মুখে কোনও বিরক্তির চিহ্ন নেই, তবু সমীরের বিরক্তিটা টের পাচ্ছিল মনোরম। ওর চোখ মনোরমের লম্বা চুল, বড় জুলপি আর কাজ করা পাঞ্জাবির ওপর থেমে থেমে সরে গেল। বোধহয় মনে মনে পোশাকটাকে সমীর পছন্দ করল না। কিন্তু কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলা সমীরের স্বভাব নয়। অভিজাতদের এইসব সুশিক্ষা থাকেই।
সমীর চোরাচোখে ঘড়িটা একবার দেখে নিল, বলল–তোমার কি কিছু বলার ছিল?
মনোরম মাথা নেড়ে বলল–না। একটু বসব বলে এসেছিলাম। বাইরে যা বৃষ্টি।
-বৃষ্টি! চোখ বড় করে বলে সমীর, তারপর একটু লাজুক হাসি হেসে বলে–বাইরের রোদ বা বৃষ্টি এখানে বসে কিচ্ছু বোঝা যায় না। তারপর একটু চিন্তিতভাবে বলে–খুব বৃষ্টি?
থেমেছিল। আবার বোধহয় শুরু হয়েছে।
অন্যমনস্কভাবে সমীর বলে–খেলাটা না ওয়াশড আউট হয়ে যায়।
কার খেলা?
ছোটবাঙাল আর বড়বাঙাল। উয়াড়ি ভারসাস ইস্টবেঙ্গল। সমীর তার সরু কিন্তু সুবিন্যস্ত দাঁত আর কোমল ঠোঁট দিয়ে আকর্ষক হাসিটা হাসে, তারপর ফোনটা তুলে নিতে নিতে বলোঁড়াও, জেনে নিই।
ফোন করল। বোধহয় ক্লাবে। সমীর অনেক ক্লাবের মেম্বার। আই এফ-এ, সি-এ-বি, ওয়াই-এম-সি-এ এবং আরও কয়েকটার। বোধহয় রোটারিয়ানও। বহুকাল ধরে মেম্বার। এতদিনে দুচারটে ক্লাবের কর্মকর্তাও হয়েছে বোধহয়।
ফোনটা নামিয়ে রেখে সোজা হয়ে বললনা, খেলা হচ্ছে। বৃষ্টিটা বোধহয় থেমে গেল। লিগের যা অবস্থা আজকের খেলাটা খুব ইম্পট্যান্ট।
থুতনিই বোধহয় মানুষের মুখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। অনেকক্ষণ সমীরকে লক্ষ করে এই সত্যটা উপলব্ধি করে মনোরম। থুতনির চমৎকার খাঁজটি সমীরের বংশগত, ওই খাঁজটিই ওর মুখটাকে এত উঁচুদরের মানুষের মুখের মতো করেছে। অনেক মানুষের মুখই সুন্দর কিন্তু সেই সৌন্দর্যে সব সময়ে ব্যক্তিত্ব থাকে না। সমীরকে দেখলেই যে সম্ভ্রান্ত এবং উঁচুদরের লোক বলে মনে হয় তা কি ওর চমৎকার খাঁজওলা ওই থুতনিটার জন্যই? মনোরম ভাবে। সমীর ঘড়ি দেখছে। বোধহয় প্রায় চারটে বাজে। ওর ওঠা দরকার। কিন্তু সে কথাটা ভদ্রতাবশত মনোরমকে বলতে পারছে না।
মনোরম সংকোচটা ঝেড়ে ফেলে বলে-সীতার কোনও খবর জানেন?
আবার মদরঙের চশমার ভিতরে চোখটা সামান্য বিস্ফারিত হল। বিস্ময়ে। একটু অস্বস্তির সঙ্গে সমীর বলে-সীতা! ভালই আছে। একদিন কি দু’দিন নার্সিং হোম-এ গিয়েছিল ওর দিদিকে দেখতে।
সে খবর নয়, অন্য কোনও খবর?
–আর কী? ওদের বাড়িতে বহুদিন যাই না, ঠিক কিছু বলতে পারব না। কীসের খবর চাও?
মনোরম টেবিলের ওপর কাঁচের ভিতরে চাপা একটা ছবি দেখল। রঙিন ফটোগ্রাফ বলে মনে হয়েছিল প্রথমে। তা নয়, হাতে আঁকা রঙিন প্রিন্ট। বনভূমিতে বেলাশেষের সিঁদুরে আলো, কয়েকটা গোরুর গাড়ি কুঁকে আছে, মাঝখানে আদিবাসী কয়েকজন নারী ও পুরুষ রান্নাবান্না করছে। পথের ওপর গেরস্থালি। ছবিটার মধ্যে একটা গল্প আছে।
সে মুখ তুলে বলল–একটু আগে আমি সীতাকে দেখলাম।
সমীর অস্বস্তিতে চেয়ারের একদিক থেকে আর একদিকে শরীরে ভর দিল। বলল–ও! কোথায়?
–এসপ্লানেডে। বোধহয় মার্কেটিংয়ে এসেছিল। ফিরে যাচ্ছিল তখন।
চুলে তেমনি আঙুল চালায় সমীর। চোখ সরিয়ে নেয় মনোরমের চোখ থেকে, তারপর একটু হালকা গলায় বলে কথাটথা বললে নাকি?
না। আমি কথা বললেও ও পাত্তা দিত না।
মনোরম ক্ষীণ একটু হাসে। সমীর চিন্তিতমুখে পার্টিশনটার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বড় একটা শ্বাস ফেলে লে–আর কিছু বলবে? হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলে–এখনও একটু সময় আছে।
কটা বাজে?
চারটে প্রায়।
–আমার কিছু বলার ছিল।
-খুব কি জরুরি কথা?
–খুব। অন্তত আমার কাছে।
–খুব জরুরি হলে না হয় আজকের প্রোগ্রামটা…
না না। আমি…আমার খুর অল্প কথা।
সমীর একটু ঝুঁকে মুখখানা তুলে চেয়ে রইল।
মনোরম বলার আগে আর একবার বনভূমির ছবিটা দেখে নিল। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে কয়েকটা গোরুর গাড়ি। গাছের ছায়ায় গোধূলি, আদিবাসী নারী ও পুরুষ উনুন জ্বেলেছে।
–আমি আজ সীতাকে দেখলাম।
বলেছ তো।
বলেছি। তবু বলতে ইচ্ছে করছে।
কী?
–সীতা এরপর কী করবে কিছু জানেন?
–ফ্রাঙ্কলি জানি না।
সমীর দুঃখিতভাবে তার দিকে চেয়ে থাকে। মুখে সত্যিকারের সমবেদনা। রক্তাভ সুন্দর আঙুল দিয়ে থুতনির খাঁজটা মুছে নিল অকারণ। একটা পোখরাজ একটু ঝলসে যায়। মনোরম বুঝতে পারে, সমীরের কিছু বলার নেই।
কিন্তু তবু মনোরমের ইচ্ছে হয়, আরও একটুক্ষণ এই সফল সুপুরুষ ও উঁচু ধরনের লোকটির সঙ্গে কাটায়। আর একটু দেখতে ইচ্ছে করে, কী আছে লোকটার। সীতার কথা একটু শুনতে ইচ্ছে করছিল তার।
সে একটা মিছে কথা বলল। চেয়ারটা ঠেলে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে–আমিও মাঠের দিকে যাচ্ছিলাম।
যাবে? বলে একটু বিস্মিতভাবে তাকিয়েই সেই ভদ্র আন্তরিক হাসিটি হেসে বলে–ইউ আর ওয়েলকাম। আমার সঙ্গে চলো।
টেবিলের ওপর ঝুঁকে মনোরম বলে–যাব?
যাবে না কেন?
মনোরম একটু বোকা-হাসি হেসে বলে–আমি কিন্তু একটু মদ্যপান করেছি। অবশ্য তেমন কিছু না, একটু বিয়ার…
তেমন ভদ্র হাসি হেসে সমীর উঠতে উঠতে বলে–গন্ধ পাচ্ছিলাম। তাতে কী? আমিও তো মাঝে মাঝে খাই। ইটস অল ইন দ্য গেম।
টেবিল থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার আগে শেষবারের মতো মনোরম ছবিটা দেখছিল। রাঙা আলোর বনভূমিতে গো-গাড়ি থামিয়ে গেরস্থালি পেতেছে কয়েকজন আদিবাসী পুরুষ ও রমণী। কী চমৎকার বিষয়, যেন ঠিক একটা গল্প বলা আছে ছবির ভিতরে। ছবিটা দেখতে দেখতেই সমীরের শেষ বাক্যটির চমৎকার ইংরিজি কটা শব্দ শুনে সে চমকে গেল। এখনও ভাল ইংরিজি বলা লোককে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে হয়। আদিবাসীদের ছবি থেকে সে চোখ সরিয়ে কলকাতায় চলে এল এক পলকে। কিছুক্ষণের জন্য যেন বা সে ওই ছবির বনভূমিতে চলে গিয়েছিল।