-কী বুঝেছি মামা? কখনও মনে হয় ও চাঁদের মাটির ওপর হাঁটছে, ঠিক যেমন নীল আর্মস্ট্রং হেঁটেছিল চাঁদে। কখনও মনে হয়, ও এক অন্য গ্রহ থেকে আসা মানুষ, জ্যোৎস্নামাখা হলুদ কুয়াশায় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে। মামা, বীরু কি রিয়ালি?
-কী বলছিস ঝুমু? রিয়াল নয়?
বীরু নামে সত্যিই কেউ আছে?
–নেই! কী বলিস তুই! বীরু নেই?
–আছে হয়তো। অন্য পৃথিবীতে।
–তুই কি পাগল? অন্য পৃথিবী আবার কী?
–জানো তো টেলিফোনের একটা তার-এ হাজার ফ্রিকোয়েন্সিতে হাজার মানুষের কথা ভেসে চলে! ধরো, একটাই তার, তাতে আমি কথা বলছি বিশ্বাসের সঙ্গে, তুমি সেই মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। বিশ্বাসের কথা তুমি শুনতে পাচ্ছ না, আমিও শুনতে পাচ্ছি না সেই মাদ্রাজি ইঞ্জিনিয়ারের কথা। ঠিক তেমনি, এই আমরা যেখানে বাস করি, সেই পৃথিবীতেই বসবাস করে বীরু। কিন্তু ফ্রিকোয়েন্সি আলাদা, পৃথিবী আলাদা।
–তোর বড় হেঁয়ালি কথা! তবু যদি সত্যি হয়, ঝুমু, আমি তোর মাইনে বাড়িয়ে দেব, তোকে ম্যানেজার করব, তুই বীরুর ফ্রিকোয়েন্সিতে ঢুকে পড়।
–চেষ্টা করছি মামা, পারছি না। বয়স হয়ে গেছে, তা ছাড়া আমারও কি দুঃখ-টুঃখ কিছু থাকতে নেই মামা? দেখ, নড়ন্ত জিভ, একটা অ্যাকসিডেন্টের স্মৃতি, সীতা, স্বপ্নের মেয়েরা ইডিও-মোটর অ্যাকশন মিলিয়ে একটা কাল, এই জাল ছিঁড়ে সহজে কি বেরোনো যায়! চেষ্টা করছি।
-কর। তুই যা চাস তোকে আমি সব দেব।
–জানি মামা।
কী জানিস?
বীরুর জন্যই তুমি আমাকে ভালবাসো। কিন্তু এখন আমার ঘুমের সময়, তুমি আর স্বপ্নের মধ্যে আমাকে ডেকো না। আমি ঘুমোব, আমি উলটে রেখেছি বই, নিবিয়ে দিয়েছি বাতি। অন্ধকারে আমার শরীরের ভিতরে এক্ষুনি জ্বলে উঠবেনীল লাল স্বপ্নের আলোগুলি। ওই তো মোড়ের তে-মাথা পেরিয়ে সেঁটে আসছে আমার ঘুম, অবিকল মানুষের মতো, হাঁসের মতো গায়ের অন্ধকার কণাগুলি ঝেড়ে ফেলে সে আসবে কাছে। সম্মোহনের দীর্ঘ আঙুলগুলি নড়বে চোখের সামনে। তোমরা যাও…আমি ঘুমিয়ে পড়ব…
একটু স্যাঁতসেঁতে বিছানাটা। ফাঁকা। মনোলমের হাত এলিয়ে পড়ে থাকে। সেই হাত কিছুই স্পর্শ করে না।
.
ঠিক দুপুরবেলায় চোখের রোদ-চশমাটা খুলে মনোরম এসপ্ল্যানেডের ট্রামগুমটির টেলিফোন বুথ-এ ঢুকে গেল। ডায়াল করল, পয়সা ফেলল।
হ্যালো। একটা চাপা সতর্ক গলা ভেসে আসে।
–দিস ইজ জেমস বন্ড।
–কে?
–জিরো জিরো সেভেন।
–গুডনেস। ব্যানার্জি?
–ইয়াঃ।
–বিসোয়াস হিয়ার। আমাকে আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে ব্যানার্জি? মানুষের আয়ুর তো শেষ আছে।
ফিসফিস করে একটা ভৌতিক গলায় কথা বলে বিশ্বাস।
–জানি বিশ্বাস। আমি একটা ট্রাফিক জ্যাম-এ পড়ে গেছি। সামনে একটা ফিয়াট গাড়ি, সেটাকে পেরোতে পারছি না। সেটাকে পেরোতে পারলেই আপনার কাছে পৌঁছে যাব। আর কয়েকটা দিন।
-ফিয়াট গাড়ি? কী বলছেন ব্যানার্জি? কার গাড়ি?
সেই ছেলেটার পিছু-নেওয়া এখনও শেষ হয়নি বিশ্বাস।
এখনও তাকে চেজ করছেন?
–এখনও?
-সে মরেনি তা হলে?
–না।
–তবে বোধহয় সে আরও কিছুকাল বেঁচে থাকবে, কিন্তু আমি বোধহয় বাঁচব না ব্যানার্জি।
–কেন?
—আমার গলাটা কেমন বসে গেছে, লক্ষ করেছেন?
হু।
ক্যানসার।
যাঃ।
বায়োপসি করিয়েছি। মাসখানেকের মধ্যেই হাসপাতালে বেড নেব।
মনোরম চুপ করে থাকে।
ব্যানার্জি!
–উ।
সময় নেই। একদম না। আমার বাচ্চারা মাইনর, বউটা বুদ্ধি রাখে না। এত সব কে দেখবে? আপনাকে ছাড়া আমার চলবে না। আপনি কথা দিয়েছিলেন।
মনোরম একটা খাস ছাড়ল।
–শুনছেন ব্যানার্জি?
–শুনছি।
নতুন জবিনেস ওপেন করব ভাবছিলাম। ড্রাগ, নারকোটিকস। ম্যারিজুয়ানা থেকে হাশিস পর্যন্ত। খুব বাজার এখন। কিন্তু কী করে করব?
-দেখছি বিশ্বাস। আর কয়েকটা দিন।
–আপনাকে চাই-ই। ঠাট্টা নয় ব্যানার্জি, আপনি সত্যিকারের জিরো জিরো সেভেন হতে পারবেন। আমি একজন রিয়্যাল জিরো জিরো সেভেন চাই। হাত মেলান ভাই।
মনোরম হাসল।
হাসবেন না। হাতটা বাড়ান…বাড়িয়েছেন?
মনোরম শূন্যে তার হাতটা সত্যিই বাড়িয়ে দিয়ে বলল বাড়িয়েছি।
–আমিও বাড়িয়েছি…এইবার ধরুন হাতটা…মুঠো করুন।
করেছি।
শূন্যেই হাত মুঠো করে মনোরম, শেকহ্যান্ডের ভঙ্গিতে।
দ্যাটস দ্য বন্ড। আমরা কিন্তু হাত মিলিয়েছি ব্যানার্জি।
–ইয়াঃ।
টেলিফোনটা হুক-এ ঝুলিয়ে রাখে মনোরম।
.
এ বছর কলকাতায় খুব শীত পড়ে গেল। উত্তুরে হু-হুঁ হাওয়া দেয়। ময়দানের গাছগুলো থেকে পাতা খসে খসে পড়ে গেল সব। দেহাতিরা সেই পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালে, হাত-পা সেঁকে নেয়। বেকার আর ভবঘুরেরা পার্কে পার্কে বেঞ্চে আর ঘাসে শুয়ে কবোষ্ণ রোদে ঘুমোয় সারা বেলা। এসপ্ল্যানেডের চাতালে তিব্বতি কিংবা ভুটিয়া মেয়েরা সস্তায় সোয়েটার বিক্রি করছে। তাদের ঘিরে এ বছর ভিড় বেড়েছে। শহরতলির দিকে আপ লোকাল ট্রেনগুলো ছুটির দিনে বোঝাই হয়ে যায়। শীতের পিকনিকে যাচ্ছে কলকাতার মানুষ। চিড়িয়াখানায় ভিড়, সিনেমা হল-এ লাইন। শীতের রোদ মাখাবার জন্য বাইরে বেরিয়ে পড়ে লোকজন।
একটা তিব্বতি মেয়ের কাছ থেকে তার হলদে দাঁতের হাসি সমেত একটা পুলওভার কিনল মনোরম। সাদা। বুকে আর পেটে পাশাপাশি চারটে চারটে আটটা সবুজ বরফি। পুলওভারটা পরে বেরোলে যে কেউ মনোরমকে দুবার ফিরে দেখে।