ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে এল চাঁদনি চকে। তার দোকানটা এখানেই। নেমে সে দোকানঘরে উঠে এল। মনোরমের আমলে সাকুল্যে চারজন কর্মচারী ছিল। এখন বেড়েছে। পুরনোর কেউ নেই। চমৎকার সানমাইকা লাগানো কাউন্টার, দেয়াল ডিসটেম্পার করা, ডিসপ্লে বোর্ড, কাঁচের আলমারি। সীতার দাদা ব্যবসা ভালই বোঝে। অনেকটা বড় হয়েছে দোকান। রমরম্ করে চলছে। ভাল জামাকাপড় পরা একজন অল্পবয়সি ছোকরা কাউন্টারের ওপর কনুইয়ের ভর রেখে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মনোরমকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললবলুন।
মনোরম গ্রাহ্য করল না। চারদিকে চেয়ে দোকানঘরটা দেখল। দোকানের নাম এখনও এস ব্যানার্জি প্রাইভেট লিমিটেড। সীতা এখনও ব্যানার্জি নামে সই করে। আপনমনে একটু হাসে মনোরম। কাউন্টারের ছেলেরা চেয়ে থাকে।
বাইরে একটা টেম্পো থেমেছে। কুলিরা মাল তুলে দিয়ে যাচ্ছে দোকানে। ছেলেটা ওপাশটায় গেল।
একা দাঁড়িয়ে থাকে মনোরম। এই দোকান-টোকান সবই সে উপহার দিয়েছিল সীতাকে। কিছু আয়কর ফাঁকি দিয়েছিল বটে, তবু তার ব্যবসাটা ছিল পরিষ্কার, দাগহীন এবং সৎ। এ সব আবার তাকে ফিরিয়ে দিলে সীতা তাকে ভুলে যেতে পারবে। পারবে কি?
কেন ভুলতে দেবে মনোরম? দেবে না। সে ফিরিয়ে নেবে না কিছুই। বিছানায় যখন মানস বুকে পড়বে সীতার ওপর, একদিন চুপি চুপি ঠিক মানসের শরীরে ভর করবে মনোরম। ভূতের মতো। থাক। মনোরম কিছুই ফিরিয়ে নেবে না। তার চেয়ে সে বিশ্বাসের অন্ধকার, বিপজ্জনক ব্যবসায় নেমে যাবে।
একটু দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বেরিয়ে এসে গাড়ি ছাড়ে সে। মনটা হঠাৎ ভাল লাগে। আজ সে সম্পূর্ণ দাবি-দাওয়া ছেড়ে দিতে পারল।
সমীরকে ফোন করল সে।
-শুনুন, আমি বিজনেস ফেরত নেব না। কিছুই নেব না।
–কেন মনোরম?
-শুনুন, আপনি হয়তো ঠিক বুঝবেন না ব্যাপারটা। তবু বলছি। সীতা ব্যবসা কেড়ে নিয়ে আমার ক্ষতিই করতে চেয়েছিল। ম্যানেজারি থেকে বরখাস্ত করেছিল আমাকে। কিন্তু তাতে ক্ষতি কিছু হয়নি। আমি মরে যাইনি। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা মানুষের হয় তা টাকাপয়সার নয়, বিষয়-সম্পত্তিরও নয়। মানুষ হারায় তার সময়।
-কী বলছ, বুঝতে পারছি না।
–আমার হারিয়েছে, ক্ষতি হয়েছে কেবলমাত্র সময়ের। সীতা আমার বিজনেস ফিরিয়ে দিতে পারে, কিন্তু হারানো সময়টা কে ফিরিয়ে দেবে? এক বছরে আমার বয়স বেড়ে গেছে ঢের। কিছু শুরু করব আবার, তা হয় না। আমি পারব না। ওকে বলে দেবেন।
–তুমি আর একবার ভেবে দেখো।
–একবার কেন? আমি আরও বহুবার ভাবব, সারাজীবন ধরে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। আমি আমার এক বন্ধুর ব্যবসায়ে নামছি। ব্যবসা বন্ধুর, আমি সেখানে চাকরি করব। অ্যান্ড দ্যাটস অল।
ফোনটা করে খুবই শান্তি পায় মনোরম।
.
–তুই আমাকে ছেড়ে যেতে চাস ঝুমু? মামা একদিন ক্লান্ত বিষণ্ণ গলায় বলে। মামার রোগা চেহারাটা আরও একটু ভেঙে গেছে। চোখের নীচে মাকড়সার জালের মতো সূক্ষ্ম কালো রেখা সব ফুটে উঠেছে। সম্ভবত শিগগিরই আবার স্ট্রোক হবে মামার।
বীরুর সঙ্গে পাল্লা দিতে আমি কি পারি মামা? ওর কত কম বয়েস, কত স্পিড ওরা কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে বরু! আমি কি পারি পাল্লা দিতে? আমার বয়সও হল।
কিন্তু তুই-ই বীরুকে ফেরাতে পারিস। আমি দেখেছি ও তোর সঙ্গে কথাটথা বলে, হাসে, ঠাট্টা করে। অবিশ্বাস্য। ও যে কারও সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে পারে তা জানতামই না। আমার বড় আশা ছিল, তুই কিছু একটা পারবি।
মনোরম একটু ভেবেচিন্তে বলে–মামা, বীরুর পিছু-নেওয়ার চাকরি একদিন তো শেষ হবেই। একদিন বীরু ঠিকই ব্যবসা-ট্যবসা বুঝে নেবে। তখন আমার চাকরিও শেষ হয়ে যাবে।
-না। তোকে আমি ম্যানেজার করব।
–কেন করবে? আমি যে কাঠের কিছুই জানি না। কিছুই শিখলাম না। বীরু মালিক হলে যে আমাকে রাখবে তারও কিছু ঠিক নেই। বয়সও হয়ে যাবে ততদিনে। পথ বন্ধ হয়ে যাবে সব। তার চেয়ে এখনই আমাকে ছেড়ে দাও।
–যেখানে যাচ্ছিস সেখানেও তো চাকরিই করবি।
–প্রথমে তাই কথা ছিল। পরে আমি কষাকষি করে আমাকে ওয়ার্কিং পার্টনার হিসেবে নিতে রাজি করিয়েছি। কমিশন পাব।
-কীরকম ব্যবসা?
–ব্ল্যাক। ভীষণ কালো। জাল-জোচ্চুরি-স্মাগলিং সবই আছে।
যাবি?
যাব না কেন? আমার এ বয়সে আর ভাল বা খারাপ কিছু হওয়ার নেই।
–যাবিই? বীরুর একটা কিছু ব্যবস্থা করে যা। ওকে ফেরা।
–কোথায় ফেরাব মামা? আমার তো ওকে কিছু শেখানোর নেই। ও আমার চেয়ে দশগুণ বেশি পড়াশুনো করেছে। অনেক বেশি বুদ্ধিমান। ভয়ংকর আত্মবিশ্বাসী। ওকে আমি কোথায় ফেরাব? ও আমাকে উড়িয়ে বেরিয়ে যাবে। বরং ও-ই আমাকে টেনে নিচ্ছে ওর দিকে। দেখো, এই বয়সে আমি লম্বা চুল আর জুলফি রাখছি, পরছি বেলবটমের সঙ্গে পাঞ্জাবি। আর কিছুদিন বীরুর পিছু নিলে আমিই বীরু হয়ে যাব।
–আর কিছুদিন থাক ঝুমু। আমার জন্যই থাক।
–আমার বাড়িভাড়াটা এখনও বাকি পড়ে আছে মামা।
–আজই নিয়ে যাস। ভূপতিকে বলে রাখছি। থাকবি? কিছুদিন?
–দেখি। বিশ্বাসকে একটা খবর দিয়ে দিতে হবে। ওরও স্ট্রোক, খুব ভেঙে পড়েছে। সময় দিতে চাইছে না।
–ওই বিপদের ব্যবসাতে কেন যাবি ঝুমু?
–কিছু তো করতেই হবে মামা। ওপনিং কোথায়? বাজার তো দেখছ! তা ছাড়া বিপদই বা কী, সবাই করছে।