বাটা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে–শীতকালেই তো সাজগোজ। মনোরমও তাই ভাবে। এই শীতে সে একটু সাজবে। একজোড়া চমৎকার জুতো কিনে ফেলল সে। ক্রোকোডাইল প্যাটার্নের চামড়া। হাঁটুতে পকেটওলা একটা মার্কিনি কায়দার প্যান্ট করল, যার সেলাইগুলো দূর থেকে দেখা যায়। মামা টাকা দিচ্ছে। দেওয়ার হাত একটু একটু করে আসছে মামার।
পুরনো বন্ধুদের এক-আধজনের সঙ্গে দেখা হলে তারা জিগ্যেস করে কী ব্যাপার? চিনতেই পারা যায় না যে!
মনোরম উত্তর দেয়–জেমস বন্ড হয়ে গেছি ভাই, কমপ্লিট জিরো জিরো সেভেন।
কাজকারবার?
নতুন ব্যবসা খুলছি ভাই! কর ফাঁকি দিতে চাও, কি নতুন ধরনের নেশা করতে চাও, যা চাও কন্ট্যাক্ট বিসোয়াস অ্যান্ড ব্যানার্জি। শিগগিরই স্টার্ট করব।
কিন্তু ঝোলাচ্ছে বীরুটা। আর মামা। বিশ্বাসকে কথা দেওয়া আছে। কিন্তু মামা ছাড়ে না কিছুতেই। প্রতি মাসে টাকা বাড়াচ্ছে আজকাল। বলে–আর কটা দিন একটু দ্যাখ।
এই শীতে বীরু নতুন পোশাক তেমন কিছু করল না। শীতের শুরুতে মাসখানেকের জন্য হিল্লি-দিল্লি কোথায় কোথায় ঘুরে এল। ততদিন মামা দিনরাত তাকে কাঠের তত্ত্ব বোঝাত। মনোরমের জন্য নয়। মামার ধারণা, মনোরম শিখে বীরুকে শেখাবে। যদি বীরু না-ই শেখে কোনওদিন, তবে মনোরম ম্যানেজার হয়ে চালিয়ে নেবে কারবার। বীরুর যেন কষ্ট না হয়।
.
তিন দিকে ঘেরা জালের মধ্যে বীরু দাঁড়িয়ে আছে। একটা দিক খোলা। সেই ভোলা দিক দিয়ে ছুটে আসে রক্তাক্ত বল। বীরুর হাতে ব্যাটটা চমকায়। কিন্তু বলের লাইনটা ধরতে পারে না, স্ট্যাম্প ভেঙে জালে লাফিয়ে পড়ে বল। পরের পর এরকম হতে থাকে। বীরু বলের লাইন দেখতে পাচ্ছে না। যে-ছেলেটা বল করছে সে নতুন, স্কুল ক্রিকেটার। বল তেমন কিছু ভাল করে না। তবু বারবারই বীরু বল খেলতে পারল না। নেট প্র্যাকটিসের বাঁধা সময় পার হয়ে গেলে সে বেরিয়ে এল।
মনোরম বশংবদ দাঁড়িয়ে আছে মাঠের ধারে। বীরুর ওপর সতর্ক চোখ।
বীরু তাকে দেখে একটু হাসল। তারপর তার ফিয়াটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললবাবার চাকরিটা করে যাচ্ছ তা হলে এখনও?
করছি।
করো। কিন্তু কিছু জানার নেই। আমিই জানি না।
–এখনও ভুলতে পারছিস না বীরু?
কী?
–সেই স্টেশনে যেটা দেখেছিলি।
বীরু একটা খাস ছেড়ে মাথা নাড়ল–না।
-কেন?
–গেথে গেছে। অটো সাজেশানের মতো। মানুষের অনেক সময় হয়, খেতে বসলে সবচেয়ে ঘেন্নার কথা মনে পড়ে, একা ঘরে মনে পড়ে ভূতের গল্প। অনেকটা সেই রকমই। যত ভুলতে চাই, তত মনে পড়ে।
কী করবি?
–ভাবছি।
–তুই একটুও ভাবছিস না।
–ভাবছি। তুমি অস্থির হয়ো না। চাকরিটা করে যাও।
বীরু, মামার বড় ভয়, তুই সুইসাইডফাইড করবি না তো কখনও?
সুইসাইড। বীরু একটু থমকে দাঁড়ায়। হঠাৎ একটি বিদ্যুৎ খেলে যায় ওর চোখে, বলে–ভাবিনি তো কখনও!
মনোরম ভীষণ হতাশ হয়ে বলে-ভাবিসনি। তবে কি আমিই তোকে মনে করিয়ে দিলাম?
–দিলে। সুইসাইডের কথা ভাবতে বোধহয় মন্দ লাগে না কখনও কখনও! মাঝে মাঝে ভাবব।
–কেন ভাববি বীরু? ভাবিস না। আমি কথাটা উইথড্র করে নিচ্ছি।
ভয় পেয়ো না। সুইসাইডের চিন্তা কখনও করিনি। চিন্তাটা করতে বোধহয় ভালই লাগবে?
–যদি ওটাও অটো সাজেশানে দাঁড়িয়ে যায়?
বীরু ধীর পায়ে তার ফিয়াটের দিকে হেঁটে চলে গেল। আর ফিরে তাকাল না।
কদিনের মধ্যেই বীরু হেঁটে ফেলল লম্বা চুল, জুলফি। শুধু ছোট একটু গোঁফ রেখে দিল। এই শীতে একটা আধময়লা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরতে লাগল। ফিয়াটটা গ্যারেজেই পড়ে থাকে। বীরু হাঁটে। এ রাস্তা থেকে ও রাস্তা। গলিখুঁজিতে চলে যায়। দিশি গাড়িটা নিয়ে বড্ড বিপদে পড়ে গেল মনোরম। এখন আর গাড়িতে বীরুকে অনুসরণ করার মানেই হয় না। সব গলিতে গাড়ি ঢোকে না, তা ছাড়া মানুষের হাঁটার গতির সমান ধীর গতিতে গাড়ি চালানো যায় না সব সময়ে। অতএব গাড়ি ছেড়ে হাঁটা ধরে মনোরম। এবং প্রথম ধাক্কাতেই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এতদূর হাঁটার অভ্যাস ছিল না তার। তার ওপর লম্বা পায়ে বীরু জোরে হেঁটে যায়, তাল রাখতে গিয়ে দমসম হয়ে পড়ে সে। তবু তীব্র এক আকর্ষণে সে ঠিকই চলে। পিছু ছাড়ে না। বীরু টের পায়। মাঝে মাঝে পিছু ফিরে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কখনও হাসে একটু, ম্লান হাসি। কখনও চাপা গলায় বলে-বাক আপ।
বুধবার রাতে বীরুকে তার অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে যেতে দেখেছে মনোরম। তারপর ফিরে গেছে পূর্ণদাস রোডের ফ্ল্যাটে। পরদিন সকালে আবার এসেছে অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে। সারাদিন বীরু নামল না। দারোয়ানের কাছে খোঁজ নিল মনোরম। না সাহেব নামেনি। অনেক রাত পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল সে। বীরু নামল না। পরদিনও না।
তৃতীয় দিন মনোরমের বুক কাঁপছিল। দারোয়ান মাথা নেড়ে বলল–কিছু জানি না। এত বড় ফ্লট বাড়ি, কে কখন আসে যায়!
সন্ধেবেলায় চাঁদ ওঠে। মনোরম হেঁটে গেল পার্ক পর্যন্ত। কুয়াশা আছে। হলুদ জ্যোৎস্না। দু-চারজন লোক আছে পার্কে, সঙ্গে কারও কারও প্রেমিকা বা ভাড়াটে মেয়েছেলে। মনোরম পার্কটার একটা কোণে দাঁড়িয়ে অ্যাপার্টমেন্টের দিকে চেয়ে রইল। বীরুর ঘরে যথারীতি অন্ধকার। তিনদিন ধরে আলো জ্বলছে না ওর ঘরে। মনোরম যখন সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করল তখন দেখে তার হাত থরথর করে কাঁপছে। পেট ডাকছে কলকল করে। উদ্বেগে সে অনেকক্ষণ কিছু খাওয়ার কথা মনে করেনি।