অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল মনোরম। পার্ক ক্রমে নির্জন হয়ে গেল। সে একা। মি পড়ে তার গা ভিজছে, মাথা ভিজছে। ঠাণ্ডায় চোখে জল আসে। গলায় ব্যথা, একটু একটু কাশি। হাতে পায়ে খিল ধরা ভাব। ঝিঁঝি লেগেছে। এ কয় মাসে বীরুকে সে ভালবেসে ফেলেছিল, তা আজ বুঝতে পারল। ওই অ্যাপার্টমেন্টে কী হয়েছে তা এত রাতে জানতে যেতে সাহস হল না তার। কোত্থেকে একটা রাতচরা পুলিশ ঘেঁটে লাঠি দোলাতে দোলাতে কাছে এসে বলল-কেয়া?
মনোরম মাথা নেড়ে বলে কুছ নহি।
–তব?
মনোরম হাঁটতে থাকে। পার্কের রেলিং ডিঙিয়ে রাস্তায় পড়ে। ফিরে আসে পূর্ণদাস রোডের ফ্ল্যাটে। ঘুমোতে পারে না। স্বপ্ন দেখেনা। তার কোনও ইডিও-মোটর অ্যাকশনও হয় না আজ। রোজ কয়েকবার যে কথাটা তার মনে পড়ে সেই ট্রেন দুর্ঘটনাও মনে পড়ে না। ঘরের বাতি নিবিয়ে সে বসে থাকে জানালার পাশে। সিগারেট খায়। তার নিঃসঙ্গতায় কেবলমাত্র সঙ্গে দেয় নড়ন্ত জিভটা। টুক টুক করে নড়ছে। নড়ছেই। সে বড় মর্মান্তিকভাবে বুঝতে পারে, বীরুকে সে বড্ড ভালবেসে ফেলেছিল। বড় বেশি। বোধ হয় আর কিছু করার নেই।
খুব ভোরবেলা সে আর একবার অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কুয়াশায় গাঢ় আকাশে বহু দূর উঠে গেছে বাড়িটা। অন্ধকার জানালা সব। কোলাপসিবল গেট বন্ধ। বীরুর জানলায় আলো নেই।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার হাঁটতে থাকে। শীতটা কি খুবই পড়ল এবার? হাত পা সিটিয়ে যাচ্ছে। ভোর-আলোয় দুটো হাত চোখের সামনে তুলে ধরে দেখে সে। হাত দুটো রক্তহীন, সাদা, আঙুলের ডগায় চামড়া কুঁচকে আছে, অনেকক্ষণ জলে ভিজলে যেমন হয়। শরীরে একটা কাঁপুনি শীতের জন্যই? নাকি অন্তর্নিহিত গুঢ় শোক থেকে উঠে আসছে শরীর জুড়ে এক নিস্তব্ধ ক্রন্দন? নাকি ভয়? অনিশ্চয়তা? হাঁটে, কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নয়। খানিকটা উদভ্রান্তের মতো।
তবু ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে সে হাজির হয় কাঠগোলায়। বীরুর ফিয়াটটা বাইরে দাঁড়ানো। আপাদমস্তক শিউরে ওঠে মনোরম।
মামা বাইরের চালায় বসে আছে। কী গম্ভীর হয়ে চোখের কোলে কালি পড়েছে। ঘুমহীন জ্বালাভরা চোখ। কষ্টে শ্বাস টানছে।
–তিন দিন তুই দেখাই দিসনি ঝুমু। বীরুর খবর কী?
একই খবর। বীরুর গাড়িটা দেখছিসতর্ক গলায় বলে মনোরম।
গভীর ক্লান্তিতে মামা বলে–আমিই এনেছি ওটা। গ্যারেজে পড়ে আছে, মাঝে মাঝে চালু না করলে ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাবে। ওর ঘরে গাড়ির চাবিটা পড়ে ছিল। ভাবলাম নিয়ে বেরোই। কখন হুট করে এসে হাজির হবে, তখন গাড়ি রেডি না পেলেই তো মাথা গরম হবে। তাই ইঞ্জিনটা চালু রাখছি।
–ও।
কী করছে এখন হারামজাদা?
–মামা, এবার আমাকে ছেড়ে দাও। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমার সেই বন্ধুর গলায় হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বেশি দিন নেই।
যাবি? বলে যেন হাতের ভর স্বলিত হয়ে যায় মামার। রোগা লম্বা শরীরটা টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে।
ঝুমু! মামা হাঁফানির খাস টেনে বলে।
–বলো মামা। মনোরম মামার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলে কী হয়েছে তোমার?
-শোন, ও যখনই ফিরুক, যবেই ফিরুক, ওর সব সাজানো রইল। ওর ঘর সাজানো আছে, ব্যবসাপত্র সব গুছিয়ে রাখা আছে, ওর গাড়ির ইঞ্জিন আমি চালু রাখছি। ওকে বলিস, আমার যা সাধ্য সব করে রেখেছি ওর জন্য।
বীরু তো সবই জানে মামা।
ভূপতিকে সব বুঝিয়ে গেলাম, তুইও দেখিস।
–তোমার কী হয়েছে?
ঝুমু, প্রদীপ নিবে গেলে একটা তেলপোড়া গন্ধ পাওয়া যায় জানিস তো?
–হ্যাঁ, বিচ্ছিরি গন্ধ।
–সেই গন্ধটা মানুষ যখন আর পায় না, তখনই বুঝতে হবে তার আর মরার দেরি নেই।
–তার মানে?
–ও একটা তুক। মানুষ মরার আগে নেবানো প্রদীপের সামনে বসেও সেই গন্ধটা পায় না। আমি গতকাল সন্ধের সময়ে পুজোর পর প্রদীপটা ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে অনেকক্ষণ বসে গন্ধটা পাওয়ার চেষ্টা করলাম। পেলাম না। ঝুমু, আমারও আর দেরি নেই।
–এ সব কথার কোনও মানে হয় না মামা।
–তুই যেন কার সঙ্গে ব্যবসাতে নাবছিস?
বন্ধু।
–যাবিই ঝুমু? কথা দিয়েছি।
–তা হলে যা। ফাঁকে ফাঁকে এসে একটু বীরুকে দেখে যাস। তোর মামিকেও।
–দেখব মামা।
মনোরম কাঠগোলা থেকে বেরিয়ে আসে। মামা এখনও কিছুদিন টের পাবে না। বীরু তো এরকম কতদিন ডুব দিয়ে থেকেছে। সে রকমই কিছু ভেবে নিশ্চিন্ত থাকবে। মনোরম একটা সত্যিকারের দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
সামনেই গোল পার্কের ওপর শীতের প্রকাণ্ড আকাশ বোদভরা হয়ে ঝুঁকে আছে। হঠাৎ কলকাতা মুছে যায়। আবছা স্মৃতির কুয়াশা ভেদ করে মনোরম দেখতে পায় ঘাটের পৈঠার মতো দীর্ঘ সব সিঁড়ি। ইস্কুলবাড়ির তিনশো ছেলে সেই সিঁড়িতে সারি সারি দাঁড়িয়ে জোড়হাতে গাইছে–জয় জগদীশ হরে…
বহু দিনের পুরনো সেই আকাশ অতীত থেকে হঠাৎ আজ ঝুঁকে পড়ে মনোরমের চোখের ওপর। হাতের উল্টো পিঠে সে চোখের জল মুছে নেয়।
.
কলকাতায় এবার কি খুব শীত পড়েছে! এত বরাদুরে হাঁটে মনোরম, তবুও শরীর তার কেঁপে ওঠে। হাত দুটো সামনে সিঁটানো। হাঁটে মনোরম। শীত যায় না। গাড়ির শব্দ হয় চারপাশে, মানুষের পদশব্দ থেকে যায় পথে। মনোরম আর কারও পিছু নেয় না কখনও। রাতে সে তার ঠাণ্ডা বিছানায় এসে শোয়। একটু ওম-এর জন্য বড় খুঁতখুঁত করে তার শরীর। চোখ বুজতে না বুজতেই ফুলের পাপড়ির মতো স্বপ্নরা ঝরে পড়ে চোখে। মনে পড়ে সেই দুর্ঘটনা। চমকে উঠে বসে সে। ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে।