–বিশ্বাস! কী হয়েছে, চেনা যায় না?
বলছি। খুব ব্যস্ত?
মনোরম মুখটা একটু বাঁকা করে হাসে–না। জাস্ট একজনকে চেজ করছিলাম।
–চেজ?
–অলমোস্ট ডিটেকশন জব। জিরো জিরো সেভেন।
কাকে?
–এক বড়লোকের লক্কা ছেলেকে।
বিশ্বাস ক্ষীণ একটু হাসল-চা খাবেন?
চা? বিশ্বাস, চায়ের কথা বলছেন? আপনাকে দেখেই একটা তেষ্টা পেয়েছিল, উবে গেল। অফ অল থিংস গরমের দুপুরে চা কেন?
–দি ওয়ার্ল্ড ইজ লস্ট ব্যানার্জি।
কী হয়েছে?
স্ট্রোক।
বিশ্বাস জোর করে চায়ের দোকানে নিয়ে গেল। বসল দুজন।
স্ট্রোক? মনোরম বলে।
স্ট্রোক।
ব্যাপারটা কী রকম হয় বিশ্বাস?
স্ট্যাবিং-এর মতো। বুকে। বিশ্বাস করবেন না। মনে হয় এতগুলো স্ট্যাবিং যদি বুকে হচ্ছেই, তবে মরছি না কেন?
হু?
–বিশ্বাস করবেন না। মৃত্যুযন্ত্রণা তবু মৃত্যু নয়। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। তার ওপর ডায়েবেটিসটাও ধরে ফেলল এই বয়সে। হাঁটাচলা ছিল না তো, কেবল গাড়ি দাবড়াতাম। ব্যানার্জি, আপনার সঙ্গে কথা আছে।
-শুনছি।
–আপনি একটা ওপেনিং চেয়েছিলেন। ম্যানেজারি করবেন?
ম্যানেজারি, বিশ্বাস? এ নিয়ে গোটা দুই করেছি, কোনওটাতেই সুবিধে করতে পারিনি। আপনারটা থার্ড অফার।
আমার ম্যানেজারিতে পারবেন। আমি বদ হলেও, কথা দিলে কথা রাখি।
টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন?
–জানেন তো ব্যানার্জি, আমার বিজনেস খুব ক্লিন নয়। কিছু গোস্ট মানি খেলা করে। কাজেই
কী?
–ওয়াচ ইয়োর স্টেপস।
–সেই রসিদের বিজনেসটাও কি এর মধ্যে?
এভরিথিং। আমার ব্যবসাগুলো ছোট, প্রত্যেকটার জন্য আলাদা ম্যানেজার রাখব কী করে? তবে টাকা দেব, ওভার অল প্রায় সাতশ। কিন্তু খুব সাবধানে হ্যাঁন্ডেল করবেন। কী, রাজি?
–দেখি।
–দেখি-টেখি নয়। আমি লোক খুঁজছি কতদিন ধরে। আজই কথা দিয়ে দিন।
বিশ্বাস, এখন আমি যে চাকরিটা করছি তাতে আমি টায়ার্ড, একটা অল্পবয়সি ছেলেকে দিনরাত চেজ করা, ওর মতো স্পিড আমার নেই, হাঁফিয়ে পড়ি।
–চেজ করেন কেন?
–ওয়াচ করার জন্য, যাতে সে বিপদে না পড়ে। বিপদ কিছু নেই, তবু তার বাবার ধারণা সে বিপদে পড়বেই। তাই।
–খুব ফাস্ট লাইফ লিড করে?
–খুব। আমার এমপ্লয়ারের সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।
–আচ্ছা, কবে আসছেন?
–শিগগিরই।
–কিন্তু মনে রাখবেন, আমার ম্যানেজারি কিন্তু অন্ধকার জগতে। এভরিথিং ব্ল্যাক।
-জানি বিশ্বাস। চলি।
—শিগগিরই আসছেন?
হু।
মনোরম বিদায় নেয়।
.
আবার একদিন বীরুর পিছু নিয়ে সে এসে পড়ে সমীরের অফিসের সামনে। জোহানসন অ্যান্ড রোর সাদা সম্ভ্রান্ত অফিস বাড়িটা। বীরুকে কলকাতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে দিয়ে মনোরম গাড়ি পার্ক করে। নামে। আঙুলে গাড়ির চাবিটা ঘোরাতে ঘোরাতে ঢুকে যায় ভিতরে।
সমীর ঠিক সেদিনের মতোই সুকুমার কোমল মুখশ্রী তুলে বলে–আরে মনোরম!
মনোরম হাসেকী খবর?
–তোমার খবর কী?
–একরকম।
–বোসো। চা খাও।
না। আমি কাজে আছি।
–বোসো, একটু কথা আছে।
কী?
–সীতার সঙ্গে আমার কিছু কথা হয়েছে।
–কীসের?
–তুমি তো জানই যে ও বিয়ে করছে।
আন্দাজ করেছিলাম। মানসকে?
–মানসকে। সীতা চাইছে তোমার বিজনেস-টিজনেস যা আছে ওর নামে, সব তোমাকে ফিরিয়ে দেয়।
–ফিরিয়ে দেবে? তবে নিল কেন?
–মানুষ তো ভুল করেই। ও বলছিল, এ সব যতদিন না ফেরত দিচ্ছে, ততদিন ও তোমাকে ভুলতে পারছে না। কাজেই তোমাকে ও অনুরোধ জানাচ্ছে, তুমি নাও। অভিমান কোরো না।
মাথাটা নিচু হয়ে আসে মনোরমের। সে কাঁচের নীচে সেই ছবিটা দেখতে পায়। নভূমি, তাতে শেষবেলার রাঙা রোদ, উপুড় হয়ে পড়ে আছে কয়েকটা গোরুর গাড়ি। আদিবাসী পুরুষ ও রমণীরা রাখছে।
সে মুখ তুলে বলল–এ সব জায়গায় আমি অনেকবার গেছি।
–কোন জায়গার কথা বলছ?
–এই যে ছবিতে। সাঁওতাল পরগনা, বিহার, উড়িষ্যায় এরকম সব অদ্ভুত বনে-জঙ্গলে আমি একসময়ে খুব ঘুরে বেড়াতাম।
সমীর করুণ চোখে চেয়ে থাকে।
-বিয়েটা কবে?
–ওরা খুব দেরি করবে না। মানস বোধহয় বদলি হয়ে যাচ্ছে আদ্রায়। বিয়ের পরেই সেখানে চলে যাবে। আমি সীতাকে কী বলব মনোরম? তুমি তো জানো, আমি কোনও ব্যাপারে নিজেকে জড়াই না। কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে সীতা এত কান্নাকাটি করেছিল যে, আমি কথা দিয়েছি তোমাকে কমিউনিকেট করব। তুমি না এলে আমিই যেতাম।
–কিছু ভাবিনি এখনও। দেখি।
–ও খুব শান্তিতে নেই।
মনোরম মনে মনে বলে যতদিন পৃথিবীতে কনভূমি থাকবে,নদীর জলে শব্দ হবে, তত দিন ভুলবে না। জ্বলবে।
বিদায় না নিয়েই একটু অন্যমনস্কভাবে বেরিয়ে এল মনোরম।
ট্রাম কোম্পানির বুথ থেকে টেলিফোন করল সীতার বাড়িতে। রিং-এর শব্দ হচ্ছে। খাসকষ্ট হতে থাকে মনোরমের। সীতা কি কথা বলবে তার সঙ্গে? এরকম ঘটনা ঘটবে কি?
মেয়েলি মিষ্টি গলায় ভেসে আসে হ্যালো।
সীতা! দম বন্ধ হয়ে আসে মনোরমের। বুকে উতরোল ঢেউ।
ধরুন, ডেকে দিচ্ছি।
একটু পরে সীতা বলল-হ্যালো।
মনোরম কিছু বলতে পারে না প্রথমে।
সীতার গলাটা হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে–কে?
মনোরম চোখ বুজে, আস্তে আস্তে বলে যায়–মেরিলি র্যাং দ্য বেল, অ্যান্ড দে ওয়্যার ওয়েড…
কে? চিৎকার করে ওঠে সীতা!
মনোরম ফোন রেখে দেয়।
ডিভোর্সের পর এক বছর পূর্ণ হয়ে গেছে কবে! সময় কত তাড়াতাড়ি যায়।
.
সীতা সব ফিরিয়ে দিচ্ছে। খুশি হবারই কথা মনোরমের। মামার গাড়িটা নিয়ে বীরুকে তাড়া করতে করতে এক সময়ে ক্লান্তি লাগে তার। পিছু-নেওয়া ছেড়ে সে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় অন্য রাস্তায়। আপনমনে ঘুরে বেড়ায়।