউ মা বলে ডাকলে ভারী ভাল লাগে তার।
সবার আগে বলতে হয় তার চুলের ঐশ্বর্যের কথা। কালো নদীর মতো স্রোত নেমে এসেছে। তাতে সামান্য ঢেউ-ঢেউ। এলো করলে আস্ত একটা কুলো দিয়েও ঢাকা যায় না। তার গায়ের রং যেন কালো চুলেরই ছায়া। একবার এক পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে এসে মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল–এ তো কালো! অহংকারী কাশ্রী লজ্জায় নতমুখী হয়েছিল। বলতে ইচ্ছে হয়েছিল–আপনি ভুল করছেন। আপনার চোখ নেই। বলেনি বটে, কিন্তু বনশ্রী মনে মনে ঠিক জানে যারা দেখতে জানে তারা দেখবে, এ রঙের কালো ফর্সা হয়না। এ হল বনের গভীর ছায়া, এ হল দীঘির জলের গভীরতা। সে দেখেছে, পুরুষ মানুষ। যন তার দিকে তাকায় তখন ওদের তেমন কাম ভাব জাগে না, কিন্তু বুক জুড়ে একটা পুরনো তেষ্টা জেগে ওঠে। খুব বেশি পুরুষ যে তাকে দেখে তা নয়, কিন্তু যারা দেখে তাদের চোখ স্বপ্নের চোখ হয়ে যায়। এ সব কি তার কল্পনা? ভুল ভাবা? ভাবতে ভাবতে সারা দিন শতবার আয়নায় মুখ দেখে বনশ্রী। কেমন মুখ? একটু লম্বাটে গড়ন, গালের ডৌলটি লাউয়ের ঢলের মতো। ঘন জোড়া জ্ব। এই একটু খুঁত তার, জোড়া বাঁধা –নাকি ভাল নয়। কিন্তু তার নীচে চোখ দুটির দিকে তাকাও। এমন মায়াভরা চোখ দ্যাখেনি কেউ। অন্য সব কিছুকে তুচ্ছ করে দেয় সীমানা ছাড়ানো তার দুই চোখ। চোখের মণি যেন দুধ-পুকুরে এক গ্রহণ-লাগা চাঁদের ছায়া। নাক চাপা বলে দুঃখ নেই বনশ্রীর। তবে ছোট বেলায় একবার বোলপুর রেলস্টেশনে একটা লোক তার নাকছাবি ছিঁড়ে নিয়েছিল নাক থেকে। সেই ক্ষতের দাগ আজও আছে। তার ঠোঁট শীতকালেও কখনও ফাটে না। সব সময়ে টইটুম্বুর হয়ে আছে পাকা ফলের মতো। লম্বা নয় বনশ্রী, কিন্তু ছোট মাপের মধ্যে তার শরীর স্বাস্থ্য ঢলঢলে। বনশ্রী নিজের রূপে মুগ্ধ বটে, কিন্তু কখনও শরীর বসিয়ে রেখে গতরখাস হওয়ার চেষ্টা করে না। রোদে-জলে সে গাঁয়ের পর গাঁ হেঁটে গ্রাম-সেবিকার কাজ করেছে। হরেক রকম ত্রাণকাজে ঘুরে বেড়িয়েছে শহরে গঞ্জে। কলেজে ইউনিয়ন করার সময় উদয়াস্ত খেটেছে নাওয়া খাওয়া ভুলে।
সে জীবনটা চুকেবুকে গেছে বনশ্রীর। এখন তাকে ঘরেই থাকতে হয়। বরং বলা চলে, ঘরে বসে তাকে অপেক্ষা করতে হয় বিয়ের জন্য। মাঝে মধ্যে পাত্রপক্ষ আসছেও। কেউ কেউ পছন্দও করছে। কিন্তু বড্ড খাঁই তাদের। মিল হতে গিয়েও ফসকে যাচ্ছে নানা গেরোয়। একটা বিয়ে সব ঠিকঠাক, শোনা গেল পাত্র দুম করে আর একজনকে রেজিষ্ট্রি করেছে। আর একজন এসেছিল তুকারাম রাঠোর। তারা নাকি তিন পুরুষ ধরে কলকাতায়, বাঙালিদের সঙ্গে বিয়ে শাদি। কিন্তু বাবা বললেন, রাঠোরটা কিছু কঠোর হয়ে যাচ্ছে। আমার নরম মেয়েটার সইবে না। খুব হাসি হয়েছিল সেই নিয়ে। বনশ্রীর বিয়ে নিয়ে কখনও মজার, কখনও দুঃখের, কখনও হতাশার নানা ঘটনা ঘটছে। বাবা সত্যব্রত এক সময়ে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে কিছুদিন ছাত্র ছিলেন। রবি ঠাকুরকে দেখেছেন। মাঝে মধ্যে তীর্থযাত্রার মতো সপরিবারে শান্তিনিকেতনে যান। তাঁর ইচ্ছে, বনশ্রীর বিয়ে হোক এমন ছেলের সঙ্গে যে শিল্প বোঝে।
ইচ্ছে করলে বনশ্রী কাউকে ভালবেসে বিয়ে করতে পারত। কিন্তু বনশ্রী এই একটা ব্যাপার কখনও মনে মনে পছন্দ করেনি। ছেলে-ছোকরাদের ভারী দায়িত্বজ্ঞানহীন, ছটফটে আর অবিশ্বাসী মনে হয় তার। সে পছন্দ করে একটু বয়স্ক লোক। অন্তত দশ বছরের বড়, বেশ ধীরস্থির বিবেচক, দায়িত্ববান। খুব পরিশ্রমী আর বিশ্বস্ত পুরুষ হবে সে। গভীর মায়া থাকবে সংসারে, চরিত্রবান হবে, ইতি-উতি তাকাবে না, ছোঁক ছোঁক করবে না। তা ছাড়া বনশ্রী ভাবে, একটা লোকই তাকে পছন্দ করে নিয়ে যাবে, সেটা যেন বড় একপেশে ব্যাপার। সে চায়, পাত্রের গোটা পরিবার তাকে পছন্দ করুক, তারিফ করুক, সবাই মিলে সাদরে গ্রহণ করুক তাকে। সেই ধরনের সম্মান আলাদা। হোটেল রেস্টুরেন্ট ঘুরে, ফাঁকা কথায় পরস্পরকে ভুলিয়ে, নিতান্ত লোভে কামুকতায় জৈবিক ইচ্ছেয় বিয়ে সে কোনওদিন চায়নি। তাই কখনও কারও সঙ্গে প্রেম হয়নি তার, যদিও বহুজন পেয়ে বসতে চেষ্টা করেছে। কত চিঠি আসত তখন। কত ইশারা ইঙ্গিত ছিল চারপাশে। নোংরামিই বা কম কী দেখেছে বনশ্রী। পথেঘাটে সুযোগ বুঝে ইতর পুরুষেরা অশ্লীল নানা মুদ্রা দেখানোর চেষ্টাও করেছে কতবার।
বনশ্রীকে তাই আজও অপেক্ষা করতে হচ্ছে। নিজের স্নিগ্ধ ছায়া নিয়ে বসে আছে সে। এক দিন সেই পরম মানুষটি বহুদূর থেকে হাক্লান্ত হেঁটে এসে ঠিক বসবে ছায়ায়। তাকে জুড়িয়ে দেবে বনশ্রী।
বিনা কাজে আজও দুপুরে এসেছিল রেবন্তদাতার জামাইবাবু। যদি বনশ্রী বুকে হাত দিয়ে বলে যে রেবন্ত লোকটাকে সে দু চোখে দেখতে পারে না তা হলে মিছে কথা বলা হবে। লম্বাটে গড়নের ভাবুক ও অন্যমনস্ক রেবন্তকে প্রথম থেকেই তার ভাল লেগেছিল। দিদি শ্যামশ্রী দেখতে খারাপ নয়, বনার মতোই। তবে তার বুদ্ধি বড় কম। অল্পে রেগে যায়, সামান্য কথা নিয়ে তুলকালাম বাঁধায়। ওদের সংসারে শান্তি নেই। শ্যামশ্রীও খুব ঠ্যাঁটা মেয়ে, রেবন্তদা যা পছন্দ করে না ঠিক সেইটা জোর করে করবে। বিয়ের পর যেটা নিয়ে ওদের সবচেয়ে বেশি অবনিবনা হয়েছিল সেটা হল চরকা। আদর্শগত দিক দিয়ে রেবন্ত চরকার বিরুদ্ধে।
অথচ মা সবিতাশ্রীর প্রভাবে তারা তিন বোনই চরকা কাটতে শিখেছে। সবিতাশ্রীর বাবা কট্টর গান্ধীবাদী ছিলেন এবং এখনও আছেন। সরল ঋজু চেহারার মানুষ, ছাগলের দুধই তাঁর প্রধান পথ্য। খুব ভোরে উঠে চরকা কাটতে বসেন। বাড়ির প্রত্যেককেই দিনের কোনও না কোনও সময়ে কিছুক্ষণ চরকা কাটতেই হবে, তাঁর অনুশাসনে। গান্ধীজির আদর্শ অনুযায়ী নিজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাউকে কাউকে হরিজনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগ্রহ ছিল তাঁর। গান্ধীজি একবার নাকি সি আর দাশকেও বলেছিলেন, তোমার ছেলেমেয়েদের মধ্যে অন্তত একজনকে হরিজনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ো। সবিতাশ্রীর বাবার সেই আগ্রহ অবশ্য কাজে পরিণত হয়নি। এ নিয়ে সত্যব্রত নানা তর্ক করেছেন। এখনও স্ত্রীকে বলেন-তোমাদের গান্ধীজি পরম রামভক্ত ছিলেন। অথচ শক বর্ণাশ্রম ভেঙেছিল বলে স্বয়ং রামচন্দ্র অকে চরম দণ্ড দেন। তা হলে বর্ণাশ্রমের সমর্থক রামচন্দ্রের ভক্ত হয়ে গান্ধীজি বর্ণাশ্রম ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন কেন? সবিতাশ্রী এর সঠিক জবাব দিতে পারেন না, বলেন–সে আমলের কথা আলাদা। সমাজ কত পাল্টে গেছে। সত্যব্রত বলেন- বাইরেটা পাল্টায় বটে কিন্তু তা বলে মানুষের রক্ত তো নীল হয়ে যায়নি। ভিতরটা পাল্টায় না। রবীন্দ্র-ভক্ত সত্যব্রত হিন্দুই বটে, ব্রাহ্ম নন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতনের সংস্পর্শে তিনি কিছুটা বিশ্বমানবতায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন একদা। কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরের পরম গান্ধীভক্তি দেখে এবং সবিতাশ্রীকেও যে একদা হরিজনের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল তা জেনে তিনি কঠোর বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী হয়ে পড়লেন। শ্বশুরের সঙ্গে ঘোর তর্ক জুড়তেন। এমনকী রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের বক্তব্যকেও প্রকাশ্যে নস্যাৎ করতে লাগলেন। এখন আর স্ত্রীর সঙ্গে তর্ক করেন না বটে তবে মাঝে মাঝে ফুট কাটেন–ওগো শুনছ, এই দ্যাখো খবরের কাগজে। লিখেছে পশ্চিমবাংলার একজন পরম গান্ধীবাদী নেতা খুব মাংস খেতে ভালবাসেন। সবিতাশ্রী অবাক হয়ে বলেন–তাতে কী? সত্যব্রত খুব হেসে বলেন, স্বয়ং গান্ধী বলতেন আমি লাঠি ভেঙে ফেলব তবু সাপকে মারব না। তা ওরকম গোঁয়ার অহিংস মানুষের চ্যালারা মাংস খাচ্ছে, এটা একটু কেমন কেমন লাগে না!
সে সব দিন পার হয়ে গেছে। এখন গোটা ব্যাপারটাই পরিহাসের বিষয়। বিয়ের সময় সবিতাশ্রীকে তাঁর বাবা একটি চরকা উপহার দেন যথারীতি। সবিতাশ্রী আগে অভ্যাসবশে রোজ চরকা কাটতেন। ছেলেমেয়ে হলে তাদেরও শেখালেন। শ্যামশ্রী, বনশ্রী, চিরশ্রী এবং শুভশ্রী চমৎকার চরকা কাটতে শিখল। কিন্তু অনুশাসন বজায় রাখার জন্য কোনও গান্ধীবাদী তো এ সংসারে নেই। তাই চরকার অভ্যাস ক্ৰমে শ্লথ হয়ে এল। এখন সংসারে নানা কাজ আর সম্পর্কে জড়িত সবিতাশ্রী কেবল গান্ধীজির জন্মদিনে কিছুক্ষণ চরকা কাটেন। ছেলেমেয়েরা আর চরকা ছোঁয়ও না। কিন্তু শ্যামশ্রীর বিয়ের সময় দাদু লোক মারফত উপহার বলে একটি চরকা পাঠিয়ে দিলেন। বিয়ের আসরে সেই চরকা দেখে প্রথম হাসাহাসি তারপর কিছু গুঞ্জন উঠল। বোকা কিন্তু জেদি শ্যামশ্রী সেইটেই অপমান বলে ধরে নেয়। অপমানের প্রতিশোধ নিতে সে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে রোজ চরকা কাটে। রেবন্তর সঙ্গেও তার সেই নিয়েই গণ্ডগোলের সূত্রপাত।
কিন্তু বনশ্রী জানে, চরকা থেকে ঝগড়াটা জন্মায়নি। দু-চার দিনেই চরকাটা হয় শ্যামশ্রী ভুলে যেত, নয়তো রেবন্ত দেখেও দেখত না। চরকাটা কারণ নয়, উপলক্ষ মাত্র। ব্যক্তিত্ববান পুরুষরা জেদি মেয়ে পছন্দ করে না, জেদি মেয়েরা পছন্দ করে না পুরুষের খবরদারি। এ হল স্বভাবের অমিল।
কিন্তু এ ছাড়াও একটা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু সেই কারণের কথা ভাবতে বনশ্রী ভয় পায়। বড় ভয় পায়। বছর দেড়েক আগে শ্যামশ্রীর যখন বিয়ে হয় তখন বনশ্রীও বিয়ের যুগ্যি যুবতী। তখন সে বেশ ভাল করে পুরুষের দৃষ্টি অনুবাদ করতে পারে। সেই বিয়ের ছ মাসের মধ্যেই সে তার নতুন জামাইবাবুর চোখে অন্য আলো দেখতে পায়। সেই থেকে ভয়।
বাইরে তারা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, কোথায় কোনও বৈলক্ষণ্য নেই। কিন্তু মাঝে মাঝে রেব তাকে এক-আধ পলক নিবিড় বিহ্বল চোখে দেখে। ঘুরে ঘুরে তাকেই দেখতে আসে না কি? যেমন আজও এসেছিল? এক দিন দুপুরে বনশ্রী ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ঘুমের মধ্যেই অস্বস্তি হতে থাকে তার। কেমন অস্বস্তি তা বলতে পারবে না, তবে কেমন যেন তার ভিতর থেকেই কেউ তাকে জেগে উঠবার ইশারা দিচ্ছিল বার বার। বেশ চমকে জেগে উঠেছিল সে। আর জেগেই দেখল তার পায়ের দিকে খাটে রেবন্ত বসে আছে। মুখে সামান্য হাসি, চোখে অপরাধীর দৃষ্টি। না, রেবন্ত কোনওদিন তার গায়ে হাত দেয়নি, কখনও খারাপ ইঙ্গিত করেনি। তবে ওই বসে থাকাটা একটু কেমন যেন। যুবতী মেয়ের ঘুমের শরীর পুরুষ দেখবেই বা কেন? বনশ্রী জাগতেই রেবন্ত বলল-বসে বসে তোমার পা দেখছিলাম। বনশ্রী তো লজ্জায় মরে যায়। ছি ছি, পায়ের ডিম পর্যন্ত শাড়ি উঠে আছে। ধড়মড়িয়ে বসে সে ঢাকাটুকি দিল। তখন রেবন্ত বলল-বনা, লজ্জা পেয়ো না, কিন্তু এমন সুন্দর পায়ের গঠন কোনও মেয়ের দেখিনি। এ খুব ভাগ্যবতীর লক্ষণ।
সেই থেকে কেমন খটকা।
জামাইদের ঘন ঘন শ্বশুরবাড়ি আসাটাও তো খুব স্বাভাবিক নয়। এখান থেকে রেবন্তর গাঁ কাছেই। শ্যামপুর। কিন্তু কাছে বলেই যে আসবে তারও তো মানে নেই। এমনিতেই গাঁয়ের জামাইদের পায়াভারী। ন মাসে ছ মাসে পায়ে ধরে যেচে আনতে হয়। স্বভাব অনুযায়ী রেবন্তর আরও পায়াভারী হওয়ার কথা। সে খুব আত্মসচেতন, রাগি, খুঁতখুঁতে। তবে আসে কেন?
আজ দুপুরের দিকে এল। রুক্ষ চেহারা, দাড়ি কামায়নি, চোখের দৃষ্টিও এলোমেলো। কথাবার্তাও কিছু অসংলগ্ন ছিল। বাইরে থেকে ডাকছিল–চিরু, এই চিরু।
চিরশ্রী তখন বাড়িতে ছিল না, স্কুলে ছিল।
বাইরে থেকে কে ডাকে দ্যাখ তো৷ জামাইয়ের গলা নয়? সবিতাশ্রী বনাকে ডেকে বলেন।
বাইরে থেকে ডাকার কিছু নেই। রেবন্ত অনায়াসে ঘরে দোরে ঢোকে। বনা গিয়ে দেখে বারান্দায় কাঁঠাল কাঠের চৌকিতে চুপ করে বসে আছে। একটু আগে পাড়ার বিশু, বাবুয়া আর কটা পাড়ার ছেলে মিলে টোয়েন্টি নাইন খেলছিল। তাস তখনও পড়ে আছে চিত উপুড় হয়ে। রেবন্ত একদৃষ্টে সেই তাসের দিকে চেয়ে। বারান্দায় ঠেস দেওয়া তার সাইকেল।
বনা যথেষ্ট অবাক ভাব দেখিয়ে বলল–ওমা। জামাইবাবু! বাইরে বসে কেন?
রেবন্ত খুব কাতর দুর্বল এক দৃষ্টিতে চাইল বনার দিকে। বলল–আমি এক্ষুনি চলে যাব।
কথাটার মানেই হয় না। চলে যাবে তো এলে কেন? তবু বনা বলে–যাবেন তো, তাড়া কী? মা ডাকছে চলুন। চা বসাই গিয়ে।
রেবন্ত মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল–আমার সঙ্গে লোক আছে।
বনা কথাটা বুঝল না, বলল–তাতে কী? লোকদের ডেকে আনুন না, সবাই বসবেন, চা করে দিচ্ছি।
রেবন্ত মাথা নেড়ে বলল–তা হয় না। কাজ আছে। জরুরি কাজ।
বনা অবশ্য কোনও লোককে দেখতে পায়নি। রাস্তার লোককে বাড়ি থেকে দেখার উপায়ও নেই। সামনে অফুরন্ত বাগান, খানিকটা খেত। মেহেদির উঁচু বেড়ার ধার ঘেঁষে ঘেঁষে নিম আম জাম তেঁতুল জামরুল গাছের নিবিড় প্রতিরোধ। তার ওপর এবার অড়হর চাষ হয়েছে বড় জায়গা জুড়ে। সেই ঢ্যাঙা গাছের মাথা দেড় মানুষ পর্যন্ত উঁচু হয়ে সব আড়াল করেছে।
বনা বলল–মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে সকাল থেকে কিছু খাননি। চারটি মুড়ি ভিজিয়ে দিচ্ছি, ডাল তরকারি দিয়ে খেয়ে তারপর রাজ্য জয়ে যাবেন খন।
রেবন্ত হাঁ করে বনার দিকে চেয়ে থেকে বলল–আমাকে কি খুব শুকনো দেখাচ্ছে? বনা ফাঁপরে পড়ে যায়। শুকনো দেখাচ্ছে বললে জামাইবাবুর যদি মন খারাপ হয়ে যায়? রোগা বলে রেবন্তর কিছু মন খারাপের ব্যাপার আছে। প্রায়ই জিজ্ঞাসা–আমার স্বাস্থ্যটা আগের চেয়ে ভাল হয়নি? বনা তাই দোনো-মোনো করে বলেরোদে এসেছেন তো তাই।
নিজের গালে হাত বুলিয়ে অন্য মনে কিছুক্ষণ বসে থেকে রেবন্ত বলে–আজ দাড়িটাও কামানো হয়নি।
গাঁয়ের কোনও লোকই রোজ দাড়ি কামায় না। এমনকী বড় ভঞ্জবাবু পর্যন্ত নির্বাচনী সভায় তিন দিনের খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়ি নিয়ে বক্তৃতা করছেন–এ দৃশ্য বনশ্রী দেখেছে। তবে রেবন্ত শ্বশুরবাড়ি আসার সময় দাড়ি কামিয়ে আসবেই। বেশির ভাগ দিনই বোধ হয় বাজারের সেলুন থেকে কাজ সেরে আসে, গালে ভেজা সাবানের দাগ লেগে থাকে।
বনা বলল–এখন আপনি আমাদের পুরনো জামাই, শ্বশুরবাড়ি আসতে বেশি নিয়ম কানুনের দরকার হয় না। উঠুন তো, ভিতরে চলুন। সঙ্গের লোকের কি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? ডেকে আনুনগে তাদের।
রেবন্ত মাথা নেড়ে বলে–ওরা আসবে না।
কথাটা বনার ভাল লাগল না। রেবন্ত যে আজকাল কিছু আজেবাজে লোকের সঙ্গে মেশে তা শ্যামশ্রীই বলে গেছে। বাবাও একদিন দেখেছেন, জামাই পটলের সঙ্গে বাগনান স্টেশনে বসে আছে। দৃশ্যটা ভাল ঠেকেনি তাঁর চোখে। পটলটা মহা বদমাশ।
সুন্দর চেহারার ভাবুক রেবন্ত কেন বদ লোকের সঙ্গে মেশে তা আকাশ পাতাল ভেবেও কূল করতে পারে না বনশ্রী। শুধু মনটা খারাপ হয়ে যায়।
রেবন্ত বনশ্রীর চোখে চোখ রেখে বলল–আমি যদি আর কখনও না আসি বনা?
বনশ্রী চমকে উঠে বলেও কী কথা?
রেবন্ত ম্লান হেসে বলে–অনেক কিছু ঘটতে পারে তো?
বনশ্রীর বুক কাঁপছিল। বলল কী হয়েছে আপনার বলুন তো! দিদি কিছু বলেছে?
–সে কথা নয়। বলে রেবন্ত তার সাইকেলটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে।
এ সময়ে সবিতাশ্রী পরিষ্কার কাপড় পরে ঘোমটা অল্প টেনে শান্ত পায়ে দরজার চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়ে বলেন–রোদে এসেছ, স্নান করে দুটি খেয়ে যাও।
রেবন্ত অবশ্য রাজি হয়নি। বলল–না, আমার কাজ আছে।
বনশ্রী চা করে দিল। সেটা খেয়েই সাইকেলে চলে গেল রেবন্ত। বনশ্রী মাকে বলল–দিদির সঙ্গে আবার বোধ হয় বেঁধেছে।
গান্ধীবাদী শিক্ষার দরুন সবিতাশ্রীর ধৈর্য খুব বেশি। সহজে রাগ উত্তেজনা হয় না, সব ব্যাপারেই কিছু অহিংস নীতির সমাধান ভেবে বের করতে চেষ্টা করেন। বললেন–জামাইকে দোষ দিই না, শ্যামা বড় জেদি।
বনশ্রী বলল–জামাইবাবুর আজকের চেহারাটা কিন্তু ভাল নয় মা। খুব একটা কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছে। তুমি বরং দিদির কাছে কাউকে পাঠিয়ে খবর নাও।
বিকেলের আগেই শুভ সাইকেলে দিদির বাড়ি থেকে ঘুরে এসে বলল–দিদি বলেছে জামাইবাবুর সঙ্গে ঝগড়া-টগড়া হয়নি। তবে কদিন ধরে নাকি জামাইবাবু রাতটুকু ছাড়া বাড়িতে থাকে না, খেতেও যায় না। বাড়ির কেউ কিছু জানে না, কাউকে বলে না কোথায় যায়। দিদি জিজ্ঞেস করে জবাব পায়নি।
সত্যব্রত এ সব খবর জানেন না। কিন্তু বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে এসে হাতমুখ ধুতে উঠোনের কোণে পাতা পিড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে পায়ে পা ঘষতে ঘষতে সবিতাশ্রীকে বললেন–আজ ইস্কুলের কাজে দুপুরে বাগনান গিয়েছিলাম। ফেরার পথে শ্যামার বাড়ি যাই। সেখানে শুনলাম অমিতার সব ঘটনা নাকি রেবন্ত জানতে পেরেছে। শ্যামার সঙ্গে তাই নিয়ে কথা কাটাকাটি। বলেছে নাকি আগে জানলে এ বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করত না।
অমিতা সবিতাশ্রীর ছোট বোন। খুবই তেজি মেয়ে এবং সমাজকর্মী। কুমারী বয়সে একবার সে সন্তানসম্ভবা হয়। এ নিয়ে হইচই খুব একটা হতে দেননি সবিতাশ্রীর বাবা। শান্তভাবেই তিনি মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, সন্তানটির বাবা কে এবং তার সঙ্গে অমিতার বিয়ে সম্ভব কি না। অমিতা সন্তানের বাবার নাম বলেনি, তবে এ কথা বলে যে বিয়ে সম্ভব নয়। সবিতাশ্রীর বাবা গগনবাবু আর কোনও চাপাচাপি করেননি। যথারীতি অমিতার সন্তান জন্মায়। গগনবাবু সেই উপলক্ষে পাড়ায় মিষ্টি বিলোন। অমিতা কিছুদিন পরেই বাবার আশ্রয় ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে চাকরি করতে থাকে। এখন সম্পর্কও রাখে না। ঘটনাটা বহুদিনের পুরনো। লোকে ভুলেও গেছে। অমিতা নামে যে কেউ আছে এ নিতান্ত তার আপনজন ছাড়া আর কারও মনেও পড়ে না।
সবিতাশ্রী চিন্তিত মুখে বললেন– কার কাছ থেকে শুনল?
সত্যব্রত ঠোঁট উল্টে বিরক্তির সঙ্গে বলেন–কে জানে! শ্যামাটা তো বোকার হদ্দ। কোনও সময়ে বলে ফেলেছে হয়তো। তবে জামাই অমিতার কাণ্ডকারখানা শুনে বিগডোয়নি। সে নাকি শ্যামাকে বলেছে, ও সব আমি অত মানি না, কিন্তু তোমার দাদু লোককে মিষ্টি খাওয়াল কেন? এটা কি আনন্দের ঘটনা? আসলে তোমাদের গুষ্টিই পাগল আর চরিত্রহীন।
সেই বিকেলের দিককার ঘটনা। বনশ্রী বা ভাইবোনরা কেউ মা-বাবার থার মাঝখানে কথা তোলে না। এই সৎশিক্ষা সবিতাই দিয়েছেন। কিন্তু কথা না বলেও সে শীতের মরা বিকেলের ফ্যাকাশে আলোয় নিজের বাবার মুখে একটা গভীর থমথমে রাগ আর বিরক্তি দেখেছিল। ঘরে যেতে যেতে বাবা বারান্দায় ভাঁজ করা বস্তায় জোরে পায়ের পাতা ঘষটাতে ঘষটাতে খুব আক্রোশে, কিন্তু চাপা গলায় বললেন কোনও পরিবারের অতীতটা যদি ভাল না হয় তবে এ সব ঝাট তো হবারই কথা। জামাইকে দুষি কেন? আমাদেরও কি ভাল লাগে?
সত্যব্রতরও গম্ভীর হতাশা রয়েছে। শান্তিনিকেতন ছেড়ে তিনি কলকাতার আর্ট স্কুলে এসে পাশ করে শিল্পী হওয়ার চেষ্টায় লেগে যান। একটা স্কুলে ড্রইং শেখাতেন সামান্য বেতনে। বড় কষ্ট গেছে। রং তুলি ক্যানভাসের খরচ তত কম নয়। তার ওপর আছে মাউন্টিং আর একজিবিশন করার খরচ। বেশ কয়েক বছর কৃসাধন করেছিলেন তিনি। কিন্তু শিল্পের লাইনে তিনি দাঁড়াতে পারলেন না। বহু টাকা গুনোগার দিয়ে অন্তত গোটা পাঁচেক একক প্রদর্শনী করেছিলেন, গ্রুপ একজিবিশনেও ছবি দিয়েছেন। তেমন কোনও প্রশংসা জোটেনি, ছবি বিক্রিও হয়নি তেমন। শিল্পসন্ধানী সাহেবদের পিছনে হ্যাংলার মতো ঘুরেছেন, শিল্প সমালোচকদের খাতির করে বেড়িয়েছেন। মদটদও তখন ধরেছিলেন ঠাটের জন্য। সব পণ্ডশ্রম। পরে জ্ঞানচক্ষু খুললে ভঞ্জদের স্কুলে ড্রইং মাস্টারের চাকরি নিয়ে চলে আসেন। বলতে কী, এখানেই তাঁর ভাগ্য খুলেছে। বুড়ো ভঞ্জ শীতলবাবু খুব স্নেহ করতেন। এই সব জমিজমা একরকম তাঁর দান বলেই ধরতে হবে। জলের দরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। চাষের জমিও পেলেন শস্তায় এবং ধারে। শীতলবাবু মরে গেলেও ছেলেরা সত্যব্রতকে শ্রদ্ধা করে। ভঞ্জদের বাড়ির অনেকেই তাঁর ছাত্র। সত্যব্রত এখন ড্রইং মাস্টার নন, হেডমাস্টার।
বনশ্রী বাবার দুঃখটা খুব টের পায়। বাইরে এক ধরনের অভাব ঘুচলেও এ লোকটার বুক খাঁ খাঁ করে। ব্যর্থতা কুরে কুরে খায়। তবে সত্যব্রতর আঁকার ব্যর্থতা থাকলেও নিজের ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা শিল্পবোধ আর সুরুচি ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। ছেলে শুভশ্রীকে একটু আধটু আঁকতেও শেখান আজকাল। কিন্তু শিল্পের অভ্যাস তাঁকে যত ছেড়ে গেছে ততই তিনি নিজের ওপর আর পারিপার্শ্বিকের ওপর মনে মনে খেপে গেছেন। মুখে প্রকাশ করেন না, কিন্তু মুখের গভীর রেখা ও দৃষ্টিতে তা মাঝে মাঝে প্রকাশ পায়।
দিনটা আজ ভাল গেল না। শ্যামশ্রী আর রেবন্তর দাম্পত্যজীবনের কথা শুনে, দেখে বনশ্রীর নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে একরকম ভয় হয়।
এইসব ঘটনায় মনটা উদাস হয়ে গেল। আর আজই যেন তার মন খারাপ করে দিতে মেঘ করল আকাশে। এমনিতেই শীতের বিকেল বড় বিষণ্ণ। তার ওপর মেঘ আর মন-খারাপ।
সন্ধের পর সত্যব্রত বেরোলেন। চিরশ্রী আর শুভশ্রী উঠোনের অন্যপ্রান্তে, পড়ার ঘরে। স্বভাব-গম্ভীর সবিতাশ্রী তার হরেক রকম ঘরের কাজে আনমনা। ফলে বনশ্রী একা। কিছুক্ষণ রেডিয়ো শোনার চেষ্টা করল, কিন্তু মেঘলা আকাশ আর বিদ্যুৎ চমকানির জন্য রেডিয়োতে বড় কড় কড় আওয়াজ হতে থাকায় বন্ধ করে দিল। বই পড়তে মন বসল না। জানালায় দাঁড়িয়ে রইল বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে। কিন্তু বড্ড কনকনে হাওয়া দিচ্ছে। ঝোড়ো হাওয়া, তাতে বৃষ্টির মিশেল। বড় মাঠে একটা বাজ পড়ল বোধ হয়।
জানালার পাল্লা বন্ধ করতে না করতেই বৃষ্টির শব্দ শোনা গেল। ছোট ছোট ঢিল পড়ার মতো শব্দ হচ্ছে দক্ষিণের ঘরের টিনের চালে। পুকুরের জলে জল পড়ার শব্দ একরকম, গাছপালায় বৃষ্টির শব্দ অন্যরকম।
মন-খারাপ নিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে হঠাৎ বনশ্রী টের পায়, বাইরের বারান্দায় কাদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
–কে?
বাইরে থেকে চেঁচিয়ে জবাব আসে–ভয় নেই, আমি কুঞ্জ, ঘরের লোক।
কুঞ্জ সকলেরই ঘরের লোক। লোকে তাকে নিজেদের ঘরের ভাবুক বা না ভাবুক কুঞ্জ নিজেকে সবার ঘরের লোক বলে মনে করে। এই ব্যাপারে তার লজ্জা সংকোচ নেই। কেউ মরলে, বিপদে পড়লে, আপনি এসে হাজির হয়। নিজেই দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে কাজ উদ্ধার করে দেয়। কুঞ্জকে লোকে ভোট হয়তো এককাট্টা হয়ে দেয় না, কারণ গাঁয়ের রাজনীতি অত সরল নয়। কিন্তু তাকে পছন্দ করে সবাই। সে কারও বাড়িতে গেলে কেউ বিরক্ত হয় না।
শ্যামশ্রীর বিয়েটা ঘটিয়েছিল কুঞ্জই। রেবন্ত তার খুব বন্ধু ছিল। এখন শোনা যায়, কুঞ্জর সঙ্গে রেবন্তর নাকি দায়ে কুড়ুলে।
কুঞ্জকে কথাটা একটু বলতে হবে ভেবে বনশ্রী দরজা খুলে সপাট বাতাসের ধাক্কা খায়। দুটো দরজা ফটাং করে ছিটকে গিয়ে কাঁপতে থাকে। বাইরের গভীর দুর্যোগের চেহারাটা এতক্ষণে টের পায় বনশ্রী।
কুঞ্জদা, ঘরে আসুন। চেঁচিয়ে বনশ্রী ডাকে।
বাইরে ঘুটঘুটি অন্ধকারে দুটো ছায়ামূর্তিকে বিদ্যুতের আলোয় দেখা গেল। দেয়াল ঘেঁষে বসে আছে।
ডাক শুনে কুঞ্জ উঠে এসে বলে–ভিতরে আজ আর যাব না। জলটা ধরলেই রওনা হয়ে পড়ব।
জমে যাবেন ঠাণ্ডায়, নিউমোনিয়া হবে।
কুঞ্জ হেসে বলে–আমাদের ও সব হয় না। বারো মাস বাইরে বাইরে কাটে।
–আসুন, কথা আছে।
কুঞ্জ বলে–চা খাওয়াও যদি তবে আসি। সঙ্গে কলকাতার এক বন্ধু আছে কিন্তু।
–আহা, তাতে কী। আমরা কি পর্দানশীন? নিয়ে আসুন। ইস, বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে গেছেন একেবারে! ডাকেননি কেন?
-গেরস্তকে বিব্রত করার দরকার কী?
আসুন তো!
কুঞ্জ গিয়ে তার বন্ধুকে ডেকে আনে। দরজা নিজেই ঠেলে বন্ধ করে। বলে, ওঃ, যা ভেজাটাই ভিজেছি। ঘরের মধ্যে ভারী ওম তো! বুঝলি রাজু, এ বলতে গেলে আমাদের আত্মীয়ের বাড়ি।
বনশ্রী কুঞ্জর বন্ধুকে ইলেকট্রিকের আলোয় কয়েক পলক দেখে। একটু শুষ্ক চেহারা, চোখের দৃষ্টি একটু বেশি তীব্র, চোখদুটো লালও। গাল ভাঙা, লম্বাটে মুখ। তবে লোকটার মুখে চোখে একটা কঠোরতার পলেস্তারা আছে। খুব শক্ত লোক।
কুঞ্জ বলে–এ হল রাজু, আমার কলেজের বন্ধু, দুজনে একসঙ্গে ইউনিয়ন করতাম।
গাঁ গঞ্জে পুরুষ ছেলের সঙ্গে যুবতী মেয়েদের এরকমভাবে পরিচয় করানো হয় না সাধারণত। তবে বনশ্রীদের বাড়ির নিয়ম অন্যরকম। বনশ্রী নিজেও ছেলেদের সঙ্গে কম মেশেনি। এখন অবশ্য কেমন একটু সংকোচ এসে গেছে। বনশ্রী মৃদুস্বরে বলল-বসুন, খুব ভিজে গেছেন, শুকনো কাপড় দিই কুঞ্জদা?
–আরে না। তেমন ভিজিনি। চা খাওয়াও, তাতেই গা গরম হয়ে যাবে।
রাজু বনশ্রীর দিকে একবারের বেশি তাকায়নি, কথাও বলেনি। এ ঘরে একটা পাটিতে ঢাকা চৌকি আর কয়েকটা কাঠের ভারী চেয়ার আছে। কুঞ্জ চৌকিতে বসল, রাজু চেয়ারে। কুঞ্জ নিঃসংকোচে, রাজু ভারী জড়সড় হয়ে।
কুঞ্জ বলল কী কথা আছে বলছিলে?
-আগে চা আনি।
ছাতা মাথায় উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘর পর্যন্ত যেতেই বনশ্রী বৃষ্টি আর হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে উঠছিল।
উনুনের সামনে বসা সবিতাশ্রী ঠাণ্ডা কঠিন মুখটা ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে বললেন–কে এসেছে?
কুঞ্জদা। ওঁকে কি জামাইবাবুর কথাটা বলব মা?
সবিতাশ্রী সামান্য সময় নিয়ে বললেন-দরকার কী? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে বাইরের লোকের না যাওয়াই ভাল।
সবিতাশ্রীর মতই এ বাড়িতে আদেশ। এত বড় হয়েছে বনশ্রী, এখনও মার মুখের কথার বিরুদ্ধে যেতে সাহস পায় না। তারা কোনও ভাইবোনই পায় না।
সবিতাশ্রীকে কিছু বলতে হল না, বড় উনুনের ওপর রান্নার কড়াইয়ের পাশে চায়ের কেটলি বসিয়ে দিলেন। বললেন–তুমি যাও, কুসুমকে দিয়ে চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। কজন?
–দুজন।
–মুড়ি দিও চায়ের সঙ্গে।
কিন্তু মুড়িটুড়ি ছুঁলও না কেউ। বনশ্রী দ্বিতীয়বার ঘরে আসার পর রাজু তার দিকে বারকয়েক তাকাল। তারপর প্রথম যে কথাটা বলল তা কিছু অদ্ভুত।
–একটু আগে আমাদের খুব ফাড়াগেছে। তিনটে লোক বড় মাঠে কুঞ্জকে খুন করতে চেষ্টা করেছিল। হাসিমুখে ঠাণ্ডা গলায় বলল রাজু।
বনশ্রী অবাক হয়ে বলে–সেকী!
কুঞ্জ মাঝখানে পড়ে বলে–আহাঃ, ও সব কিছু নয়। রাজু, তোর আক্কেলটা কী রে?
বনশ্রী একটু বিরক্ত হয়ে বলে কোচ্ছেন কেন কুঞ্জদা? এ অঞ্চলের ব্যাপার যখন আমাদেরও জানা দরকার। তিনটে লোক কারা?
অন্ধকারে দেখেছি নাকি? হবে কেউ। কুঞ্জ উদাসী ভাব করে বলে।
কিন্তু বনশ্রীর ধারণা হয়, কুঞ্জ একেবারে না দেখেছে এমন নয়। হাতে টর্চ আছে, অন্তত এক ঝলক হলেও দেখা সম্ভব। তা ছাড়া কুঞ্জ না চেনে হেন লোক এখানে নেই। অন্ধকারেও ঠিক ঠাহর পাবে।
বনশ্রী বলে–মারতে পারেনি তা হলে?
কুঞ্জ মাথা নেড়ে বলে–রাজু থাকায় বেঁচে গেছি। ওকে দেখে ওরা ভড়কে যায়। তিনজনকে আশা করেনি তো। ভেবেছিল রোজকার মতো আমি আর রবি ফিরব।
–রবি কোথায়? বনশ্রী জিজ্ঞেস করে।
—রবির ওপরই প্রথম হামলা করে। সে টর্চ ফেলে দৌড়।
–আপনার লাগেটাগেনি তো!
না।
চা খেতে বৃষ্টির জোর কিছু মিয়োলো। বনশ্রী দুটো লেডিজ ছাতা এনে দিয়ে বলল–আমার আর চিরুরটা দিয়ে দিচ্ছি। আর ভিজবেন না।
কুঞ্জ উঠে দাঁড়িয়ে বলল–কী কথা বললে না তো!
–আজ থাক।
–থাকল না হয়। রেবন্ত আর শ্যামার কথা বলবে না তো?
বনশ্রী চুপ করে থাকে। কী বুঝল কুঞ্জ কে জানে, তবে কথা বাড়াল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-চ, রাজু।
দুজনে চলে গেলে বনশ্রী ভাবতে বসে।
.
০৪.
অন্ধকার উঠোন ছপ ছপ করছে জলে। বৃষ্টির জোর কমে গিয়ে এখন ঝিরিঝিরি পড়ছে। এই গুড়ো বৃষ্টি সহজে থামে না। সেই সঙ্গে পাথুরে ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বইছে থেকে থেকে, দমকা দিয়ে। শরীরের হাজারটা রন্ধ্রপথ দিয়ে হাড়পাঁজরে ঢুকে কাঁপ ধরাচ্ছে।
খাওয়া-দাওয়া সেরে রাজু আর কুঞ্জ ঘরে এসে বসেছে। এ ঘরটা বাইরের দিকে, ভিতর বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এটায় কুঞ্জ থাকে। ভিতর বাড়িতে তাদের সংসারটা বেশ বড়সড়। রাজু সঠিক জানে না, কুঞ্জরা ক ভাইবোন। আন্দাজ পাঁচ-ছ জন হবে। নিজের বাড়ির সঙ্গে কুঞ্জর সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। খায়, ঘুমোয় এই পর্যন্ত।
গামছায় ঘষে ঘষে পায়ের জল মুছল কুঞ্জ চৌকিতে বসে। বলল রবির বাড়িতে একটু খোঁজ নিতে হবে।
রাজু বিরক্ত হয়ে বলে-রাত বাজে নটা। তার ওপর এই ওয়েদার।
-আরে দূর। এ আবার আমাদের রাত নাকি? তুই শুয়ে পড়! আমি একটু জিরিয়ে নিয়ে বেরোব। বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাব, তোকে উঠে দরজা খুলতে হবে না।
একটি অল্পবয়সি বউ একটু আগে এসে ঘুরঘুর করে গেছে এ ঘরে। বিছানাটা টানটান করল, আলনাটা খামোকা গোছাল। ঘোমটা ছিল একটু, তবু ঢলঢলে মুখখানা দেখতে পেয়েছিল রাজু। দুখানা মস্ত চোখে কেমন একরকমের মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি। রাজুর মনটা বার বার রাডার যন্ত্রে কী একটা অস্ফুট তরঙ্গ টের পেয়েছিল তখন। সেই বউটাই এখন পিরিচে পান সুপারি দিয়ে গেল ঘরে। আজকাল রাজু যেন অনেক কিছু টের পায়। অনেক অদ্ভুত গন্ধ, স্পর্শ, তরঙ্গ। যেগুলো স্বাভাবিক মানুষ পায় না।
কুঞ্জ অন্য দিকে চেয়ে ছিল। বউটা চলে যেতেই বলল-ও হল কেষ্টর বউ। বাগনানের এক মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে। বিয়েটা দিতে অনেক ঝামেলা গেছে।
কেষ্ট কে?
কুঞ্জ উদাস স্বরে বলে–আমার মেজো ভাই। দেখেছি, মনে নেই হয়তো। অল্প বয়সেই নেশা-ফেশা করে খুব খলিফা বনে গিয়েছিল। তার ওপর এই মেয়েটার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি শুরু করে। উদ্যোগী হয়ে আমিই বিয়েটা দিই। কিন্তু বাড়িতে সেই থেকে মহা অশান্তি। বউটাকে দিনরাত কথা শোনাচ্ছে, উঠতে বসতে বাপান্ত করছে।
-কেন?
–এরকমই হয়। বিয়ের নামে ছেলে বেচে মোটা টাকা আসে যে। এই কেসটায় তো সেটা হয়নি। বললে বিশ্বাস করবি না, কেষ্ট পর্যন্ত সেই কারণে আমার ওপর টা। বলে কুঞ্জ অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর খুব অন্যমনস্ক ভাবে বলে–এরপর আর বিরে ঘটকালিটা করবই না ভাবছি। কয়েকটা অভিজ্ঞতা তো হল। সত্যবাবুর বাড়িতে যে মেয়েটাকে দেখলি তার বড় বোন শ্যামার বিয়ে আমিই দিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও খুব গণ্ডগোল বেঁধে গেছে। আমার কপালটাই খারাপ।
রাজুর এ সব ভ্যাজর ভ্যাজর কথা ভাল লাগছিল না। সটান বিছানায় শুয়ে গায়ে মস্ত লেপটা টেনে নিয়ে চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে চোখ বুজল। বুজতেই কীর ঢলঢলে মুখখানা দেখতে পেল চোখের সামনে। কেমন স্নিগ্ধতায় ভরে গেল ভিতরটা। বড় সুন্দর মেয়ে। ও যদি আমার বউ হত।
অবশ্য এটা কোনও নতুন ভাবনা নয়। সুন্দর মেয়ে দেখলেই মনে হয়-ও যদি আমার বউ হত।
কাঠের চেয়ারে একটু কচমচ শব্দ হয়। কুঞ্জ উঠেছে, টের পায় রাজু। ওর হচ্ছে বুনো মোষের স্বভাব। যা গোঁ ধরবে তা করবেই। রবির খোঁজ কাল সকালেও নেওয়া যেত।
চোখ বুজেই রাজু বলে-কুঞ্জ, একটা কথা বলব?
বল।
–যারা মাঠের মধ্যে রবিকে ধরেছিল তাদের কাউকে তুই চিনিস না?
কুঞ্জ একটু সময়ের ফাঁক দিয়ে বলে-কী করে চিনব? দেখতেই পেলাম না ভাল করে।
–আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে, তুই চেপে যাচ্ছিস।
না রে। তবে রবি কাউকে দেখে থাকতে পারে। ওর হাতে টর্চ ছিল। যদি দেখে থাকে তবে বিপদে পড়বে। লোকগুলো ভাল নয়।
রাজু শ্বাস ফেলে বলে–রবি দেখেছে, তুইও দেখেছিস। ভাল করে না দেখলেও আবছা দেখেছিস ঠিকই। কিন্তু পলিটিকস করে করে তোর মনটা এখন খুব প্যাঁচালো হয়ে গেছে। তাই চেপে যাচ্ছিস।
কুঞ্জ নরম স্বরে বলল–সিওর না হয়ে কোনও মত দেওয়া ঠিক নয় রে। তাই জোর দিয়ে কিছু বলতে পারব না।
তুই যে বেরোচ্ছিস, ওরা যদি ধারে কাছে ওঁৎ পেতে থেকে থাকে, তা হলে?
–এই বৃষ্টি বাদলায় শেয়ালটাও বাইরে নেই, ওরা তো মানুষ। বলে কুঞ্জ একটু হাসে।
রাজু আর কিছু বলল না। শুয়ে থেকে চোখ বুজেই টের পায় কুঞ্জ বেরোল, বাইরে শিকল টেনে তালা দিল। কেষ্টর বউয়ের চোখে ওরকম মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি কেন তা ভাবতে থাকে রাজু। বউটা কি কেষ্টকে ভালবাসে না? অন্য কাউকে বাসে?
লেপের ওম পেয়েও ঘুমটা ঘনিয়ে এল না রাজুর। ভিতরটা বড় অস্থির। বুকের মধ্যে ধমাস ধমাস করে মিলিটারির বুটজুতোর মতো তার হৃৎপিণ্ড শব্দ করছে।
চারদিকে ঘনঘোর বৃষ্টির বেড়াজাল। অবিরল বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে। মেঘ ডেকে উঠছে দূরে বাঘের মতো। হাওয়া দাপিয়ে পড়ছে গাছপালায় জানালায় দরজায়। কেন একা করে দেয় তাকে এই দুর্যোগ। আর যখনই একা মনে হয় নিজেকে তখনই সে সেই কালো আকাশ আর নীলাভ উজ্জ্বল রথটির কথা ভাবে। মনে পড়ে মৃত্যু।
রাজু উঠে বসে। ভেজা জামাটা একটা পেরেকে ব্রাকেটে ঝুলছে। উঠে গিয়ে পকেট থেকে সিগারেট আর দেশলাই বের করে আনে। কিন্তু সিগারেট ধরাতে পারে না। দেশলাইটা জলে ভিজে মিইয়ে গেছে। এ ঘরে লণ্ঠনের ব্যবস্থা নেই। কাপড়কলের পাওয়ার হাউস থেকে বিজলি আসে বলে তেঁতুলতলায় প্রায় কলের ঘরেই বিজলি বাতি। সন্ধেবেলা আলো ঢিমিয়ে জ্বলে, রাত হলে আলোর তেজ বাড়ে।
রাজু সিগারেটের প্যাকেট আর দেলাই হাতে করে বসে রইল চুপচাপ। আর বসে থেকে সিগারেট ধরানোর কথা ভুলে গেল। ভিতর বাড়ি থেকে একটা চেঁচামেচির শব্দ আসছে। উল্টোপাল্টা হাওয়া আর বৃষ্টিতে প্রথমটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। তারপর চেঁচানিটা চৌদুনে উঠে গেল। সেই সঙ্গে মারের শব্দ। মেয়েগলার আর্ত চিৎকার। তারপর অনেক মেয়েপুরুষের গলায় চেঁচামেচি–ছেড়ে দে! আর মারিস না! ও নিতাই, ধর না বউটাকে! কেষ্ট, এই কেষ্ট, কী হচ্ছেটা কী? ইত্যাদি। রাজু একটু চমকে গেলেও খুব যেন অবাক হল না। তার মাথায় এখন একটা রাডার যন্ত্র কাজ করে। সে বুঝতে পারে, এরকমই হওয়ার কথা। সম্পর্কের মধ্যে মৃদু বিষ মিশেছে ওদের।
মারের এই সব শব্দ যেন রাজুর ভিতরে বোমার মতো ফেটে পড়ছিল। তার চার পাশের পৃথিবী আজকাল তাকে এইভাবেই আক্রমণ করে। মারধোর, চেঁচামেচি, গালমন্দ তাকে অসম্ভব অস্থির করে তোলে। এমনকী সে আজকাল দুর্ঘটনার খবর পর্যন্ত পড়তে পারে না, খুনখারাপির সংবাদ এড়িয়ে যায়, মৃত্যুর খবর সইতে পারে না। অথচ তার চারপাশে অবিরল এইসবই ঘটছে।
রাজু উঠে সন্তর্পণে ভিতর বাড়ির দিকের দরজাটা খুলে অল্প ফাঁক করে। হাওয়ার চাপে দরজাটা তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। পাল্লা ঠেসে ধরে রাখতে বেশ জোর খাটাতে হয় তাকে। পাল্লার ফাঁক দিয়ে দেখে, উঠোনের ডান পাশে কিছু তফাতে এক ঘরের বারান্দায় কিছু চাকরবাকর শ্রেণীর লোক লণ্ঠন ঘিরে উবু হয়ে বসেছে। সেই ঘরের বারান্দায় কিছু মেয়েপুরুষ দাঁড়িয়ে দরজা ধাকাচ্ছে। একজন মোটা লোক চেঁচিয়ে বলে-মেরে ফেলবি নাকি রে হারামজাদা? ফাঁসিতে ঝুলবি যে! গলাটা ছেড়ে দে বলছি এখনও।
হাওয়া ভেদ করেও বন্ধ ঘর থেকে একটি মেয়ের অবরুদ্ধ গলার কোঁকানি আসছিল। হাঁফ ধরা, দম বন্ধ আর সাদাতিক কষ্ট থেকে মাঝে মাঝে ছাড়া পেয়ে গলার স্বরটা গোঙায়। একজন পুরুষের গলা প্রচণ্ড চাপা আক্রোশে ঝলছে-কল চামনা! বাঁচতে চাস তো স্বীকার কর।
বারান্দার লোকগুলো উবু হয়ে বসে নির্বিকারে খেতেই থাকে। তাদের মাঝখানে লণ্ঠনটার আলো দাপিয়ে উঠে নিভে যেতে চায়। একজন একটা র্যাপার দিয়ে লণ্ঠনকে হাওয়া থেকে আড়াল করল। মস্ত একটা ছায়া পড়ল উঠোনে। হয়তো বারান্দার বিজলি আলো ফিউজ হয়ে গেছে, কিংবা হয়তো চাকরবাকর খাচ্ছে বলে বিজলি আলো জ্বালানো হয়নি। কে জানে রহস্য?
আঁচলে মাথা ঢেকে একটা মেয়ে উঠান থেকে এ বারান্দায় উঠে এসেছে। ও বারান্দার লণ্ঠনের আলো আড়াল করে সে সামনে এসে দাঁড়াতেই রাজু চমকে ওঠে এবং মেয়েটার মুখোমুখি পড়ে যায়।
মেয়েটা দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে চাপা তীব্র স্বরে ডাকে–বড়দা!
রাজু দরজা ছেড়ে দিতেই পাল্লা দুটো ছিটকে খোলে। মেয়েটা চৌকাঠে দাঁড়িয়ে রাজুকে দেখেই একটু আড়ালে সরে বলো নেই?
-একটু বেরিয়েছে।
রাজু মেয়েটাকে চেনে।ক্ষর তিনটে আইবুড়ো বোনের একটি। কখনও কথাটথা বলেনি আগে।
মেয়েটা বিপন্ন গলায় বলেকেখায় গেছে বলে যায়নি?
রবির বাড়ি। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে রাজু বলেই ফেলল–ও ঘরে কী হচ্ছে বলে তো?
মেয়েটির বয়স বেশি নয়, বছর পনেরো-ষোলো হবে। দেখতে কালো, রোগা, দাঁত উঁচু। আড়াল থেকেই জবাব দেয়–মেজদা খেপে গেছে।
-কেন?
মেয়েটা জবাব দেয় না। রাজু রিক্ত হয়ে একটু ধমকের স্বরে বলে–তুমি ভিতরে এসো তো! ব্যাপারটা খুলে বল।
মেয়েটা বোধ হয় ঘাবড়ে গিয়েই ঘরে এসে দাঁড়ায়। গায়ে আধভেজা শাড়ি আর খদ্দরের নকশা-চাদর। শীতে জড়সড়। মাথা সামান্য নিচু করে ভয়ের গলায় বলে–দোষটা বউদিরই। বাপের বাড়িতে খবর দিয়েছিল নিয়ে যাওয়ার জন্য। আজ বিকেলে ভাই এসেছিল নিয়ে যেতে। এ বাড়ির কাউকে আগে জানায়নি পর্যন্ত। খবর পেয়ে মেজদা রেগে গেছে।
রাজু ঘরের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে রাগে গরম হচ্ছিল। কঠিন গলায় বলে–কেষ্ট কি মদ খেয়ে এসেছে?
–সে তো রোজ খেয়ে আসে।
বউটাকে তো খুনও করে ফেলতে পারে। তোমরা কী করছ?
–সেই জন্যই তো বড়দাকে খুঁজছি। কেউ ঘরে ঢুকতে পারছে না যে!
–রোজ মারে?
মেয়েটা একটু থতমতভাবে চেয়ে মাথাটা এক ধারে নেড়ে বলে-মারে, তবে রোজ নয়। আজ বড্ড খেপে গেছে। কী যে করছে, মাথার ঠিক নেই।
মাথার ঠিক নেই।
মাথার ঠিক নেই রাজুরও। মাথার মধ্যে একটা আগুনের গোলা ঘুরছে। কথার ওজন না রেখে সে গাঁক করে উঠে বলে–কেষ্টকে গিয়ে বলল, এক্ষুনি যদি বাঁদরামি বন্ধ না করে তবে আমি ওর প্রত্যেকটা দাঁত ভেঙে দেব। তারপর পুলিশে চালান করব। যাও বলো গিয়ে। বোলো, আমার নাম রাজীব ব্যানার্জি।
মেয়েটা কোনও জবাব দিল না। কিন্তু তাড়াতাড়ি চলে গেল।
বুঝতে কষ্ট হয় না যে এ সব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু রাজুর ভিতর থেকে একটা পুরনো রাজু ফুঁসছে, আঁচড়ে কামড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ভিতরের সেই ছটফটানিতে সে বসে বসে কাঁপে। তারপর শান্ত অবসাদ নিয়ে বসে থাকে। ও ঘরের সামনের বারান্দায় কেউ নেই এখন। অন্ধকার দরজার ফাঁক দিয়ে আলোর একটু চিকন রেখা দেখা যাচ্ছে মাত্র।
ঠাণ্ডায় কান কনকন করছিল রাজুর। ভেজা বাতাসে ঘরটা স্যাঁতস্যাঁত করছে। ঘরের বিজলি আলো এখন টিমটিম করে জ্বলছে। খোলা দরজার সামনে বসে সে কেষ্টর ঘরের দিকে ভয়ঙ্কর চোখে চেয়ে ছিল।
হুড়কো খোলার শব্দ হল। তারপর ও ঘরের দরজা খুলে একটা লোক বেরিয়ে এল। কেষ্টই হবে। বারান্দা থেকেই খুব মেজাজি গলায় ডাকল–টুসি! এই টুসি!
কোত্থেকে যাই মেজদা সাড়া দিল টুসি। কেষ্ট ফের ঘরে ঢুকে পড়ে। একটু বাদে রাজু দেখে সেই কালো রোগা কিশোরী মেয়েটা দৌড় পায়ে এসে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
একটু বাদে দরজাটা খুলে টুসি কেষ্টর বউকে ধরে ধরে বারান্দায় আনে। বউটা টুসির কাঁধে মাথা রেখে এলিয়ে রয়েছে। বারান্দার ধারে টুসি তাকে উবু করে বসায়। একটা ঘটি থেকে জল দেয় চোখে মুখে। ঘরের ভিতরে আলোয় সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে দেখতে পায় রাজু।
হঠাৎ তার দমকা রাগটা আবার ঘূর্ণি ঝড়ের মতো উঠে আসে ভিতর তোলপাড় করে। পুরনো রাজু তার পাঁজরায় ধাক্কা মেরে বলেওঠো। ওই শুয়োরের বাচ্চার দাঁত কটা ভেঙে দাও।
এই রকমই রাগ ছিল রাজুর। গোখরোর মতো ছোবল তুলত সে। রাজু কত লোককে যে মেরেছে তার হিসেব নেই। মার খেয়েছেও বিস্তর। কিন্তু যেখানে প্রতিবাদ করা উচিত সেখানে কোনওদিন সে চুপ করে থাকেনি। একশো জন বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও নয়।
কিন্তু আজকাল এ কেমন ধারা হয়ে গেছে রাজু? একটা স্বপ্ন কি মানুষকে শেষ করে দিতে পারে এত নিঃশেষে? বসে বসেই নিজের রাগের হলকায় পুড়ে যাচ্ছে সে, কিন্তু কিছুতেই উঠোনের দূরত্বটুকু পেরিয়ে গিয়ে ওই হারামজাদার চুলের মুঠি ধরে বের করে আনতে পারছে না। একদিকে ভিতরে যেমন রাগ ফোঁস ফোঁস করছে, অন্যদিকে তেমনি বুকের মধ্যে এক ভয়ের পাতাল কুয়ো।
বউটি মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে তেমনি টুসির ওপর ভর রেখে ঘরে গিয়ে ঢোকে।
রাজু উঠে এসে বিছানায় আধশোয়া হয়ে গলা পর্যন্ত লেপ টেনে নেয়। চোখ বুজে ঠাণ্ডার ছোবল খেতে থাকে চুপ করে।
হঠাৎ চোখ চেয়েই রাজু কুঞ্জর বোনকে দেখতে পায়। একটা পেতলের জলের জগ আর গেলাস রাখছে টেবিলের ওপর। রাজুকে তাকাতে দেখে কুণ্ঠিত স্বরে বলল–আর কিছু লাগবে আপনার?
রাজু উঠে বসে বলে–একটা দেশলাই দিতে পার?
–দিচ্ছি। বলে মেয়েটা চলে যায়। রাজু টের পায়, মেয়েটা এ ঘরের বারান্দার কোনা থেকে কেষ্টর ঘরের বারান্দার কোনায় লাফিয়ে চলে গেল। দরজায় শেকল নেড়ে কেষ্টর কাছে দেশলাই চাইল।
একটু বাদে দেশলাই হাতে এসে বলে–এই যে।
মেয়েটার সামনে রাজুর লজ্জা করছে। হাত বাড়িয়ে দেশলাইটা নিয়ে বলে–আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম তখন। মেয়েমানুষের গায়ে হাত তোলাটা কে সহ্য করতে পারে বলো!
টুসি রাজুর দিকে অপটে চেয়ে থাকে। চোখের দৃষ্টি খুব স্বাভাবিক নয়। কেমন যেন গভীর আতঙ্কের ছাপ আছে। একটু চেয়ে থেকে বলল বউদির কিন্তু খুব লেগেছে। কেমন এলিয়ে পড়ে যাচ্ছে বার বার। কথা বলতে পারছে না। চোখ উল্টে আছে। দাঁত লেগে যাচ্ছে। আর…
বলে টুসি দ্বিধা করে একটু।
রাজুর শরীরে লোম দাঁড়িয়ে যেতে থাকে। ভয়ে, রাগে। বলে–আর কী?
-খুব স্রাব হচ্ছে। পোয়াতি ছিল। কী জানি কী হবে!
ডাক্তার নেই আশেপাশে?
মেয়েটা ভয়-খাওয়া গলায় বলে–রাধু যাচ্ছিল ডাকতে। মেজদা তাকে বলেছে ডাক্তার ডাকলে খুন করে ফেলবে। বড়দা কোথায় যে গেল! বড়দা ছাড়া এখন কেউ কিছু করতে পারবে না।
এই বলতে বলতে টুসি চোখের জল ফস করে আঁচলে চেপে ধরে।
আজকাল একটা অক্ষম মন নিয়ে চলে রাজু। বর্ষার জলকাদায় খাপুর খুপুর করে যেমন কষ্টে চলতে হয়, রাজুর বেঁচে থাকা এবং কাজ কর্তব্য করাটাও তেমনি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব কাজেই তার ভয়, সব সিদ্ধান্তেই তার নানারকম দ্বিধা।
তবু কষ্টে সে নিজের মনটাকে ঝেড়ে ফেলে উঠে পড়ে। বলে–একটা ছাতা দাও, আর রাধুকে ডেকে দাও।
ধরা গলায় টুসি বলে–আপনি যাবেন?
–যেতেই হবে। নইলে বউটা মরে যাবে যে!
টুসি একটু ভরসা পেয়ে বলে-ঝড়-বাদলায় আপনার যেয়ে দরকার নেই। রাধু ডেকে আনতে পারবে। আপনি শুধু মেজদাকে একটু সামলাবেন। আপনি বড়দার বন্ধু তো, তার ওপর কলকাতার লোক। আপনি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কিছু বলতে সাহস পাবে না।
রেগে গেলে রাজু সেই পুরনো রাজু। ভয়ডর থাকে না, দ্বিধা থাকে না।
রাজু উঠে দাঁড়িয়ে বলে-আধুকে দৌড়ে যেতে বলল। আমি কেষ্টর ঘরে যাচ্ছি। দড়িতে কুঞ্জর একটা খদ্দরের চাদর ঝুলছিল। সেটা টেনে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে উঠোন পেরিয়ে গিয়ে কেষ্টর দরজায় ধাক্কা মেরে বলল-এই কেষ্ট। দরজাটা খোলো তো।
কেষ্ট দরজা খুলে বেকুবের মতো চেয়ে থাকে। বেশ আঁটসাট গড়নের লম্বাটে চেহারা। ভুরভুর করে কাঁচা দেশি মদের গন্ধ ছাড়ছে। গায়ে এই শীতেও কেবল একটা হাতওলা গেঞ্জি।
রাজু ধমক দিয়ে বলে কী হয়েছে?
অবাক কেষ্ট গলা ঝেড়ে বলে সাবির শরীরটা খারাপ হয়েছে। রক্ত যাচ্ছে।
ওকে এক্ষুনি একটা চড় কষাতে ইচ্ছে করে রাজুর। কিন্তু সেই সঙ্গে ওর মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারে, কেষ্ট তাকে দেখে ভয় পেয়েছে। এ ব্যাপারটা বেশ ভাল লাগে রাজুর। তাকে যে কেউ ভয় পাচ্ছে এটা ভেবে তার আত্মবিশ্বাস এসে যায়। গম্ভীর গলায় সে বলে তার জন্য কী ব্যবস্থা করেছ এতক্ষণ? কাউকে ডাকনি কেন?
কেষ্ট সামনের বড় বড় শুকনো দাঁতগুলোয় জিভ বুলিয়ে বলে–কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি একবার ভিতরে এসে দেখুন না, খুব সিরিয়াস কেস কি না!
ভিতর থেকে গভীর যন্ত্রণার একটা গোঙানির শব্দ হয় এ সময়ে। রাজুর শরীর কেঁপে ওঠে। একটু আগেই বউটা পান দিয়ে এল ঘরে। আর এখন মরতে চলেছে বুঝি! সে এ সব যন্ত্রণার দৃশ্য সহ্য করতে পারে না আজকাল। রক্তের রং দেখলে তার হাত পা মাথা অবশ হয়ে যায়। সে মাথা নেড়ে বলে, না! তুমি বরং লোকজন ডেকে আনো।
কেষ্টর রগচটা ভাব মরে গিয়ে এখন সত্যিকারের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মদের নেশা কেটে গেছে একেবারে। বললযাচ্ছি। আপনি একটু দাঁড়ান এখানে, টুসি এক্ষুনি আসবে।
এই বলে কেষ্ট উঠোনে নেমে অন্ধকারে কোথায় তাড়াতাড়ি নিমেষে মিলিয়ে যায়। ওর ভাবসাব রাজুর ভাল লাগল না। তার মনে হল, কেষ্ট এই যে গেল, আর সহজে ফিরবে না। কেষ্টর যাওয়ার ভঙ্গি দেখেই রাজুর ভিতরের রাডার যন্ত্রে ব্যাপারটা ধরতে পারে রাজু। কেষ্ট বোধ হয় ধরেই নিয়েছে যে সাবি বাঁচবে না। থানাপুলিশ হবে। তাই পিটটান দিল।
৫-৮. ছাতার শিক ছটকে উল্টে গেছে
০৫.
হাউর বাতাসে ছাতার শিক ছটকে উল্টে গেছে, হাঁটুভর কাদা আর ঝড় বাদলা ঠেলে শেয়ালের মতো ভিজতে ভিজতে রবিরবাড়ি পৌঁছয় কুঞ্জ। ভেজা শরীরে বাতাস লেগে শীতে মুরগির ছানার মতো কাঁপছে।
ডাকাডাকিতে খোড়ো চালের মেটে ঘর থেকে জানালার ঝাঁপ ঠেলে সতর্ক চোখে কুঞ্জকে আগে দেখে নেয় রবি। দরজা খুলতেই কুঞ্জ দেখল রবির হাতে একটা মস্ত দা। কুঞ্জ জামাকাপড়ের জল যথাসাধ্য নিংড়ে ঘরে ঢুকতেই রবি দড়াম করে দোর দিয়ে বাঠাম লাগাল। কনো মুখে আর চোখের চাউনিতে কুঞ্জকে ভাল করে আর একবার দেখে নিয়ে দাটা কুলুঙ্গিতে খাড়া করে রেখে এসে বলল– ভাবলাম বুঝি তোমার পেটি আর গাদা আলাদা করেছে শালারা।
শীতে সিটিয়ে গেছে কুঞ্জ। দাঁতে দাঁতে ঠকঠক শব্দ। চাদর নিংড়ে মাথা গা মুছতে মুছতে বলে চিনতে পেরেছিস?
রবি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে–টের পেলে খুন করবে। তুমি বলেই বলছি। শালা লাফ দিয়ে সামনে পড়ে আমার চুলের মুঠি ধরে মাথাটা নামিয়ে ফেলল, হাতে অ্যাই বড় গজ। মুখটা কম্ফর্টারে ঢাকা। খুব একটা ঘড়ঘড়ে খাসের শব্দ হচ্ছিল। আমি তো সব সময়ে তোমার পেছু পেছু যাই, তাই মনে হয় আমাকে তুমি ভেবে ভুল করেছিল। গজ যেই তুলেছে, অমনি পিছন থেকে আর এক শালা বলল ওটা কুঞ্জ নয়, রবি। দুটো গাট্টা দিয়ে ছেড়ে দে, খুব পালাবে। তখন ছাড়ল। পেটে দুটো হাটুর গুতো দিয়ে বলল-রা করলে খুন হয়ে যাবি। ছাড়া পেয়ে পোঁ-পোঁ দৌড়ে পালিয়ে এসেছি। পালাতে পালাতেই ঠিক পেলুম, এ হল পটল। পিছনের দুজন কে ঠাহর পাইনি। একজন লম্বা।
কুঞ্জর গা থেকে জল গড়িয়ে ঘরে থকথকে কাদা হয়ে গেল। একদিকে বাঁশের মাচানে চ্যাটাই আর গুচ্ছের ময়লা কাঁথার বিছানা। অন্য ধারে একটা মস্ত ছাগল চটের জামা পরে একরাশ নাদির মধ্যে বসে এই রাতেও কী চিবোচ্ছে। ঘরময় ভরভরে ছাগলের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কুঞ্জ রবির দিকে স্থির চোখে চেয়ে সবটা শুনে মৃদু স্বরে বলল দেখেছিস দেখেছিস। ক্লাবে কিছু জানাসনি তো!
যখন দৌড়চ্ছি তখন ক্লাবের সামনে একজন জিজ্ঞেস করছিল কী হয়েছে, কেন দৌডুচ্ছি। কিন্তু তখন এত হাঁফ ধরেছে যে মুখে কথা এলই না। তোমাকে কী করল?
কী করবে! কিছু করেনি।
–তুমি মরে ভূত হয়ে আসনি তো কুঞ্জদা!ইস, ভিজে ঢোল হয়েছ। আমার ক্যাঁথা কম্বল গায়ে দিয়ে বোসো। ছাতাটা দাও, সুতো দিয়ে শিকগুলো বেঁধে দিই।
রবির ঘরে ছাগলের গন্ধের মধ্যে ময়লা কাঁথা আর তুলোর কম্বল গায়ে চাপিয়ে অনেকক্ষণ ঝুম হয়ে বসে থাকে কুঞ্জ। বস্তা থেকে সুতলি খুলে রবি খুব যত্নে ছাতার ডাঁটির সঙ্গে শিকের ডগাগুলো বেঁধে দিচ্ছিল, যাতে বাতাসে ফের উল্টে না যায়। বলল-ক্লাবে খবর দেবে না? তোমার গায়ে ফের হাত পুড়েছে শুনলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে, মক্তগঙ্গা বইবে। ৭৫২
কুঞ্জ জবাব দিল না। চোখ বুজে সে একটা লম্বা লোকের কথা ভাবছিল। রবির টর্চটা কেতরে পড়েছিল মাঠে। আলোটা টেরছা হয়ে ওপর দিকে উঠেছে। সেই আলোতে ক্ষণেকের জন্য একটা ফর্সা মুখ ঝলসে উঠেছিল। রেবন্ত।
কুঞ্জ ছাতাটা নিয়ে উঠে পড়ে বলল কাউকে কিছু বলিস না। বিপদে পড়ে যাবি। যা করার আমিই করব।
রবি অবাক হয়ে বলল-তুমি একা কী করবে? ও হল খুনে পটলা। ভাল চাও তো ক্লাবে খবর দাও।
সুস্থির চোখে রবির দিকে চেয়ে কুঞ্জ বলে কাউকে না। কাকপক্ষীতেও জানবে না। বুঝেছিস?
রবি তবু মাথা নেড়ে বলে–পাবলিসিটি হবে না বলছ? তুমিই তো বলো, এরকম সব হামলা-টামলা হলে লোকের পপুলারিটি বাড়ে, ভোট পাওয়া যায়! এমন একখানা জলজ্যান্ত কাণ্ড চেপে যাবে?
কুঞ্জর এত দুঃখেও হাসি হাসে। রবি যে রবি, সেও আজকাল পলিটিক্সের শেয়াল হয়ে উঠল। কথাটা মিথ্যেও নয়। যেবার বুকে সড়কি খেল সেবার হু-হুঁ করে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তখন ভোট হলে কুঞ্জ জিতে যেত। কিন্তু কুঞ্জ জানে, এটা ভোটের মামলা নয়। সে যদি মরে তা হলে এখন হয়তো এ চত্বরে অনেকেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। রবির দিকে চেয়ে নে ঠাণ্ডা গলায় বলে অনেক ব্যাপার আছে রে। তুই সব বুঝবি না।
দরজা খুলে দিয়ে রবি বলল–সাবধানে যেয়ো। তারপর একটু লজ্জার স্বরে বলেবুঝলে কুঞ্জদা, সবসময়ে মনে হয় আমি তোমার জন্য জান দিতে পারি, কিন্তু আজ বিপদে পড়ে প্রাণটা কেন যেন পালাই-পালাই করে উঠেছিল। তুমি হয়তো ভাবছ, রবিটা নেমকহারাম। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি…
আবার জলঝড় ঝাঁপিড়ে পড়ে কুঞ্জর ওপর। তোল্লাই বাতাস এসে হ্যাঁচকা টান মারে খোলা ছাতায়। খুব ভাল করে শিক বেঁধে দিয়েছে রবি। সহজে ওলটাবে না। বাতাসের মুখে ছররার মতো ছিটকে আসছে জলের ফোঁটা। কুঞ্জ প্রাণপণে ছাতার আড়াল রাখতে চেষ্টা করে। কাদায় পা রাখা দায়, একবার পা ফেললে দু-তিন কিলো কাদা পায়ে আটকে উঠে আসে। ভুসভাস নরম মাটিতে গেঁথে যাচ্ছে পা। বাতাস টালাচ্ছে। শীতের কম্প উঠে পেট বুক কাঁপিয়ে তুলছে। কুঞ্জ কোনওক্রমে শুধু এগিয়ে যাওয়াটা বজায় রাখতে থাকে। আর মনের মধ্যে বার বার বীজমন্ত্রের মতো পপুলারিটি শব্দটা এসে হানা দেয়।
এর আগেও কুঞ্জর ওপর বহু হামলা হয়ে গেছে। দুবার মরতে মরতে বেঁচেছে। কিন্তু তাতে দমে যায়নি কুঞ্জ। তখন শত্রুপক্ষ তাকে মর্যাদা দিতে, প্রবলতর প্রতিদ্বন্দ্বী বলে ভাবত, যত জখম হয়েছে তত লোকের কাছে সে হয়ে উঠেছে গুরুতর মানুষ। লোকে তো আর যাকে তাকে খুন করতে চায় না। কুঞ্জ খুব বিচক্ষণের মতোই সেইসব হামলার ঘটনাকে ভাঙিয়ে নিয়েছিল রাজনীতির খুচরো লোভে। কিন্তু সে জানে, আজকের মামলা তা নয়। ধারে কাছে কোনও নির্বাচন নেই, কোনও তেমন রাজনৈতিক ঘটনা ঘটেনি। আজ তার কপালে ছিল উটকো মৃত্যু। এই মৃত্যু তাকে মহৎ করত না। লোকের গোপন কেনামি জমি ধরে দেওয়ার বিপজ্জনক কাজে নেমেই সে টের পেয়েছিল, এ হল জাতসাপের লেজ দিয়ে কান চুলকোনো। কিংবা যখন হাবুর ঝোপড়ায় মদো মাতাল বদমাশদের আড্ডা ভাঙতে গিয়েছিল তখনই সে কি জেনেশুনে বিষ করেনি পান? কাজেই মরার ব্যাপারে তার তেমন চিন্তা নেই। কিন্তু বার বার আজ পপুলারিটি কথাটা তার বুকে হাতুড়ি মারে। কেন যেন মনে হচ্ছে, তার পপুলারিটির শক্ত ডাঙা জমি বড় ক্ষয় হয়ে গেছে। টর্চের আলোয় রেবন্তর মুখ দেখে চমকে যায়। কিন্তু রেবন্ত তাকে খুন করতে চায় বলে সে তত চমকায়নি। তাকে খুন করতে চাইতেও পারে রেব। তার কারণ আছে। কিন্তু খুন করলেও রেবন্ত তাকে ঘেন্না করবে না, কুঞ্জর এমন একটা ধারণা ছিল, তাই রেবম্ভকে দেখে সে যত না চমকেছে তার চেয়ে ঢের বেশি অবাক হয়েছে রেবন্তর মুখে একটা বাটি নির্ভেজাল তীব্র ঘেন্নার ভাব দেখে।
পিচ রাস্তা পেয়ে কুঞ্জ একটু হাঁফ ছাড়ল। তেঁতুলতলা যুবসরে পাকা বারান্দায় উঠে ছাতাটা মুড়ে নিয়ে সে দরজায় ধাক্কা দেয়। এত রাতেও কয়েকজন বসে তাস খেলছে। কুঞ্জকে দেখে হাঁ করে চেয়ে থাকে সবাই।
গোটা তেঁতুলতলাই কুঞ্জর মামাবাড়ি। জ্ঞাতিগুষ্টি মিলে তারা সংখ্যায় বড় কম নয়। তাস খেলুড়েদের মধ্যেও কুঞ্জর এক মামা, দুই মাসতুতো ভাই রয়েছে।
সতুমামা বলল–এই দুর্যোগে ব্যাপার কী রে? কোনও হাঙ্গামা নাকি?
কুঞ্জ মাথা নাড়ল।
–তা হলে?
তা হলে কী তা কুঞ্জও তো জানে না। সে শুধু আজ সন্দেহভরে জানতে চায় তার বিশ্বস্ত ঘাটিগুলো এখনও তার দখলে, আছে কি না! বোঝা বড় শক্ত। এই ক্লাবখানা তার নিজের হাতে গড়া। রাজ্যের ছেলে-হোকরা জুটিয়ে জবরদস্ত ক্লাবখানা জমিয়ে দিয়েছিল কুঞ্জ। পিছনের ঘরে লাঠি, সড়কি, দু-একখানা খাঁটি তরোয়াল এখনও মজুত। কুঞ্জর বিপদ শুনলে এখনও হয়তো গোটা ক্লাব ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। গতবার ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ইলেকশনে কুঞ্জ তার এক মাসতুতো দাদার কাছে হারতে হারতে কোনওক্রমে দশ ভোটে জিতেছিল। এই কথাটা এখন বড় খোঁচাচ্ছে তাকে। পায়ের নীচে মাটি এখনও আছে বটে, কিন্তু চোখের আড়ালে পাতালের অন্ধ গহুর নিঃশব্দে মাটি খসিয়ে নিচ্ছে না তো? কুঞ্জর বিপদ শুনলে এক দল রুখে দাঁড়াবে ঠিক, কুঞ্জ নির্বাচনে দাঁড়ালে এক দঙ্গল তার হয়ে খাটবে ঠিক, তবু আর একটা দল নিস্পৃহ থেকেই যাবে।
মাসতুতো ভাইদের মধ্যে একজন নলিনী। সে বলল–খুব ভিজেছ কুঞ্জদা, তোমার না বুকের অসুখ! বইয়ের আলমারির ওপর আমার বর্ষাতিটা মেলে দেওয়া আছে, নিয়ে যাও।
কুঞ্জ মাথা নেড়ে বলে-না রে, কিছু হবে না।
নলিনী আর কিছু বলে না। তাস বাটা হতে থাকে। বহুকাল বাদে কুঞ্জর যেন একটু অভিমান হয়। বর্ষাতিটা নিলুম না, তা আর একটু সাধতে পারলি না নলিনী?
কুঞ্জ বেরিয়ে আসে। তার আর একটা ঘাঁটি ছিল ফুটুনিমামার দোকান। জেলেপাড়ার যাট সত্তর ঘর রায়ত ফুটুনিমামার ভারী বশংবদ। একসময়ে পড়াশোনা ছেড়ে রাজনীতিতে নামার দরুন কুঞ্জকে তার বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়েছিল। তখন ফুটুনিমামা কুঞ্জকে আশ্রয় দেয়। বাড়ি গিয়ে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বলে এসেছিল, আপনি না রাখেন ত্যাজ্যপুত্র করুন, কুঞ্জকে আমি পুষ্যি নেব। নির্বাচনে ফুটুনিমামা তার রায়তদের কুঞ্জর পক্ষে কাজে নামিয়ে দিয়েছিল।
মোড়ের মাথায় ফুটুনিমামার দোকানে ঝাঁপ ঠেলে বহুদিন বাদে কুঞ্জ হানা দিল! মামা উরুর ওপর লম্বা খাতা রেখে হিসেব করছে। খোল, ভুসি, হাঁসমুরগির খাবার আর মশলাপাতির ঝাঁঝালো গন্ধট বহুকাল ভুলে গিয়েছিল কুঞ্জ। আজকাল আসা হয় না। গন্ধটা পেয়ে একটা হারানো বয়স কুঞ্জর কাছে ফিরে এল বুঝি।
মামা মুখ তুলে দেখে বলল কী খবর রে? বলেই ফের হিসেবে ডু দেয়।
কুঞ্জ ঠাণ্ডা হচ্ছে। খুব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। পাথর হয়ে যাচ্ছে। মা আবার মুখ তুলে বলে-দুর্যোগে বেরিয়েছিস, ঠাণ্ডা লাগাবি যে! তারপর খবর-টবর কী?
কুঞ্জ বলে-ভাল।
—ভাল বলছিস? ফুটুনিমামা তাকিয়ে একটু হাসে। কিন্তু তাকানোর মধ্যে দৃষ্টি নেই, হাসির মধ্যে অনেক ভেজাল। একসময়ে খুব বাবুগিরি করত বলে নামই হয়ে গিয়েছিল ফুটুনি। এখন বাবুগিরি নেই। হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে, কাছা খুলে রোজগার করছে মামা। কোথায় যায় মানুষের দিন?
ফুটুনিমামা ভ্রু কুঁচকে বোধ হয় একটা উড়ন্ত মশার দিকে চেয়ে থেকে বলে–তা হলে খবর-টবর সব ভাল?
ঝুরঝুরে মাটির ওপর দিয়ে কুঞ্জ হাঁটছে। যে কোনও একটা পদক্ষেপেই সে দেখতে পাবে সামনেই ধস। তবু কতখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার একটা হিসেব নিকেশ থাকা ভাল।
পপুলারিটি শব্দটা রবারের বলের মতো মাথার মধ্যে ধাপাচ্ছে কে!
অন্য দিন সময় হয় না কুঞ্জর। এই দুর্যোগে আজ হঠাৎ সময় হল। বহুদিন বাদে ঝড়বাদল ঠেলে সে মেজদাদুর বাড়ির বারান্দায় উঠে এল। মেজদাদু হলেন এখন ভঞ্জলের সবচেয়ে বড় শরিক! কয়েক কোটি টাকা বোধ হয় তাঁর রোলিং ক্যাপিটাল। দেখে কিছু বোঝা যায় না। সাদাসিধে, গেঁয়ো।
আশির কাছাকাছি বয়স। মস্ত ঘরে কাঠের চেয়ারে বসে আছেন। গায়ে তুষের চাদর, পায়ে মোজা, মাথায় বাঁদুরে টুপি। একদৃষ্টে চেয়ে দেখলেন। বললেন–এত রাতে এলে? খুব দরকার নাকি? কারও কিছু হয়নি তো?
না।
মেজদাদু শ্বাস ছেড়ে বললেন সর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকি। আমি মরলে তোমাদের অশৌচও হয় না জানি। মাতুল বংশ, তায় জ্ঞাতি। কিন্তু আমার ভাবনা তেমনধারা নয়। আমি ভাবি, তেঁতুলতলায় সব আমার মানুষ। কখন কে মরে, কে পড়ে। ভারী দুশ্চিন্তা।
–অনেকদিন দেখা করিনি, তাই এলাম।
কথাটা যেন বিশ্বাস হল না মেজদাদুর। সন্দেহের চোখে কুঞ্জর মুখের দিকে চেয়ে বললেন কারও কোনও বিপদ হয়নি, ঠিক বলছ? ভয়ের কিছু নেই তো!
-না মেজদাদু।
তুমি ভাল আছি তো? বাড়ির সবাই? তোমার মাকে বহুকাল দেখি না। আজকাল সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করে।
বলব।
মেজদাদু খানিক চুপ থেকে বলেন-বুদ্ধি পরামর্শ নিতে আমার কাছে কোনওদিন এলে না কুঞ্জ! এলে কি আমি তোমাকে কুপরামর্শ দিতুম! আমি তোমার কতখানি ভাল চেয়েছিলাম তা জানলে না।
কুঞ্জ খুব নিবিড় চোখে মেজদাদুকে দেখছিল। আগে দেখা হলে মেজদাদুর মুখে যে একটা খুশির দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ত তা আজ আর কই? সে বুঝতে পারে, সুর কেটে যাচ্ছে। কোথায় লয়ে-তালে গোলমাল।
কুঞ্জকে জেতানোর জন্য সেবার মেজদাদু নিজের নমিনেশন উইথড্র করে নিয়ে বলেছিলেন লোকে কুঞ্জকেই চায়। আমাদের খামোখা দাঁড়ানো। কথাটা বলেছিলেন হাসিমুখে, আত্মগৌরবের সঙ্গে। সেবার সড়কি খেয়ে কুঞ্জর জখমটা দাঁড়িয়েছিল মারাত্মক। ডাক্তার কলকাতায় পাঠাতে চেয়েছিল। মেজদাদু রুখে দাঁড়িয়ে বললে-কলকাতার হাসপাতাল! কেন, কুঞ্জ কি ভাগাড়ে নড়া। কাতার হাসপাতালে আজকাল মানুষের চিকিৎসা হয় নাকি? ভঞ্জদের লোকবল, অর্থবল সবটুকু ঢেলে দিয়ে মেজদাদু কুঞ্জকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলেন। আর তার জন্যই তেঁতুলতলার ছোট হাসপাতালে হাজারো যন্ত্রপাতি আমদানি হল, তাল এক ডাক্তার এল চাকরি পেয়ে, এল এক্স-রে ইউনিট! কুঞ্জ যে খুব একটা কৃতজ্ঞ বোধ করছে, তা নয়। সে তখন ভাবত, তাকে বাঁচানোর জন্য লোকে তো এ সব করবেই। সে যে নেতা।
আজ মেজদাদুর সামনে তাই একটু লজ্জা বোধ করে কুঞ্জ। মেজদাদুর জন্য তার যা করা উচিত ছিল তা তো করা হয়নি। অকৃজ্ঞতার পাপ তাকে কিছুটা ছুঁয়ে আছে আজও।
কুঞ্জ মাথা নিচু করে বলে–আপনি আর আগের মতো ডাক খোঁজ করেন না তো দাদু! কোনও অপরাধ করিনি তো?
ভঞ্জবাবু ভারী অবাক হয়ে শশব্যস্তে বললেন–এ সব কী বলছ? অপরাধ আবার কী? বুড়ো বয়সে বাইরের ব্যাপারে বেশি যাই না। তুমিও ব্যস্ত মানুষ। তবে খোঁজখবরে সবই পাই। তোমার হচ্ছে পাবলিক লাইফ, আমরা তো নিজের ধান্দা নিয়ে পড়ে আছি। এই বলে মেজদাদু খানিক কী যেন ভেবে আস্তে করে বলেন–তবে তোমার চেহারায় আগে যেমন একটা তেজ দেখতুম এখন আর সেটা দেখি না।
আমি কি কোনও ভুল করছি? কোনও অন্যায় পথে চলছি? কুঞ্জ গলায় চাপা ব্যাকুলত ফোটে। টর্চের আলোয় দেখা রেবন্তর মুখটায় বড় ঘেন্না ফুটে ছিল যে! ঠোঁট বাঁকান, চোখে আগুন দাঁতে দাঁতে বজ্র আঁটুনি। হিংসে নয়, সংকোচ বা দ্বিধাও নেই। যেন মাজরা-পোকা নিকেশ করতে এসেছিল।
মেজদাদু এবার একটু ব্যস্ত হয়ে বলেন–ভেজা শরীরে এই হিমে কতক্ষণ থাকবে? তোমার শরীর ভাল নয়।
কুঞ্জ সংবিৎ ফিরে পায়। আজ সে কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে তা হঠাৎ টের পেয়ে ভারী লজ্জা করে তার। কোনওদিন কোনও মানুষের কাছে ঠিক এভাবে নিজের সম্পর্কে জানতে চায়নি কুঞ্জ। সে বরাবর নিজের সম্পর্কে গভীর বিশ্বাসী। নিজেকে অভ্রান্ত ভাবাই কুঞ্জর স্বভাব।
সংবিৎ ফিরে পেয়েই কুঞ্জ গুটিয়ে গেল। গম্ভীর মুখখানায় হাসি এল না, তাই না হেসেই বলল যাই মেজদাদু।
–এসো গিয়ে। মাঝে মাঝে এলে ভাল লাগে। বাড়িতে তোমার কেউ যত্ন করে না নাকি তেমন? শুকিয়ে গেছ। তোমার মাকে দেখলে বলব তো।
কুঞ্জ আবার জলঝড়ের মধ্যে বেরিয়ে আসে। বাতাসের মুখে ধেয়ে আসে ধরন বৃষ্টির অস্ত্রশস্ত্র। গেথে ফেলে তাকে বার বার। বৃষ্টির মিছিল চলে তার পিছনে পিছনে, ধিক্কার দেয়–ছিয়া, ছিয়া, ছিয়া…
পিচ রাস্তায় এক নিয়নবাতির তলায় ছোট ভাই রাধানাথের সঙ্গে দেখা। ছাতার নীচে উঁড়ি মেরে যাচ্ছিল। কুঞ্জকে দেখে ভয়ার্ত মুখ তুলে বলল বউদির বড্ড অসুখ, ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি।
-কী অসুখ?
–মেজদা মেরেছে। রক্ত যাচ্ছে খুব।
কুঞ্জ সামান্য কেঁপে ওঠে। হয়তো ভেজা শরীরে হঠাৎ বাতাস লাগল, কিংবা হয়তো অন্য কিছু। ভাবতে চাইল না কুঞ্জ। ভাবতে নেই।
.
খুব অনেক রাতে মেঘ কেটে আকাশে সামান্য জ্যোৎস্না ফুটেছে। বাস থেমেছে। কুগির ঘরখানা নিরিবিলি হয়েছে এতক্ষণে। টুসি জেগে ছিল এতক্ষণ। আর পারল না। এক ধারে মাদুর পেতে তুলোর কম্বল মুড়ি দিয়ে নেতিয়ে পড়েছে অঢেল ঘুমে।
কুঞ্জ একা হল। সাবিত্রীর অবশ্য সাড়া নেই। রক্ত বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ। কয়েকবারই অজ্ঞান হয়েছে, আবার জ্ঞান ফিরেছে, ফের দাঁতে দাঁত লেগে চোখ উল্টে গোঁ-গোঁ আওয়াজ করেছে। মেঝে ভেসে গিয়েছিল রক্তে। কুঞ্জ তখন ঘরে আসেনি। ভাসুর তো। সব ধোয়া মোছ হওয়ার পর, ভিড় পাতলা হয়ে গেলে এসে একটু দুরে চেয়ার পেতে বসে থেকেছে। এ ঘরে এভাবে বসেখা তার উচিত নয়। খারাপ দেখায়। তবু তার উপায়ও নেই। রাস্তাকি আর মা থাকতে চেয়েছিল, এম জোর করে তাদের শুতে পাঠিয়েছে। কেবল টুসি। ডাক্তার বলে গেছে–ভয় নেই। কিন্তু কুর ভয় অন্য জায়গায়। সে নিঃশব্দে চেয়ে থেকেছে সাড়হীন সাবিত্রীর দিকে। টের পেয়েছে ঠাণ্ডায় বৃষ্টিতে ভিজে তার ডান বুকে জল জমছে। বাঁ বুকে ভয়।
টুসির শ্বাসের শব্দ মন দিয়ে শুনল কুঞ্জ। ঘুমন্ত খাসের শব্দ চিনতে পেরে নিশ্চিন্ত হল একটু। আস্তে নিঃশব্দে উঠে এল বিছানার কাছে। ডাকল না, তবে বিছানার এক পাশে বসল খুব সাবধানে।
অনেক, অনেকক্ষণ বসে রইল। ঘরে একটা মৃদু নীল ঘুমআলোর ডুম জ্বালানো। তাতে আলো হয় না। কেবল দৃশ্যগুলো জলে-ডোবা আবছায়া মতো দেখা যায়। সেই আলোয় যুবতী সাবিত্রীকে বুড়ি বুড়ির মতো দেখায়। দেখতে ভাল লাগে না। অনিচ্ছে হয়। চোখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে জাগে।
গভীর রাতের এক নিস্তব্ধ মুহূর্তে যখন সাবিত্রীর বিছানায় সসঙ্কোচে বসে অন কুঞ্জ পপুলারিটির কথাই ভাবছিল তখন হঠাৎ খুব বড় করে চোখ মেলল সাবিত্রী। মাঝরাতে হঠাৎ সেই অকানো চোখের দিকে চেয়ে শিউরে ওঠে কুঞ্জ। তারপর মুখ এগিয়ে খুব নরম স্বরে জিজ্ঞেস করে এখন কেমন আছ?
সাবিত্রী জবাব দিল না। বড় বড় চোখে নিষ্প্রাণ প্রতিমা যেমন চেয়ে থাকেঅফেক্ষণ সেইরকম চেয়ে রইল। তারপর খুব ক্ষীণ, নাকিস্বরে বললও কোথায়?
কুঞ্জ গম্ভীর হয়ে বলল-পালিয়েছে।
সাবিত্রী চারদিকে চাইল। টুসিকে দেখল, কুঞ্জর দিকে চেয়ে চোখের ইঙ্গিত করে বলল টুসি।
-ঘুমোচ্ছে।
সাবিত্রী গভীর শ্বাস ছেড়ে বলে–আর সবই?
ধারে কাছে কেউ নেই।
শুনে সাবিত্রী সামান্যক্ষণ চুপ করে থেকে একটু ফুঁপিয়ে উঠে বলে আপনাকেকবার বলেছি ও আমাকে সন্দেহ করে। কিছু টের পেয়েছে।
–আজ কী বলল?
সাবিত্রী কুঞ্জর দিক থেকে অন্যধারে পাশ ফেরে। বলেও জানে।
কুঞ্জ ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায় হঠাৎ। বুক জুড়ে একটা বেলুন ফেঁপে ফুলে উঠে তার দম চেপে ধরে।
কুঞ্জ আস্তে করে বলে–টের পাওয়ার কথা নয়।
সাবিত্রী মুখ ঘুরিয়ে তাকায়। চোখে জল। একটু ক্ষুব্ধ গলায় বলে কী করে জানলেন, টের পাওয়ার কথা নয়? আপনি কি কখনও আমাদের গোপন সম্পর্কের কথা জানতে চেয়েছেন। গত চার মাস ও আমাকে দেয়নি।
বজ্রপাতের মতো আবার সেই পপুলারিটি কথাটা মাথার মধ্যে ফেটে পড়ে কুঞ্জর। তার মন অভ্যাসবশে হিসেব করে নেয়, যদি কেষ্ট সন্দেহ করে থাকে, তবে সেটা চাউর করা তার পক্ষে অসম্ভব নয়। হাব কেপড়ায় মদের মুখে স্যাঙাতদের কাছে বলবে না কি আর? বউ আর দাদাকে জড়িয়ে তামসিক আনন্দ পাবে। যদি কথাটা ছড়ায় তবে কুঞ্জর অনেকখানি চলে যাবে। রেবঙও কি জানে?
বড় ছটফট করে ওঠে কুঞ্জ। বলে–ছোঁয়নি?
সাবিত্রী চেয়েই ছিল। ধীর স্বরে বলল কখনও-সখনও চাইত। আমার ইচ্ছে হত না। ঝগড়া করতুম। তখন রাগ করে গুটিয়ে যেত।
সাবিত্রীর এই বোকামিতে হাঁ হয়ে রইল কুঞ্জ। বোকা, জেদি মেয়েটা। খুব হতাশ গলায় কুঞ্জ বলল তা হলে আর ওর দোষ কী? যদি কথাটা আমাকে আগে বলতে তবে তোমাকে পরামর্শ দিতুম অন্তত এক-আব্বার ওকে অ্যালাউ করতে। দোষটা কেটে থাকত।
সাবিত্রী জেদি গলায় বলে আমার ইচ্ছে হত না। ঘেন্না পেতাম।
কুঞ্জ কাহিল গলায় বলে কিন্তু ধরা পড়ে গেলে যে!
সাবিত্রী মুখ ফিরিয়ে নেয় লজ্জায়। ক্ষীণ স্বরে বলে–গেলাম তো! কিন্তু সব দোষ কি আমার? আপনার কিছু করার ছিল না?
সাবিত্রীর ওপর এই মুহূর্তে ভারী একটা ঘেন্নার মতো ভাব হল কুঞ্জর। দোষ তোমার নয়তো কার? বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই কেন তুমি আর সবাইকে ছেড়ে সুযোগ পেলেই হাঁ করে দেখতে আমাকে? বাড়ির লোক আমাকে যত্ন করে না বলে কেন অনুযোগ তুলতে সবার কাছে? কেন আমার স্নানের সময় পুকুরঘাটে গেছ? আমার ঘরে গিয়ে সোহাগ করে বিছানা টান করত, আলনা আর টেবিল গোছাত কে? কেষ্টকে মদ ছাড়ানোর চেষ্টা করনি, রাতে ও না ফিরলে তেমন গা করনি কখনও। সেসব কেন? যদি স্বামী হিসেবে কেষ্টকে তোমার পছন্দ নয়, তবে বিয়ের আগে নটঘটি করেছিলে কেন? ঠিক কথা, দোষ আমারও। কী করব, আমার যে সেচহীন শুকনো জীবনের চাষ। একটা বয়সের পর পুরুষ চোত মাসের খরার জমি হয়ে যায় জান না? মেয়েমানুষ হল জলভরা কালো মেঘের মতো। আমার সেই মেঘ কেটে গেছে কবে! তনু বিয়ে করে চলে গেল। শুকনো ড্যাঙা জমি পড়েছিলুম! ছিলুম তো ছিলুম। কে তোমাকে মেঘ হয়ে আসতে মাথার দিব্যি দিয়েছিল? চনমন করতে, উচাটন হতে, সম্পর্কের বাঁধন খসিয়ে ফেলতে চাইতো তোমার চোখমুখ দেখেই জলের মতো বোঝা যেত। আর যত সেটা বুঝতে পারলুম তত আমারও চৈত্রের জমি মেঘ দেখে ফুঁসে উঠল। সেটা দোষ বটে, কিন্তু বিবেচনা করলে, বিশ্লেষণ করলে, তলিয়ে দেখলে দেখতে পাবে মেঘের ছায়া পড়েছিল বলেই খরার জমি উন্মন হয়েছিল। শরীর জিনিসটা সম্পর্ক মানতে চায় না, সমাজ মানতে চায় না, আগে পরে কী হবে ভাবতে চায় না। বেবা, কালা, অন্ধ, অবিবেচক। যখন জাগে তখন মাতালের মতো জাগে, লণ্ডভণ্ড করে দিতে চায় সব। হাকুর কোপড়ায় একাতিয়াকে নিয়ে পড়ে থাকত কেষ্ট। তুমি এ ঘরে একা। আমি ও ঘরে একা। মেঘ ডাকত, খরার মাটিও অপেক্ষা করত। তারপর এক ঘোর নিশুত রাতে ছোট্ট করে শেকল নড়ল দরজায়।…আমি যেন জানতুম, অবিকল এইভাবেই একদিন নিশুত রাতে শিকল নড়বে। আমি এত নিশ্চিতভাবে জানতুম যে শেকল কেনাড়ল তা জিজ্ঞেসও করিনি। উঠে কাঁপা হাতে দরজা খুলে দিলুম। মনে কোরো না যে ভেসে গিয়েছিলুম, ডুবে গিয়েছিলুম, সুখে ভরে উঠলাম। মোটেই তা নয়। শরীর নিতলে বড় ঘেন্না হয়েছিল নিজের ওপর। সমাজ, সংসার, সম্পর্ক সব বজ্রাঘাতের মতো মাথায় পড়তে লাগল এসে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, তুমি ভারী সুখী হয়েছে, তৃপ্তি শান্তি আনন্দে ঝলমল করছে মূর্খ। বলেছিলে, যে মানুষ মস্ত বড় তাকে সব দেওয়া যায়। দোষ হয় না। বলনি?
কুঞ্জ শুকনো মুখে বলল–কে জানে বলছ! কিন্তু লোকটা যে আমিই তা ঠিক পেল কী করে?
সাবিত্রী গভীর বেদনার শব্দ করল একটু। আস্তে করে বলল–বড্ড কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ ব্যথা।
সাদা ঠাণ্ডা একটা হাত বাড়িয়ে কুঞ্জর হাতখানা ধরল সাবিত্রী। ভারী দুর্বল হাতের সেই ধরাটা যেন শালিখ পাখির পায়ের আঁকড়ের মতো। কুঞ্জর গা সামান্য ঘিনঘিন করে। অশুচি লাগে। ঘরের কোণে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে রক্তমাখা কাপড়চোপড়, ন্যাকড়া। ঘরের আঁশটে গন্ধটা যেন আরও ঘুলিয়ে ওঠে হঠাৎ। টুসি গভীর ঘুমের মধ্যে দাঁত কিড়মিড় করে কী বলে ওঠে। কুঞ্জ হাত ছাড়িয়ে নেয়।
সাবিত্রী ক্লান্ত আধবোজা চোখে কুঞ্জর দিকে চেয়ে বলে–আপনার কথা আমিই বলেছি।
-তুমি! কুঞ্জ ভারী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
–রোজ জানতে চাইত, আপনিই কিনা। পেটে ছেলে এল, অথচ ওর নয়। তবে কার, তা হিসেব করে দেখত। স্বীকার করানোর জন্য মারত। কাল বলে ফেললাম।
–তুমি কি পাগল?
সাবিত্রীর ক্ষীণ স্বরে যেন একটু জোয়ার লাগে–পাগল কেন হব? আমার তো সবাইকে ডেকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে। ভাবতে কত সুখ হয়! গায়ে কাঁটা দেয়। মনে হয়, আপনার মতো মানুষ, এত বড় একটা মানুষ, যার এত নামডাক সে কিনা আমাকে এত স্নেহ করে! আমার এত আনন্দ হয়, সবাইকে বলতে ইচ্ছে করে। কাল মাঝরাতে যখন ও আমাকে গলা টিপে ধরেছিল তখন চোখে চোখ রেখে একটুও ভয় না খেয়ে বলেছিলাম। একটুও ভয় করেনি। বলে এত সুখ হল, গায়ে কাঁটা দিল আনন্দে। ও যখন মারছিল তখন একটুও লাগছিল না। আমি তখনও হাসছিলুম।
আস্তে আস্তে আড়ষ্ট হয়ে যায় কুঞ্জ। ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু হয়। এ যে বদ্ধ বেহেড হয়ে গেছে। এখন যে এ আর কোনও হায়া লজ্জা মানছে না! মাথাটা টলে যায় কুঞ্জর। বিছানার ওপর হাতের ভর রেখে ঝুঁকে সাবিত্রীর মুখের দিকে চেয়ে থাকে, যেন ভূত দেখছে। বলে কী করলে বলো তো! ছিঃ ছিঃ!
–আমি ভয় পাই না। আমার লজ্জা নেই। এত মারল, কত কষ্ট পেলাম দেখুন তবু এখনও মনে হচ্ছে বলে দিয়ে বেশ করেছি।
কুঞ্জ কুঁকড়ে বসে হাঁটুতে থুতনি রেখে ক্ষীণ গলায় বলে–শুনে কেষ্ট কী করল?
–খুব অবাক হল। সন্দেহ করত বটে কিন্তু আপনার মতো মানুষ এ কাজ করতে পারে তা যেন ওর বিশ্বাস হত না। তাই কথাটা শুনে কেমনধারা ভ্যাবলা হয়ে গেল। মারল আমাকে, কিন্তু কেমন পাগলাটে হয়ে গেল মুখ, মারতে মারতেই কেঁদে ফেলল। তারপর দরজা খুলে পালিয়ে গেল দৌড়ে। ফিরল আজ সন্ধেবেলায়। আবার ধরল আমাকে, বলল, দাদাকে মিথ্যে করে জড়াচ্ছ। দাদা নয়, অন্য কেউ। কে সত্যি করে বলো। আমি তেমনি চোখে চোখ রেখে বললাম। বলল, আমাদের দুজনকেই খুন করবে। আগে কোনওদিন পেটে মারেনি, আজ মারল। বলতে বলতে মুখ বালিশে চেপে ফুঁপিয়ে ওঠে সাবিত্রী।
কুঞ্জ অসাড় হয়ে বসে থাকে। পপুলারিটি কথাটা খামচে ধরে মাথা। এক নাগাড়ে অনেক কথা বলে ভারী ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সাবিত্রী। থর থর করে কাঁপছিল, ঠোঁট সাদা। লেপ টেনে মুড়ি দিয়ে গভীর ব্যথা-বেদনার শব্দ করে বলল–আমার শরীর বড্ড খারাপ লাগছে। ভীষণ শীত আর কাঁপুনি।
কুঞ্জ টুসিকে ডেকে তোলে। রাঙাকাকি আর মাকে ডেকে আনে।
.
০৬.
এতদিনে তবে কি বুড়ো হল পটল? চোখে ছানি আসছে নাকি? একটু আলো লাগলেই চোখ বড় ঝলসে যায় যে আজকাল? নইলে কি রবিকে কুঞ্জ বলে ভুল করত? টর্চের আলোটা এমন বিশাল গোলপানা চক্করের মতো ঝলসে উঠেছিল যে ধাঁধা লেগে গেল। সে ভুলটাও শুধরে নিতে পারত। কিন্তু একটা ফাঁকা আওয়াজে, একটা উটকো লোকের হাঁকাড় শুনে মাথাটা কেন যে ঘেবড়ে গেল আজ। হাবুর ঘরে মুড়িসুড়ি দিয়ে বসে অফুরন্ত হাঁফের টান ভোগ করতে করতে এইসব কথা ভাবে পটল। শ্লেষ্মর পর শ্লেষ্ম উঠে আসছে কাশির সঙ্গে। হরি ডাক্তার মরে গিয়ে অবধি এই শ্লেষ্মর আর চিকিৎসা হল না। বুকের মধ্যে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে শ্বাসের কষ্ট। এরপর কি মরবে পটল? ঝাড়গ্রামে মামাশ্বশুর সস্তায় একটা কলাবাগান বেচে দিচ্ছে। পটলের বড় ইচ্ছে, বাগানটা কেনে। মরবার আগে ছেলেপুলে সহ বউ বাসন্তীকে ঝাড়গ্রামে বসিয়ে যেতে পারলে একটা কাজের কাজ হয়। বাসন্তীর ব্যবসার মাথা আছে, কলা বেচে ঠিক সংসার চালিয়ে নেবে। আজ কুঞ্জকে খুন করতে পারলে রেবন্তবাবু বাগান কেনার টাকা দেবে, কথা ছিল। খুন পটলের কাছে নতুন জিনিস তো নয়। পলিটিক্সয়ালাদের হয়ে, জোত-মালিকের হয়ে, হরেক কারবারির হয়ে নানান রকম মানুষ মেরেছে সে। সেজন্য বড় একটা আফশোসও নেই তার। মশা মাছি, পাঁঠা ছাগল মারলে যদি পাপ না হয় তবে মানুষ মারলেও হয় না। আর যদি পাপ হয়ই হবে পাঁঠা-ছাগল মারলে যতটা হয় তার বেশি হয় না। এ তত্ত্ব পটল অনেক ভেবে ঠিক পেয়েছে। কিন্তু এখন তার সন্দেহ হয়, সত্যিকারের বুড়ো হল নাকি সে? ছানি আসছে চোখে? মাথাটা কাজের সময় ঠিক থাকছে না কেন? এমন হলে লাশটা ফেলতে পারবে না পটল, আর যদি না ফেলতে পারে তবে ঝাড়গ্রামের কলাবাগানটা যে হাতছাড়া হয়ে যাবে! রেবন্তবাবু দায়ে দফায় অনেক দেখেছে তাকে; তার এই কাজটুকু করে যে দিতেই হয় পটলকে! ভাবছে আর কাশছে পটল। হাবুর দেওয়া বড় মাটির ভাঁড়টা ভরে উঠল শ্লেষ্ময়। বড় শ্বাসের কষ্ট।
চ্যাটাইয়ের অন্যধারে বসে কালিদাস তাড়ি টানছিল খুব। মাথাটা টলমলে হয়ে এসেছে। মিটিমিটি হাসছে আর পটলের দিকে চাইছে। বিড়বিড় করে বলছে–হোমিওর কী গুণ বাবা! নিজের চোখে দেখলুম তো! কুঞ্জ ওই অত দূরে থাকতে পকেট থেকে শিশি বের করে ওষুধ খেল, আর সেই ওষুধের গুণে একশো হাত দূরে পটলার চোখে ধাঁধা লেগে গেল। শুধু তাই? হোমিওর গুণেই না কুঞ্জ আগেভাগে জানতে পেরেছিল যে আজ সে খুন হবে! তাইনা এক বকরাক্ষসকে জুটিয়ে এনেছিল সঙ্গে। কী চেঁচাল বাবা মুশকো লোকটা! কাঁচা খেয়ে ফেলত ধরতে পারলে। পটল যে পটল সেও ভয় খেয়ে পালায় না হলে? রেবন্তবাবুও ঘাবড়ে গেছে খুব। এই জল ঝড়ের মধ্যেই লেজ গুটিয়ে পালাল।
.
নারকোল বাগানের বাইরে আসতেই ধারালো বৃষ্টি ঘেঁকে ধরল রেবকে। পাথুরে ঠাণ্ডা জল। দমফাটা হুমো বাতাস খোলা মাঠের মধ্যে তাকে এলোমেলো ঘাড়ধাক্কা দিতে থাকে। দেয়ালের মতো নিরেট অন্ধকার চারদিকে, এক লহমায় ভিজে গেল রেবন্ত। গায়ের সোয়টার, জামা গেঞ্জি ছুঁড়ে জল ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। বৃষ্টি বাতাস আর মাঠে জমা জল ঠেলে জোরে হাঁটা যায় না। তবু প্রাণপণে হাঁটে রেবন্ত। শীতে ঠকঠক করে কাঁপে সে। দুটো কানে বিষফোঁড়ার যন্ত্রণা। ঝোড়ো বাতাস হাড়-পাঁজরায় ঢুকে প্রাণটুকু শুষে নিচ্ছে। তবু সে পিছন ফিরে একবার দেখে নিল, ছায়া দুটো পিছু নিয়েছে কিনা, ওই দুজনের কাছ থেকে এখন তাকে যতদূর সম্ভব তফাত হতে হবে।
শরীর অবশ করে গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা আর কাঁপুনি ধরে গেল। কানের যন্ত্রণাটা মাথাময় ভোমরার ডাক ডাকতে থাকে, চিন্তার শক্তি পর্যন্ত থাকে না। এই অবস্থায় কীভাবে সে শ্যামপুর পৌঁছল সেটা সে নিজেও ভাল বলতে পারবে না।
আবছা মনে পড়ে, বাজারে তেজেনের দোকান থেকে নিজের সাইকেলটা নেওয়ার সময় তেজেন বলেছিল, পাগল নাকি? এ ভাবে যেতে পারে মানুষ! থেকে যাও।
রেবন্ত কথাটা কানে নেয়নি, অন্ধকারে বৃষ্টি আর ঝড়ের মধ্যে সে প্রবল বেগে সাইকেল চালিয়েছিল। কয়েকবার সাইকেল হড়কে পড়ে গেল। চাকার রিমে টাল খেয়েছে। চালানোর সময় ফর্কের সঙ্গে টায়ার ঘষা খাচ্ছিল খ্যাস খ্যাস করে। জোরে চলতে চাইছিল না। তবু পৌঁছেও গেল রেবন্ত।
শ্যামশ্রীর সামনে কোনওদিন কোনও দুর্বলতা প্রকাশ করে না, আজও করল না। যখন উত্তরের দালানের বারান্দায় সাইকেলটা হিঁচড়ে তুলল তখন তার শরীর আপনা থেকেই টলে পড়ে যাচ্ছিল মেঝেয়। স্রেফ মনের জোরে খাড়া রইল সে। গামছায় শরীর মুছল, জামাকাপড় পালটাল। মাথার যন্ত্রণার সঙ্গে চোখ আর নাক দিয়ে অবিরল জল ঝরছে। প্রবল হাঁচি দিল কয়েকটা।
শ্যামশ্রী মুখে কিছু বলছিল না বটে, কিন্তু দরজা খুলবার পর থেকেই একদৃষ্টে লক্ষ করছিল তাকে। ছাড়া জামাকাপড়গুলোর জল নিংড়ে দড়িতে মেলে দিয়ে এল শ্যামশ্রী। নীরবে শুকনো জামাকাপড় সোয়েটার এগিয়ে দিল। রেবন্তর গা আর জামাকাপড় থেকে জল ঝরে মেঝেয় গড়িয়ে যাচ্ছিল, নিজে হাতে চট নিয়ে এসে তা চাপাও দিল শ্যামশ্রী। অস্ফুট স্বরে একবার বলল–ছাদের ঘরে এখন যেয়ো না, ঠাণ্ডা, কিছুক্ষণ এখানেই শুয়ে থাকো লেপ গায়ে দিয়ে।
মাসখানেকের বেশি হল, নীচের শোওয়ার ঘরে শ্যামশ্রীর সঙ্গে শোয় না রেবন্তছাদে একটা ছোট্ট ঘরে গিয়ে শোয়। শ্যামশ্রীর সঙ্গে শরীরের সম্পর্কও তার নেই বেশ কিছুদিন। কথাবার্তাও প্রায় হয়ই না।
রেবন্ত শ্যামশ্রীর কথার জবাব দিল না, কিন্তু ওর খাটের নরম বিছানায় গিয়ে বসল। ভাঁজ করা লেপটাও টেনে নিয়ে যথাসাধ্য মুড়ি দিল গায়ে। মাথা আর কান জুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা। সহ্য করতে লাগল চোখ বুজে।
শ্যামশ্রী হয়তো বুঝতে পারল রেস্তর অবস্থা ভাল নয়। নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। একটু বাদে একটা বড় কাঁচের গ্লাস ভর্তি আদা-চা নিয়ে এল, সঙ্গে মুড়ি, আলুভাজা আর লঙ্কা।
গরম চা পেটে যাওয়ার পর আচ্ছন্নভাবটা কিছু কাটে। কিন্তু স্বাভাবিক বোধ করে না রেবন্ত। ভেতরে একটা ভয়ঙ্কর অস্থিরতা।
নকশাল আমলে এ অঞ্চলে খুনখারাবি হতে পারেনি। পাঁচটা-সাতটা গাঁ জুড়ে তৈরি হয়েছিল প্রতিরোধ বাহিনী। এ সব কাজে সবচেয়ে বেশি জান লড়িয়েছিল কুঞ্জই। সে ছিল অস্ত্রহীন সেনাপতি। প্রাণের দায়ে পুলিশ কুঞ্জকে সাহায্য করেছে। তখন কুঞ্জর ছায়া হয়ে ফিরত রেবন্ত। রাত জেগে সাইকেলে ঘুরে গাঁয়ের পর গাঁ চৌকি দিত দুজনে। কুঞ্জ বুকের দোষ বলে নিজে সাইকেল চালাত না। তাকে সামনের রডে বসিয়ে নিয়ে চালাত রেবন্ত। সাইকেলেই দুজনের রাজ্যের কথা হত। হৃদয়ের কত গভীর কথা সে সব: স্বর্গরাজ্য তৈরি করার কত অবাস্তব স্বপ্ন! কুঞ্জ কখনও নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলতে চাইত না। অসম্ভব চাপা ছিল। কিন্তু একদিন মাঝরাতে জ্যোৎস্নায় খাডুবেড়ের মোড় থেকে বেলপুকুর ফিরবার পথে সাইকেলের রডে বসে দুর্বল মুহূর্তে কেঠো স্বভাবের কুঞ্জও বলে ফেলেছিল তনুর কথা। রাজুর বোন তনু। আর কাউকে কখনও বলেনি কুঞ্জ, বিশ্বাস করে শুধু তাকেই বলেছিল।
সেই বিশ্বাসটা আর অবশ্য নেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর তারা দুজনে গিয়েছিল যশোর অবধি। তাদের প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তখন ছিল প্রবলতম, কিন্তু সেইটেই আবার ছিল বিচ্ছেদেরও পূর্বাভাস। যশোরযাত্রাই ছিল তাদের বন্ধুত্বেরও শেষ যাত্রা! মুক্তিযুদ্ধের পরই ইলেকশন। কংগ্রেসের হয়ে নমিনেশন পাওয়ার আশায় কুঞ্জ লড়ে গেল নানুর সঙ্গে। পারল না। পারার কথাই নয়। কুঞ্জ এ অঞ্চলের জন্য অনেক করেছে বটে, কিন্তু তার মানে তো এ নয় যে বিধানসভায় দাঁড়ানোর ক্ষমতাও তার এসে গেছে। সেই প্রথম রেবন্ত চটেছিল কুঞ্জর ওপর। বোকার মতোই কুঞ্জ দাঁড়াল নির্দল হয়ে। রেবন্ত খাটতে লাগল নানুর জন্য। পাঁচ-সাতটা গাঁয়ে কুঞ্জর প্রভাব বেশি, নানু পাত্তা পাবে না। কিন্তু তখন নানু হারলে দলের বেইজ্জত। নিছক জোর ছাড়া গতি ছিল না। এমনিতেই হয়তো নানু জিতত, তবু সন্দেহের অবকাশ না রাখতে রেস্তরা বুথ দখল করল ভোটের দিন ভোরবেলায়। তখন থেকেই গোলমালের সুত্রপাত। কুঞ্জর পোলিং এজেন্ট বেলপুকুর কলেজে মার খায়। যারা মেরেছিল তাদের মধ্যে রেবন্ত ছিল। তখন রেবন্ত দরকার হলে কুঞ্জকেও মারতে পারত।
সে যাত্রা কুঞ্জ জেতেনি। ইলেকশনের পর আবার ভাবসাব হয়ে গিয়েছিল কুঞ্জর সঙ্গে রেবন্তর। তবে কুঞ্জ আর দলে ফেরেনি। অন্য দলে ভিড়েছে। কিন্তু আজও ঝিমিয়ে যায়নি। সব সময় কিছু না কিছু করছে। দল পাকাচ্ছে, চাঁদা তুলছে, বক্তৃতা দিচ্ছে, সাহায্য বা ত্রাণের কাজ করছে।
শ্যামপুরে রেবন্তদের পরিবারের প্রতাপ খুব। নামে বেনামে তাদের বিস্তর জমি, চালের কল, বাগনানে তাদের মস্ত কাপড়ের দোকান। রেবকে কাজকর্ম করতে হয় না। বি এসসি পাশ করে সে বহুদিন শুয়ে বসে আর পলিটিক্স করে কাটাচ্ছিল। তাঁতপুরে একটা ইস্কুলে অঙ্কের মাস্টারি করত। অলস মাথায় শয়তানের বাসা। রোজ বিকেলের দিকে একটু নেশা করার অভ্যাস দাঁড়িয়ে গেল। বেলপুকুর বাজারের পিছনে ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা ভিতর দিকে নির্জন জায়গায় হাবুর ঝোপড়া হল নেশার আস্তানা।
কিছু বদমাশ লোক হাবুর বউয়ের নামই দিয়েছিল একরাতিয়া। আসল নাম একরত্তি। মা বাপের আদর করে রাখা সেই নাম একরত্তি এখন বদমাশদের মুখে একরাতিয়া। অর্থাৎ এক রাতের মেয়েমানুষ। একরাতিয়া দেখতে এমন কিছু নয়। স্বাস্থ্যটা ভাল। ছেলেপুলে নেই। কিছুটা হাবুর লোভানিতে, কিছুটা একঘেয়েমি কাটাতে রেবন্ত সেই ফাঁদে পা দেয়।
একদিন রাত্রে যখন রেবন্ত ঝোপড়ার ভিতরের খুপরিতে একরাতিয়ার সঙ্গে ছিল তখন ঝাঁপ ঠেলে টর্চ হাতে আচমকা ঢুকল কুঞ্জ। তার পিছনে জনা পাঁচ-সাত ছেলে-ছোকরা সমাজরক্ষী। কুঞ্জ অবশ্য টর্চটা লুট করে নিবিয়ে ঝাপটা ঠেলে বন্ধ করে দিয়েছিল। বলেছিল, পালিয়ে যা সামনের ঘর দিয়ে। আর কখনও আসিস না।
রেবন্ত পালিয়েছিল। তারপর লোকলজ্জার ভয়ে সিঁটিয়ে থেকে ছিল কয়েকদিন। সামাজিক নোংরামি বন্ধ করতে কুঞ্জ তখন নানা জায়গায় হানা দিচ্ছে দলবল নিয়ে যত অকাজের কাজ। কয়েকদিন বাদে একদিন শ্যামপুরে এসে রেবন্তর সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে বলল-সত্যবাবুর বড় মেয়েটি ভাল। তোদের স্বঘর।
রেবন্ত চোখ তুলে তাকাতে পারছিল না লজ্জায়। কিন্তু মনে মনে বুঝতে পেরেছিল এটা ব্ল্যাকমেল। প্রথমটায় রাজি হয়নি। কিন্তু কুঞ্জর উসকানিতে তার বাবা মা আর কাকারা বিরে জন্য পিছনে লাগল। পারিবারিক চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা তাকে করতে হয়।
বিয়েটা পুরুষের জীবনের কী সাংঘাতিক গুরুতর ব্যাপার তা আগে জানত না রেব। বিয়ের পর হাড়ে হাড়ে জানল। বিয়ের আসরে দানসামগ্রীর মধ্যে একটা চরকা দেখে বরযাত্রীরা কিছু ঠাট্টা রসিকতা করেছিল। সে তেমন কিছু নয়। কিন্তু কন্যা সম্প্রদানের সময় রেবন্ত টের পেল তার করতলে শ্যামশ্রীর হাত শক্ত, ঘোমটার মধ্যে মুখখানা গোঁজ। বিদ্রোহের সেই শুরু। রেবন্তকে শ্যামশ্রী বহুভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে কালচারের দিক দিয়ে তার যোগ্য বর রেবন্ত নয়। এ কথা আরও নানা জনেও কানাঘুষো করে। একদিন এক বকারাজ খুড়শ্বশুর কলকাতা থেকে এসে সব দেখেশুনে মুখের ওপরেই তাকে বলেছিল-সত্যদা কলকাতায় থাকলে এ বিয়ের কথা ভাবতেই পারত না! গাঁ-ঘরে কি শ্যামাকে মানায়?
আস্তে আস্তে শক্ত হয়ে গেল রেবন্তও। শ্যামশ্রী দেখতে খারাপ নয়। সত্যিকারের ঢলঢলে চেহারা। মস্ত মস্ত গভীর চোখ। ভারী নরম তার চলাফেরা, কথাবার্তা, কিন্তু ওই নরম চেহারার ভিতরকার স্বভাবটি অহংকারী, জেদি, নিষ্ঠুর! বিয়ের পর থেকেই এক ঘরের মধ্যে তারা দুজন জন্মশত্রুর মতো এ ওকে আক্রমণ করার সুযোগ খুঁজত। এখন আক্রমণ নেই। নিরুত্তাপ বিরাগ রয়েছে।
এ বাড়ির কারও সঙ্গেই শ্যামশ্রীর তেমন বনিবনা নেই, তবে সে এত গভীর এবং ব্যক্তিত্বময়ী যে কেউ তাকে বড় একটা ঘটাতে সাহসও করে না। উঁচু গলায় শ্যামশ্রী বড় একটা কথা বলে না। তার তেজ রাগ সব ঠাণ্ডা ধরনের। সকালে উঠে সে রোজ চরকা কাটে, গান্ধীর বাণী পড়ে। এগুলো ওর সত্যিকারের ব্যাপার, না কি বিদ্রোহের প্রকাশ তা জানে না রেবন্ত। সে নিজে কিছু রাজনীতি করেছে বটে তবে কোনও আদর্শই তার ভিতরে গম্ভীর হয়ে বসেনি। তার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্কই নেই। নিজের চারপাশেও সে বরাবর তার নিজের মতো লোকজনকেই দেখেছে। তাদের কারওরই কোনও নেতার প্রতি অবিচল ভক্তি নেই, শ্রদ্ধা বা বিশ্বাসও নেই। তাই শ্যামশ্রীকে দেখে তার অসহ্য লাগে। গান্ধী কেন চরকা কাটতেন বা গান্ধী কী বলে গেছেন তা কখনও অনুসন্ধান করে দেখেনি রেবন্ত। সে শুধু জানে গান্ধী অহিংসবাদী ছিলেন, অসহযোগ আর ভারত ছাড়ো আন্দোলন করেছিলেন, লোককে চরকা কাটতে বলতেন, এর বেশি জানার আগ্রহ বেস্তর নেই। উপরন্তু এখন শ্যামশ্রীর জন্যই গান্ধীকে সে মনেপ্রাণে অপছন্দ করতে শুরু করেছে।
বিয়ের পর শ্যামশ্রীকে সে পায়নি বটে, কিন্তু পেয়েছে বনাকে। যতবার সে কনাকে দেখে ততবার মনে হয়, এই বনা তো আমার জন্যই জন্মেছিল। বনশ্রীর কথা মনে পড়লেই তার ভিতরকার অন্ধকার আলো হয়ে ওঠে। সমস্ত শরীর, মনপ্রাণ জেগে ওঠে। একাগ্র হয়ে ওঠে সে।
বড় গোপন কথা। কোনওদিন বনশ্রীকে সে কিছু বুঝতে দেয়নি, কখনও লঙন করেনি সম্পর্কের নিয়ম। শুধু তার মন জানে। যা অন্তরে গোপন করা যায় তাই বেড়ে ওঠে। যত দিন যাচ্ছে তত তার মন ভরে ওঠে বনশ্রীতে। কখনও পাগল পাগল লাগে। অসহায় আবেগে সে ঘন্টার পর ঘন্টা বনশ্রীকে চিন্তা করে। মনে মনে জিয়ন্ত করে তোলে তাকে। তারপর ভালবাসার কথা বলে পাগলের মতো।
এই অসহ্য অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই আবার সে যাওয়া শুরু করেছিল হাবুর ঝোপড়ায়। একরাতিয়ার সঙ্গে আবার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এখন আর সে লোকলজ্জার ভয়ও পায় না। ভারী বেপরোয়া লাগে নিজেকে। শ্যামশ্রী তার জীবনটা নষ্ট করেছে, এবং বনশ্রীকে সে হয়তো কোনওদিনই পাবে না। তবে আর ভয় কীসের, ভাবনাই বা কী? কুঞ্জর সমাজরক্ষী দল স্বাভাবিক নিয়মেই ভেঙে গেছে। এখন আর কেউ হামলা করে না। হাবুর ঝোপড়ায় মাইকেল জমেছে খুব। এমনকী কুঞ্জর নিজের ভাই কেষ্টও এখন হাবুর ঝোপড়ায় রোজকার খদ্দের।
বনশ্রীর কথা আর কেউ না জানুক, একদিন জেনে গেল কুঞ্জ। মাতাল অবস্থায় তাকে সেদিন তুলে এনেছিল কুঞ্জ। রিকশায় তাকে পাশে নিয়ে বসে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছিল রাতের বেলায়। এ সব করাই তো কুঞ্জর কাজ। মহৎ হওয়ার বড় নেশা ওর। আর সেই দিন রিকশায় ফাঁকা রাস্তায় কুঞ্জকে বহু দিন পরে একা পেয়ে রেবন্ত সামলাতে পারেনি নিজেকে। শ্যামশ্রীর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল কুঞ্জ, সেই আক্রোশ শীতের সাপের মতো ঘুমিয়ে থাকে তার মনের মধ্যে। কুঞ্জকে পেয়ে ফুঁসে উঠল। দুর্বল হাতে কুঞ্জর জামার গলা চেপে ধরে সে বলল–কেন আমার সর্বনাশ করলি হারামি? কে তোকে দালালি করতে বলেছিল?
বার বার এই প্রশ্ন করে যাচ্ছিল সে। পারলে সেদিনই খুন করত কুঞ্জকে। কিন্তু ঠাণ্ডা গলায় কুঞ্জ তাকে নানা উপদেশ দিচ্ছিল। ভাল হতে বলছিল, যেমন সবাই বলে। কুঞ্জকে রিকশা থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল রেবন্ত বার বার। বলেছিল–কে তোকে শ্যামার সঙ্গে বিয়ে দিতে বলেছিল? আমি তো বনাকে ভালবাসি, আমি বনাকে ভালবাসি। শ্যামশ্রীকে খুন করে আমি বনশ্রীকে বিয়ে করব।
মাতাল অবস্থায় কী বলেছিল তা মনে ছিল না রেবন্তর। কিন্তু পরদিন সকালে কুঞ্জই এল। নিরালায় ডেকে নিয়ে গিয়ে থমথমে মুখে বললবনশ্রীর সঙ্গে তোর কোনও খারাপ সম্পর্ক নেই তো?
আতঙ্কে সাদা হয়ে গিয়েছিল রেবন্ত। ঘোলাটে স্মৃতি ভেদ করে গত রাত্রির কথা কিছু মনে পড়েছিল তার। সে হাবুর ঝোপড়ায় গিয়ে মদ খায় বা একরাতিয়ার সঙ্গে শোয়–এ কথা লোকে জানলেও সে আর পরোয়া করে না। কিন্তু বনশ্রীর কথা সে কোনও পাখি-পতঙ্গের কাছেও প্রকাশ করতে পারবে না যে। কী করবে ভেবে না পেয়ে রেবস্তার মাথা গুলিয়ে গেল। ঝুপ করে কুঞ্জর দুহাত ধরে বলল–না, না। দোহাই, বিশ্বাস কর।
কুঞ্জ বিশ্বাস করেনি। অত বোকা সে নয়। কিন্তু মুখে বলেওনি কিছু। শুধু কেমনধারা শুকনো হেসেছিল। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললবনশ্রী বড় ভাল মেয়ে। নষ্ট করিস না।
তারপর থেকে কুঞ্জ এখন প্রাণপণে বনশ্রীর জন্য ভাল ভাল সম্বন্ধ জোগাড় করছে। বিয়ে হয়েও যেত এতদিনে। কিন্তু বড় মেয়ের বিয়েটা সুখের হয়নি বলে বনশ্রীর মা বাবা চট করে কোনও জায়গায় মত দিতে দ্বিধা করছেন। এবার একটু ভাল করে দেখেশুনে বিয়ে দেবেন ওঁরা।
রেবন্ত জানে, কুঞ্জ কখনও বনশ্রী সম্পর্কে তার মনের কথা কাউকে জানাবে না। মরে গেলেও না। সে স্বভাব কুঞ্জর নয়। কিন্তু রেবন্তর তবুবুকে জ্বলুনিটা যায় না। কুঞ্জ তো জানে। জেনে গেছে। পৃথিবীর একটা লোক তো জানল!
ইদানীং কুঞ্জর আর এক কাজ হয়েছে। কে তার মাথায় ঢুকিয়েছে বে-আইনি জমি ধরতে হবে। সেই থেকে গাঁয়ে গাঁয়ে পাগলের মতো ঘোরে সে। বাগনান হাওড়া আর কলকাতার কাছারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দলিল দস্তাবেজের খোঁজখবর নেয়, নকল বের করে। বি ডি ও থেকে শুরু করে মহকুমা হাকিম, ল্যান্ড সেটেলমেন্ট থেকে থানা–কোথায় কোথায় না হন্যে হয়ে হানা দিচ্ছে সে? যে ব্যাপারে হাত দেয় তাতেই ওর রোখ চাপে। আগুপিছু ভাবে না।
জমির স্বত্ব মানুষের কাছে কী সাংঘাতিক তা যে জানে না কুঞ্জ এমন নয়। সরকার বাড়তি জমি ছাড়তে বললেই লোকে ছাড়ে কখনও? তবে তো সরকার একদিন এও বলতে পারে, বাড়তি ছেলেপুলে বিলিয়ে দাও।
কুঞ্জ বিপদটা বুঝেও বোঝেনি। এই জমি উদ্ধারের জন্য সে আর একবার খুন হতে হতে বেঁচে যায় বরাত জোরে। তবু বোঝেনি। রেবন্ত জানে গোটা এলাকা জুড়ে এখন সযত্নে একটি স্টেজ তৈরি হয়ে রয়েছে, যে স্টেজে কুঞ্জর জীবনের শেষ দৃশটার অভিনয় হবে। আজ বেঁচে গেল বটে, কিন্তু রোজ কি বাঁচবে? তার দিন ঘনিয়ে এল। তার জন্য টাকা খাটছে, পাকা মাথার লোক রয়েছে পিছনে। এও ঠিক হয়ে আছে, কুঞ্জ মরলে পুলিশ তদন্ত করবে পলিটিক্যাল লাইন ধরে। যে কোনও দলের ঘাড়ে দোষটা চাপানো হবে। দল থেকে প্রতিবাদ উঠবে। হইচই হবে কিছুদিন। তারপর থিতিয়ে পড়বে। কুঞ্জ মরবেই। রেবন্ত, পটল বা কালিদাসের হাতে যদি নাও মরে তবু কারও না কারও হাতে মরতেই হবে। নানা জায়গায় লোক লাগানো আছে। শুধু ইশারার অপেক্ষা। কিন্তু সেজন্য কুঞ্জকে খুন করতে চায়নি রেবন্ত। কুঞ্জ যাই করুক ওকে সত্যিকারের ঘেন্না করতে পারেনি সে কোনওদিন। ঘেন্না না হলে, খুনে রাগ না উঠলে কি মারা যায়? সেই অভাবটুকু এতদিন ছিল। আজ আর নেই। আপন মনে রেবন্ত একটু হাসে। কুঞ্জ, তোর সঙ্গে আর পাঁচজনের তফাত রইল না। তুই আর আমার চেয়ে মহৎ নোস। সাবিত্রীর কথা আমি জানি।
বাইরে একটা দমকা হাওয়া দিল। বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা সাইকেলটা ঘড়াং করে পড়ে গেল। একটা চাকা বোঁ বোঁ করে ঘুরছে। উৎকর্ণ হয়ে শোনে রেবন্ত। খুবই দামি সাইকেল। বিয়ের পাওয়া জিনিস। কিন্তু উঠল না সে। কানের যন্ত্রণায় অস্থির রেবন্ত লেপমুড়ি দিয়ে বোম হয়ে বসেই রইল। শ্যামশ্রী ঘরে নেই, কিন্তু চারদিকে তারই জিনিসপত্র ছড়িয়ে রয়েছে। বিয়ের সময় শ্যামশ্রীদের বাড়ি থেকে অনেক জিনিস আদায় করা হয়েছিল। এ ঘরে খাট, বিছানা, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল এমনকী পাপোষটা পর্যন্ত ওদের দেওয়া। ভেবে হঠাৎ গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠে রেবম্ভর। লেপটা ফেলে। উঠে পড়ে বিছানা থেকে। আজকাল শ্বশুরবাড়ির জিনিসগুলোতে পর্যন্ত সে ঘেন্না পায়। সেই ঘেন্নায় এ ঘরে থাকার পাটই তুলে দিয়েছে।
ছাদের ঘরে যাবে বলে রেব বাইরের বারান্দার দিকে দরজাটা খুলতে যাচ্ছিল এমন সময় দেখল শ্যামশ্রী ভিতরে দরদালানের দিককার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। একদৃষ্টে দেখছে তাকে।
রেবন্ত যথাসম্ভব তেতো গলায় বলে–আমি যাচ্ছি। দরজাটা বন্ধ করে দাও।
শীতল কঠিন একরকম গলায় শ্যামশ্রী জিজ্ঞেস করে–তুমি আজ দুপুরে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলে?
রেবন্ত শ্যামশ্রীর চোখ থেকে চট করে চোখ সরিয়ে নেয়। বলে–হ্যাঁ।
–পুরুষদের শ্বশুরবাড়িতে বেশি যাওয়া ঠিক নয়।
শুনে রেবন্ত জ্বলে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে মুখ ঘুরিয়ে বলে–কেন, কোনও অসুবিধে হয়েছে নাকি?
শ্যামশ্রী বড় বড় চোখে অনুত্তেজিত স্বরে বলে–হয়। শুভ এসেছিল তোমার আমার ঝগড়া হয়েছে কিনা তা জানতে। আমি চাই না, আমার বাপের বাড়ির লোকেরা কোনও কিছু সন্দেহ করুক। তোমার হাবভাব দেখে ওরা আজ নাকি ভেবেছে যে তুমি বাড়ি থেকে ঝগড়া করে গেছ।
মনে মনে বড় অসহায় হয়ে পড়ে রেবন্ত। শ্বশুরবাড়ি! শ্বশুরবাড়ি বলে সে সেখানে যায় নাকি? সে তো যায় বনার কাছে। না গিয়ে সে থাকবে কেমন করে? তার জীবনের একমাত্র খোলা জানালা, একমাত্র ডানায় ভর দেওয়া মুক্তি ওই বনা। বনার কাছে সে যাবে না? মুখে সে শুধু বলল–ও।
শ্যামশ্রী মৃদুস্বরে বলল–আর যেয়ো না। আমার ছোট ভাইবোনেরাও এখন বুঝতে শিখছে। তারা টেয় পায়।
শিউরে উঠে রেবন্ত কূট সন্দেহে বলে কী টের পায়?
শ্যামশ্রী তেমনি বড় বড় চোখে তাকিয়ে বলে–আমাদের সম্পর্কটা।
শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রেবন্ত, শ্যামশ্রীর এই কথায় সহজ হল। বলল–টের পেলেও কিছু যায় আসে না।
–তোমার যায় আসে না জানি। কিন্তু তোমার মতো গায়ের চামড়া তো সকলের পুরু নয়। আমার যায় আসে। জামাই হয়ে শ্বশুরবাড়িতে ঘন ঘন যাবেই বা কেন? তোমার লজ্জা হয় না? এ সব কথা খুবই শান্ত স্বরে আস্তে আস্তে বলল শ্যামশ্রী। যেন বিশ্লেষণ করছে, বোঝাচ্ছে, জানতে চাইছে। শিক্ষয়িত্রীর মতো ভঙ্গিতে।
অনেক দিনের গভীর আক্রোশ জমে জমে তাল পাকিয়ে আছে রেবন্তর ভিতরে। বনার প্রতি গোপন ভালবাসা, কুঞ্জর প্রতি আক্রোশ, শ্যামশ্রীর প্রতি ঘৃণা। সে একদম স্বাভাবিক নেই। কান মাথা জুড়ে তীব্র যন্ত্রণা ফেটে পড়ছে। বাইরে চলমান হাওয়ায় সাইকেলের চাকাটা ঘুরে যাচ্ছে অবিরল। ফ্রি হুইলের কির কির শব্দ আসছে।
শ্যামশ্রীর দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনতে শুনতে ভিতরে আক্রোশের পিণ্ডটা বোমার মতো ফাটল। তার ভেতরে একটা রাগে উন্মাদ পাগল চেঁচাল–প্রতিশোধ নাও, প্রত্যাঘাত করো।
দাঁতে দাঁত ঘষল রেবন্ত। সন্ধেবেলা কুঞ্জকে খুন করতে গিয়ে পারেনি, এখন সেই আক্রোশটা তার সমস্ত শরীরকে জাগিয়ে তোলে। ভিতরের পাগলটা চেঁচায়লণ্ডভণ্ড করে দাও ওকে। শেষ করে দাও।
শ্যামশ্রী ঘরের মাঝখানটায় ভাল মানুষের মতো অবাক চোখে চেয়ে দেখছিল রেবন্তকে। রেবন্ত আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে। মারবে? মারুক। শ্যামশ্রী মারকে ভয় খায় না। গান্ধীজিও কি মার খাননি? শ্যামশ্রী এক পাও নড়ল না।
রেবন্ত সামনে এসে দু হাতে খামচে ধরল তার কাঁধ। তীব্র গরম খাস মুখে ফেলে বলল তুমি আমাকে শেখাবে?
বলে একটা ঝাঁকুনি দিল শরীরে। শ্যামশ্রী শরীর শক্ত করে বলল-দরকার হলে শেখাব। চোখ রাঙিও না, আমি তোমাকে ভয় পাই না।
–পাও না? এক অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে অবাক গলায় বলে রেবন্ত। ভিতরের পাগলটা চেঁচায়– ছিঁড়ে নাও পোশাক। মারো। ধর্ষণ করো। শেষ করো।
শ্যামশ্রীর আঁচল খসে পড়েছিল। বড় বড় চোখে ভয়হীন ঘৃণায় সে দেখে রেবন্তকে। রেবন্তও দেখে ওই নরম চেহারার অহংকারী জেদি মেয়েটাকে।
কয়েক পলক তারা এরকম রইল। তারপরই রেবন্ত হঠাৎ শ্যামশ্রীর সবুজ উলের ব্লাউজের বড় বড় বোতামগুলো হিংস্র আঙুলে খুলে ফেলতে লাগল।
প্রাণপণে বাধা দিল শ্যামশ্রী। দুহাতে ঠেকাচ্ছে রেবম্ভর হাত, বলছে কী করছ! ছাড়ো, ছাড়ো।
প্রবল ঘৃণা, আক্রোশ আর ভীষণ খুন করার ইচ্ছেয় পাগল রেবন্ত একটা চড় কষাল শ্যামশ্রীর গালে। চাপা গলায় বলল–চুপ। খুন করে ফেলব।
শ্যামশ্রী কী করবে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার সব আবরণ খসিয়ে ফেলে রেবন্ত। প্রায় হিঁচড়ে ধাক্কা দিয়ে নিয়ে ফেলে বিছানায়। চুলের মুঠি চেপে ধরে শুইয়ে দেয়। তারপর কামড়ে ধরে ঠেটি। দাঁতে চিবিয়ে রক্তাক্ত করে দিতে থাকে। দাঁত বসায় গাল, স্তনে, গলায়। প্রবল ব্যথায় গোঙাতে থাকে শ্যামশ্রী। চেঁচায় না। দরদালানের দরজা এখনও খোলা। চেঁচালে কেউ এসে পড়বে। তাই ভয়ে, আতঙ্কে, লজ্জায় যতদূর সম্ভব নীরবে সহ্য করার চেষ্টা করে।
রেবন্ত নয়, যেন ন্যাংটো এক পাগল হামলে পড়ে তার ওপর। সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে থাকে। শ্যামশ্রী বুঝতে পারে, রেস্তর শরীরের ভিতর থেকে যে কাঁপুনি উঠে এসে তাকেও কাঁপাচ্ছে তা ঠিক দেহমিলনের উত্তেজনা নয়, প্রেম নয়। বহুদিনের পুঞ্জীভূত রাগ প্রতিশোধ নিচ্ছে মাত্র। এ হল ধর্ষণ, বলাৎকার।
শান্ত, সংযত, পাথরের মতো শক্ত শ্যামশ্রীকে প্রবল হাতে পায়ে দাঁতে থেঁতলে নিষ্পেষিত করে, নিংড়ে নিতে থাকে রেবন্ত। একদম ছোটলোক বর্বরর মতো হতে পেরে সে তীব্র আনন্দ পায়। এই শাস্তি বহু দিন হল পাওনা হয়েছে শ্যামশ্রীর। দাঁতে দাঁত চেপে আছে শ্যামশ্রী, চোখ ঊর্ধ্বমুখী, শরীর দিয়ে খানিকক্ষণ প্রতিরোধ করেছিল, এখন ছেড়ে দিয়েছে সব। ওর মুখে গরম শ্বাস ফেলে চাপা গলায় রেবন্ত মাঝে মাঝে হুংকার দেয়চুপ! খুন! খুন করে ফেলব। একবার অস্ফুট স্বরে শ্যামশ্রী বলেছিল–তাই করো। এর চেয়ে সেটা ভাল। রেবন্ত তক্ষুনি কনুই দিয়ে নির্মমভাবে চেপে ধরেছে ওর মুখ।
দরদালানের দরজা হাট করে খোলা। বাইরের বারান্দায় প্রবল বাতাসে কিরকির করে ঘুরে যাচ্ছে সাইকেলের চাকা।
শ্যামশ্রীকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে যখন উঠে বসল রেবন্ত তখন অবসাদে সে টলছে। তবু কাণ্ডজ্ঞান ফিরে এসেছে তার। উঠে গিয়ে দরদালানের খোলা দরজা বন্ধ করে খিল দিল। বিছানার দিকে চেয়ে সে দেখল, শ্যামশ্রী তার শরীর ঢাকা দেয়নি। উপুড় হয়ে পড়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফোঁপাচ্ছে। মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় অমানুষিক গলায় গোঙানির শব্দ করছে।
এক মুহূর্তের জন্য যেন কী করবে ভেবে পেল না রেবন্ত। কাউকে ডাকবে? পরমুহূর্তেই মনটা কঠিন হয়ে গেল তার। এইটেই তো সে চেয়েছিল। ঠিক এইভাবে বর্বরের মতো ওকে ধ্বংস করতে।
রেবন্ত বাইরের বারান্দার দরজা খুলল। মুখ ফিরিয়ে হিংস্র গলায় বলল–আমি যাচ্ছি। দরজাটা দিয়ে দাও।
বলতে বলতেই সে লক্ষ করে বিছানার গোলাপি ঢাকনায় রক্তের ফোঁটা পড়েছে অনেক। শ্যামশ্রীর মুখের ওর এলো চুলের ঝাপটা এসে পড়েছে। গভীর যন্ত্রণায় গুমরে মুখটা ফেরাতেই দেখা গেল তার রক্তাক্ত ঠোঁটে, গালে গভীর ক্ষত। স্থির চোখে আরও একটু চেয়ে থেকে রেবন্ত ওর বুকে আর কাঁধে তার নিজের দাঁতের কামড়ে ফুলে ওঠা চাকা চাকা দাগও দেখতে পায়।
রেবন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারল না। তার মনে হল, সে চলে গেলেও শ্যামশ্রী উঠবে না। ঢাকবে না নিজেকে ঠিক ওইভাবেই পড়ে থাকবে, যাতে বাড়ির লোক এসে তাকে দেখতে পায়। যদি দেখতে পায় তবে রেবন্তর কীর্তির কথাটা চাউর হয়ে যাবে। শ্যামশ্রীর গায়ের সমস্ত ক্ষতচিহ্ন সাক্ষ্য দেবে তার বর্বরতার। শ্যামশ্রী ঠিক তাই চাইবে।
খাটের কাছে গিয়ে রেবন্ত লেপটা টেনে শ্যামশ্রীর শরীরটা ঢেকে দিল। স্থির দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল একটু, তারপর বলল–আমি যাচ্ছি।
জবাব নেই। শুধু গুমরে ওঠার শব্দ হয় কান্নার এক ঝলক তরঙ্গের মতো বয়ে যায় শ্যামশ্রীর ওপর দিয়ে। কিন্তু সেই কান্নাও বড় অফুট। বলতে কী শ্যামশ্রীকে কাঁদতে প্রায় কখনওই দেখেনি রেবন্ত। যত যাই হোক, শান্ত ও কঠিন শ্যামশ্রী কখনওই কাঁদে না। তাই নিজেকে একটু বোকা বোকা লাগে রেবন্তর। তার ভিতরে গরমটা কমে গেছে। অস্বাভাবিক রাগটা আর নেই। মাথা আর কানের যন্ত্রণার সঙ্গে গভীর একটা ক্লান্তি টের পাচ্ছে সে। এক এবার মনে হচ্ছে, এ কাজটা ভাল হল না।
কিন্তু শ্যামশ্রী আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। কান্নায় ভেসে গেল না সে। কিছুক্ষণ পড়ে থেকে দাঁতে দাঁত চেপে ধীরে ধীরে উঠে বসল। চুলগুলো সরিয়ে দিল মুখ থেকে। মস্ত মস্ত চোখে গভীর ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখল একবার রেবকে। ঠোঁটের রক্ত ঘন হয়ে থকথক করছে, ফুলে ঝুলে পড়েছে ঠোঁট। গালের দু জায়গায় কামড়ের দাগ ঘিরে লালচে বেগনি কালশিটে। চেনা মুখটা অচেনা আর ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে।
আস্তে উঠে দাঁড়ায় শ্যামশ্রী। ধীরে ধীরে পোশাক পরে। রেবন্তর দিকে তাকায় না।
রেবন্ত বাইরের দরজার কাছে গিয়ে ছিটকিনির দিকে হাত বাড়িয়ে আবার বলল–যাচ্ছি।
শ্যামশ্রী মুখ ফিরিয়ে তাকাল। তারপর ওই বীভৎস ফোলা, প্রচণ্ড ব্যথার ঠোঁটেও একটু হাসল। সে হাসিতে বিষ মেশানো। উত্তেজনাহীন, অদ্ভুত ঠাণ্ডা গলায় বলল–তবু যদি মুরোদ থাকত মেয়েমানুষকে ঠাণ্ডা করার! যদি সেই ক্ষমতাটুকুও দেখাতে পারতে!
রেবন্ত তার পাগলা রাগের চোখে চেয়ে থাকে শ্যামশ্রীর দিকে। শ্যামশ্রী তার বড় ঠাণ্ডা চোখে চাউনিটা ফেরত দিয়ে বলে-কত বীরত্ব তোমার।
রেবন্ত দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসে। আর একটুক্ষণ এ ঘরে থাকলে সে শ্যামশ্রীর গলা টিপে ধরবে হয়তো।
সাইকেলের চাকাটা কির কির করে ঘুরে যাচ্ছে। রেবন্ত সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে ছাদের ঘরে উঠে যায়। পিছনে মৃদু শব্দে শ্যামশ্রীর ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
.
০৭.
এই যে এত সব বানিয়েছে মানুষ, বাড়িঘর আসবাবপত্তর, আর ওই যে গাছপালা, প্রকৃতির জগৎ, এ সব একটা বেড়ালের চোখে কেমন দেখায়? সে তো বোঝে না কেন এই ঘর বারান্দা, খাট, গদি, কাঠের চেয়ার। সে জানেও না এ সবের দাম বা উপযোগ। তবু সে তো দেখে কেমন দেখে? কী বোধ করে সে? সে কি অনুভব করে আকাশের নীল, সূর্যের আলো? সে কি লজ্জা পায় মহিলার নগ্নতা দেখে?
রাজু নিবিষ্টমনে পায়ের কাছের বেড়ালটার মাথায় পায়ের চেটো ধীরে ধীরে বুলিয়ে দেয়। মনে মনে প্রশ্ন করে–কেমন রে তুই? তোর চোখ, মন, বুদ্ধি দিয়ে দেখলে কেমন দেখাবে জগৎটাকে? সে কি খুব অন্যরকম? যদি তোর চোখ দিয়ে দেখি তবে কি এই বাড়িঘর হয়ে যাবে পাগলাটে হাস্যকর এক নকশার মতো? অর্থহীন কিছু ধাঁধা? আকাশের নীল রং দেখা যাবে না? জ্যোৎস্না যে সুন্দর তা বুঝতেও পারব না নাকি?
তবে সে কেমন হবে? ভাবতে ভাবতে খুব নিবিড় হয়ে এল রাজুর চিন্তাশক্তি। অল্প অল্প করে সে নিজের ভিতরে একটা বেড়ালের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করতে লাগল। বেড়ালের কার্যকারণ জ্ঞান নেই। সে জানে না, বীজ থেকে গাছ হয়। সে জানে না ঘরবাড়ি তৈরি করে মানুষের শ্রম ও বুদ্ধি, সে বোঝে না যুক্তির বিচারে সৌন্দর্যের সার্থকতা! তার জগৎ কেবল গন্ধ, শব্দ ও জৈব বোধ দ্বারা আচ্ছন্ন। অসীম অজ্ঞানতা তার। সুতরাং বেড়ালের চোখে গোটা জগৎকে দেখতে হলে সব বোধ বৃদ্ধি ও যুক্তির বিচার ভুলতে হবে। প্রাণপণে রাজু সেই চেষ্টাই করতে থাকে।
ঝোড়ো হাওয়ার মুখে মুখে কখন উড়ে গেছে মেঘ! মাঝরাতে ভাঙা ভুতুড়ে এক চাঁদের কুয়াশা মাখা জ্যোৎস্নায় চারদিকে গহীন প্রেতরাজ্য জেগে ওঠে। সঞ্চিত জল ঝরে পড়ছে টুপ টাপ টিনের চাল থেকে, গাছের পাতা থেকে। কী শব্দহীনতার শব্দ। উঠোন জুড়ে টলটলে জলের গাঙ।
মেঘ কেটে এক মরুণে ঠাণ্ডা পড়ল চারদিকে। এত শীত যে শরীর পাথর হয়ে যায়। কান-মুখ কম্বলে ঢেকে বারান্দার চেয়ারে বসে পাথর হয়েই থাকে রাজু। এখন বাতাসের শব্দ নেই, মানুষের শব্দ নেই। গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে সে পা দিয়ে বেড়ালটাকে ছুঁয়ে খুব ধীরে ধীরে বেড়ালের চেতনার মধ্যে ডুবে যেতে থাকে।
ক্ষয়া চাঁদটার দিকে চেয়ে সে ভাবে–বেড়ালের চোখে চাঁদের কোনও অর্থ নেই, নাম নেই, বস্তুজ্ঞান নেই। তা হলে কেমন? চাঁদের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে রাজু! ক্রমে ক্রমে বোধ বুদ্ধি, যুক্তি বিচার ও বস্তুজ্ঞান ডুবে যেতে থাকে। হঠাৎ চমকে সে দেখে, আকাশটা এক্সরে প্লেটের মতো স্বচ্ছ, কালো। তার একধারে লাল, রাগি, আগুনের মতো আকারহীন চাঁদ। গ্রহ, নক্ষত্র সব লম্বাটে, আগুনের মতো। চারদিকে ভুসো ছাইরঙা অন্ধকার। কিন্তু তাতে পরিষ্কার বেড়ালের চোখে সে দেখতে পায় লালচে গাছ, লালচে পাতা। অনেক পোকামাকড়ও নজরে আসে তার এই অন্ধকারে।
বুদ্ধিকে আরও ত্যাগ করতে থাকে রাজু। ছেড়ে দিতে থাকে মানুষের বস্তুজন। বেড়ালের আত্মীয় হতে থাকে। শুধু চৈতন্যটুকু জেগে থাকে তার। শুধু অনুভব। অনেকক্ষণ চোখ বুজে মনকে স্থির রাখে সে। অনেকক্ষণ। গভীরভাবে ভাবতে থাকে–আমি বেড়াল। আমি বেড়াল। আমি বেড়াল।
ভাবতে ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মানুষের বোধবুদ্ধি নিভে গেল তার। সঙ্গে সঙ্গে টের পেল, সে এক স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রাণী। তার গোষ্ঠী নেই, সমাজ নেই, রাষ্ট্র নেই, আত্মীয়স্বজন নেই! চারদিকে যে রং ও রূপের ঐশ্বর্যময় জগৎ ছিল তা মুছে গেছে। তার নাকে আসে বিচিত্র সব গন্ধ যা কোনওদিন মানুষ হিসেবে সে টের পায়নি। তার সজাগ কানে এসে পৌঁছোয় অদ্ভুত সব দূর ও কাছের আওয়াজ। সামনে মস্ত গাছের মগডালে ঘুমের মধ্যে একটা পাখি একটু নড়ল বুঝি, সেই শব্দও তার কানে আসে। কোনও স্মৃতি নেই, শুধু মস্তিষ্কের কিছু নির্দেশ কাজ করে তার মধ্যে। কোনও চিন্তা নেই, শুধু ক্ষুধা ভয় ও প্রীতি মুহূর্তের অনিশ্চয়তার বোধ আছে মাত্র। অবাক হয়ে সে দেখে, চারদিকে সব কিছুই আমূল বদলে গেছে। ভারী গোলমেলে সব নকশা, নানা আকার ও আকৃতি, অদ্ভুত সব রং। লাল, গাঢ় লাল, ফিকে লাল, কালো, আবছা কালো, বেগুনি। নাকের কাছে দিপ দিপ করে একটা পোকা জ্বলে আর নেভে। পোকাটাকে খুবই স্পষ্ট দেখতে পায় সে। তার মুখ চোখ পাখনার গতি কিছুই নজর এড়ায় না। একদৃষ্টে চেয়ে সে একটা থাবা দেয়। পোকাটা ওপরে উঠে যায়। নিস্পৃহ লাগে তার। সামনে একটা সমতল, তারপর নিচু, তারপর আবার সমতল। ওদিকে একটা দরজা খুলে যায়। লম্বাটে এক প্রাণী বেরিয়ে এসে দুর্বোধ্য ভাষায় কী বলে। তার কানে গমগম করে শব্দটা। তবে সে বোঝে, এ শব্দে তাকে ডাকা হচ্ছে না। সে জানে, অদ্ভুত একটা শব্দ আছে, যে শব্দ হলেই তাকে কাছে যেতে হবে। সে খাবার পাবে, বা কোলের ওম আর আদর।
রাজু চেয়ে থেকে কুঁদ হয়ে যায়। বেড়ালের চোখে আশ্চর্য এক পৃথিবী দেখতে থাকে। এ যেন দুরূহতম ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকলা। একদিকে চৌকো কিউঁকি সব আকৃতি। অন্যদিকে গলে পড়ছে জ্যাবড়া রং। রঙের সঙ্গে আলোর মিশেল। খুব কাছের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায় সে। একটা পিঁপড়ে হাঁটছে তার থাবার ওপর। কেঁচো বাইছে খুটির গায়ে। কিন্তু কেঁচো বা পিঁপড়ে বলে সে চিনতে পারে না এদের। শুধু জানে, কিছু জিনিস চলে, কিছু স্থির থাকে। রাজু অবাক হয়ে দেখে আর দেখে। সে আর মানুষ নেই, বেড়াল হয়ে গেছে।
খুব কাছ থেকে কে যেন তাকে ডাকছে অনেকক্ষণ, সেই ডাক তার বোধের ভিতরে কোনও ঢেউ তোলে না। তারপর আস্তে আস্তে এক গভীর জলের পুকুর থেকে সে ভেসে ওঠে। কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে থাকে। কিছু বুঝতে পারে না।
কুঞ্জ মৃদুস্বরে বলে–ঘুমিয়ে পড়েছিলি? ভিতরে গিয়ে শুয়ে থাক না। বসে আছিস কেন?
রাজু কথা বলল না। চেয়ে রইল শুধু। তার বেড়ালের বোধ এখনও সবটা কাটেনি।
কুঞ্জর হাতে একটা অচেনা জিনিস। একটু চেয়ে অবশ্য রাজু চিনতে পারে জিনিসটা হটওয়াটার ব্যাগ।
কুঞ্জ রবারের ব্যাগটা টেনেটুনে দেখছিল। বলল–এটা একটু দ্যাখ তো, চলবে কিনা, বহুকাল পড়ে ছিল ঘরে।
রাজু ব্যাগটা হাতে নিল। বারান্দার আলো জ্বেলেছে কুঞ্জ। রাজু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলল–রবার গলে গেছে। গরম জল ভরলেই ভুস করে ফুটো হয়ে যাবে।
–তা হলে অন্য কারও বাড়ি থেকে আনাতে হবে।
কুঞ্জর মুখ কেমন যেন সাদা, চোখে মড়ার মতো দৃষ্টি। মানুষের জগৎ বুদ্ধিতে ফিরে এসে রাজু এখন মাথা ঝাঁকিয়ে বেড়ালের বোধ সবটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বলল-কেষ্টর বউ কেমন আছে?
কুঞ্জ মৃদু স্বরে বলে–ভাল! টুসিকে সঙ্গে নিয়ে কুঞ্জ কোন বাড়ি থেকে গরম জলের ব্যাগ আনতে যাচ্ছে। রাজু তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বলে–চল তা হলে তোদের সঙ্গে খানিকটা ঘুরেই আসি।
খানিক পরে কুঞ্জ আর টুসির পিছু পিছু টর্চ আর ভুতুড়ে জোৎস্নার আলোয় জল, এটেল কাদার গর্তে ভর্তি রাস্তা পেরিয়ে ঝোপজঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছিল রাজু, তখনও তার মনের মধ্যে নানারকম অস্বাভাবিকত। কোথায় যাচ্ছে তা বার বার ভুলে যাচ্ছিল সে। কেবলই মনে হচ্ছিল, মনের দুটো ছায়ামূর্তি কেউ নয়। ওরা এক্ষুনি এগিয়ে যাবে, দূরে চলে গিয়ে হারিয়ে যাবে। তখন একা রাজুকে টেনে নেবে উদ্ভিদের জগৎ। টেনে ধরবে গভীর মাটি। রাজুর গতি হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো। এক জায়গায় সে গাছ হয়ে ডালপালায় বাতাস আর রোদ মাখবে সারা দিন, সারা জীবন।
রাতের আর বেশি বাকি নেই। ধোঁয়াটে কুয়াশা ও জ্যোৎস্নায় মাখা অন্ধকারে রাজু কেবলই পিছিয়ে পড়ছে। একটা অস্পষ্ট আতঙ্ক উঠে আসে বুকে। তাকে কুঞ্জ!
সামনে কুঞ্জ টর্চের মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ায়। মাঝখানে টুসি। কুঞ্জ বলে–আয়। বড় পিছিয়ে পড়েছিল। হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে না তো?
রাজু নিজের সব অস্বাভাবিক লক্ষণগুলি নিপুণভাবে চাপা দিতে চেষ্টা করে আজকাল। বলে, বড্ড পিছল। আমার অভ্যেস নেই তো।
টুসি মায়াভরা গলায় বলে-ইস! আপনার বড় কষ্ট হচ্ছে রাজুদা। এলেন কেন?
আগে অনেকবার কুঞ্জদের বাড়ি এসেছে রাজু। কোনওদিনই টুসি বা কুঞ্জর অন্য বোনদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়নি। ওরা বড় বাইরের পুরুষের সামনে আসে না। এবার কেষ্টর বউ যমে মানুষে টানাটানির মধ্যে পড়ায় টুসির সঙ্গে ভাব হয়ে গেল। এইভাবেই ভাব হয়, ঘটনার ভিতর দিয়ে, ঘটনায় জড়িত হয়ে, অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে নিতে।
রাজুও প্রাণপণে তাই চায়। পৃথিবীর কোনও-না-কোনও ঘটনার সঙ্গে একের পর এক জড়িয়ে পড়তে। ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ, জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে সামাজিক হয়ে উঠতে, দায়িত্বশীল হয়ে পড়তে। কিন্তু পারছে না। মনে মনে সে কেবলই ফিরে আসছে ভীষণ ব্যক্তিগত চিন্তায়, সমস্যায়। সে টুসিকে বলে এলাম। ভালই লাগছে তো।
প্রাণপণে ওদের সঙ্গে তাল রেখে হাঁটে রাজু। টুসি সামনে থেকে বলে রাস্তায় পা দেবেন না। পিছল। ঘাসে পা রেখে আসুন।
কুঞ্জ সামনে থেকে মাঝে মাঝেই টর্চ ঘুরিয়ে ফেলে। বলে–এই তো এসে গেছি।
ফটকে ঢুকে অনেকখানি বাগান পার হয় তারা। তারপর অন্ধকার এক বাড়ির দাওয়ায় ওঠে।
এই তো সেই সুন্দর মেয়েটার বাড়ি। না? কী যেন নাম মেয়েটার! বনশ্রী। হ্যাঁ, বনশ্রীই।
রাজুর বুক ধক ধক করে ওঠে। প্রেম নয়। এত সহজে আর আজকাল প্রেম হয় না। রাজু জীবনে বহু মেয়ের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে। তবু যে বুক ধ্বক করে ওঠে তার কারণ অন্য। সে ভাবে আহা, ওই মেয়েটা যদি আমার বউ হত! ভাবে, তার কারণ আজকাল তার খুব বিয়ের ইচ্ছে হয়। প্রেম বা কাম বা গেরস্থালির জন্য নয়। সে চায়, সারা রাত তার একজন সঙ্গী থাক। তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সদাসতর্ক একজোড়া চোখ তাকে নজরে রাখুক। তার কথা ভাবে এমন এক ঘনিষ্ঠ হৃদয় বড় চায় সে।
টুসি দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকে–মাসি! ও মাসি। এই বনাদিদি। চিরু। এই চিরু।
বনশ্রীর ঘুমই সব চাইতে পাতলা। বরাবর এক ডাকে ঘুম ভাঙে তার।
আজও ভাঙল। টুসির গলার স্বর না? এমনিতে বনশ্রীর ভয়টয় খুব কম। তবু মাঝ রাতে চেনা স্বর শুনেই সাড়া দিতে নেই বা দরজা খুলতে হয় না। তাই একটু অপেক্ষা করে বনশ্রী।
পাশের ঘর থেকে সবিতা পরিষ্কার গলায় বলে ওঠেন-কে রে? কী হয়েছে?
বাইরে থেকে টুসি বলে–মাসিমা, আপনাদের গরম জলের ব্যাগটা নিতে এসেছি। বউদির খুব অসুখ।
দাঁড়া। দিচ্ছি। বলে সবিতাশ্রী উঠতে যাচ্ছিলেন বোধ হয়।
বনশ্রী লেপ সরিয়ে উঠে পড়ে। বলে–মা, তুমি উঠো না। আমিই উঠেছি।
বউটার কী হয়েছে জিজ্ঞেস করিস তো। সবিতাশ্রী উদ্বেগের গলায় বললেন।
বাইরের ঘরে এসোশ্রী দরজা খোলে এবং একটু সংকুচিত হয়ে পড়ে। টুসির পিছনে কুঞ্জ দাঁড়ানো আর তার পিছনে বারান্দার বাইরে উঠোনের মলিন জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে রয়েছে রাজু।
কপাটের আড়ালে ঘরে এসে বনশ্রী বলে– সাবির কী হয়েছে?
টুসি কলকলিয়ে মিথ্যে কথা বলল, আর বোলো না, পিছল উঠোনে পড়ে গিয়ে খুব লেগেছে।
– সর্বনাশ। বনশ্রী একটু শিউরে ওঠে, তারপর চাপা গলায় বলে-পোয়াতি ছিল যে!
সেই তো। রক্ষে হল না বোধ হয়।
দাঁড়া, ব্যাগ এনে দিচ্ছি।
দ্রুতপদে কাশী মায়ের ঘরে ঢোকে। দেয়ালে পুরনো ন্যাকড়ায় বাঁধা ব্যাগটা যথাস্থানে ঝুলছে। এ বাড়িতে সব জিনিস নিখুঁত গোছানো। জায়গার জিনিস সব সময়ে ঠিক জায়গায় পাবে। রবারের ব্যাগটা রাখাও হয়েছে ভারী যত্নে। জল ঝরিয়ে কনো করে, ফুঁ দিয়ে একটু হাওয়া ভরে ফুলিয়ে ছিপি এঁটে।
বনশ্রী সেটা এনে টুসির হাতে দিয়ে বলে কী হবে তা হলে?
–কী করে বলি?
— আমি যাব?
-এত রাতে আর তোমার যেয়ে দরকার নেই। সকালে যেয়ো। যা হওয়ার তো হয়েই গেছে।
–সাবি বাঁচবে তে, ও কুঞ্জদা?
কুঞ্জ চুপচাপ ছিল এতক্ষ, এবার এক পা এগিয়ে এসে বলল–বেঁচে যাবে।
শ্রীকুর দিকে চেয়ে বলে চিকিৎসা আপনি করছেন না তো?
কুঞ্জ ম্লান হেসে বলে-না না। আমার ওষুধে ওরা কেউ বিশ্বাস করে না।
টুসি তাড়া দিয়ে বলে– চলো বড়দা।
ওরা চলে যাওয়ার ও কিক্ষণ বনশ্রী দরজা বন্ধ করল না। দু হাতে দুই পাল্লা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে মেঘ ভেঙে সামান্য জ্যোৎস্না ফুটেছে। অল্প কুয়াশা। প্রচণ্ড শীত। বনশ্রীর বেশ লাগছিল চেয়ে থাকতে। এমনিতে দেখার কিছু নেই। সেই রোজকার দেখা একই বাগান, গাছপালা। তবু রঙের একটা অদল বদল, দু-একটা চৌকস তুলির টানে চেনা ছবিটা কত গম্ভীর হয়ে গেছে। রাজু ওদের সঙ্গে এসেছিল কেন তা কিছুতেই ভেবে পায় না বনশ্রী। কেনই বা ওর মন খারাপ।
.
ঝরঝরে রোদ মাথায় করে ভোর হল। বনশ্রীর দিন শুরু হয় খুব ভোরে। বিছানাপাটি তুলে ঘরদোর গুছিয়ে সে যখন একটু অবসর পেয়ে ভোর দেখতে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল তখনও সে অন্যমনস্ক। সিঁড়ির ধাপে পা রেখে দাওয়ায় বসে সে নিজের একরাশ খোলা চুলের জট ছাড়ায় আঙুলে। আর ভাবে।
বাইরের ঘরে জনা দশ-বারো ছাত্রকে বসিয়ে পড়াচ্ছেন সত্যব্রত। পড়ানোর শব্দ ভাল লাগছিল না বনশ্রীর। খানিকক্ষণ বসে সে উঠে পড়ল। বাগানের ভিতরে বেড়াতে বেড়াতে চলে গেল অনেকটা। নির্জনে একা একা থাকতে ইচ্ছে করছে আজ। অলস লাগছে।
সাইকেলের শব্দে বনশ্রী ফিরে দেখে, ঝকঝকে মুগার পাটভাঙা পাঞ্জাবি, ধোয়া শাল আর ধবধবে সাদা ধুতি পরা রেবন্ত সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে ফটক দিয়ে সোঁ করে ঢুকে পড়ল। এত সকালেও গালের দাড়ি কামানো। ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে। কিন্তু মুখখানা গম্ভীর।
দেখে একটু আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল বনশ্রী৷ রেবন্ত অনেকটা এগিয়ে গেছে ভিতরবাগে।
পিছন থেকে বনশ্রী হঠাৎ ডাকল–রেবন্তদা!
সেই ডাকে সাইকেলটা দুটো মস্ত টাল খেল। যেন পড়ে যাবে। পড়ল না অবশ্য। রেবন্ত লম্বা পা বাড়িয়ে ঠেক দিয়ে ফিরে দেখল তাকে।
বনশ্রী হেসে বলল–এত সকালে?
সাইকেলটা হাঁটিয়ে নিয়ে রেবন্ত আস্তে আস্তে কাছে আসে। মুখে হাসির একটা চেষ্টা আছে, কিন্তু আসলে ওর মনে যে হাসি নেই তা দেখলেই বোঝা যায়।
হালকা হওয়ার জন্যই বনশ্রী বলল–একেবারে জামাইবাবু সেজে এসেছেন যে! ওমা। কী সুন্দর, দেখাচ্ছে।
ফর্সা রেবন্তর মুখটা লাল হল একটু। গলা সামান্য ভাঙা, একটু কাশি আছে সঙ্গে। সেই গলাতে বলল–আমি একটা কথা জানতে এসেছি না।
কথার ধরনটা খুব ভাল লাগল না বনশ্রীর। একটু যেন ছাইচাপা আগুনের মতো রাগ ধিকিধিকি করছে ভিতরে। বনশ্রী মুখে হাসি টেনে বলল কী কথা বলুন তো!
–শ্যামা আমাকে এ বাড়িতে আসতে বারণ করে কেন?
বনা তার মস্ত এলোচুলের ঝাপটার আড়াল থেকে বড় বড় চোখে চেয়ে বলল–আবার ঝগড়া করেছেন আপনারা?
কী করব? ও যে আমাকে কথায় কথায় অপমান করে। না, তোমরা সবাই ভারী অহংকারী।
বনশ্রী শ্বাস ফেলে বলে–হবে হয়তো। আপনি নিজেও খুব কম অহঙ্কারী নাকি মশাই? কাল দুপুরে এসে কেমন ব্যবহারটা করে গেলেন মনে আছে?
জামগাছের নীচে রেবন্ত সাইকেলের ওপর ভর রেখে আধখানা ভেঙে দাঁড়িয়ে। মাথায় কপাল ঢাকা মধু রংয়ের একরাশ ফন চুলের পুলি ফণা ধরে আছে। দুধসাদা শাল, ঝকমকে মুগা আর ফর্সা রঙের ওপর ঝরে পড়ছে অজস্র আলো আর ছায়ার টুকরো। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে ওকে! যেন এই ভোরের আলো থেকে রূপ ধরে এল। কয়েক পলকের রূপমুগ্ধতায় শ্রী সম্পর্ক ভুলে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে রেবন্ত যদি বলে চলে না, দুজনে পালিয়ে যাই, তবে শ্রী একত্রে বেরিয়ে যেতে পারে।
মনের ওপর একটু ছায়া ফেলে পাপ চিন্তাটা সরে যায়। তবু একটু শিহরন থেকে গেল, গা কাঁটা দিয়ে রইল একটু বনশ্রীর। সে কোনওদিন কাউকে ভালবাসেনি, এখনও বাসে না। তবু এ কী?
চাপা অভিমানে টলমল করছে রেবন্তর মুখ। বলল–আমি এ বাড়িতে আসি বলে তোমরা কিছু মনে করো না তো বনা?
বনশ্রী অবাক হয়ে বলে–ওমা! কী মনে করব?
রেবন্ত অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে–তবে শ্যামা আমাকে এখানে আসতে বারণ করল কেন?
বনশ্রী মুখ নামিয়ে বলল–দিদিই বা কেন বারণ করবে?
রেবন্তর চোখমুখ আস্তে আস্তে অন্য একরকম হয়ে যায়। ভিতরে কী একটা তীব্র বেদনা বোধ চেপে রাখছে অতি কষ্টে। চোখমুখ ফেটে পড়ছে রুদ্ধ আবেগে। নাকের ডগা লাল, ঠোঁট কাঁপছে। স্খলিত গলায় বলল–আমি কি না এসে থাকতে পারব? বনা, একদিন তোমাকে একটা ভারী গোপন কথা বলার আছে।
বিহ্বল বনশ্রী উন্মুখ চোখে চেয়ে গাঢ় স্বরে বলে–বলবেন।
.
০৮.
এন সি সি-র সিনিয়র ক্যাডেট হিসেবে সে যে রাইফেল ব্যবহার করত সেরকম নয়, অথবা সম্বলপুরে শিকার করতে গিয়ে যে থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালিয়েছে সেরকমও নয়, রাজুর হাতের এ রাইফেলটা প্রচণ্ড ভারী, আকারে বিশাল। ব্যারেলটা কামানের মতো মোটা। একটা ডবল ডেকার বাসের দোতলার একদম সামনের সিটে বসে আছে সে, হাতের ভারী রাইফেলের নল সামনের খোলা জানালা দিয়ে বাড়ানো। বাসের দোতলাটা একদম ফাঁকা। সামনে নীচে কলকাতার প্রচণ্ড ভিড়ের রাস্তা। বাসটা হরদম চলছে, স্টপ দিচ্ছে না। রাজু ঝাঁকুনিতে টাল্লা খেয়ে যাচ্ছে, রাইফেলের নল জানালার ওপর ঘর-ঘর করে গড়িয়ে যাচ্ছে তাতে। কিন্তু এরকম হলে চলবে না। রাজু শক্ত হতে চেষ্টা করে। সামনেই জানালা থেকে সাপের লেজের মতো একটা দড়ি দেখতে পায় এবং তাতে একটা টান দেয় সে। নীচে ড্রাইভারের কেবিনে টং করে একটা শব্দ হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে বাসটার গতি কমে আসে।
রাজু রাইফেলটা টিপ করার চেষ্টা করে। তারপর ভাবেটিপ করার দরকার নেই। এত লোক চারদিকে, গুলি চালালে কেউ না কেউ মরবেই। আর এ কথা কে না জানে যে, সব মানুষই তার শত্রু।
ভাবতে ভাবতে ট্রিগার টেপে রাজু। রাইফেলের বুনো ঘোড়ার পিছনের পায়ের মতো লাথি দেয় তাকে, আর সঙ্গে সঙ্গে বোতলের টাইট ছিগি আচমকা খোলার মতো দম করে শব্দ হয়। রাজু দেখতে পায়, রাস্তায় একটা লম্বা লোক সটান শুয়ে আছে।
টং টং। দুবার দড়ি টানে রাজু। বাস আবার বেটাল হয়ে প্রচণ্ড জোরে ছোটে! রাজু আবার দড়ি টেনে বাসের গতি কমায় এবং খুব লক্ষ্য স্থির করে একটা বেঁটে লোককে মারে। পরের বার মারে একটা মস্তান গোছের ছোকরাকে। গা গরম হচ্ছে তার। টুকটাক এরকম লোক মারতে তার মন্দ লাগছে না। ভিয়েতনামের জঙ্গলে মার্কিন স্নাইপাররা এইভাবেই গাছের ডাল থেকে, ঝোপঝাড় থেকে লুকিয়ে একটা-দুটো করে ভিয়েতকং গেরিলা মারত।
কিন্তু একটা ভারী মুশকিল হল! আগে লক্ষ করেনি রাজু, রাইফেলের নলের মুখটা ফানেলের মতো ছড়ানো। এত বড় মুখ যে, পুরনো আমলের গ্রামোফোনের চোঙের মতো মনে হয়। আর আশ্চর্য এই, সেই চোঙ থেকে লাউডস্পিকারের বিকট শব্দে হিন্দি গান বাজছে। দম মারো দম। কান ঝালাপালা। মাথা গরম হয়ে গেল রাজুর। রাইফেলের ওপরে একটা ঘোড়া টেনে দিল সে। এবার রাইফেলটা হয়ে গেল অটোমেটিক। রাজু ট্রিগার টিপতেই মুষলধারে নল দিয়ে টিরিটিরি টিরিটিরি শব্দে ছুটতে থাকে বুলেট। সেই সঙ্গে পরিত্রাহি গানও বেজে যায়। তুমসে মুহব্বত..প্যার…হাম তুম.এই সব শব্দ গুলিবিদ্ধ হয়েও তার কানে আসে। আর সে দেখে সামনেই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। রাস্তার একধার দিয়ে বয়ে চলেছে চমৎকার একটা কৃত্রিম খাল, তাতে গণ্ডোলা ভেসে বেড়াচ্ছে। আর একদিকে মাইল মাইল বাগান চলেছে। কিছু অস্বাভাবিক লাগে না তার। সে ঠিকই চিনতে পারে, এটাই রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। রাস্তার ওপর হাজার হাজার মানুষ লুটিয়ে পড়ছে গুলি খেয়ে। রক্ত, রক্ত আর লাশ। আর, দম মারো দম।
দৃশ্যটা পাল্টে যায়। সে দেখতে পায়, কলকাতার ঠিক মাঝখানে একটা ভীষণ উঁচু কনট্রোল টাওয়ারে সে বসে আছে। ঘরটা চক্রাকার, চারদিক স্বচ্ছ কাঁচে ঘেরা। চারদিকে নিচু জটিল সব যন্ত্রপাতি। সুইচ বোর্ডের সামনে কানে হেডফোন লাগানো গোমড়ামুখো কয়েকজন লোক বসে আছে। বাইরে ঝকঝকে রোদে বহু নীচে দেখা যাচ্ছে শহর। কী সুন্দর শহর! কলকাতা যে অবিকল নিউ ইয়র্কের মতো তা এত ওপর থেকে না দেখলে বোঝাই যেত না। আশি-নব্বই তলা সব বাড়ি, হাজার হাজার, অফুরন্ত। বহু দূরে আকাশের গায়ে অতিকায় তিমি মাছের পাঁজরের মতো হাওড়া ব্রিজ দেখা যাচ্ছে। ব্রিজের মাথা এত উঁচু যে তাতে মেঘ এসে ঠেকে আছে একটু। হাওড়া ব্রিজ যে এতটাই উঁচু তা তার জানা ছিল না, কিন্তু অবাকও হল না সে। এত বাড়ির জঙ্গলের মধ্যে মনুমেন্টটাকে খুঁজে পাচ্ছিল না সে। বহু খুঁজে দেখতে পেল মনুমেন্টটা খুবই কাছে টাওয়ারের পায়ের নীচে পড়ে আছে। গড়ের মাঠ দেখা যাচ্ছে ডানদিকে যেদিকটায় শেয়ালদা স্টেশন। উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর মধ্যে কয়েকটা একটু হেলে আছে। এত সুন্দর শহর, অথচ মাঝখানটায় একটা কাদামোলা জলের পুকুর। পুকুরের চারধারে কচু ন, মাটির পাড়। রোদে কয়েকটা লোক আর মেয়েমানুষ গায়ে মাটি মেখে হাপুস হুপুস স্নান করছে পুকুরে। পাশে মস্ত বটগাছ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাল্যস্মৃতিতে এই পুকুরটার কথাই বলেছিলেন বটে। আজও পুকুরটাকে বুজিয়ে ফেলা হয়নি দেখে ভারী রাগ হল রাজুর। এত সুন্দর শহরের মাঝখানে ওই নোংরা পুকুর কি মানায়? হেডফোনওয়ালা একজন বলে উঠল–নাউ, ইটস অলমোস্ট দি টাইম। এ কথায় রাজুর চৈতন্য হয়। তাই তো! এ শহরটার আয়ু তো মাত্র আর কয়েক মিনিট কথা আছে, বেলা বারোটা পাঁচ মিনিটে কলকাতায় হাইড্রোজেন বোমা ফেলা হবে। রাজু ঝুঁকে দেখে, পুকুরে স্নানরত লোকজন ছাড়া শহরটা একদম ফাঁকা। রাস্তাঘাট থম থম করছে। নিঃশব্দে প্রহর গুনছে শহর। পশ্চিম দিকে নীল আকাশে ছোট্ট বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে একটা উড়োজাহাজকে। রুপালি মশার মতো। চোখের পলকে মশাটা মাছির মতো বড় হয়ে উঠল। মাছিটা আরও কাছে আসতেই হয়ে গেল ফড়িংয়ের মতো বড়। তীরের মতো চলে আসছে, পিছনে দুটো টানা ধোঁয়ার লাইন। হেডফোনওয়ালা একটা লোক মাইক্রোফোনে জিরো আওয়ার গুনতে শুরু করে। টেন…নাইন..এইট… সেভেন… সিক্স… ফাইভ. ফোর… থ্রি… টু-উড়োজাহাজ একটা ঝড়ের বাতাস তুলে পলকে মিলিয়ে যায় দিগন্তে! আর হঠাৎ বাঁ দিকে সামা! একটু ঝলকানি দেখা দেয়। রাত তাকিয়ে ভাবে, এই নাকি হাইড্রোজেন বোম, ধুস! কিন্তু না। হেডফোন ওয়ালা একজন বলে ওঠে-পিছনে তাকা। তাকায় রাজু, আর আতঙ্কে বরফের মতো দমে যায় পাতাল থেকে আকাশ পর্যন্ত এক তিকায় মহাবৃক্ষের মতো জমাট কালো ধোঁয়া। দিরি দিরি করে সেই ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে আরও আরও বিশাল করাল চেহারা দিচ্ছে। একটু গরম লাগছিল বটে রাজু, কিন্তু একটা লোক একটা টেলিভিশন স্ক্রিনের দিকে চেয়ে বলল–অল ভেপোরাইজড। রাজু ঘুরে দেখে শহরের বাড়ি-ঘর সব ছিটকে আকাশে উঠে কাছে বা দূরে ঘুড়ির মতো লাট খাচ্ছে। বাষ্পীভূত অবস্থা কি একেই বলে? শুধু হাওড়া ব্রিজ এখনও আকাশ ছুঁয়ে খাড়া রয়েছে, তার ডগায় এখনও লেগে আছে ছবির মতো স্থির একটু মেঘ। একজন হেডফোনওয়ালা বলে উঠল– আমাদের টাওয়ারের সাপোর্টটা উড়ে গেছে। আমরা এখন শূন্যে, ইন অরবিট। রাজু হাইড্রোজেন বোমার ক্রিয়াকাণ্ড আগে কখনও দেখেনি। এখন খুব মন দিয়ে দেখতে লাগল। দেখতে কিছু খারাপ লাগছে না। একদিকে ছত্রাকের মতো অতিকায় ধোঁয়ার মিশমিশে কালো মেঘ। সেই মেঘের কোলে কলকাতার সব উড়ন্ত ঘরবাড়ি। তাদের এই কনট্রোল টাওয়ারের কেবিনটাও নাকি উড়ছে। সে অবশ্য তেমন কিছু টের পাচ্ছে না। কিন্তু সে পরিষ্কার দেখতে পেল, কলকাতার মধ্যিখানে সেই আদ্যিকালের নোংরা পুকুরটার কিছুই হয়নি। তার চারদিকে এখনও সেই কচু বন, মাটির পাড়, একধারে মস্ত বট। মেয়েপুরুষরা এখনও কাদাগোলা জলে ঝুপ ঝাঁপ স্নান করছে। তারা শুধু এক-আধবার অবাক হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে দেখল। তারপর নির্বিকারভাবে স্নান করে যেতে লাগল।
ভীষণ বান আসছে! ভীষণ ঢেউ! কে যে চেঁচাচ্ছিল তা বুঝল না রাজু। কিন্তু বুকের ভিতরে একটা ভয় জলস্তম্ভের মতো খাড়া হয়ে উঠছিল। রেডিয়োতে খুব শান্ত কঠিন গলায় একজন ঘোষক বলে ওঠে: সামুদ্রিক যে ঢেউ কলকাতার দিকে আসছে তার উচ্চতা দেড় শ থেকে দুশো ফুট হতে পারে। রাজু একটা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। যতদূর সে জানে, এ বাড়িটা তাদেরই। দোতলার ব্যালকনির নীচেই একটা নর্দমা। সে দেখে নর্দমার জল হঠাৎ উপচে পড়ে রাস্তা ভাসিয়ে বয়ে যাচ্ছে। শুনতে পেল, তাদের কলঘরে এই অসময়ে কল দিয়ে অবিরল জল পড়ছে। বারান্দায় রাখা আধ বালতি জল হঠাৎ ফুলে উঠল, বালতি উপচে বইতে লাগল শানের ওপর। এ কি জলের বিদ্রোহ? এই সব দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ তুলেই সে একই সঙ্গে মুগ্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে গেল। দিগন্তে ও কি মেঘ? আকাশের গায়ে এ প্রান্ত ও প্রান্ত জুড়ে ফ্যাকাশে রঙের ওটা কী তা হলে? ভাবতে হল না। হঠাৎ সে জলের গম্ভীর শব্দ শুনতে পেল। লক্ষ লক্ষ জলপ্রপাতের শব্দ এক করলে যেমনটা শোনায় ঠিক তেমন গভীর গভীর ভয়াল। নীচের রাস্তা থেকে একটা বুড়ো লোক হঠাৎ মুখ তুলে বলল–আগেই বলেছিলাম এ সব জায়গা সমুদ্রের ভিতর থেকে উঠেছে। যাকে বলে চরজমি। অনেকদিন পই পই করে বলে আসছি এখানে শহর-টহর কোরো না। যার জিনিস একদিন সে-ই নেবে। এখন হল তো। হুঃ! বলে বুড়ো লোকটা রাগ করে রাস্তার জল ভেঙে চলতে লাগল। রাজু দেখল, কয়েক পলকের মধ্যেই নালা থেকে গড়ানে জল রাস্তায় হাঁটু অবধি হয়ে গেছে। দিগন্তে সেই জলের পদা ক্রমে আরও উঁচু হয়েছে। চলন্ত পাহাড়ের মতো আসছে! কলঘরে জলের শব্দ চৌদ্দনে উঠে গেল। কলের মুখ সেই তোড়ে ছিটকে মেঝেয় পড়ে লাফাতে লাফাতে চলে এল বারান্দায়। রাজু নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিল সেটা। কলঘরে হোসপাইপের মতো জল ঘর ভাসিয়ে বারান্দায় চলে আসছে। বারান্দার বালতিটায় জলের মান লেগেছে। টলে টলে, নাচতে নাচতে উপচে পড়ছে তো পড়ছেই। বড়ো লোকটা কি ঠিক বলেছে? সমুদ্র তার হারানো জমি উদ্ধার করতে আসছে নাকি? কিংবা পৃথিবীর সব জলই বিদ্রোহ করেছে সৃষ্টির প্রথম যুগের মতো পৃথিবী আবার জলময় করবে বলে? এ কি জলের বিদ্রোহ? এই কি বিপ্লব? ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক রাজু আচমকা চেয়ে দেখে সব পশ্চাৎভূমি মুছে তার হাতের নাগালেই চলে এল জলের প্রকাণ্ড দেয়াল। এই তো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়। শব্দ হচ্ছে লললল। কী প্রচণ্ড গম্ভীর গভীর শব্দ! মাটি কাঁপছে, বাতাস কাঁপছে। সামনে নিচু একটা ঢেউ ডিগবাজি খেয়ে রোলারের মতো গড়িয়ে আসছে। তার চাপে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে মানুষের যত নির্মাণ আর প্রতিরোধ। সেই রোলারের পিছনেই মহামহিম অতিকায় জলের দেয়াল। ঘোলা মেটে এবড়ো-খেবড়ো অন্ধ হৃদয়হীন ও নির্বিকার। রাজু শক্ত হয়ে গিয়েছিল আতঙ্কে। সে ভাবল, এবার বরং আত্মহত্যা করি, এ রকম ভয় সহ্য করা যায় না। ভাবতে ভাবতে সে লাফিয়ে উঠল রেলিঙে। ঝাঁপও দিল, কিন্তু নীচে পড়তে পারল না। তার আগেই জলের ঢেউ লুফে নিল তাকে। কোলে নিয়ে তাকে দোল দিল জল। তারপর আস্তে আস্তে তরঙ্গ থেকে তরঙ্গের মাথায় মাথায় তুলে দিতে থাকল। রাজু ওলট পালট খেতে থাকে। টের পায়, ক্রমে ক্রমে সে জলের মাথায় চড়ে এক অসম্ভব উচ্চতায় চলে যাচ্ছে। এত! এত জল! এই কি মহাপ্লাবন? তীব্র ঘূর্ণির সঙ্গে পাক খেয়ে ছুটে যেতে যেতে হঠাৎ রাজু হাতে পেয়ে গেল একটা কার্নিশ। উঠে পড়ল। দেখে, একটা ছোটমোটো ছাদে জনা কুড়ি কাকভেজা লোক বসে আছে। তাদের মধ্যে একজন বলল খিচুড়ি হচ্ছে, চিন্তা নেই। রাজুর কথাটা ভাল লাগল। মনে হল, পৃথিবীতে কয়েকটা ভাল লোক আছে এখনও। চারদিকে চেয়ে দেখল, জল ছুটছে নক্ষত্রের বেগে। যেন একটা প্রকাণ্ড জলপ্রপাত শুয়ে পড়েছে হঠাৎ। চারদিকে কিছুই প্রায় নেই। বহু বহু দূরে এক-আধটা বাড়ির ছাদ দেখা যায়। তাতে পিঁপড়ের মতো মানুষ। যে লোকটা খিচুড়ির খবর দিয়েছিল সে এবার বলল কিন্তু গুনতিতে মেয়েমানুষ বড় কম পড়ে গেল। জল তোকমবেই একদিন, ড্যাঙা জমিও দেখা দেবে। কিন্তু তখন দুনিয়া আবার মানুষে ভরে দিতে অনেক বছর লেগে যাবে। মেয়েমানুষ ছাড়া সে এলেম কারই বা আছে!
পাশ ফিরতেই চটকা ভেঙে রাজু তাকায়, জানালা দিয়ে সাদা ধপধপে একটা রোদের চৌখুপি এসে পড়েছে মেঝে আর খাট জুড়ে। চোখ চেয়েও সে স্পষ্টই সেই জলের শব্দ পাচ্ছিল, সেই উড়ন্ত টাওয়ার আর কলকাতার পথে পথে রক্ত আর লাশ দেখতে পাচ্ছিল স্পষ্ট। এত সত্য, এত স্পষ্ট, এত নিখুঁত কী করে স্বপ্ন হবে? লেপের ভিতরে সে নিজের গায়ে হাত দিয়ে ভেজা ভাব আছে কিনা দেখে। ধাতস্থ হতে অনেক সময় লাগে তার। কোথায় সে আছে তা খুব আস্তে আস্তে মনে পড়ে।
হাতঘড়িতে প্রায় সাড়ে নটা। ভারী লজ্জা করতে থাকে রাজুর। অন্যের বাড়িতে এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোনো! কে জানে কী মনে করবে এরা!
কুঞ্জর বিছানায় থাকার কথা নয়, নেইও। ঘর ফাঁকা। দোর ভেজানো। রাজু খুব স্মার্টভাবে তোক করে উঠে পড়ে। যতদূর সম্ভব নিজেকে চারদিকের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
বাইরে কটকটে রোদের উঠোন, গাছপালা ঘেরা ঘরোয়া বাগান, কুয়ো, কিছু বিষয়কর্মে রত মানুষ। রাজু চারদিকে চেয়ে সবকিছু চিনে নিতে থাকে। হ্যাঁ, এই তো রোদ, মানুষ, গাছপালা। এই তো সব চেনা।
আজকাল প্রতিদিন রাজুকে এই লড়াইটা করতে হচ্ছে। এক কল্পনার থাবা তাকে কেড়ে নেয় মাঝে মাঝে। আবার ছেড়ে দেয় বাস্তবতার মধ্যে। রাজু ভেবে পায় না, সে কি পাগল?
এই নিয়ে তিনবার বনশ্রীর সঙ্গে দেখা হল রাজুর, বেরিয়েই সকালে প্রথম যে মানুষের মুখ দেখল সেবনশ্রী। কেষ্টর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে টুসির সঙ্গে কথা বলছে। গায়ে শান্তিনিকেতনি খদ্দরের চাদর। এত সুন্দর নকশা কদাচিৎ দেখা যায়, মেয়েটার মাথার খোঁপাটা মস্ত বড়। ঘুম থেকে ওঠার পর এই সকালের দিকটায় মুখখানা আরও একটু বেশি লাবণ্য মাখানো, রাজু হাঁ করে দেখছিল। সে মোটেই মুগ্ধ হয়ে যায়নি, প্রেমে পড়েনি, কিন্তু গুলি, হাইড্রোজেন বোমা আর মহাপ্লাবনের পর এই অসম্ভব শান্ত ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথমেই একটি সুন্দরী মেয়ের মুখ দেখতে বেশ লাগছিল তার। যেন কিছুতেই ঠিক বুঝতে পারছিল না এটা স্বপ্ন, না ওটা।
রাজুদা, উঠেছেন! বলে টুসি হঠাৎ তর তর করে স্রোতের মতো ধেয়ে এল–দাঁড়ান, মাজন এনে দিচ্ছি। বারান্দার কোণে বালতিতে জল রাখা আছে। বলতে বলতে চড়াই পাখির মতো উড়ে গেল যেন ফুড়ুৎ করে।
এ বারান্দা থেকে ও বারান্দা, মাঝখানে একটু উঠোনের ফাঁকা শূন্যতা। সেই শূন্যতা ভরাট করে বনশ্রী একবার তাকায় রাজুর দিকে। চোখের চাউনির মধ্যে কী দেখল রাজু কে জানে! তার ভিতরে কে যেন ফিস ফিস করে বলে ওঠে, এ মেয়েটা প্রেমে পড়েছে। পাপের ছায়া স্পর্শ করেছে ওকে।
বনশ্রী আস্তে আস্তে মুখ ফিরিয়ে নিল। কেমন যেন বিভোর ভাবভঙ্গি ওর। যেন নিজের ভিতরে কিছু প্রত্যক্ষ করছে নিবিড়ভাবে। কূট চোখে চেয়ে দেখে রাজু। বনশ্রী উঠোনে নেমে ধীরে ধীরে গায়ে রোদ মেখে, মাথা নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে চলে গেল।
টুসি একটা সাদা মাজনের শিশি এনে বারান্দায় রেখে আবার উড়ে যেতে যেতে বলে গেল, চা আনছি।
সকালের দৈহিক কাজকর্ম বড় ক্লান্তিকর রাজুর কাছে। মুখ ধোও, কলঘরে যাও, ছোট বাইরে বড় বাইরে সারো।
ধীরে ধীরে প্রবল অনিচ্ছের সঙ্গে সবই সেরে নেয় রাজু। এর মধ্যেই টুসির অনর্গল কথা শুনে নিতে থাকে। কেষ্ট কাল রাত থেকে হাওয়া, বউদির পেটে রাজপুত্রের মতো ছেলে ছিল, নষ্ট হয়ে গেছে। রাজুদা নাকি আজই চলে যাবেন? সে হবে না।
বাইরের দিকে আলাদা একটা ঘরে কুঞ্জর ডিসপেনসারি। আজ রোদ হাওয়ার দিনে একাই বেরিয়ে পড়বে বলে রাজু ঘরের বার হয়ে ডিসপেনসারির দরজায় একটু দাঁড়ায়। ঘরের মধ্যে অনেকগুলো কাঠের বেঞ্চে বিস্তর ছেলেছোকরা গুলতানি করছে। কয়েকজন বিমর্ষ চেহারার রুগীকেও দেখতে পাওয়া যায়। মাঝখানে একটা চেয়ারে কুঞ্জ বসা, সামনের টেবিলের ওপর ঝুঁকে কাগজের পুরিয়ায় গুনে গুনে বড়ি ফেলছে। একবার চোখ তুলে রাজুকে দেখে স্মিত হাসি হেসে বলে উঠেছিস? আয়, বোস এসে।
রাজু বলে–আমি একটু ঘুরে আসছি।
কুঞ্জ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। চলে যেতে গিয়েও রাজু মুখ ফিরিয়ে কুঞ্জর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থাকে। আর চেয়ে থাকতে থাকতেই রাজু হঠাৎ কেমন ঠাণ্ডা আর শক্ত হয়ে গেল। কুঞ্জ যখন তাকাল তখন রাজু কেন একটা মড়ার মুখের মতো ছাপ দেখল ওর মুখে? কেন দেখল, ওর চোখের মণি উধমুখী এবং স্থির? কেন ওর সাদা ঠাণ্ডা ঠোঁট? পাঁশুটে দাঁত? কেন মনে হল, কুঞ্জর গায়ের চামড়ার নীচে জমাট রক্তের আড়ষ্টতা?
কুও কি মরে যাবে? আজ কিংবা কাল?
রাজু ডিসপেনসারির বারান্দা থেকে নেমে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকে। দুর্যোগের পর আজ চারদিকে এক পুকুর রোদ টলটল করছে। টেরিলিনের মতো মসৃণ নীল আকাশ, চারদিকে গাঢ় সবুজ গাছপালার গহীন রাজ্য। রাজু কিছু ভাল করে দেখছিল না। আজ তার কি কোনও অন্তর্দৃষ্টি খুলে গেল কিংবা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়? নাকি এ সব তার আবোল-তাবোল ভাবনা মাত্র?
সামনে আড়াআড়ি পথ পড়ে আছে। রাস্তায় পা দিয়ে রাজু অনেকক্ষণ ঠিক করতে পারল না, কোনদিকে যাবে। ডানদিকের পথটায় ভারী সুন্দর গাছের ছায়া পড়ে আছে। লোকজন নেই। শুধু একটা একলা কুকুর ল্যাং ল্যাং করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। রাজু সেই দিকে হাঁটতে থাকে।
ফাঁকা রাস্তায় রাজু একটা অদ্ভুত গন্ধ পাচ্ছিল। গন্ধটা ভাল না মন্দ তা সে বুঝতে পারছিল না। তবে চারদিক থেকে অজস্র অদ্ভুত সব গন্ধ ভেসে আসছে। তার মধ্যে এই গন্ধটাই তাকে টানছে। বাতাস শুঁকতে শুঁকতে রাজু এগোতে থাকে। অনির্দিষ্টভাবে বেড়াবে বলে বেরিয়ে এসেছে সে, কিন্তু এখন সে স্পষ্ট টের পাচ্ছিল, তার এই গন্ধটা অনুসরণ করে যাওয়া উচিত। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে যেতে হবে তাকে।
মাঝে মাঝে উত্তরের শুকনো ঠাণ্ডা বাতাসে গন্ধটা হারিয়ে যায়। থমকে দাঁড়ায় রাজু। চারদিকে চেয়ে প্রবলভাবে শ্বাস টানে। আকুলি ব্যাকুলি করে ওঠে বুক। গন্ধটা হারিয়ে গেল না তো! না, আবার পায়। রাস্তা ছেড়ে ঘাস জমিতে নেমে গাছপালার মধ্যে গন্ধটা খুঁজতে হয় তাকে। সুড়ি পথ ধরে সে তর তর করে এগোতে থাকে। গত রাত্রির জল কাদায় থকথকে পথটাকে সে গ্রাহ্য করে না। এগোতে হবে। কোথাও পৌঁছোতে হবে।
একটা বাঁশঝাড়ের কোণে ভারী নিস্তব্ধ একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে পথ ঠিক করতে চেষ্টা করছিল রাজু। সে সময়ে হঠাৎ টের পেল, কাল রাতের মতো আজও সে অন্য এক চোখে পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছে। যেন পিছন দিকে তার লেজ নড়ে উঠল হঠাৎ। কান দুটো খাড়া হল। বুঝতে পারল, সে অবিকল কুকুরের চোখে চেয়ে আছে। রোদ, আলো, হাওয়া কোনওটারই আর কোনও অর্থ নেই তার কাছে। তার আছে এক গন্ধের জগৎ। অনেক বিচিত্র শব্দও পায় সে। বহু অদ্ভুত পোকামাকড় দেখে চারদিকে। মাথার মধ্যে কোনও চিন্তা নেই। আছে শুধু এক গন্ধের নিশানা। শুধু জানে, যেতে হবে। কিন্তু যেদিকেই যাক সেদিকেই পথে পথে বহু প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে দেখা হবে বলে টের পায় সে। খুবই সতর্কতা দরকার। বহু বহু দূর পর্যন্ত দেখতে পায় সে। আলো অন্ধকারের কোনও অর্থ নেই তার কাছে। শুধু জানে কখনও সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কখনও আবছা। চারদিকে এখন সেই স্পষ্টতা। এটা খেলার সময়। সে টের পায় তার কোনও আপনজন নেই। জন্ম বা মৃত্যুর কোনও চিন্তা নেই। অভাববোধ নেই। সে জানে, খুঁজলে খাবার পাওয়া যাবে। দেহের প্রয়োজনে আর একটা দেহ জুটে যাবে ঠিক।
রাজু এগোতে থাকে। গন্ধের রেখাটা মাটির সমান্তরাল এক অদৃশ্য সুতোর মতো চলেছে। কোনও অসুবিধে হয় না। মাঝে মাঝে এক-আধবার ঘুরে পিছনটা দেখে নেয় সে, থমকে দাঁড়িয়ে শব্দ শোনে। কে ডাকল ঘেউ! জবাব দিতে ইচ্ছে হল তার। কিন্তু দিল না। এখন এগোতে হবে।
সুড়ি পথটা একটু আগেই আর একটা পথে মিশে গেছে। সেখানে গন্ধের সুতো তাকে টেনে নেয় একটা মস্ত ঘেরা বাগানের দিকে। বাগানের ফটকের ভিতরে ঢুকে পড়ে রাজু। গন্ধটা এখানে খুব গাঢ়, ঘন, পুঞ্জীভূত।
গাছপালার ভিতরে একটা নির্জন কোণে ফাঁকা সবুজ একটা মাঠের মতো জায়গা। সেখানে চুপ করে নিঝুম হয়ে বসে আছে মেয়েটি। তোলা হাঁটুতে মুখ, ডান হাতে আনমনে ঘাস ছিঁড়ছে। চেয়ে আছে, কিন্তু বাইরের কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। দেখছে নিজের ভিতরের নানা দৃশ্য।
গন্ধটা এইখানে মূর্তি ধরে আছে। উন্মুখ রাজু সামনে দাঁড়ায়। তার ছায়া পড়ে মেয়েটির সামনে।
বনশ্রী চমকায় না। ধীরে মুখ তুলে তাকায়। অনেকক্ষণ লাগে তার পৃথিবীতে ফিরে আসতে।
রাজুরও অনেকক্ষণ লাগে কুকুর থেকে মানুষের অনুভূতি ও বোধে জেগে উঠতে!
তারপর দুজনেই দুজনের দিকে ক্ষণকাল অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
বনশ্রী ধীরে উঠে দাঁড়ায়, মৃদু স্বরে বলে–আপনি!
যে গন্ধের রেখা ধরে সে এসেছে তার উৎস যে বনশ্রী তা তো রাজু জানত না। কেন সেই গন্ধ তাকে টেনে এনেছে এখানে তাও জানা নেই। কিন্তু মনের মধ্যে জল বুদবুদের মতো অস্পষ্ট কথা ভেসে উঠছে, মিলিয়ে যাচ্ছে। একে কি কিছু বলার আছে রাজুর?
এক বিচারহীন অনুভূতির জগৎ থেকে বুদ্ধির জগতে জেগে উঠেছে রাজু। শহুরে অভিজ্ঞতা আর বোধ-বুদ্ধি খেলে যাচ্ছে মাথায়। চারদিকে চেয়ে দেখে নিয়ে সামান্য হেসে সে বলে-আদাদের বাগানটা বেশ। বেড়াতে বেরিয়ে বাগানটা দেখে বড় লোভ হল, তাই ঢুকে পড়েছি।
বনশ্রী হেসে বলে–বাগানটা এমন কী সুন্দর! এখন আর গাছটাছ লাগানো হয় না। এমনি পড়ে থাকে। কত জঙ্গল হয়েছে।
রাজু মাথা নেড়ে বলে সাজানো বাগান আমার ভাল লাগে না।
সাজানো বাগানের কথায় কী ভেবে মুখ নিচু করে একটু হাসে বনশ্রী। রাজু স্পষ্ট দেখল, বনশ্রীর মুখ থেকে মিষ্টি হাসিটুকু ঝরে পড়ল ঘাসের সবুজে, ফুলের পরাগের মতো গুড়ো গুঁড়ো ছড়িয়ে গেল বাতাসে, ওর গা থেকে একটা শ্যামল আলো গিয়ে রোদের সঙ্গে মিশে নরম করে দিল আলোর প্রখরতা। ভারী স্নিগ্ধ ও উজ্জ্বল হয়ে উঠল চারপাশ। দীর্ঘকাল ধরে কলকাতার নামি কাগজে ইংরিজি আর বাংলায় বুঝে না বুঝে রাজু আর্ট রিভিউ লিখে আসছে। ছবির চোখ আছে বলেই আবহে ছড়িয়ে যাওয়া হাসিটাকে বুঝতে পারে রাজু। চারদিকে নিবিড় গাছপালার গাঢ় সবুজ, রুপোলি রোদ আর অনেকখানি প্রসারিত ফাঁকা জমির ওপর স্নিগ্ধ শ্যাম মেয়েটির এই ছবি যদি আঁকতে চায় কেউ তবে তাকে খুব বড় দার্শনিক হতে হবে। একটা সবুজ বাগান, কালো মেয়ে বা ফর্সা বোদ এঁকে দিতে পারে যে কোনও হেঁদো পেইন্টার। গভীর অনুভূতি ছাড়া কী করে টের পাওয়া যাবে এখানে এখন বাতাসের গায়ে রোদের কুঁড়ো ছড়িয়ে রয়েছে? ঘাস থেকে এই যে গাঢ় সবুজ আভা উঠে এসে সবুজে ছুপিয়ে দিল বনশ্রীকে, কে দেখবে তা?
কী করে সাধারণ চোখে বোঝা যাবে, মেয়েটির অনেকখানি গলে মিশে আছে চারপাশের সঙ্গে? কে বুঝবে, পিছনে মস্ত ফাঁকা অনেকখানি ওই যে পটভূমি তা কেন্দ্রাভিগ গতিতে ছুটে আসছে মেয়েটিকে লক্ষ্য করে? তারা বলছেসরে যেয়ো না, চলে যেয়ো না! তুমি না থাকলে মূল খিলানের অভাবে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে পটভূমি। সব অন্যরকম হয়ে যাবে।
বনশ্রী মুখ তুলে বলল কাল সারা রাত আপনাদের ঘুম হয়নি, না? টুসি বলছিল।
টুসি কে মনে পড়ল না রাজুর। কাল রাতে সে কি ঘুমোয়নি? হবেও বা। যা মনে এল তাই বলে দিল রাজু রাতটা কেটে গেছে কোনওক্রমে। অন্ধকারেই যত গণ্ডগোল। দিনটা কত ফর্সা আর স্পষ্ট।
বনশ্রী মায়াভরা মুখে বলল–বেড়াতে এসে কষ্ট পেলেন। আসবেন আমাদের বাড়িতে? আসুন না, চা খেয়ে যাবেন!
সকালে যখন মেয়েটিকে দেখেছিল তখনও রাজুর মনের মধ্যে একটা কালো বেড়াল হেঁটে গিয়েছিল। এখনও গেল। মেয়েটির মুখের উজ্জ্বলতায় মিশে আছে একটু পাপ। চালচিত্রের মতো ঘিরে আছে। পেখম মেলেছে ময়ূরের মতো। এই উজ্জ্বলতা স্বাভাবিক নয়। দূর থেকে কে যেন আয়নার আলো ফেলার মতো বনশ্রীর মুখে অনবরত প্রক্ষেপ করে যাচ্ছে নিজেকে। কোথায় যেন জ্বালা ধরেছে বনশ্রীর। গেঁয়ো মেয়ে, খুব বেশি ভাববার মতো মাথা নয়। তবু সাজানো বাগানের কথা শুনে হেসেছিল কেন? ও কি এখন একটা সাজানো বাগান ছেয়ে ফেলতে চায় ভয়ঙ্কর বন্যতা দিয়ে? ভাঙতে চায় কারও সাজানো সংসার?
রাজু বনশ্রীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে–চলুন।
৯-১২. মাথাটা পাক মারল
০৯.
উঠতে গিয়ে মাথাটা পাক মারল একটা। টেবিলটায় ভর দিয়ে সামলে নিল কুঞ্জ। শ্বাস কিছু ভারী লাগছে। বুকে অস্পষ্ট ব্যথা।
সাবিত্রীর বাবা এসেছে। ভিতর বাড়িতে একবার যাওয়া উচিত। কিন্তু বড় দ্বিধা আসছে। দিনের আলো, চেনা মানুষজন, কথাবার্তা কিছুই সহ্য হচ্ছে না তার। একটা অন্ধকার ঘরে একা যদি বসে থাকতে পারত কিংবা যদি চলে যেতে পারত অনেক দূরে!
ডিসপেনসারির দরজায় তালা দিয়ে কুঞ্জ খুব ধীর পায়ে যেন হাটুভর জল ঠেলে ভিতর বাড়িতে আসে। মুখ তুলে কোনও দিকে চায় না।
সাবিত্রীর ঘরে অনেকের ভিড়। শিয়রের কাছে একটা চেয়ারে সাবিত্রীর বাবা বসে আছে। তাকে ঘিরে মেয়েমানুষেরা একসঙ্গে কথা বলছে সবাই। কুঞ্জ ঘরে ঢুকে সবার পিছনে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ কোনওদিকে চাইতে পারে না। কিন্তু যখন তাকাল তখন যেদিকে, যার দিকে তাকাবে না বলে ঠিক করেছিল তার মুখের ওপর সোজা গিয়ে পড়ল চোখ।
অত ভিড়ের মধ্যেও ফাঁক ফোঁকর দিয়ে সাবিত্রীর অপলক চোখ তার দিকেই চেয়ে আছে। ঠোঁট সাদা, মুখ ফ্যাকাশে, বসা চোখের কোলে দুই বাটি অন্ধকার টলটল করছে। তবু সবটুকু প্রাণশক্তি দিয়ে তার দিকেই চেয়ে আছে সাবিত্রী। লজ্জা নেই, ঘৃণা নেই, অপরাধবোধ নেই, ধরা পড়বার ভয়ও নেই। একরত্তি। কুঞ্জর কাছ থেকে ও কোনও আশ্বাস চায়নি, বিপদ থেকে বাঁচাতে বলেনি, কোনও নালিশ নেই ওর। কুঞ্জর কেমন যেন মনে হয়, সাবিত্রী মানুষকে কুঞ্জর সাথে তার সম্পর্কের কথা বলে দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ওকে বোধহয় ঠেকানোও যাবে না। ও কেমন? বেহেড? মেয়েমানুষের কীই বা জানে কুঞ্জ! ওরা যখন বেহেড হয় তখন বুঝি এরকমই হয়। কই, তনু কোনওদিন কারও জন্য হয়নি তো! বরং নাড়ি টিপে, বুকের স্পন্দন শুনে, রক্তচাপ পরীক্ষা করে ডাক্তাররা যেমন রুগীকে যাচাই করে তেমনি আবেগহীন ঠাণ্ডা মাথায় তনু তার প্রেমিকদের যাচাই করেছে। মেয়েমানুষ সম্পর্কে ভুল ধারণাটা কুঞ্জর মনে গেঁথে দিয়েছিল সে-ই। ধারণাটা ভাঙল। যদি বেঁচে থাকে কুঞ্জ তবে আরও কত ধারণা ভাঙবে, আরও কত শিখবে সে।
সাবিত্রীর স্থির তাকিয়ে থাকা দেখে কুঞ্জ চমকায় না। কেবল তার ভিতরটা নিভে যায়। ঠাণ্ডা এক আড়ষ্টতা শরীরে আস্তে আস্তে নেমে আসে। ভালবাসা কত বিপজ্জনক হয়!
কুঞ্জ দাঁড়ায় না। বেরিয়ে আসে। পিছন থেকে এসে তার সঙ্গ ধরে সাবিত্রীর বাবা। একটু গা শিরশির করে ওঠে কুঞ্জর। ভয়-ভয় করে। বেহেড সাবিত্রী কিছু বলেনি তো! মুখে চোখে তেমন উদ্বেগ নেই, একটু চিন্তার ভ্রূ কোঁচকানো রয়েছে কেবল। বারবাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল–নিয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু ওর মার হার্টের ব্যানো, দেখবে কে? যেমন আছে থাক, বরং তুমিই দেখো।
কুঞ্জ মৃদুস্বরে বলে-কদিন ঘুরে এলে পারত।
বলতে গিয়ে সে টের পায়, কখন গলাটা যেন ধরে গেছে।
সাবিত্রীর বাবা মাথা নেড়ে বলে বাড়িতে ওকে দেখবার কেউ তো নেই। এখানে তোমাদের বড় পরিবার, দেখার লোক আছে। আমার সবচেয়ে বড় ভরসা অবশ্য তুমি।
কুঞ্জ মুখ নিচু করে থাকে, বলে–এখন কিছুদিন বাইরে গেলে ওর মনটা ভাল হবে। শরীরটা
সাবিত্রীর বাবা ঝাঁকি দিয়ে বলে–এ অবস্থায়? পাগল হয়েছ? ওর মার চিকিৎসা করাতেই আমি ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছি। ঘন ঘন ই সি জি, ওষুধ; সাবি নিজেও তো যাওয়ার কথায় তেমন গা করল না। বলল, এখানে তাকে দেখার লোক আছে।
কুঞ্জর আর কী বলার থাকতে পারে? চুপ করে রইল। সাবিত্রী যাচ্ছে না। তার মানে, সাবিত্রী রইল।
বার বাড়িতে রওনা হওয়ার মুখে একটু দাঁড়িয়ে সাবিত্রীর বাবা বলে কেষ্টকে আজ সকালেই বাগনান স্টেশনে দেখা গেছে জান বোধ হয়?
কেষ্টর নাম কানে আসতেই বুকটা হঠাৎ ক্ষণেকের জন্য পাথর হয়ে যায়। কথা বলতে গলাটা কেঁপে গেল না তো!
–আমার দুজন ছাত্র দেখেছে। বলছিল। বোধহয় ট্রেন ধরে কলকাতা কি আর কোথাও পালাল। খবরটা সময়মতো পেলে ধরতাম গিয়ে।
পালিয়েছে! কেষ্ট পালিয়েছে। তা হলে কেষ্টর সঙ্গে এখন মুখোমুখি হতে হবে না তাকে! কুঞ্জর মনটায় একটা ভরসার বাতাস দোল দেয়। যদি পালিয়ে থাকে তবে এখনও খুব বেশি লোককে বলে যেতে পারেনি কেষ্ট। খুব বেশি দুর্বল করে দিয়ে যায়নি কুঞ্জর ভিত। পরমুহূর্তেই কুঞ্জর মনের মধ্যে লুকোনো কাঁটা খচ করে বেঁধে। কেষ্ট নয়, কেষ্টর চেয়ে ঢের বেশি বিপজ্জনক সাবিত্রী।
বাগনানের স্কুলমাস্টার বিদায় নিলে কুঞ্জ খুব আস্তে আস্তে একদিকে হাঁটতে থাকে। আর গভীর চিন্তায় ডুবে যায়।
এই যে এইখানে মস্ত পিপুল গাছ, বহুকাল আগ ছেলেবেলায় এই গাছের তলায় একটা সাদা খরগোশ ধরেছিল কুঞ্জ। খরগোশটা তেমন ছুটতে পারছিল না, একটু যেন খুঁড়িয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে থিরিক থিরিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দামাল কুঞ্জ তাড়া করে করে ধরে সোজা বুকের মধ্যে জামার তলায় চালান করে দিল। আঙুলে কুটুস করে কামড়ে দিয়েছিল গোশটা। আজও খুঁজলে ডানহাতের কড়ে আঙুলে স্পষ্ট দাগটা দেখা যাবে হয়তো। কামড় খেয়েও ছাড়েনি। বুকের মধ্যে কী নরম হয়ে লেগে ছিল খরগোশ! নরম হাড়, তুলতুলে শরীর, চিকন সাদা লোম, চুনি পাথরের মতো লাল চোখে বোতামের ফাঁক দিয়ে দেখছিল কুঞ্জকে। চেয়ে কুঞ্জ মুগ্ধ হয়ে গেল। মনে হল–এ আমার। দিন দুই তাদের বাড়িতে ছিল খরগোশটা। রজনীগন্ধা ফুল খেতে ভালবাসত খুব, কাঠের বারে ঘুমোত। তারপর খবর হল ভঞ্জবাড়ির খরগোশ পালিয়েছে। লোকে খুঁজছে। কুঞ্জর মা খবর পাঠিয়ে দিতে বড় বাড়ির চাকর এসে নিয়ে গেল একদিন। খুব কেঁদেছিল কুঞ্জ। গভীর দুঃখের ভিতর দিয়ে বুঝতে শিখেছিল, এ পৃথিবীতে কিছু জিনিস তার, কিছু জিনিস তার নয়।
এই দিকটা ভারী নির্জন। ভাঁট জঙ্গলের আড়াল। পিপুলের ছায়ায় ভেজা মাটিতে বসে সামনে খাঁ খাঁ রোদ্দুরে উদাস মাঠখানার দিকে চেয়ে থাকে কুঞ্জ। কী জানি কেন, আজ সেই খরগোশটার কথা তার বড় মনে পড়ছে। কিছু জিনিস তার, কিছু জিনিস তার নয়–এ কথা ভঞ্জদের খরগোশের কাছে শিখেছিল কুঞ্জ। যখন রাত্রিবেলা সব সম্পর্কের বাঁধন ছিঁড়ে নিশি-পাওয়াসাবিত্রী আসত তার কাছে তখন সে কি জানত না, এ হল কেষ্টর বউ? তার নয়?
একটা নোংরা কাদামাখা রোগা ভেঁয়ো পিঁপড়ে তার গোড়ালি বেয়ে উঠে আসছে। পায়ের লোমের ভিতর দিয়ে বাইছে সুড়সুড় করে। হঠাৎ ঘেন্নায় রি-রি করে ওঠে কুঞ্জর গা। পিঁপড়েটা ঝেড়ে ফেলে সে ওঠে, দাঁড়ায়। সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুমোয়নি কুঞ্জ, তার ওপর রাতে অত ভিজে ঠাণ্ডা বসেছে বুকে। হঠাৎ দাঁড়ালে, হাঁটতে গেলে টলমল করছে মাথা। ডান বুকে একটা ব্যথা থানা গেড়ে বসে আছে কখন থেকে। গায়ে কিছু জ্বরও থাকতে পারে।
কিন্তু শরীরের এই সব অস্বস্তি ভাল করে টেরই পাচ্ছিল না কুঞ্জ। এঁটেল কাদায় পিছল আলের রাস্তায় ভাঙা জমি আর কখনও আগাছা ভেদ করে হাঁটছে সে৷ এই পষ্টাপষ্টি আলোয় যতদূর দেখা যায়, এই তেঁতুলতলা বেলপুকুর শ্যামপুর জুড়ে গোটা চত্বরকে সে শিশু বয়স থেকে জেনে এসেছে নিজের জায়গা বলে। এইখানেই তার জন্ম, বেড়ে ওঠা। প্রতিটি মানুষের সঙ্গে তার অন্তরঙ্গ চেনাচেনি। কিন্তু এখন তার কেবলই মনে হয়, এ সব তার নিজের নয়। এ বড় দূরের দেশ। এখানে বিদেশি মানুষের বাস। এ তো তার নয়।
মাথার মধ্যে বিকারের মতো অসংলগ্ন সব চিন্তা ভিড় করে কথা কইছে। একবার যেন সে তনুকে ডেকে বলল–তোমার জন্যেই তো। কোনওদিন বুঝতে দাওনি যে, তুমি আমার নও। যখন পরের জিনিস হয়ে গেলে তখনও মনে হত, তুমি আমার, অন্যের কাছে গচ্ছিত রয়েছ। ভাবতুম একদিন খুব বড় হব, নাম ডাক ফেলে দেব চারদিকে, সেদিন বুঝবে তুমি কাকে ছেড়ে কার ঘর করছ। বুঝলে তনু, আমাদের শিশুবয়স কখনও কাটে না। কোনটা আমার, কোনটা নয় তা চিনতে এখনও বড় ভুল হয়ে যায়।
নিচু একটা জমিতে জল জমে আছে এখনও। কুঞ্জ জলে নামবার মুখে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় জলে। সামান্য বাতাসে জল নড়ছে, তার ছায়াটা ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। এক দুই পাঁচ সাত টুকরো হয়ে যাচ্ছে কুঞ্জ। এই হচ্ছে মানুষের ঠিক প্রতিবিম্ব। কোনও মানুষই তো একটা মানুষ নয়, এক এক অবস্থায় পড়ে সে হয়ে যায় এক এক মানুষ। আর বেশি দিন নয়, কেষ্ট ফিরবে, বেহেড সাবিত্রী বিকারের ঘোরে প্রলাপের মতো গোপন কথা বিলিয়ে দেবে বাতাসে। তেঁতুলতলা, বেলপুকুর, শ্যামপুর হয়ে বাগনান পর্যন্ত ছড়িয়ে যাবে কথা। লোকে জানবে জননেতা কুঞ্জনাথ আসলে কেমন মানুষ।
জলের মাঠ পার হয়ে কুঞ্জ ঢালু জমি বেয়ে উঠতে থাকে। সামনেই অনেক কটা নারকোল গাছের জড়ামড়ি। তার ভিতরে সাদা উঠোন। দুটো মাটির ঘর।
ভূতগ্রস্তের মতো কুঞ্জ এগোতে থাকে। উঠোনে পা দেওয়ার মুখে একবার ফিরে তাকায়। অনেক দূর অবধি ঢলে পড়েছে গভীর নীল দ্যুতিময় আকাশ। কী বিশাল ছড়ানো সবুজ। কুঞ্জ তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। মনে মনে কেষ্টকে ডেকে বলে–এ সব কিছু নয় রে। সময় কাটতে দে। একশো বছর পর দেখবি আজকের কোনও ঘটনার চিহ্নই নেই পৃথিবীতে। কেউ মনে করে রাখেনি। সময় এসে পলিমাটির আস্তরণ ফেলে যাবে। কুঞ্জ আর সাবিত্রীর কেচ্ছা নিয়ে যেটুকু হইচই উঠবে, পৃথিবীর মস্ত মস্ত ঘটনার তলায় কোথায় চাপা পড়ে যাবে তা। মানুষ কি অত মনে রাখে!
প্রায় মাইল তিনেক এক নাগাড়ে হেঁটে এসে কুঞ্জ উঠোনের মুখে দাঁড়িয়ে রইল। সাদা রোদে কাঁথা মাদুর শুকোচ্ছে, একটা কালো চেহারার বাচ্চা বসে খেলছে আপনমনে। কাক ডাকছে। উত্তরের হাওয়া বইছে গাছপালায়।
কুঞ্জ ডাকল-পটল। এই পটল।
প্রথমে অনেকক্ষণ কেউ সাড়া দিল না। বাচ্চাটা হাঁ করে বোধহীন চোখে চেয়ে রইল। কুঞ্জ আস্তে আস্তে উঠোনের মধ্যে এগিয়ে যায়। দাওয়ায় ওঠে। ডাকে–পটল।
নোংরা কম্বল মুড়ি দিয়ে বিশাল চেহারার পটল আচমকা দরজা জুড়ে দেখা দেয়। গলায় কটার, মাথা কান ঢেকে একটা লাল কাপড়ের টুকরো জড়ানো! নূর চোখ, মুখে হাসি নেই। ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থেকে ঘড়ঘড়ে গলায় বলে-কী বলছ?
কথা আছে। কুঞ্জ চোখে চোখে বলে বাইরে আসবি?
-আমার শরীর ভাল নয়। হাঁফের টান উঠেছে, পড়ে আছি। পটল এক পা ঘরের মধ্যে পিছিয়ে যায়যা বলবার এইখানে বলো।
কুঞ্জ ঠাণ্ডা গলায় বলে আমার সঙ্গে লোক নেই রে। ভয় খাস না।
পটল একটু ঝেকে উঠে বলে-ভয় খাওয়ার কথা উঠছে কেন বলো তো?
কুঞ্জ খুব ক্লান্ত গলায় বলে–অস্তরটা নিয়ে বেরিয়ে আয়। মাঠবাগে চল, যে জায়গায় তোর খুশি। আজ কেউ ঠেকাবে না। মারবি পটল?
পটল তেরিয়া হয়ে বলে–তোমার মাথাটা খারাপ হল নাকি? ঝুটমুট এসে ঝামেলা করছ? বাড়ি যাও তত বাবু, আমার শরীর ভাল নয় বলছি।
দাঁতে দাঁত চেপে কুঞ্জ গিয়ে চৌকাঠে দাঁড়ায়। ঘরের ভিতরে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার, ভ্যাপসা গন্ধ। পটল পিছিয়ে অন্ধকারে সেঁধোয়। কুঞ্জ মৃদুস্বরে বলে–আমি কখনও মিছে বলেছি রে? বিশ্বাস কর, সঙ্গে লোক নেই, লুকোনো ছুরিছোরা নেই। মারলে একটা শব্দও করব না। শুধু দুটো কথা জিজ্ঞেস করব। বাইরে আয়।
পটল বাইরে আসে। দাওয়ায় উবু হয়ে বসে অনেকক্ষণ কাশে, গয়ের তোলে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলে কী হয়েছে বাবু তোমার, বলো তো?
কুঞ্জ পাথরের মতো ঠাণ্ডা গলায় বলে–রেবন্ত আমাকে মারতে চায় কেন বলবি?
পটল ভারী অবাক হয়ে তাকায়। তারপর ময়লা ছাতলা পড়া দাঁত বের করে হেসে বলে-বলছ। কী গো! তোমায় রেবন্তবাবু মারতে চাইবে কেন? মাথাটাই বিগড়েছে। বাড়ি যাও তো বাবু।
তুই টাকার জন্য সব করতে পারিস জানি। তোর কথা ধরি না। কিন্তু রেবন্ত কেন চায় তার ঠিক কারণটা বলবি?
ঝুটমুট আমাকে ধরছ বাবু। আমি মরি নিজের জ্বালায়।
ঝাড়গ্রামের কলাবাগানটা কি কিনে ফেলেছিস পটল?
পটল এ কথায় বিন্দুমাত্র চমকায় না। কলাবাগান কেনার জন্য সে বহুকাল ধরে চেষ্টা করছে। কথাটা সবাই জানে। পটল ঝিম ধরে চোখ বুজে থেকে শুধু ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল, বলল–টাকা কই?
-কেন, রেবন্ত দেবে না?
পটল একটা ঝোড়ো শ্বাস ছেড়ে বলে–পটলকে সবাই দেওয়ার জন্য বসে আছে! রেবন্তবাবু দেবে কেন বলো তো? বলে পটল মিটমিটে ক্রুর চোখে কুঞ্জর দিকে চেয়ে থাকে।
কুঞ্জর মাথায় এখনও সঠিক যুক্তি বুদ্ধি ফিরে আসেনি। কেমন ধোঁয়াটে অসংলগ্ন চিন্তা। বলল হাবুর ঝোপড়ায় কেষ্ট তোদের সঙ্গে রোজ বসে?
পটল একটু চুপ করে থেকে দুঃখের সঙ্গে বলল তার আর আমরা কী করব বলল। বসে।
কিছু বলে না?
কী বলবে?
বলে না যে বড় ঠিক সময়ে কুঞ্জর মুখে পড়ে গেল। কথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে বলল–আমার নিন্দে করে না?
–তুমি আজ ভারী উল্টোপাল্টা কছ বাবু। পটল বিরক্তি প্রকাশ করে মুড়ি দিয়ে বসে। উঠোনের দিকে চেয়ে বলেনিন্দে করার কী আছে, তুমি কি মন্দ লোক?
কুঞ্জ সামান্য হেসে বলে-তবে কি ভাল?তুই কী বলিস?
পটল আবার হাসল। বলল–লোক ভাল, তবে ডাক্তার ভাল নও। বাপের এলেমদারিটা পাওনি। হরিবাবুর দু ফোঁটা ওষুধে ছ মাস খাড়া থাকর্তামা । হরিবাবা গিয়ে অবধি রোগটার চিকিৎসে হল না আর। ভাল করে ভেবে চিন্তে একটা ওষুধ দিয়ে দিকি।
কুঞ্জ চেয়ে ছিল। পটল তার কাছে ওষুধ চাইছে। হঠাৎ খুব ভারী একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গিয়ে কুঞ্জর বুকটা অনেক হালকা লাগল। এতক্ষণ যে জ্বরটা তার মাথায় বিকারের ঘোর তৈরি করেছিল তা হঠাৎ ছেড়ে গেল বুঝি।
পটলের বউ বাসন্তী কতক কাঁথা কাপড় কেচে নিয়ে এল পুকুরঘাট থেকে। উঠোনে ঢুকে কুঞ্জকে দেখে একটু অবাক। জড়সড়ো হয়ে বলেভাল আছেন তো বাবু?
জেলে পাড়ার মেয়ে বাসন্তীকে চেনে কুঞ্জ। এর আগে আরও দুবার বিয়ে বসেছিল। কুঞ্জ যতদূর জানে, ওর দুনম্বর স্বামীকে শিবগঞ্জের হাটে পটলই খুন করেছিল।
বাসন্তীর পিছনে গোটা তিন-চার ছেলে মেয়ে। কুস্থির চোখে চেয়ে দেখে। তিন পক্ষের ছেলেপুলে নিয়েই পটলের ঘর করছে বাসন্তী। গোটা সমাজটা যদি এরকম হত তো আজ বেঁচে যেত কুঞ্জ।
পটল ধীর স্বরে বললবাড়ি যাও বাবু।
কুঞ্জ ওঠে। বাইরে এসে উদাস পায়ে ফের তিন মাইল পথ ভেঙে ফিরতে থাকে।
.
দক্ষিণে শিয়র। শিয়রে খোলা জানালা দিয়ে রোদ হাওয়ার লুটোপুটি। বেলাভর জামগাছে কোকিল ডেকেছে। সেই জানালা দিয়ে বাতাসের শব্দের মতো মৃদুস্বরে ডাক এল-সাবিত্রী।
জেগে ঘুমিয়েছিল সাবিত্রী, অথবা ঘুমিয়ে জেগে। হয়তো ঘুমের ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার। বার বার চুলে পড়ছে ঘুমে, জেগে উঠছে। কখন ঘুম কখন জেগে ওঠা তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে না সে। জেগে যার কথা চিন্তা করছে, ঘুমের মধ্যে সে-ই হয়ে যাচ্ছে স্বপ্ন। কাকে ভাবছে? আপনমনে মৃদু হাসে সাবিত্রী। কুঞ্জ ছাড়া কখনও আর কার কথা তার মনেই আসে না যে। সম্পর্কের কথা তোমরা কেউ বোলো না, বোলো না। বলি, রাধা মেনেছিল? বঙ্কিমের উপন্যাসে শৈবলিনীর বর তাকে জিজ্ঞেস করেছিল প্রতাপ কি তোমার জার? শিউরে উঠে শৈবলিনী বলেছিলনা, আমরা একবৃন্তে দুটি ফুল। সাবিত্রীকে কেউ যদি প্রশ্ন করে, কুঞ্জ কি তোমার প্রেমিক? সাবিত্রী ভেবে পায় না কী বলবে। সে কখনও কুঞ্জকে আপনি থেকে তুমি বলেনি। শরীরের গাঢ়তম ভালবাসার সময়েও নয়। প্রেমিক নয়, তবে? কী দেখে মজলে সাবিত্রী? ও যে রোগাটে, কালো, ফুসফুসে জখম, ঘাড় শক্ত। কী এমন ও! তার সাবিত্রী কী জানে? কুঞ্জ সুন্দর কিনা তা তো কখনও ভেবেও দেখেনি সাবিত্রী। তবে? আছে, তোমরা জানো না, আছে। ও কি যে সে? বাগনানের জনসভায় সেই প্রায়-কিশোরী বয়সে সাবিত্রী দেখেছিল কুঞ্জকে। কালো, রোগা এক মানুষ হাজাকের আলোয় দড়িয়ে মুঠি তুলে বক্তৃতা দিচ্ছে। সেই অদ্ভুত গম্ভীর, বিষাদময়, তীব্র ও গভীর স্বর যেন দিকদিগন্তে আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল। কারও মনে নেই, কুঞ্জরও না, স্কুলের এক পুরস্কার বিতরণী সভায় প্রেসিডেন্ট কুঞ্জর হাত থেকে প্রাইজ নিয়েছিল সাবিত্রী। তখন কুঞ্জ দাড়ি কামায় না। অল্প নরম দাড়িতে আচ্ছন্ন শান্ত মুখ, টানা কোমল দুটি চোখে বৈরাগ্যের চাহনি। কতই বয়স তখন কুঞ্জর। তবু সেই বয়সেই সে এ অঞ্চলের প্রধান নেতা। প্রাইজ নিতে আঙুলে আঙুল ছুঁয়েছিল বুঝি। সাবিত্রীর সেই শিহরন আজও রয়ে গেছে। ও কি আমার প্রেমিক? না তো। প্রেমিক বললে যে ভারী ছোট হয়ে যায় ও। তার চেয়ে ঢের বেশি যে। ও কি আমার প্রভু দেবতা?ও ভারী বড় বড় কথা। ওতে ওকে মানায় না যে। তবে কী সাবিত্রী? তবে ও তোমার কে? সাবিত্রী মৃদু হাসি হেসে বালিশের কানে কানে বলে-ও আমার।
ঘুমিয়ে ছিল কি সাবিত্রী? নাকি জেগে ছিল?ডাক শুনে সমস্ত শরীর কেঁপে ওঠে মৃদুংকারে। কিন্তু চমকায়নি সাবিত্রী, তার সমস্ত শরীর ওর ডাকে এমনিভাবেই সাড়া দেয়। স্বপ্লেখিতের মতো সাবিত্রী মাথাটা তুলে বলেন।
জানালার ওপাশটা দেখা যায় না। ওপাশে রয়েছে ভাট ঘেঁটুর জঙ্গল, খেতের মাচান। জানালা দিয়ে কিছু গাছপালা, আকাশের নীল চোখে পড়ে।
মৃদু বাতাসের মতো স্বর বলে–আমার সব নষ্ট হয়ে গেল। আমরা এ সব কী করলাম?
বিমুগ্ধা সাবিত্রী মৃদু একটু হাসে। বালিশে কনুইয়ের ভর রেখে করতলে গাল পেতে বলে আপনি কেন নষ্ট হবেন? পুরুষদের তো দোষ লাগে না।
-কে বলল দোষ লাগে না? জানাজানি হয়ে যাবে সাবিত্রী। তখন আমার যেটুকু ছিল তাও নষ্ট হয়ে যাবে।
সামান্য একটু ভাবে সাবিত্রী। তারপর বলে–আপনি তো সকলের মতো সাধারণ মানুষ নন। আলোর গায়ে কি ছায়া পড়ে?
–ও সব বই-পড়া কথা। তোমার নিজের বিপদের কথাও কি কখনও ভাব না সাবিত্রী?
সাবিত্রী আপনমনে অদ্ভুত একটু হেসে বলে–পোয়াতির পেটের ছেলে নষ্ট হয়ে গেল, আর কী বিপদ হবে?
বাইরে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। মৃদু স্বরে বলে আমি মরে গেলে সব মিটিয়ে নিয়ে সাবিত্রী। কাউকে আমার কথা বোকার মতো বলতে যেয়ো না। আমি তোমার ভাল চাই।
সাবিত্রী উৎকর্ণ হয়। সচকিত হয়। কষ্টে উঠে বসবার চেষ্টা করতে করতে বলেও কথা কেন বলছেন? মরবেন কেন? মরা কি আপনাকে মানায়? শুনুন, আমি না হয় আর কখনও কাউকে বলব না।
কিন্তু জানালার ওপাশে আর কেউ দাঁড়িয়ে নেই, টের পেল সাবিত্রী! নিমীলিত চোখে সে ধীরে ধীরে বালিশে মাথা রাখল। প্রথমে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল চোখের কোল বেয়ে। তারপর আবার কান্না আমি যে মরার কথাও ভাবতে পারি না। মরলে ভালবাসব কী করে? ভালবাসা-নিদানে, পালিয়ে যাওয়া বিধান বঁধু পেলে কোনখানে?
.
১০.
ভিতরের বারান্দায় কাঠের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে কোলে খাতা রেখে রাজু পেনসিলে দ্রুত হাতে চিরশ্রীর স্কেচ আঁকছে। তাকে ঘিরে ছোট একটা ভিড়।
এ পর্যন্ত গোটা সাতেক স্কেচ এঁকে দিয়েছে রাজু। বনশ্রীর, সবিতাশ্রীর, সত্যব্রতর, শুভশ্রীর, আর কিছু পাড়া-পড়শির। তার আগে ভরাট গলায় শুনিয়েছে রবীন্দ্রসংগীত। ফাঁকে ফাঁকে পলিটিক্স আর আর্ট নিয়ে দেদার কথা বলেছে। হাত দেখেছে সকলের। খেয়েছে অন্তত চার কাপ চা, ওমলেট,চালকুমড়োর পুর ভাজা। অবশেষে সবিতাশ্রী বলেছেন–আজ আর দুপুরে কুঞ্জদের বাড়ি গিয়ে কাজ নেই। যা অঘটন ঘটল ওদের বাড়িতে। খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি, এবেলা তুমি এ বাড়িতে যাবে।
এ কথা শুনে রাজু হঠাৎ মুখ তুলে নশ্রীর দিকে চেয়ে ফেলল। তারপর প্রাণপণে মনে করতে চেষ্টা করল, কোন বইতে সে যেন ঠিক এইভাবে প্রেম হওয়ার কথা পড়েছিল। শরৎচন্দ্র? হবে। কিন্তু একসময়ে এরকম ভাবেই প্রেম হত।
তবে রাজু নেমন্তন্নটা নিয়ে নিল।
সবিতাশ্রী একটু দেরিতে হলেন, কিন্তু সত্যব্রত মুগ্ধ হয়েছেন অনেকক্ষণ আগেই। এ ছোকরা একে বিখ্যাত আর্ট ক্রিটিক তার ওপর কলকাতার ছেলে। শ্যামশ্রীর বিয়ের পর সত্যব্রত মনে মনে স্থির করে রেখেছেন আর কোনও মেয়ের বিয়ে গাঁয়ের ছেলের সঙ্গে দেবেন না। কলকাতায় দেলে। সেই ছেলেই বুঝি আজ হেঁটে এল ঘরে। কী ভাল ছেলে। কী চোখা আর চালাক। কত খবর রাখে। তার ওপর সান্যাল, বারেন্দ্র, স্বঘর। এত যোগাযোগ একসঙ্গে হয় কী করে, যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা না থাকে? সবিতাশ্রী রান্নাঘরে গেলে তাঁর পিছু পিছু সত্যব্রতও গেলেন। নিচু স্বরে কথা বলতে লাগলেন দুজনে।
সেই ফাঁকে রাজু মুখ তুলে বনশ্রীকে বলল–এভাবেও হয়।
কাশী সিঁড়ির ধাপে বসে ছিল। চোখে সম্মোহিত দৃষ্টি। এর আগে সে কোনওদিন প্রেমে পড়েনি। আজ একদিনে দুবার পড়ল কি? সে বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলকী?
রাজু ফের স্কেচ করতে করতে বলে–কোথায় যেন পড়েছিলাম। আগে এইভাবে হত। প্রথম যাতায়াত, তারপর খাওয়া-দাওয়া, তারপর থেমে চিন্তিত মুখে মাথা নেড়ে রাজু ফের বলে– ভাবেও হয়।
স্কেচটা শেষ করে পাতাটা ছিঁড়ে চিরশ্রীর হাতে দিল রাজু। কিশোরী মেয়েটির লাবণ্যে ঢলঢল মুখ আলোয় আলো হয়ে গেল নিজের অবিকল ছবি দেখে।
পরের পাতায় রাজু দুটো নিখুঁত বৃত্ত আঁকল পাশাপাশি। তারপর মৃদু একটু হাসল। বনশ্রী একটু বুকে এল দেখতে। বলল–এটা কী?
বলুন তো কী?
বনশ্রী তার বিশাল চুলের বোঝা সমেত মাথাটা ডাইনে বাঁয়ে নেড়ে বলে জানি না তো কী আছে আপনার মনে।
রাজু দুটো বৃত্তকে ভরে দিল স্পোক দিয়ে, আঁকল মাডগার্ড, হ্যান্ডেল, সিট।
বনশ্রী ভ্রূ তুলে বলে–ওমা। একটা সাইকেল।
একটা সাইকেল। অনেকক্ষণ ধরে সাইকেলটাকে টের পাচ্ছে রাজু। খুব দূরে নয়। একটা সাইকেল গাছপালার আড়াল দিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরছে, ঘুরছে, ঘুরছে। ঝরে পড়া শুকনো পাতার ওপর দিয়ে কখনও জু ছুি খানা-খন্দে ঝাঁকুনি খেতে খেতে, অপথ কুপথ দিয়ে চলেছে অবিরাম। উৎকর্ণ হয়ে সাইকেলের শব্দ শোনে রাজু। মনের পর্দায় আবছা দেখতে পায় সাইকেলের ছায়া। চোরের মতো, ভয় ঘিষা লজ্জায় জড়ানো তার গতি। কিন্তু ঘুরছে। অনেকক্ষণ ধরে এ বাড়ির চৌহদ্দির বাইরে দিয়ে চক্রাকারে ঘুরে চলেছে। একবার, দুবার, তিনবার করে অসংখ্যবার। এক-একবার যেন আবর্তন পথ থেকে সরে যাবে বলে সাইকেলের মুখ ফেরাতে চাইল অন্যদিকে। পারল না। কেন্দ্রাভিগ এক আকর্ষণ টেনে বাল তাকে।
রাজু সাইকেলের ছবিটা শেষ করে বলে একটা সাইকেল হলে বহু দূর ঘুরে আসা যেত। একটা ইলে কত কাজে লাগে।
বনশ্রী খুব হেসে বলে-সাইকেল চাই বললেই তো হয়। আমাদের বাড়িতে দু-দুটো সাইকেল।
রাজু সে কথার জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ভ্রূ কোঁচকানো, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আপন মনে বলে অনেক ধরে ঘুরছে সাইকেলটা।
বনশ্রী সামান্য অবাক হয়ে বলে–কে ঘুরছে? কার সাইকেল?
আছে। বলে উঠোনে নেমে পড়ে রাজু। একটা সাইকেলের ছায়া, মাটিতে চাকা গড়িয়ে যাওয়ার একটা শব্দকে লক্ষ্য করে এগোতে থাকে।
বাড়ির পিছন দিকে মস্ত খড়ের টাল, ধানের গোলা। সবজির খেত। কপিকল লাগানো একটা কুয়ো থেকে কালো একটা মেয়েছেলে জল তুলছিল, অবাক হয়ে দেখল একটু। খেত ডিঙিয়ে রাজু এগোতে অকে। অন্য জমি পার হয়। সামনে কোমর সমান উঁচু ঘাসের মতো এক ধরনের জঙ্গল।
পিছনে তিরতির পায়ে বনশ্রী এগিয়ে আসতে আসতে ডাকে–শুনুন, শুনুন, কোথায় চললেন? ও দিকে পথ নেই যে।
মানুষের ভাষা রাজু বুঝতে পারে না আর। হিলহিলে সরীসৃপের মতো পিছল গতিতে এগিয়ে যায় সে। চোখে বহু দূরবর্তী এক সাইকেলের ছায়া, কানে মৃদু সাইকেলের শব্দ। ঘাসজঙ্গল মুহূর্তে পার হয়ে যায় সে। সামনে শ্যাওলা ধরা ইটের দেয়াল। খুব উঁচু নয়। বুকে ভর রেখে রাজু দেয়ালের ওপর ওঠে। উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শোনে।
বনশ্রী ঘাসজঙ্গল ভেদ করে পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাকছে-শুনুন, ও মশাই, পড়ে যাবেন যে। কী করছেন বলুন তো?
মাতালের মতো টলতে টলতে সাইকেলটা আসছে। বড় ধীর গতি। ডান দিক থেকে মোড় ফিরে একটা কাঁচা নর্দমা পার হল ঝকাং করে। খানিকটা জু জমি বেয়ে উঠে এল কষ্টে। সাইকেলটার গা ধুলোয় ধুলোটে, পিছনের টায়ারে হাওয়া নেই, তেলহীন ক্যাঁচকোঁচ শব্দ উঠছে যন্ত্রপাতির।
একদৃষ্টে সাইকেলটা দেখল রাজু। এত ক্লান্ত সাইকেল সে আগে কখনও দেখেনি। সামনে সাদা ধুলোর পথের ওপর পড়ে আছে চাকার অসংখ্যবার পরিক্রমার ছাপ।
রাজু বিড়বিড় করে বলে–এ ভাবেও হয়।
.
ভেবে দেখলে কাজটা খুব সহজ নয়। গলায় ফাঁস আটকে টেনে ধরলে মরতে শ্যামশ্রীর দু মিনিট লাগবে। তারপর সিলিং-এর আংটায় ঝুলিয়ে তলায় একটা টুল কাত করে ফেলে রাখলে হুবহু আত্মহত্যার মতো দেখাবে। কিন্তু সন্দেহের উর্ধ্বে কিন্তু থাকতে পারবে রেবন্ত? পুলিশ খোঁজ করবে আত্মহত্যা কবুলের চিঠি। আর, আত্মহত্যা করার সময়ে কেউ ঘরের দরজা খুলে রেখে মরে না তো, রেবন্ত বাইরে থেকে কী করে ভিতরে দরজায় খিল দেবে?
একটা হয়, যখন পুকুরে যাবে তখন জঙ্গুলে পথটায় যদি মাথায় ইট মেরে অজ্ঞান করে দেওয়া যায়। বাদবাকি রাস্তাটুকু টেনে নিয়ে জলে ফেলে দিলেই হল। পরিষ্কার অ্যাকসিডেন্টের মামলা। অবশ্য শ্যামা সাঁতার জানে, সুতরাং পুলিশের সন্দেহ থেকেই যাবে। মাথার চোটটাই বা গোপন করবে কীভাবে? আর লোকের চোখে পড়ার ভয়ও থেকে যাচ্ছে না? ঘাট তো বাথরুম নয়।
যদি শ্যামাকে নিয়ে পাহাড়ে বেড়াতে যায় রেব? খুব উঁচু পাহাড় হবে, খাড়াই। একদম ধারে চলে যাবে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে। শেষ সময়টায় একটু চমকে দিতে হবে ওকে। সতর্কতা হারিয়ে ফেলবে তখন। সামান্য একটু ধাক্কা মাত্র। একটু সাবধান হতে হবে রেবকে, শেষ সময়ে না পড়বার মুহূর্তে তাকে আঁকড়ে ধরে। যে ভাবে মরলে কাজটা অনেকখানি বিপদমুক্ত খোঁজ খবর কি আর হবে না? রেবন্ত তো হোটেলে নিজের আসল নাম-ঠিকানা লেখাবে না। খোঁজ করে হয়রান হবে পুলিশ।
খবরের কাগজে পড়েছে রেবন্ত, দীঘার সমুদ্রের ধারে কটেজে কয়েকটাই খুন হয়েছে। মেয়েটার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। পুরুষটা লোগট। দীঘা খুব দূরেও নয়। যাবে? কিন্তু পুলিশ নয় তার খোঁজ নাই পেল, বাড়ির লোক কিছু জানতে চাইবে? শ্যামার বাড়ি থেকে জিজ্ঞেস করবে না-শ্যামাকে কোথায় রেখে এলে রেব? একট ক্ষীণ উপায় আছে অবশ্য। রেবন্ত রটিয়ে দেবে, শ্যামা আর একটা ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। খুব অবিশ্বাস্য হবে না। ওদের রক্তে চরিত্রহীনতার বদ রক্ত কি নেই? কেন, সেই মাসি, যে বিয়ের আগে ছেলে প্রসব করেছিল?
কিন্তু যত দিক ভেবে দেখে রেব, কোনও দিকই নিরাপদ মনে হয় না। সন্দেহ থেকে যাবে, বিপদ থেকে যাবে।
কিছু করতেই হবে যে রেবন্তকে! এতদিন বনশ্রী সম্পর্কে তার কিছু অনিশ্চয়তা ছিল। আজ সকালে অঝোর আলোয় স্বচ্ছ জলের মধ্যে রঙিন মাছের মতো সে দেখেছে বনশ্রীর হৃদয়। এতটুকু সন্দেহ নেই আর। বনশ্রীর এই দুর্বলতাটুকু কতদিন থাকবে তার কোনও ঠিক তো নেই। তাই দেরি করতে পারবে না রেবন্ত।
পটলকে বলবে? ভাবতে ভাবতে ব্রেক কষে বেন্ত। সাইকেল থেমে টলে পড়ে যেতে চায়। পায়ে মাটিতে ঠেকা দিয়ে রেবন্ত একটু ভেবে মাথা নাড়ে। মেয়েছেলে মারতে চাইবে না পটল। নিজের বউকে ও বড় ভালবাসে। তবে ঝাড়গ্রামের কলাবাগানটা কোর বড় ইচ্ছে ওর। রাজি হতেও পারে।
প্যাডেলে আবার ঠলা মারে রেব। গত রাত্রির জল রোদের প্রচও তাতে টেনে গিয়ে এখন ধুলো উড়ছে। থেমে গেছে রেবন্ত। মুগার পাঞ্জাবি, সাদা শাল, কাঁচি ধুতির আর সেই জেল্লা নেই। তার মুখ শুকিয়ে চড়চড় করছে এখন। তবে চলেও যেতে পারেনা সে। আর একবার বনশ্রীর গভীর দৃষ্টি দেখবে না? আর একবার শিউরে দেবে না ওকে? কী করে চলে যাবে সে? কত সহজেই ওদের বাড়িতে এতদিন হুটহাট এসে ঢুকে গেছে রেবন্ত, কিন্তু আজ সকালের দুর্বলতাটুকুর পর আর কিছুতেই ফটক পেরোতে পারছে না। এক টানসুতোয় বাঁধা সে সম্মোহিতের মতো পাক খেয়ে যাচ্ছে কেবল! কখন কোন কাঁটায় লেগে পিছনের চাকার হাওয়া বেরিয়ে গেছে, উঁচুনিচু পথহীন জমি, আগাছা, খানাখন্দ দুরমুশ করে চলেছে অবিরাম সাইকেল। বড় ক্লান্ত হয়েছে শরীর। প্রতিবারই মনে হয়, এবার চলে যাব, আর ফিরব না।
চলে গিয়েছিল রেবন্ত। তেজেনের দোকান অবধি। আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে যাওয়ার মুখে মন ডাক দিল–আর একবার দেখে যাই। এরকম কয়েকবারই চলে গিয়ে ফিরে এসেছে রেবন্ত। ঘুরছে আর ঘুরছে। বাগানের অত ভিতরে গভীরে কেন বাড়ি করলে তোমরা বনা? কেন এত দুর্লভ হলে?
ভ্রু কুঁচকে আনমনে শ্যামার কথা মাঝে মাঝেই ভেবে দেখে সে। না মেরেও হয়। যদি বনশ্রীকে নিয়ে পালিয়ে যাই? থাক না শ্যামা বেঁচে বর্তে!
সব দিক ভেবে দেখছে রেবন্ত। পালানোও বড় মুখের কথা নয়। চাকরির প্রশ্ন, আশ্রয়ের প্রশ্ন, টাকার প্রশ্ন নেই? ভাবতে হবে। অনেক ভাবতে হবে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি।
কাঁচা নর্দমার ওপর প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে সাইকেলের চাকা গেল। নিচু দেয়ালের ওপর দিয়ে বার বার ভিতরবাগে চেয়ে দেখেছে রেবন্ত। শুধু গাছপালা, দূরে একটা কপিকলের মাথা, বাড়ির ছাদ। আর কিছু দেখা যায় না।
উল্টো সম্ভাবনার কথাও ভেবে দেখে সে। যদি শ্যামা না-ই মরে, যদি পালানোও ঘটে না-ই ওঠে, তবে একদিন নির্জনে বনশ্রীকে সম্মোহিত করবে রেবন্ত। হয়তো বাধা দেবে বনশ্রী। সব বাধা কি মানতে হয়? শরীরে শরীর ডুবিয়ে দেবে জোর করে। তখন সুখ। এতদিন এত সহজে এ সব কথা ভাবতে পারেনি সে। কাঁটা হয়ে ছিল কুঞ্জ। ঘাড় শক্ত, রোগা গড়নের তেরিয়া কুঞ্জ। নীতিবাগীশ, অসহ্য রকমের সৎ ও বিপজ্জনক রকমের সমাজ সংস্কারক।
হেসে ওঠে রেবন্ত। বেলুন চুপসে গেল রে কুঞ্জ? শেষে ভারবউ? হাঃ হাঃ! হাসতে হাসতে বুঝি চোখে জল এসে যায় তার। শেষে কেষ্টর বউ? বেড়ে! বাঃ! এই তো চাই। জুজুর মতো তোকে ভয় খেতুম যে রে! অ্যাঁ, ভাবলুম যা-ই করি কুঞ্জ ঠিক টের পাবে। কুঞ্জর হাজারটা ন, হাজাবো চোখ ঠিক এসে পথ আগলে দাঁড়াবে। গুপ্ত কথা টেনে বের করবে পেট থেকে! শেষে ভাদ্দ-বউ কু? আাঁ!
রেবন্ত মাথা নাড়ে। বড় কষ্টে প্রাণপণে প্যাডেল মেরে একটু উঁচু জমিতে ঠেলে তোলে হাওয়াহীন সাইকেল! কপালের ঘাম মুছবে বলে রুমালের জন্য পকেটে হাত দেয়। তারপরই ভীষণ চমকে যায় সে। সামনের পথের ওপর লাফিয়ে নামল, ও কে? রাজু না?
সাইকেলের হ্যান্ডেল টালমাটাল হয়ে যায়। প্রাণণে সামনের চাকা সোজা রাখে রেবন্ত। খুব জোরে প্যাডেল মারতে থাকে। সাইকেল ধীরে ধীরে এগোয়।
রেবন্ত শক্ত করে মাথা নামিয়ে রাখে, যাতে চোখে চোখ না পড়ে যায়। হয়তো রাজুর তাকে মনে নেই, হয়তো চিনতে পারবে না। রেবন্তও চেনা দেবে না।
তবু বুক কাঁপতে থাকে তার। কাল রাতে অন্ধকারেও তাকে দেখেছিল নাকি রাজু? চিনেছিল? এ পথে ও ফাঁদ পেতে বসে ছিল না তো! দাঙ্গাবাজ ছেলে রাজু। হামলা করবে না তো?
কিন্তু রাজু কিছুই করে না। সাইকেল ওর খুব কাছ ঘেঁষে পেরিয়ে যায়। রেবন্ত মাথা তোলে না। কিন্তু খুব জোরে প্রাণপণে চালাতে থাকে তার সাইকেল। কিন্তু হাওয়াহীন চাকা এবড়ো-খেবড়ো জমির ওপর দিয়ে ক্লান্ত শরীরে তেমন টানতে পারে না। ভারী ধীরে চাকা ঘুরছে।
পিছু ফিরে চোর-চোখে চায় রেবন্ত। আবার চমকে যায়। রাজু আসছে একটু লম্বা পায়ে, তার দিকে স্থির চোখ রেখে হেঁটে আসছে রাজু। মন্থর সাইকেলের সঙ্গে সমান গতিবেগ বজায় রেখে।
প্রাণপণ চেষ্টা করে রেবন্ত। সিট থেকে উঠে শরীরের সমস্ত ওজন দিয়ে চেপে ধরে প্যাডেল। নির্মম পায়ের লাথিতে দাঁতে দাঁত চেপে সাইকেলটাকে নির্যাতন করে। কিন্তু নিঃশেষ আয়ুর মতো সাইকেলের গতি ক্রমে আরও কমে আসতে থাকে। রাজু এগিয়ে আসছে। খুব জোরে নয়। প্রায় স্বাভাবিক হাঁটার গতিতে। কিন্তু রেবন্তর সাইকেল যেন আজ এক কোমর জলের মধ্যে নেমেছে। এগোয় না, পালাতে চায় না, ধরে দেবে বলে কেবলই পেছিয়ে পড়ে।
রাজু আসছে। রেবন্ত রাস্তায় উঠে মাঠের দিকে সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে নেয়। পিচ রাস্তা ধরলে অনেকখানি পথ। অত পথ পেরোতে পারবে না। কোনাকুনি মাঠ পেরোলে খালের সাঁকো পেরিয়ে বাজারে উঠলেই সাইকেল সারাইয়ের দোকান।
রেবন্ত পিছনে তাকায়। রাজু স্থির চোখে চেয়ে সোজা চলে আসছে। আসছেই। যদি ধরতে চায় তবু একটু জোরে পা চালালেই রতে পারে। তা করছে না রাজু। সে সমান একটা দূরত্ব বজায় রেখেছে। কিন্তু আসছে।
বহুকাল এমন শরীরে কাঁটা দেয়নি রেবন্তর। মাঠের গড়ানে জমিতে সাইকেল ছেড়ে দিয়ে দ্রুত গড়িয়ে নামতে নামতে তার মনে হল, এই নির্জন মাঠে রাজুর মুখোমুখি হওয়া কি ঠিক হবে?
আবার তাকায় রেবন্ত। একই গতিতে রাজু আসছে। তার পিছু পিছু। মাঠের ঢালু বেয়ে ওই নামল। এখনও একটু দূরে। তবে অনেকটা কমে আসছে দূরত্ব।
মাঠের মধ্যে উল্টোপাল্টা হাওয়ায় সাইকেল টাল খায়। বেঁকে যায় হাতল। এগোয় বটে, কিন্তু বড্ড পিছনের টান। কোত্থেকে এল রাজু?কী করে টের পেল সে ওই পথ দিয়ে সাইকেলে আসবে?
রেবন্ত পিছনে আর একবার চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জোরে চালাতে চেষ্টা করে লাভ নেই। রাজু ঠিক তার পিছনে এসে গেছে। ভন্ন হাতখানা বাড়িয়ে আলতো করে ছুঁয়ে আছে ক্যারিয়ার।
রেবন্ত ব্রেক চেপে ধরে। নামে। বলে রাজুবাবু, কেমন আছেন?
রাজু অবাক হয়ে তার দিকে চায়। অনেকক্ষণ ধরে দেখে তাকে। বলে-আরে! রেবন্তবাবু না?
-চিনতে পারছিলেন না?কাঠহাসি হেসে রেবন্ত বলে।
না তো! আপনাকে লক্ষ করিনি। আমি শুধু সাইকেলটা দেখছিলাম।
– সাইকেল! বলে বুঝতে না পেরে ব্রেন্ত রাজুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এ কোন শহুরে চালাকি বাবা!
মায়া ভরে সাইকেলের সিটে হাত রেখে রাজু বলে সাইকেলের মতো জিনিস হয় না। একটা সাইকেল থাকলে কত দূর চলে যাওয়া যায়!
বড্ড ঘেমে যাচ্ছে রেবন্ত। কিছুতেই বুঝতে পারছে না, বিপদটা কোন দিক দিয়ে আসবে। সাইকেলের প্রসঙ্গটা একদম ভাল লাগছে না তার। রুমালে ঘাড় গলা মোছে রেবন্ত। ভাববার সময় নেয়। রাজু তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে চেয়ে আছে। রেবন্ত অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় চট করে। বলে এই সাইকেলটাই নিয়ে ঘুরে আসতে পারতেন, কিন্তু এটার পিছনের চাকাটায় হাওয়া নেই যে!
ভারী খুশি হয়ে রাজু বলে তা হোক, তা হোক। আফটার অল সাইকেল তো!
কথাগুলো যত বুঝতে না পারে ততই মনে এক আতঙ্ক জেগে ওঠে রেবন্তর। রাজু পাগল নয়। ক্ষুরের মতো ওর বুদ্ধির ধার। ওর মুখোমুখি হলেই একটা ঝাঁজ টের পাওয়া যায়। কেমন গুটিয়ে যেতে, লুকিয়ে পড়তে ইচ্ছে জাগে। ক্লেব তাই বলল–রেখে দিন তা হলে সাইকেলটা। পরে কুঞ্জর বাড়ি থেকে নিয়ে যাব।
রাজু কোনও কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদের কথা বলল না। এক ঝটকায় রেবন্তর হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল সাইকেলটা। ঘুরিয়ে নিয়ে মহানন্দে উঠে বসল সিটে।
রেবন্ত মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়েকয়েক পলক দেখে দৃশ্যটা। কোনও মানে হয় না। রাজু হাওয়াহীন চাকার সাইকেলে মাতালের মতো টলতে টলতে ওই দূরে চলে যাচ্ছে।
রেবন্ত বাজারের দিকে হাঁটতে থাকে। মাথার মধ্যে একটা অস্পষ্ট দুশ্চিন্তা খামচে ধরেছে হঠাৎ। কোনও মানে হয় না।
.
১১.
শ্যাওলারা পিছন দেয়ালের একটা খাঁজে পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর রেখে উঠে বনশ্রী অবাক হয়ে দৃশ্যটা দেখল। ধূলিধূসর সাইকেলে হক্লান্ত রেবন্ত আর তার পিছু পিছু রাজু। একটা আতা গাছ তার উচ্ছল সবুজ পাতা নিয়ে কেঁপে পড়েছে সামনে। তার আড়ালে চলে গেল ওরা।
এত অবাক বনশ্রী যে, ডাকতেও পারল না৷ রেবন্ত এই অবেলায় বাড়ির পিছনের ছাড়া জমিতে কী করছিল? কেনই বা রাজু বলছিল সাইকেলের কথা?
বনশ্রী পাঁচিল থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ফটকের দিকে যেতে থাকে। একটা কিছু হবে, একটা কিছু ঘটবে, তার মন বলছে।
ফটকের বাইরে এসে একই দৃশ্য দেখতে পায়। একটু দূরে খুব ধীরে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে রেবন্ত। পিছনে রাজু। রেবন্ত মাঝে মাঝে ফিরে দেখছে রাজুকে।
এত দূর থেকে ডাকলে রাজু শুনতে পাবে না। নশ্রী তাই দ্রুত পায়ে এগোতে থাকে। তাড়াহুড়োয় চটি পায়ে দিয়ে আসেনি, কাঁকর ফুটছে, ব্যথা লাগছে বড্ড। তবু বনশ্রী হাঁটতে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে বড় মাঠের ধারে শিমুল গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। মাঠের মাঝখানে সাইকেলের দুদিকে দুজন দাঁড়িয়ে। কী কথা হচ্ছে ওদের? মারামারি হবে না তো! ভাবসাব বড় ভাল লাগে না বনশ্রীর। বুকটা কেঁপে ওঠে।
মাঠে নামতে ঢালুতে পা বাড়িয়েছিল শ্রী, হঠাৎ দেখল রাজু সাইকেলটা কেড়ে নিয়েছে রেবন্তর কাছ থেকে। বহু দূরে মাঠের মধ্যে এ বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে রেবন্ত। রাজু টলমল করে বাচ্চা ছেলের মতো চালিয়ে আসছে সাইকেল। মুখে উপচে পড়ছে হাসি। একটু চেয়ে থেকে রেবন্ত মুখ। ফিরিয়ে হাঁটা দিল। ক্রমে মিলিয়ে গেল, অজস্র বোপ জঙ্গলের আড়ালে ব্যাপারটা মাথামুণ্ড কিছুই বুঝল না বনশ্রী।
রেবন্ত চলে গেলে বনশ্রী তরতর করে নেমে আসে খোলা মাঠের মধ্যে। রাজু এখনও অনেকটা দূরে। হাত তুলে বনশ্রী অকেএই যে শুনুন, শুনছেন? এই যে!
রাজু টলমলে সাইকেলে আসতে আসতে খোলা মাঠের মধ্যে হঠাৎ বোঁ করে ঘুরে গিয়ে চক্কর খায়। আবার এগিয়ে আসে। কী ভেবে আবার উল্টোবাগে ঘুরে দূরে চলে যেতে থাকে।
আচ্ছা পাগলা! বনশ্রী ডান হাতখানা তুলে ব্যাকুল হয়ে ডাকে-শুনুন, শুনুন, ও মশাই, শুনছেন? স্নান করবেন না? খিদে পায় না আপনার?
রাজু আবার ঘুরে গেল অন্য দিকে। বনশ্রী আবছা শুনতে পায় সাইকেলে বসে রাজু গান গাইছে ঝিলমিল…ঝিলমিল…ঝিলমিল…ঝিলমিল…।
বড্ড বাঁধন-ছেঁড়া, বড্ড অবাধ্য লোক তো! বনশ্রী দাঁতে দাঁত চাপে। রাগে। কোমরে আঁচল জড়িয়ে লঘু পায়ে ছুটে যায় সে। কোথায় পালাবে লোকটা? পালাতে দেবে কেন বনশ্রী?
ধীর সাইকেলে কিছু দূর চলে গিয়ে আবার মুখ ফিরিয়ে আসতে থাকে রাজু। যেন জীবনে প্রথম সাইকেল শিখছে।
বনশ্রীর মুখ লাল। ঘামে ভেজা, চুলের ঝাপটা এসে পড়েছে কপালে। সাইকেলের পাশাপাশি ছুটতে ছুটতে বলে–এটা কী হচ্ছে শুনি!
রাজু বনশ্রীর মুখের দিকে চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসে। হঠাৎ হ্যান্ডেল ছেড়ে দুহাত তুলে চেঁচায়– ঝিলমিল…ঝিলমিল…ঝিলমিল…।
বনশ্রী হ্যান্ডেল ঠেলে ধরে। সাইকেলটা কাত হয়ে পড়ে। রাজু ফের টেনে তোলে সাইকেল। গম্ভীর মুখে বলে–এটা নিয়ম নয়।
বনশ্রী হাসে–আমি নিয়ম মানি না।
কাতর স্বরে রাজু বলে–সবাই দুয়ো দেবে যে!
অবাক বনশ্রী বলে-কীসের জন্য দুয়ো দেবে?
রাজু মাথা নেড়ে বলে-সাইকেল থামাতে নেই। অবিরাম চলবে। অবিরাম। ঝিলমিল…ঝিলমিল…ঝিলমিল..
বনশ্রী বাধা দিতে ভুলে যায়। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে। রাজু হাওয়াহীন চাকার ধীরগতি সাইকেলে উঠে ভারী কষ্টে প্যাডেল ঠেলতে থাকে।
মাটির নীচে প্যাঁচপ্যাঁচে জল, কাদামাখা ঘাস, পিছল জমি হওয়াহীন চাকাটাকে টেনে ধরে বার বার। গভীর চাকার দাগ বসে মেতে থাকে মাটিতে। সাইকেল ধীরে ধীরে চক্কর দেয়।
বনশ্রীর গা শিউরে ওঠে হঠাৎ। সে দেখে, রাজুর সাইকেল তাকে মাঝখানে রেখে বার বার ঘুরছে, ঘুরছে আর ঘুরছে।
.
নিজের রোগলক্ষণ খুব ভাল চেনে কুঞ্জ। বুকে ধীরে ধীরে জল জমছে। জ্বর বাড়ছে। অপঘাতের জন্য তাকে হয়তো অপেক্ষা করতে হবেনা। শুধু নিজেকে একটু ঠেলে দিতে হবে মৃত্যুর গড়ানে ঢালুর ওপর দিয়ে। যখন গড়িয়ে যাবে তখন কিছু আঁকড়ে ধরার চেষ্টা না করলেই হল! আজ দুপুরে খুব ঠাণ্ডা হিম পুকুরের জলে অনেকক্ষণ ডুব দিয়ে স্নান করবে সে। পেট পুরে খাবে ভাত, ডাল, অম্বল। হইহই করে জ্বর বেড়ে পড়বে বিকেলের দিকে। ভাবতে ভাবতে কুঞ্জ একটু করে হাসে, আর শুকনো ঠোঁট চিরে রক্ত গড়িয়ে নামে।
তেল মেপে পয়সা গুনে নিয়ে তেজেন ফিরে এলে চৌকিতে উবু হয়ে বসে বলে-মাতালের কথা কে ধরছে বলো।কত আগডুম বাগড়ম বলে। বাজারের মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে তোমাকে আর ওর বউকে নিয়ে অত যে খারাপ খারাপ কথা চেঁচিয়ে বলল তা কে বিশ্বাস করছে? তারপর আমার দোকানেই তো সব এল ভিড় করে। হাসাহাসি কাণ্ড।
-কাল কি পরশু রাতে ঘটনাটা আমাকে বলিসনি কেন তেজেন? সারা বাজার জানল, কিন্তু আমার কানে কেউ তুলল না।
তেজেন খুব সান্ত্বনার স্বরে বলে–ও নিয়ে কেউ মাথা ঘামিয়েছে নাকি? রোজই কোনও না কোনও মাতালের মাতলামি শুনছে সবাই। গুরুত্বই দেয়নি কেউ। আর তোমাকে ও সব কথা বলতে লজ্জা না? বলে কেউ? আজ তুমি জিজ্ঞেস করলে বলে বললাম। তুমি ভেবো না, ও সব কেউ মনেও রাখেনি, বিশ্বস তো দুরের কথা।
কুঞ্জ আস্তে করে বলে–মানুষ ঘেঁটে বড় হলাম রে তেজেন। মানুষের নাড়ি আমি চিনি। ভাল কথা ঢাক বাজিয়ে বললেও মনে রাখে না, মন্দ কথা ফিসফিসিয়ে বললেও মনে গেঁথে রাখে। সবাই না হোক, কিছু লোক কি ভাববে না, হতেও পারে কুঞ্জ এরকম।
দূর দূর! পাগল ছাড়া কে ভাববে অমন কথা? তোমাকে নিয়ে ও সব ভাবা যায়, বলো? কুঞ্জনাথ নামটার মানেই দাঁড়িয়ে গেছে ভদ্রলোক।
কুঞ্জ মাথা নাড়ে। সে জানে। চোখ জ্বালা করে জল আসে তার। মরতেই হবে, তাকে মরতেই হবে। মহৎ এক মৃত্যুর বড় সাধ ছিল কুঞ্জর। হাজার জন জয়ধ্বনি দিতে দিতে নিয়ে যাবে তাকে শ্মশানে। দলের ফ্ল্যাগে ঢাকা থাকবে তার মৃতদেহ। চন্দন কাঠের চিতায় পড়বে সে। কত মানুষ চোখের জল ফেলবে! রেডিয়োতে বলবে, খবরের কাগজে বেরোবে, জায়গায় জায়গায় শোকসভা হবে। এখন আর তা আশা করে না কুঞ্জ। না, মৃত্যুটা তেমন মহৎ হবে না তার। তবু মৃত্যু তো হবে। সেটা ভেবে বুক থেকে খাস হয়ে একটা ভার নেমে যায়।
তেজেনের দোকান থেকে বেরিয়ে বাজারের দিকটায় একটু চেয়ে থাকে কুঞ্জ। জমজমাট বাজার। দর্জিঘর, শুকনো নারকোলের ডাঁই নিয়ে বসে আছে ব্যাপারিরা, শীতের সবজির দোকানে দোকানে থলি হাতে লোক। খুব ফটফটে রোদে সব স্পষ্ট পরিষ্কার। তবু এর ভিতরে ভিতরে উইপোকার সুড়ঙ্গের মতো অন্ধকারের নালী ঘা ছড়িয়ে রয়েছে। বাজার ইউনিয়নের সেক্রেটারি কুঞ্জনাথ তাকিয়ে থেকে বুকভাঙা আর একটা শ্বাস ফেলল। সেই খাস বলে উঠল–ওরা জানে।
জীবনে এই প্রথম মুখ নিচু করে হাঁটে কুঞ্জ। তার শক্ত ঘাড় ব্যথিত হয়ে ওঠে। তবু কুঁজো হয়ে নিজের পায়ের কাছে মাটিতে মিশে যেতে যেতে সে হাঁটতে থাকে।
.
মাথায় নীল রঙের ক্র্যাশ হেলমেট, চোখে মস্ত গগলস পরা মামাতো ভাই নিশীথ তার নতুন কেনা স্কুটারে বেচক্কর দিয়ে এসে খবর দিল-মেলা ঘর পড়ে গেছে। অযোধ্যা, অনন্তপুর, নারকেলদা থেকে বহু লোক বউ-বাচ্চা নিয়ে এসে বাজারে থানা গেড়েছে। যাবে না কুঞ্জদা? মাতব্বররা সব তোমার জন্য হাঁ করে বসে আছে যে!
বাইরের ঝড়ে কতটা ভাঙা হয়েছে ভাল করে দেখতে পায় না কুঞ্জ। সে সারাক্ষণ দেখছে তার। ভিতরে মূল সুদ্ধ উপড়ে পড়েছে গাছ, উড়ে গেছে ঘরের চাল। ডিসপেনসারির বারান্দায় বিবশভাবে বসে নিজের ভাজুর দেখছিল কুঞ্জ।
চল। বলে উঠতে গিয়ে কুরমাথাটা আবার টাল্লা খায়। ডান বুকের ভিতরে একটা রবারের বল ভেসে উঠছে, ফের নেমে যাচ্ছে বারবার। রোগলক্ষণ চেনে কুঞ্জ। স্কুটারের পিছনে বসে বাজারের দিকে যেতে যেতে বার বার ঝিমুনি আসছিল তার। মনে হচ্ছিল, একটা ঢালুর মুখে গড়িয়ে যাচ্ছে সে।
মেলা কাদা মাখা, জলে ভেজা বিপর্যস্ত মানুষ, বাজারের পুব ধারে নিজেদের রোদে শুকিয়ে নিচ্ছে। শুকোচ্ছে ন্যাংটো আধ ন্যাংটো বাচ্চারা, কাঁধাকানি, মাদুর, চাটাই, পরনের কাপড়, শুকোচ্ছে মেয়েদের তেলহীন মাথার কটাসে রঙের ফুল। তেজেনের দোকানঘরে পঞ্চায়েতের মাতব্বররা উদ্বিগ্ন মুখে বসে। কুঞ্জকে দেখে তারা খাস ছাড়ে ওই কুঞ্জ এসে গেছে! ক্লাবের ছেলেরা জড়ো হয়েছে বিস্তর, কিন্তু মাতব্বরদের তারা বড় একটা গ্রাহ্য করে না। কী করতে হবে, কার হুকুমে কে চলবে তা নিয়ে কোনও মীমাংসাও হচ্ছিল না।
কুঞ্জ আর নিজের শরীরটাকে টের পেল না অনেকক্ষণ। বাজারে তোলা তুলতে বেরিয়ে পড়ল ছেলেছোকরাদের নিয়ে। একদল গেল নারকেল, আর একদল গেল পুর্বপাড়া, অযোধ্যা, তেঁতুলতলা মুষ্টিভিক্ষা জোগাড় করতে।
বাজারের চালাঘর প্রায় সব কটাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। তারই বাঁশ খুঁটি দিয়ে মস্ত উনুনে শ দেড়েক লোকের আন্দাজ খিচুড়ি চাপতে বেলা হয়ে গেল বেশ।
মহীনের দর্জিঘরের সামনে আতা গাছের ছায়ায় একটা টুল পেতে বসে কুঞ্জ খুব কষ্টে দম নেয়। পোড়া কাঠের ধোঁয়া আর তেল ছাড়া খিচুড়ির ভ্যাপসা গন্ধ আসছে। অনেক বেলা হবে বটে তবু লোকগুলো খেতে পাবে-এই ভেবে কুঞ্জ এক রকম তৃপ্তি পাচ্ছিল। পপুলারিটির কথাটা ক্ষণে ক্ষণে আজও হানা দিচ্ছে বুকের দরজায়। এই তো ভাল আদায় করতে গিয়ে ঘুরে দেখল, সে গিয়ে দাঁড়ালে মানুষ এখনও না করতে পারে না। কারও সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ কখনও করে না সে, কারও আঁতে ঘা দিয়ে বা অহংকারে আঘাত করে কথা বলেন, কাউকেই কনেও খামোখা চটিয়ে দেয় না, তোয়াজে সোহাগে সেবা দিয়ে সে মানুষকে অনেকটাই অর্জন করে রেখেছে। তাই আজও কারও কাছে গিয়ে হাত পাততে তার বাধে না। পাতলে পায়ও সে স্বলে; আর এই করে করেই সে কুঞ্জ, এক এবং অদ্বিতীয় কুঞ্জ। হয়তো এখনও তার টক শেষ হয়ে চায়ন।
ভাবতে ভাবতে দর্জিঘরের দেয়ালে ঠেস দিয়ে একটু চোখ বুজেছিল কুঞ্জ। অমনি যেন কোত্থেকে কেষ্ট এসে সামনে দাঁড়াল। লাল চোখ, উলেগুলো চুল, বিকট মুখ। বলল- তা বটে। তুমি হলে এ তল্লাটের মস্ত মাতব্বর কুঞ্জনাখ। তবে কী জানো বড় মানুষের দিকেই সকলের চোখ একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। নজর রাখে, লোকটা দড়ির ওপর কি মতো হাঁটতে পারছে কিনা। নাকি টাল খাচ্ছে পড়ো-পড়ো হচ্ছে, কিংবা পড়েই গেল নাকি। উঁচুতে উঠলে তাই সবসময়ে পড়ার ভয়। আমাদের মতো মদো মাতাল বদমাশ যত যাই করি লোকে তেমন মাথা ঘামায় না। কিন্তু তুমি হলে কুঞ্জনাথ, তুমি পড়লে লোকে ছাড়বে কেন? বড় মানুষ পড়লে লোকের ভারী আনন্দ হয়। বড় মানুষের গায়ে থুথু দেওয়ার আনন্দ, বড় মানুষের গায়ে লাথি দেওয়ার আনন্দ।
একটা বিলি ব্যবস্থা হয়েছে দেখে নিশ্চিন্তু মনে মাতব্বররা যে যার রওনা দিচ্ছে। নেত্য সাঁপুই এসে কুঞ্জর কাঁধে একটা ঠেলা দিয়ে বলল-পোয়াতি বউটা তোমার জন্যই প্রাণে বেঁচে গেল এ যাত্রা। গোপাল ডাক্তারও বলছিল,কু না থাকলে কেষ্টর বউয়ের হয়ে গিয়েছিল।
মড়ার চোখে কুঞ্জ তাকায়। শুকনো ঠাটে একটু হাসবার চেষ্টা করতে গিয়ে রক্তের নোনতা স্বাদ কে জিভে। সবাই জানে, নেত্য সাইয়ের পোষা ভূত আছে। এ তল্লাটের লোকের যত গুহ্য আর গুপ্ত কথা, যত কেলেঙ্কারি আছে তার সব খবর এনে দেয় নেত্যকে। নেত্য বাতাস শুঁকে টের পান কোথায় মানুষের পচন ধরেছে, নিশুত রাতে কার ঘরে কে যায়, কোথায় ইধার কা মাল উধার হয়।
কুঞ্জ চোখ নামিয়ে নেয়।
নেত্য আফশোসের গলায় বলে বাড়ি যাও। কাল সারাটা রাত জেগে কাটিয়েছ। কুঞ্জ ওঠে। নেত্য সঙ্গ ধরে আসতে আসতে বলে-বউটা রক্ষে পেল সেইটেই এখন মস্ত সানা। তুমি বুক দিয়ে না পড়লে বাঁচত না। গলাটা খাটো করে নেত্য হঠাৎ জিজ্ঞেস করে-কাল সাঁঝবেলায় বড় মাঠে নাকি কারা হামলা করেছিল তোমার ওপর। বলনি তো?
কুঞ্জ উদাস স্বরে বলেও কিছু নয়। চোর-টোর হবে, আমাদের দেশে পালিয়ে যায়।
-কেষ্টর কোনও খোঁজ পেলে?
–খোঁজ করিনি।
নেত্য খুব রাগ দেখিয়ে বলে–খোঁজ নেওয়া উচিতও নয়। পাষণ্ড একেবারে। মুখেরও লাগাম নেই।
শীতটা হঠাৎ ভারী চেপে ধরে কুঞ্জকে। নেত্যর শেষ কথাটায় একটু ইঙ্গিত আছে না? মুখের লাগাম নেই কথাটার মানে কী?
নেত্য সাঁপুইয়ের মুখের দিকে আর তাকাল না কুঞ্জ, বাঁ ধারে ঢালুতে নেমে যেতে যেতে বলল চলি নেত্যদা, শরীরটা ভাল নেই।
নেত্য চেঁচিয়ে বলে–এসো গিয়ে।
খালপোলে উঠতে গিয়ে এতক্ষণ বাদে কুঞ্জ আবার তার শরীরটাকে টের পায়। গা ভরে জ্বর আসছে। বুকের ব্যথা চৌদুনে উঠে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। খাসকষ্ট চেপে ধরছে কঠা। দুপুরের সাদা রোদকে হলুদ দেখাচ্ছে চোখে। পুরো রাস্তাটা হেঁটে পার হওয়া যাবে না। কুঞ্জ সাঁকোর ধারে দুর্বল মাথা চেপে উবু হয়ে বসে পড়ে। সুযোগ পেয়ে কেষ্ট যেন সামনে এসে দাঁড়ায়, দাঁত কেলিয়ে হাসে, বলে মানুষ পচলে তার গন্ধ বেরোবে না? তোমাকে যে পচায় ধরেছে তা আপনি ছড়িয়ে পড়বে। ও কি ঠেকানো যায়? আমার মুখের কথা বলে লোকে হয়তো প্রথমটায় তেমন বিশ্বাস করবে না, ভাববে কুঞ্জনাথ কি কখনও এ রকম হতে পারে? কিন্তু ধীরে ধীরে পচা গন্ধ ছড়াবে ঠিকই।
সাবিত্রীকে বলে এসেছিল কুঞ্জ, মরবে। মৃত্যুর একটা গহীন গড়ানে ঢালু উপত্যকা এখন তার সুমুখেই। যদি এখন নিজেকে একটু ঠেলে দেয় কুঞ্জ, যদি কোনও কিছু আঁকড়ে না ধরে তবে গড়াতে গতাতে ঝম করে পড়ে যাবে নীচে, যেখানে মায়ের মতো কোন পেতে আছে শমন। নিজের রোগলক্ষণ চেনে সে। ডান বুকে জল জমছে। ব্যথা জ্বর। আজ ফিরে গিয়ে পুকুরে হিম ঠাণ্ডা জলে খুব ডুবে ডুবে স্নান করবেকুঞ্জ। ভাত খাবে। রাতে শিয়রের জানালা খোলা রেখে শোবে। নিজেকে একটু ঠেলে দেওয়া মাত্র।
মুখ তুলে সে তনুকে দেখতে পায় মনের মধ্যে। ভারী জলজ্যান্ত দেখতে পায়। বলে, অনু, একদিন তুমিও তো জানতে পারবে কুঞ্জদাকে যা ভাবতে তা সে নয়।
তনু করুণ মায়াভরা চোখে চেয়ে বলে, আমি তো তোমাকে কখনও ভুলিনি কুঞ্জদা। ঘর-সংসারের মধ্যে জড়িয়ে থাকি তবু এক মুহূর্ত আমার মন তোমাকে ছাড়া নয়। তবে তুমি কী করে ভুললে আমাকে? অন্য মেয়ে, পরের বউ তাকে কী করে চাইলে?
কুঞ্জ মাথা নেড়ে বলে, সাবিত্রীকে তো আমার মন চায়নি তনু, শরীর চেয়েছিল। আমার শরীর এঁটো হয়েছে, মন নয়। ঠিক তোমার যেমন।
খালধারে মজন্তালির বাড়ি। কুঞ্জকে দেখে বেরিয়ে এল কী গো, বসে পড়লে যে। শরীর ভাল তো?
কুঞ্জ মাথা নাড়ে–ভালই।
বলে উঠে দাঁড়ায়। মাথা টলমল করছে। দুপুরের রোদে কাঁচা হলুদের রং দেখছে সে। আর চারদিকটা কেমন যেন থিয়েটারের সিনসিনারির মতো অবাস্তব। কুঞ্জ হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, সে যেন কল্পনার রঙে ডোবানো অদ্ভুত এক স্বপ্নের মতো জায়গায় ঢুকে যাচ্ছে। চারদিকটা গভীরভাবে অবাস্তব, অপ্রাকৃত পরীর রাজ্য যেন। ঝিম ঝিম নেশার ঘোরের মতো জ্বর উঠছে তারা ফিরে যাবেনাকি? রিকশা ধরে নিতে পারবে বাজার থেকে কিংবা নিদেন কারও সাইকেলে সওয়ার হতে পারবে।
একটু দাঁড়ায় কুঞ্জ। তারপর ভাবে, নিজেকে সেই গহীন খাদটার দিকে একটু একটু করে ঠেলে দেওয়াই ভাল। সে ফেরে না। বড় মাঠের দিকে এগোতে থাকে।
মন্ত বাঁশবন সামনে। সামনের মেঠোপথে কাঁচা হলুদ রোদে ঝলকানি তুলে কে যেন বাঁশবনের মধ্যে ঢুকে গেল কুঞ্জকে দেখে। চোখের ভুল নয় তো! এক ঝলক দেখা, তবু চেহারাটা কি চেনে না কুঞ্জ? বড় শ্বাসের কষ্ট বুকে। কুঞ্জ একবার বুকটা হাতের চেটোয় চেপে ধরে। বড় করে শ্বাস নেয়। চারদিকে এক অদ্ভুত রঙিন আলোয় অবাস্তব দৃশ্য দেখতে পায় সে। কানে ঝিমঝিম করে ঝিঁঝির ডাক বেজে যাচ্ছে। তবু বাঁশবনের অন্ধকারে ঝরা পাতার ওপর সাবধানী পা ফেলার আওয়াজ ঠিকই শুনতে পায় সে।
মেঠো পথ ছেড়ে কুঞ্জ বাঁশবনের ছায়ায় ঢুকে যায়। সামনে পথ বলে কিছু নেই। রোগা রোগা অজস্র ফ্যাঁকড়া বের করে বাঁশবন পথ আটকায়। কুঞ্জ গুঁড়ি মেরে ঢোকে ভিতরে। ভিতরে চিকড়ি-মিকড়ি আলো-ছায়া। পায়ের নীচে গতকালের বৃষ্টির জল, পচা পাতা। একটা লম্বাটে ছায়া নিচু হয়ে সরে যাচ্ছে পুব দিকে।
রেবন্ত। চাপা স্বরে ডাকে কুঞ্জ।
ছায়াটা দাঁড়ায়।
কাতর স্বরে কুঞ্জ বলে দাঁড়া রেবন্ত। চলে যাস না।
বাঁশবনে বাতাসের শব্দ হয় হু হু করে। পচাটে কটু গন্ধ উঠছে।
রেবন্ত গম্ভীর গলায় বলে–কী বলবি?
ধীরে ধীরে বাঁশ গাছের অজস্র কুটিকাটি ডালপালা সরিয়ে এগোয় কুঞ্জ। গালে মুখে চোখে খোঁচা খায়। তার চাদর ধুতি আটকে যায় বার বার। বলে আমি মরলে কি ভাল হয় রেবন্ত?
রেবন্ত চুপ করে থাকে। তারপর বলে–তার আমি কী বলব?
কুঞ্জ প্রাণপণে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে ছায়াটার দিকে এগোয়। বলে–তুই বড় নষ্ট হয়ে গেছিস রেবন্ত। আমিও। আমরা মরলে কেমন হয়?
রেবন্ত চুপ করে থাকে। প্রায় হাত পনেরো তফাতে রেবন্তকে প্রায় স্পষ্ট দেখতে পায় কুঞ্জ। গায়ে শাল, মুগার পাঞ্জাবি, ধুতি। এলোমেলো চুল। বড় সুন্দর দেখতে।
কুঞ্জ বলে দাঁড়া রেবন্ত। পালাস না।
রেবন্ত খুব অবহেলাভরে বলে-পালাব কেন? তোর ভয়ে?
কুঞ্জ হাসে। বলে–আজ আর আমাকে ভয় পাস না রেবন্ত?
-না।
আগে পেতিস না?
–কোনওদিনই তোকে ভয় পেতাম না।
কুঞ্জ গর্জন করে ওঠে–পেতিস না? সত্যি করে বল পেতিস না? তোর সব জানি রেবন্ত। সত্যি করে বল!
খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল কুঞ্জ। রেবন্ত মুখ ঘুরিয়ে লম্বা পায়ে একটা ফাঁকা জমি পেরিয়ে আর একটা ঝোপের আড়ালে চলে যায়। বলে–ওইসব ভেবেই আনন্দে থাক। তবে জেনে রাখিস তোকে কেউ ভয় পায় না। ভয় পাওয়ার মতো কী আছে তোর?
কিছু নেই। কুঞ্জ জানে, আর কিছু নেই। থমকে দাঁড়ায় সে। সামনেই যেন কেষ্ট একটা লম্বা বাঁশ বেয়ে নেমে এসে তাকে হাতের বুড়ো আঙুল তুলে কাঁচকলা দেখায়। বলে তুমি তো আর দাদা নও। তুমি হচ্ছ আমার বউয়ের নাঙ। লোকে জানবে তুমি আর কিছু পেল্লাদ নও, আমরা পাঁচজন যেমন দোষে-গুণে তুমিও তেমনি।
দাঁড়া রেবন্ত। শোন!
রেবন্ত দাঁড়ায়।
কুঞ্জ বাঁশবনের মাঝখানটায় ফাঁকা জায়গায় চলে এসেছে। ভারী নির্জনতা। খাড়া রোদ পড়েছে মুখে। ঝোপের আড়ালে রেবন্ত ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে। বলে বল।
কুঞ্জ ক্লান্ত স্বরে বলে–অমি যদি মরি তা হলে তো দোষ কাটবে। তখনও কি আমার বদনাম করবি রেবন্ত?
রেবন্ত জবাব দেয় না।
কুঞ্জ আর এগোয় না। উবু হয়ে বসে নিজের টলমলে মাথাটা দু হাতে ধরে থেকে বলে–আমি একটু ভালভাবে মরতে চাই। দিবি মরতে সেভাবে? একটু সম্মান নিয়ে, একটু ভালবাসা নিয়ে। সাবিত্রীর কথা রটাস না রেবন্ত। পটলকে বলিস আমি সন্ধের পর বড় মাঠ আসব। তৈরি থাকে যেন।
রেবন্ত জবাব দেয় না। বাঁশবনের ছায়ায় ছায়ায় তার লম্বা শরীরটা ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে থাকে। ঝরা পাতার ওপর পায়ের শব্দ হয় অস্পষ্ট।
.
১২.
খাওয়ার পর ভিতরের বারান্দায় সাইকেলটা কাত করে ফেলে চাকার ফুটো সারাতে বসেছে রাজু। হাতের কাছে বড় কাঁচি, রবারের টুকরো, সলিউশনের টিউব, বার ঘষে পাতলা করার জন্য ঝামা, হাওয়া ভরার পাম্প। অভ্যেস নেই বলে কাজটা ঠিক মতো হচ্ছেনা। শুভশ্রী করুণাপরবশ হয়ে এসে বলেছিল–দিন না রাজুদা, আমি সারিয়ে দিচ্ছি। রোজ সারাচ্ছি, আমার অভ্যেস আছে।
রাজু রাজি হয়নি–না, তুমি বরং দূরে বসে ডিরেকশন দাও।
বাইরের কোনও ছেলে বহুকাল ভিতরবাড়িতে ঢুকে এমন আপনজনের মতো ব্যবহার করেনি। সবিতাশ্রীর মুখে তাই মৃদু একটু স্মিত ভাব। বললেন আমার জামাই বড় বাবু মানুষ। বিয়ের সময় এই দামি সাইকেল যৌতুক দিয়েছিলুম। বেশি দিনের কথা তো নয়, দ্যাখো কেমন দশা করেছে! একটু কিছু গোলমাল হলেই দোকানে দিয়ে আসে। গান্ধীজি চাইতেন নিজেদের কাজ নিজেরা করতে যেন আমরা লজ্জা না পাই। এই যে তুমি কলকাতার বড় ঘরের ছেলে, কেন বসে বসে সাইকেল সারাচ্ছ–এই ছবিটাই কী সুন্দর!
রাজু মৃদু হাসে শুধু।
সত্যবাবু তাঁর ঘরের দাওয়ায় বসে দৃশ্যটা দেখছেন অনেকক্ষণ ধরে। সবিতাশ্রী তাঁকে জলের জগ দিয়ে আসতে গেলে তিনি আনন্দের স্বরে বললেন–ছোকরার রোখ দেখেছ! এ জীবনে যে আরও কত উন্নতি করবে! কুঞ্জকে আজ বিকেলেই বলব, কার সঙ্গে জোড় মেলাতেই হবে।
মা বাবার মনের ভাব টের পেতে খুব বেশি দেরি হয়নি বনশ্রীর। তাই আর রাজুর সামনে আসেনি লজ্জায়। ঘরে শুয়ে সে একটা ভোলা বইয়ের পাতায় চোখ রেখে আছে। কতবার যে পড়ল পাতাটা। একটা অক্ষরেরও মানে বুঝল না।
রবিবারের দুপুর। শুভশ্রী ক্লাবে গেল ক্রিকেট খেলতে বাবা শুলেন। মা বললেন সেলাই নিয়ে। রাজুর অদূরে শুধু ডগমগ চোখে চেয়ে অনেকক্ষণ বসে ছিল চিরশ্রী। সে মুগ্ধ, সম্মোহিত। অবশেষে সেও গঙ্গাযমুনা খেলতে যায়।
দ্বিধা জড়ানো পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে আসে বনশ্রী। বলে হল?
রাজু মুখ তোলে। একটু হাসে। মাথা নাড়ে।–না।
কী অদ্ভুত মানুষ। ওই সাইকেলটা না হলেই চলছিল না? বাড়িতে দুদুটো সাইকেল ছিল যে?
রাজু মৃদু হেসে বলে–এই সাইকেলটার কাছ থেকে আমার অনেক কিছু জেনে নেওয়ার আছে।
বনশ্রী হেসে ফেলে। বলে মাথায় পোকা।
রাজু গম্ভীর মুখে চায়। ফের মুখ নিচু করে ঝামা দিয়ে রবার ঘষে পাতলা করতে করতে বলে এই সাইকেলটারও কিছু বলবার আছে। শুনতে জানা চাই। সব জিনিসের মধ্যেই ঘটনা প্রবাহ, চেতনা আর চিন্তার কিছু ছাপ থেকে যায়। নইলে গ্রামোফোনের নিষ্প্রাণ রেকর্ড কি গান ধরে রাখতে পারত?
বনশ্রী তর্ক করল না। কেনই বা করবে? সে এ রকম কথা জয়ে শোনেনি। এ সব কথার প্রতিবাদ করারও কিছু নেই তো! শুনতে বেশ লাগে। হতেও তো পারে!
বলল-আমাকে শেখাবেন?
রাজু রবারে সলিউশন লাগিয়ে টিউবের ফুটোয় চেপে ধরে বলে কী?
কী ভাবে সাইকেলের কথা বোঝা যায়।
রাজু ঘাড় কাত করে বলে–শেখাব।
টিউবের ফুটো বন্ধ হয়ে গেল অবশেষে। রাজু সাইকেল দাঁড় করিয়ে হাওয়া ভরে। ক্রমে টনটনে হয়ে ওঠে চাকা। বড় উঠোনটায় সাইকেলটাকে একটা চক্কর দিয়ে এনে বারান্দায় পা ঠেকিয়ে দাঁড় করায় রাজু। বলে–চমৎকার।
জড়ো করা হাঁটুতে খুঁতনি রেখে চেয়ে স্মিত হাসে বনশ্রী। বলে সাইকেল কী বলল?
রাজু হাসে একটু-সাইকেল বলল, রাজু, আজ সকালেও আমি রেবন্তর ছিলুম, এখন তোমার।
বনশ্রী চোখ বড় করে বলে আপনার মানে? জামাইবাবুকে সাইকেল ফেরত দেবেন না নাকি আপনি?
রাজু মৃদুস্বরে বলে কথাটা তো আমার নয়। সাইকেলের। সাইকেল হয়তো ভুল বলছে, কিন্তু বলছে।
–আর কী বলছে?
রাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব কিছু কি সহজে বোঝা যায়? আরও অনেক কিছু বলার আছে এর। ধীরে ধীরে বলবে।
রাজু আবার ধীর গতিতে সাইকেল ছাড়ে। উঠোনে চক্কর দিতে থাকে আস্তে আস্তে।
বনশ্রী জিজ্ঞেস করে-কী বলছে?
রাজু ভ্রূ কুঁচকে বলে–ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি জানতে চাই ভরদুপুরে এই সাইকেলটা কেন আপনাদের বাড়ির চারদিকে চক্কর মারছিল।
নত্রীর মুখে ধীরে একটা ছায়া নামে। সে মৃদুস্বরে বলে–আমি জানি না।
রাজু মৃদু হাসে আপনার কাছে জানতে চায়নি কেউ। সাইকেলই বলবে।
বনশ্রী হঠাৎ তার বিশাল চোখে চেয়ে বলে–ওটা অলক্ষুণে সাইকেল। আপনি ওতে আর চড়বেন না। নামুন শিগগির নেমে আসুন!
আত্মবিস্মৃত বনশ্রী বারান্দার প্রান্তে এগিয়ে আসে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রেখে ঝুঁকে বলে– আর কিছুতেই না। সাইকেলের কথা বুঝবার দরকার নেই আমাদের।
রাজু চেয়ে দেখে, সকালে যে লোকটা আয়নার আলো ফেলার মতো করে নিজেকে দূর থেকে বনশ্রীর মুখে প্রক্ষেপ করছিল বার বার সে লোকটার দম ফুরিয়েছে। রূপমুগ্ধ সেই অন্যমনস্কতা কেটে গেছে বনশ্রীর।
রাজু সাইকেল থেকে নামে। একটু ভেবে বলে–আমারও তাই মনে হয়। সাইকেলের কাছ থেকে আর কিছু না জানলেও আমাদের চলে যাবে।
বেলা ঢলে পড়ছে। গাছগাছালির রূপময় ছায়া উঠোনে নকশা ফেলে এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। দূরে কুয়োয় বালতি ফেলার শব্দ হল ছপ। একটা কোকিল শিউরে উঠল নিজের ডাকে।
.
সাবিত্রী পাশ ফিরল। বড্ড যন্ত্রণা। আবার ও-পাশ ফিরল। বড় যন্ত্রণা!
ডাকল–টুসি! ও টুসি!
কেউ সাড়া দিল না।
বড় অভিমান হল, বড় একা লাগল সাবিত্রীর। শিয়রের জানালায় রোদ মরে এল। মহানিমের গাছে কুলকুল করে পাখি ডাকছে হাজারে-বিজারে।
সাবিত্রী শিয়রের জানালার দিকে তাকায়। ও পাশে কেউ নেই, জানে। তবু খুব কষ্টে উঠে বসে সাবিত্রী। জানালার দিকে চেয়ে বলে–আপনার জন্য বড় কষ্ট হচ্ছে। কোথায় আপনি?
বলে কান পেতে থাকে সাবিত্রী। পায়ের দিকের জানালা দিয়ে হু হু করে উত্তরে বাতাস এসে দক্ষিণের জানালা দিয়ে বয়ে যায়।
সাবিত্রী বলে–এরা কেবল ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখছে আমাকে। আবার হয়তো এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ব। কোথায় আপনি?
কেউ নেই।
সাবিত্রীর চোখ ভরে জল আসে। বড় অভিমান। বলে নিজেকে কক্ষনও খারাপ ভাববেন না। লোকে বলবে লম্পট, চরিত্রহীন! লোকে কত বলে। ওরা তো জানে না! দোহাই, আপনার পায়ে পড়ি, আপনি নিজে কখনও নিজেকে ভাববেন না।
উত্তর থেকে বাতাস দক্ষিণে বয়ে যায়। বড় ঠাণ্ডা হিম বাতাস। একটা জোলো অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠে। আকাশে একটা-দুটো তারা ফোটে।
সাবিত্রী ঘুমিয়ে পড়ার আগে চোখের জল মোছে। শিয়রের জানালার দিকে চেয়ে বলে–মরে গিয়ে আমাদের কারও লাভ নেই। আছে, বলুন? রবার ঘষে ঘষে পেনসিলের দাগ তুলতুম ইস্কুলে। দাগগুলো না হয় বাদবাকি জীবন ধরে তুলে ফেলব দুজনায়। বলছি তিন সত্যি, আর রক্ত-মাংসের মানুষের মধ্যে নামিয়ে দেখব না আপনাকে দূরে থাকবেন, কিন্তু বলুন বেঁচে থাকবেন।
সাবিত্রী উৎকর্ণ হয়ে চেয়ে থাকে জানালার দিকে। কেউ জবাব দেয় না। শুধু পাখিদের শব্দ গাঢ় হয়। বাতাস নদীর স্রোতের মতো শব্দ তুলে গাছগাছালির ভিতর দিয়ে বয়ে যায়।
অবসন্ন মাথাটা বালিশে ফেলে সাবিত্রী। আবার একটা ঘুমের ঢল নেমে আসছে।
সাবিত্রী চোখ বোজে। নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ে। চোখের কোলে জল শুকিয়ে কনো নদীর খাতের চিহ্ন আঁকা হয়।
.
কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বুকে হেঁটে ধীরে ধীরে প্রকাণ্ড মাঠখানা পার হয় কুঞ্জ। কাঁচা হলুদ রঙের রোদ রক্তের মতো লাল হয়েছিল, তারপর গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেছে চরাচর। আকাশে হাজারো লণ্ঠন জ্বলে ওঠে। কুঞ্জ দেখে, এক মস্ত সমুদ্রের ধারে বিশাল জাহাজঘাটায় আলো জ্বলছে। সে ওইখানে যাবে।
জ্বরের ঘোর গাঢ় মদের নেশার মতো শরীর ভরে দিল। বার বার টলে পড়ে যায় কুঞ্জ। দাঁড়াতে গেলেই মাথা টলে যায়। তাই হামাগুড়ি দিয়ে এগোয়। আবার ওঠে। ভেজা মাটির ওপর কুয়াশার মেঘ ভেসে.আছে। ক্রমে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে দিগবিদিক। পরীর জগৎ মুছে যায়। চারদিকে কালো সেটে আঁকা এক ভুতুড়ে জায়গার ছবি।
রেবন্তকে কথা দিয়েছিল, সন্ধেবেলায় এই মাঠে থাকবে। কথা রাখল কুঞ্জ। ঠিক যেইখানে রবির টর্চ পড়েছিল কাল সেইখানে এসে দাঁড়াল সে। বলল–পটল, বড় দেরি হল রে! গায়ে জ্বর নিয়ে বাঁশ বনের মধ্যে পড়ে রইলুম যে অনেকক্ষণ। বেলা ঠাহর পাইনি। যখন চাইলুম তখন বেলা ফুরিয়েছে। তবু দ্যাখ, কথা রেখেছি। এই তো আমি। দ্যাখ, এই তো আমি। কাজ সেরে ফ্যাল এই বেলা। আর দেরি নয়। কোথায় কোন বাধা হয়, বিঘ্ন আসে!
শুধু বাতাস বইল। চারদিকে লম্বা লম্বা ভূতের ছায়া। আকাশে লণ্ঠন নাড়ে কালপুরুষ। সমুদ্রে অনেক জাহাজ ভেসে যাচ্ছে।
–পটল!
কেউ সাড়া দেয় না।
অনেক অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে কুঞ্জ। বড় হতাশ হয়।
–আর কতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখবি বাপ! একটা কোপের তো মামলা। এ তো নাটক নভেলের ভ্যানতারা নয় রে! কত জখম আমার শরীরে। টিকটিক করে বেঁচে আছি। তোর হাতও পরিষ্কার। এক কোপে কাজ হয়ে যাবে। আয় রে, তাড়াতাড়ি আয়।
কেউ আসে না। আকাশে লণ্ঠন নড়ে। সমুদ্রে জাহাজ ভেসে পড়ছে একের পর এক। কয়েকটা বাদুড় উড়ে যায় পাগলাটে ডানায়।
বিশাল ভারী মালগাড়ি টানতে যেমন হাফসে যায় পুরনো বুড়ো ইঞ্জিন, তেমনি বড় কষ্টে নিজেকে টেনে এগোয় কুঞ্জ। কোথাও পৌঁছোতে চায় না সে। শুধু একটা গড়ানে মস্ত খাদের দিকে নিয়ে যাবে সে নিজেকে। একটু ঠেলে দেবে শুধু। নীচে গভীর সবুজ উপত্যকা কোল পেতে আছে মায়ের মতো। আজ রাতে শিয়রের জানালা খোলা রেখে শোবে সে, কাল ভোরে পুকুরের হিম জলে ডুবে ডুবে স্নান করবে অনেকক্ষণ। নিজের রোগলক্ষণসেচেন।
হিমে ভিজে যাচ্ছে চাদর। মাথায় ঠাণ্ডা বসে যাচ্ছে। বুকের ডানধারে রবারের বলটা মস্ত হয়ে ফুলে উঠেছে এখন। বাঘের মতো থাবা দিচ্ছে ব্যথা।
কুঞ্জ বসে। হামাগুড়ি দেয়। উঠেআবার কয়েক পা করে হাঁটে। কত ভূতের ছায়া চারদিকে! আকাশে লাল নীল লণ্ঠন দোলে। কত জাহাজ আলো জ্বেলে চলেছে গাঢ় অন্ধকার সমুদ্রে।
শিরীষ গাছের বিশাল ঘন ছায়া পার হতে গিয়ে একটু দাঁড়ায় কুঞ্জ। খুব ভাল ঠাহর পায় না জায়গাটা। এই কি তেঁতুলতলা? ওই কি পিচ রাস্তা? ওইসব আলো কি ভঞ্জদের বাড়ির?
চারদিকে চায় কুঞ্জ। কত জোনাকি পোকা শেয়ালের চোখের মতো দেখছে তাকে! এইখানে ছেলেবেলায় একটা খরগোশ ধরেছিল না সে? সেই খরগোশ শিখিয়েছিল কিছু জিনিস তার, কিছু তার নয়। বড় ভুল শিক্ষা। আসলে আজ কুঞ্জ শিখেছে, এখানে এই প্রবাসে কিছু তার নয়। পরের ধনে জমিদারি। পরের ঘরে বাস। এই তো কুঞ্জর ঝাটি পাটি গুটিয়ে গেল। যে শরীরটা দেখে কুঞ্জ বলে চিনত লোকে তাও সাপের খোলসের মতো ছেড়ে ফেলার সময় হল। সামনেই গড়ানে ঢাল। মৃত্যুর উপত্যকা কোল পেতে আছে।
গাছের গায়ে ভর রেখে দম নেয় কুঞ্জ। শ্বাসকষ্ট গলায় ফাঁসের মতো এটে বসছে ক্রমে।
গাছের ভর ছেড়ে কুঞ্জ টলতে টলতে এগোয়।
ডিসপেনসারির সামনে উপুড় হয়ে থেমে আছে একটা গোরুর গাড়ি। অন্ধকারে দুটো গোরু বড় শ্বাস ফেলে ঘাস খাচ্ছে। একটা ধোঁয়ায় কালি লণ্ঠন জ্বলছে ডিসপেনসারির বারান্দায়। সবই আবছা দেখে কুঞ্জ। কিন্তু দেখতে পায় একটা লোক কম্বল মুড়ি দিয়ে শোয়া। একটা বউ তার মাথার কাছে বসে আছে।
কুঞ্জর কানে ঝিঁঝি ডেকে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব শব্দই বড় ক্ষীণ মনে হয়। তবু সে শোয়ানো লোকটার ঘড়ঘড়ে শ্বাস আর ভয়ঙ্কর যন্ত্রণাদায়ক ঘঙঘঙ কাশির শব্দ শুনতে পায়।
আলোর চৌহদ্দিতে পা দেওয়ার আগেই বউটি উঠে দু পা এগিয়ে এসে আর্তস্বরে ডাকল, বাবু!
কুঞ্জর ঘোলাটে মাথার মধ্যে চিৎকারটা ঢোকে। ঢুকে কিছু কুয়াশা কাটিয়ে দেয় যেন। লোকের সামনে কোনওদিন দুর্বলতা প্রকাশ করে না সে। সে যে কুঞ্জনাথ!
প্রাণপণে নিজেকে খাড়া রেখে গলার ভাঙা স্বর যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে–কে?
-আমি বাসন্তী।
–কে বাসন্তী?
পটলের বউ। পটল যে যায়! কখন থেকে এসে বসে আছি। গোপাল ডাক্তার জবাব দিয়েছে। বলেছে হাসপাতালে যেতে। সেখেনে নিচ্ছে না।
কুঞ্জ চেয়ে থাকে। কিছুই বুঝতে পারে না অনেকক্ষণ।
বাসন্তী বলেও বলছে, হরিবাবুর ভিটেয় নিয়ে চলো। যদি তাঁর আত্মা ভর করে তবে বাঁচব।
টলমল করছিল হাত, পা, মাথা। তবু নিজেকে সোজা রাখতে পারল কুঞ্জ। ফ্যাঁসফাঁসে গলায় বললকী চাস?
ওষুধ দাও। আর কী চাইব? পটল বলছে তোমার ওপর হরিবাবা মাঝে মাঝে ভর করে।
কুঞ্জ ডিসপেনসারির বারান্দায় উঠে আসে।
ধোঁয়াটে লণ্ঠনের একটুখানি আলোয় ভাল দেখা যায় না। তবু অন্ধকার থেকে যখন আলোর দিকে মুখ ফেরাল পটল তখন সেই মুখ দেখে বুকটা মোচড় দেয় কুঞ্জর। দুখানা লাল টুকটুকে চোখ, এত লাল যে মনে হয় কেউ গেলে দিয়েছে চোখের মণি। মুখ ফুলে ঢোল হয়ে আছে। মুখের নাল আর শ্লেষ্ময় মাখামাখি ঠোঁট। কম্বলে কটারে জড়ানো বুক থেকে ঘড় ঘড় শব্দ। হাঁ করে প্রাণপণে বাতাস টানার চেষ্টা করছে দমফোট বুকে। কথা ফুটছে না। তবু অতি কষ্টে বলল-হরিবাবার ছেলে তুমি…সে মড়া বাঁচাত..পারবে না?..ভর হোক…তোমার ওপর ভর হোক…
কুঞ্জ ডিসপেনসারির দরজা খোলে। বাতি জ্বালে। বাসন্তীকে বলে–ভিতরে এনে শুইয়ে দে বেঞ্চিতে।
গোরুর গাড়ির গারোয়ান আর বাসন্তী ধরে ধরে আনে পটলকে। কুঞ্জ আর তাকায় না পটলের দিকে। তাকাতে নেই। মানুষের মন তো! হিংসে আসে, বিদ্বেষ আসে, সংকীর্ণতা আসে। বেদ হয়ে পড়ে, গণ্ডি হয়ে পড়ে। কোনওদিন কাউকে শত্রু ভাবে না কুঞ্জ। আজই বা ভাবতে গিয়ে নিজেকে ছোট করবে লে? সে যদি মরে তো মাথা উঁচু করে মরবে একদিন।
আলমারি খুলে হরেক ওষুধের নাম শুনন করতে থাকে সে। প্রতিটি লক্ষণ মিলিয়ে আস্তে আস্তে তার বাবা এইভাবে গুন গুন করনে। ধীরে ধীরে ওষুধের সংখ্যা কমে আসত। তারপর ঠিক একটা অমোঘ শিশির গায়ে হাত পড়ত তাঁর।
চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছিল না কুঞ্জ। কিন্তু তাতে কোনও অসুবিধে নেই। কোন তাকে কোন শিশির পর কোন শিশি আছে তা তার মুখস্ত। একটু দোনোমোনো করতে করতে একটা শিশির গায়ে হাত রাখে সে।
পটল ওষুধটা খাওয়ার আগে মাথায় ঠেকাল।
ঘণ্টাখানেকের ওপর বসে রইল পটল। তারপর আর একটা ডোজ দিল কুঞ্জ। শিশিটা বাসন্তীর হাতে দিয়ে বলে নিয়ে যা। মাঝরাতে একবার খাওয়াস।
যাওয়ার সময় পটল কারও ওপর ভর দিল না। নিজে হেঁটে গেল। দরজার কাছ থেকে ফিরে চাইল একবার। অস্পষ্ট স্বরে বলল–হরিবাবা আজ নিজে এসেছিলেন। স্পষ্ট টের পেলুম।
.
চেয়ারে নেতিয়ে ঝুম হয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকে কুঞ্জ। বড় শীত। খোলা দরজা দিয়ে হুড় হুড় করে ঠাণ্ডার ধারালো হাওয়া আসে। কুঞ্জ চোখ বুজেও টের পায়, সামনেই সেই গড়ানে উপত্যকা, কী সবুজ! কী গভীর!
বহুকাল বাদে বাবা যেন ডিসপেনসারিতে এলেন আবার। কুঞ্জর পিছনে অস্ফুট গুন গুন স্বরে ওষুধের নাম বলতে বলতে আলমারি হাতড়াচ্ছেন। বাবা? নাকি রাজু? একবার মুখ ফিরিয়ে কুঞ্জকে দেখলেন, খুব হেলাফেলার গলায় জিজ্ঞেস করলেন-তুই মরতে চাস কেন কুঞ্জ?
-না মরে কী হবে?
–জীবনটা কি তোর?
তবে কার?
যদি জানতিস কত করে একটা মানুষ জন্মায়, কত কষ্ট, কত খেসারত, কত রহস্য থেকে যায় পিছনে! তুই কি তোর জীবনের মালিক? মানুষের একটা স্রোত, একটা ধারায় তুই একজন। কত কষ্ট হয় গাছের একটা ফল ধরাতে জানিস?
–সব জানি, সব জানি। আর কিছু জানার নেই।
তুই যে বড় ভালবাসতে জানতিস কুঞ্জ!
কুঞ্জ ধীরে ধীরে মুখ ফেরাতে চেষ্টা করে। ডানদিকে ফেরাতে পারে না, শক্ত ঘাড়। তাই অল্প শরীর ঘুরিয়ে তাকায়। ঘোলা চোখে কিছুই স্পষ্ট দেখতে পায় না সে। এখনও চারদিকে অবাস্তব, অপ্রাকৃত, ভূতুড়ে জগৎ। কী প্রকাণ্ড জ দেখায় ওষুধের আলমারিগুলোকে। আলোটাকে মনে হয় গাঢ় হলুদগোলা জলের মতো অস্বচ্ছ। খুব অস্পষ্ট এক ছায়ার মতো মানুষকে দেখতে পায় সে। ছায়াও নয়, যেন কেউ ঘরের শূন্যতায় নিজের একটা ছাপ ফেলে রেখে চলে গেছে। ও কি বাবা? নাকি রাজু?
কুঞ্জ বলে–তুই কি রাজু। রাজু, ভোর রাতে ঘুমের মধ্যে কত ভয়ের শব্দ, যন্ত্রণার শব্দ করেছিস! কত কথা বলেছিস! তোর কীসের দুব তা তো জানি না রাজু, তবে মনে হয়, কলকাতা শহর তোকে অল্প অল্প করে বিস্কুটের মতো ভেঙে ভেঙে খেয়ে নিচ্ছে। টের পাস না? তোকে যেমন খাচ্ছে শহর, আমাকেও তেমনি
ছায়ামূর্তি গাঢ় শ্বাস ফেলে বলে সব শহরই মানুষ খায়। সাপের মতো বাঁকানো দাঁত, একবার ধরলে আর ছাড়তে পারে না। যদি জোর করে ছিনিয়ে আনিস তবে সাপের মুখের ব্যাঙ যেমন বাঁচে না শহর থেকে ছিনিয়ে আনা মানুষও তেমনি বাঁচে না। কলকাতা একদিন আমাকে খাবে। কিন্তু তুই যে বড় ভালবাসতে জানতিস কুঞ্জ!
–আমাকেও ভালবাসাই খেয়ে নিচ্ছে। তুমি কি বাবা? নাকি তুই রাজু? শোনো বাবা, আমি যে কুঞ্জনাথ! কুঞ্জনাথের কি কলঙ্ক মানায়!
রাজু নয়, যেন বাবা অলক্ষ্যে জবাব দেয় কিন্তু তুই যে একশো বছরের কথা বলেছিলি। মনে নেই? একশো বছর পরের কথা ভেবে দ্যাখ, কেউ মনে রাখেনি এসব। কে কুঞ্জনাথ আর কীই বা তার কলঙ্ক।
কে লোকটা তা বুঝতে পারে না কুঞ্জ। হয়তো বাবা, হয়তো রাজু। তার কাছে এখন জীবিত বা মৃত দুই জগৎই সমান। বাবা না রাজু তা বুঝতে পারল না কুঞ্জ। অস্পষ্ট লোকটার দিকে চেয়ে বলল বড় কষ্ট যে।
–তুই যে বড় ভালবাসতে জানতিস কুঞ্জ। কত ভালবাসা তোর চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে।
কুঞ্জ মাথা নেড়ে বলে–আমি বাঁচবনা, বড় জ্বর, বুকে ব্যথা, ডান ফুসফুসে জল জমছে হু হু করে।
বাবা বলে–দুর বোকা, ওঠ না। ডান দিকের আলমারির দুনম্বর তাকে খুঁজে দ্যাখ।
গড়ানে ঢালের মুখে কুঞ্জ থামে। নিজেকে ঠেলে দেওয়ার আগে একবার দেখে নেয় চারদিক। গহীন খাদ। সবুজ উপত্যকা কোল পেতে আছে। টলতে টলতে সে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ায়।
কুঞ্জ ডানদিকের আলমারির পাল্লা খুলে হাত বাড়ায়। ওষুধের নাম গুন গুন করতে থাকে আপনমনে।