ননীবালা বলেন—সে যেমনই হোক, তুইয়েবুইয়ে ভুলিয়ে রাখিস ওকে। কোথাও যেতে দিস না। ওর জন্যই আমার চিন্তা। বলতে কী, ওর জন্যই আমার এখানে আসা। |
—কেন মা?
—ও বড্ড বকত আমাকে। বুঝতাম, বাবাকে আলাদা রেখে মা ছেলের সংসারে থাকে—এটা ও ভাল চোখে দেখে না। তাই বুঝি আমাকে ইদানীং সহ্য করতে পারত না। তাই অনেক ভেবেচিন্তে সব দিক বজায় রাখতে চলে এসেছি। এখন যদি আবার দূরান্তে চলে যায় তবে বড় দুশ্চিন্তা নিয়ে মরব।
ঘুরে ঘুরে সব দেখে সোমেন। এর আগে এমনি এক শীতকালে সে এসেছিল এখানে। এর মধ্যে তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। শুধু সেই বিশাল মানুষ বহেরু একটু যা বুড়িয়ে গেছে। গন্ধ বিশ্বেসেরও বাঁচার শেষ নেই। এখনও টিকে আছে। মচ্ছবের গন্ধে-গন্ধে এসে বসে আছে গাবগাছের তলায়। দিগম্বরকেও ভিড়ের মধ্যে এক-আধবার দেখা গেছে। খোলটা সঙ্গেই আছে, যখন নির্জনতা পাবে বাজাতে বসবে। বিন্দুর সঙ্গেও চোখাচোখি হয়েছে। কয়েকবার। সেবার যখন এসেছিল তখন বিন্দুর শরীরের অসহ্য উত্তাপ টের পেয়ে গেছে। এবার তাই লজ্জা-মেশানো ভয় করল তাকে। সে বড় ভীতু। হেমন্ত বা অন্য বন্ধুরা কেউ হলে, এমনকী শ্যামল যদি আসত তা হলেও একটা কিছু প্র্যাকটিক্যাল প্রেম করতই। সে পারে না। ব্রজগোপালের ছেলে তো, তাই কতগুলো ভয়-ভীতি ছেলেবেলা থেকেই বাসা বেঁধে আছে ভিতরে।
চারদিকেই গুরুজন বলে সে উত্তরধারে কাঁটাঝোপের পাশে একটা ঢিবির ওপর এসে নির্জনে সিগারেট ধরিয়ে বসল। এখান থেকে অনেকটা দেখা যায়। বহেরুর বাড়ি ক্ষেত, আর একটু দূরে তাদের নতুন বাড়িটা। যজ্ঞধূমের গন্ধ আসছে, থিক থিক করছে লোকজন। হাল্লা-চিৎকার শোনা যাচ্ছে। শীতের বাতাস এই দুপুরেও হাড় কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে, পুকুরের জলে বিশাল জলহস্তীর মতো রণেন সাঁতার কাটছে। না, জলহস্তী বলাক। হল না। রণেন আর তেমন মোটাসোটা নেই। অনেক রোগা হয়ে গেছে। প্রায়ই বলে—আমি মা বাবার কাছে চলে যাব। এছাড়া আর কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। হ্যাঁ, আর একটা আছে।। এখনও রাতেরবেলা চুপি চুপি উঠে কলের গান শোনে। নইলে, সবই ঠিক আছে।।
সোমেন অনেকক্ষণ বসে থাকে, টিবিটার ওপর। মনে কত রকমের চিন্তা শরতের মেঘের। মতো ছায়া ফেলে যায়। এত চিন্তা সোমেনের ছিল না কখনও। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে। এই তো কিছুদিন আগে ম্যাক্স চলে গেল। তাকে দমদমে তুলে দিতে গিয়েছিল, সোমেন, যাওয়ার সময়ে ম্যাক্স তার হাত ধরে বলেছিল—নোংরা গরিব ঠিকই, তবু তোমার দেশের বেশি কিছু শিখবার নেই বিদেশ থেকে, একসেপ্ট সাম টেকনিক্যাল নলেজ, এনডিভার, অ্যান্ড এ প্র্যাকটিক্যাল আউটলুক ইন সাম ম্যাটার্স।
কথাটা শুনে খুব অহংকার হয়েছিল সোমেনের। নিজের দেশ সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানে না সোমেন, কিন্তু ম্যাক্স জেনে গেছে। ম্যাক্স সারা ভারতবর্ষ কয়েকবার ঘুরেছে, কাশীতে সংস্কৃত শিখে বেদ-বেদান্ত পড়েছে, ভিখিরি কাঙাল থেকে সমাজের উচ্চস্তরের মানুষদের সঙ্গে অবাধে মিশেছে, উগ্রপন্থীদের সঙ্গে বিপ্লব করতে গিয়ে কিছুদিন জেলও খেটে গেছে। রোগা সাহেবটা অল্প কদিনে যা করে গেছে সোমেন হয়তো সারা জীবনেও করতে পারবে না। উলটেপালটে এদেশকে দেখে গেছে ম্যাক্স। তাই তার কথায় নিজের দেশের ওপর আবার আস্থা ফিরে আসে সোমেনের। লক্ষ্মণকে এইসব কথা বলেছিল সোমেন। লক্ষ্মণ অনেক চিন্তা করে বলেছিল—সেক্স আর টেকনোলজি ছাড়া ওদেশে কিছু নেই, এমন নয় সোমেন। তবে ভাল যা আছে তা সবই একটু থমকে গেছে। কিন্তু যেহেতু ওরা খুব উদ্যোগী মানুষ সেইহেতু যেদিন ভুল ধরা পড়বে সেদিনই ভূতের মতো খেটে ভুল শোধরাতে কাজে লেগে যাবে। আমাদের মতো ম্যাদামারা মানুষ ওরা নয়। বারংবার ম্যাক্সও বলে গেছে—সোমেন, ইওর্স ইজ এ গুড কান্ট্রি। আমি বুড়ো বয়সে বেনারসে এসে সেটেল করব দেখো।
বাতাসে সিগারেটটা তাড়াতাড়ি পুড়ে যাচ্ছে। দাদা এখনও সাঁতার কাটছে। বোধ হয় বার দুই-তিন পুকুরটা এপার-ওপার করল। আর বেশিক্ষণ জলে থাকলে ওর ঠান্ডা লেগে যাবে। সোমেন তাই ঢিবির ওপর থেকে নেমে আসে আস্তে আস্তে পুকুরধারে গিয়ে ডাকে—দাদা!
রণেন গলা-জলে দাঁড়িয়ে মুখে জল সমেত বলে—আয় আসবি? তোকে সাঁতার শিখিয়ে দিই।
—আমি জানি দাদা। তুমি উঠে এস।
—আর একটু থাকি। খুব ঠান্ডা।
—সর্দি লাগবে যে।
রণেন তার দিকে তাকিয়ে বলে—পাগলের কখনও সর্দি লাগে না, বুঝলি, সর্দি লাগলে। পাগলামি সেরে যায়।
সোমেন বিরক্ত হয়ে বলে—তা হলে বউদিকে ডেকে আনি।
রণেন কোমর থেকে গামছা খুলে ছপাং করে জলে লম্বা করে ফেলে বলে—দাঁড়া, উঠছি।
গৃহপ্রবেশ হয়ে গেল। অনেক লোক জুটে ব্রজগোপালের সামান্য জিনিসপত্র মুহূর্তের মধ্যে বয়ে এনে দিল নতুন বাড়িতে। শীলা আর ইলা সাজাতে লাগল। বীণা রান্নাঘর গুছোয়। বলে—মা, আমাদের একটা জায়গা হল এতদিনে।।
ননীবালা গভীর শ্বাস ফেলে বলেন—আর জায়গা! কখনও কি এসে থাকবে বউমা? আমরা বুড়োবুড়ি মাটি কামড়ে পড়ে থাকব মরা ইস্তক। যদি মনে হয় তো এস। আমাদের বুক জুড়িয়ে দিয়ে যেয়ো। মা দুর্গার মতো ছানাপোনা নিয়ে ঝুমঝুমিয়ে আসবে যাবে, তা কি আমার ভাগ্যে হবে বউমা!
সোমেনকে দেখে নিরালায় ডাকেন ননীবালা, বলেন—কিরে, রোগা হয়ে গেছিস নাকি?