-কেন?
–আমি একটু একা থাকি।
পকেটে হাত, চিন্তিত মুখটা নোয়ানো, বীরু আস্তে আস্তে কুয়াশার শরীর নিয়ে ঘোরে। গাড়িতে স্টার্ট দেওয়ার সময়ে দূর থেকে দৃশ্যটা অস্পষ্ট দেখে মনোরম।
০৫.
ঝুমু, তুই বাসাটা ছেড়ে দে। আমার বাড়িতে চলে আয়। যা বাকি বকেয়া পড়েছে তা আমি দিয়ে দেব।
-কেন?
ওয়াচ হিম। ওয়াচ হিজ স্টেপস।
–কোনও লাভ নেই।
কেন?
–ওর ভিতরে কিছু সাহেবি ব্যাপার ঢুকে গেছে।
–সেটা কী?
–সব বুঝবার তোমার দরকার কী?
আমার ছেলে, আর আমার বুঝবার দরকার নেই?
–জেনারেশন গ্যাপ বোঝো?
বুঝব না কেন? বুঝি কিন্তু মানি না। ও সব বানানো কথা।
হবে।
ঝুমু, আমার কেবলই মনে হয় ও শিগগিরই নিজেকে শেষ করবে।
মনোরম চুপ করে থাকে।
তুই সব সময়ে আমার আর ওর কাছাকাছি থাক ঝুমু।
–মানুষ তো আমি একটা, দুজনের কাছে থাকব কী করে?
সময় ভাগ করে নে। না, বরং তুই ওর কাছে কাছেই থাক। ওরই বিপদ বেশি।
–এ কথা বলছ কেন? কীসের বিপদ?
ও তো কিছু বলে না, কিন্তু মনে হয়, ও একটা প্রবলেমের মধ্যে আছে।
–প্রবলেমের মধ্যে সবাই থাকে।
-কিন্তু বীরুর তো প্রবলেমের কোনও কারণ নেই। ভেবে পাই না, ওর প্রবলেমের কী থাকতে পারে। তাই মনে হয়, ওর বড় বিপদ।
বিপদ? না কিছুই খুঁজে পায় না, ভেবে পায় না মনোরম। ও খারাপ মেয়েমানুষের কাছে যায় না যে রোগ নিয়ে আসবে। ওর মেয়েবন্ধুরা অভিজাত পরিবারের। অবৈধ সন্তানের ভয় নেই, খোলা বাজারে বিক্রি হয় কন্ট্রাসেপটিভ। ওর প্রেমের কোনও ঝামেলা নেই, কারণ ঘুমের সময়ে ওর কারও মুখ মনে পড়ে না। জুয়ায় অনেক টাকা হেরে গেলেও ওর অনেক থাকবে।
প্রবলেমটা খুঁজে পায় না বটে মনোরম, কিন্তু খুঁজে ফেরে। দিশি গাড়িটা নিয়ে সে ক্লান্তিহীন ছোটে বীর পিছনে। বীরু মুহুর্মুহু পোশাক কেনে, কেনে গ্রামোফোনের উত্তেজক ডিস্ক, ভাল হোটেলে খায়, নাচে, খেলে বেড়ায় বড় ছোট ক্লাবে, সাঁতরায়, মেয়েদের নিয়ে যায় অ্যাপার্টমেন্টে, মনোরম সারা কলকাতা বীরুর ফিয়াটটাকে তাড়া করে ফেরে। বীরু বিতর্কসভায় বক্তৃতা করে, ভিয়েতনামে মার্কিন বোমারু বিমানের কাণ্ডকারখানার হুবহু বর্ণনা দেয়, লাইফ ম্যাগাজিনের পাতা খুলে জনসাধারণকে দেখায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মর্মন্তুদ ছবি। কিন্তু কোথাও থেমে নেই বীরু। চলছে। চলবে।
অনেক রাতে যখন বাসায় ফেরে মনোরম, তখন ক্লান্ত লাগে। বড় ক্লান্ত লাগে। রাতে সে প্রায় কিছুই খায় না। দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে বিস্বাদ দলাগুলি গিলে ফেলে। দু ঘরেই জ্বেলে দেয় টিউবলাইটগুলি। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়। মাঝে মাঝে ওপরের দিকে চেয়ে দেখে।
কী দেখে মনোরম? দেখে নীলচে স্বপ্নের আলো। জানালার বুটিদার পর্দাগুলি উড়ছে বাতাসে। ঠিক মনে হয়, ঘরের ভিতরে রয়েছে তার প্রিয় মেয়েমানুষটি। সে কে? রিনা? চপলা? না কি এক প্রাণহীন মেমসাহেব-পুতুল প্রাণ পেয়ে ঘুরছে তার শূন্য ঘরে? সীতা নয় তো?
রক্তমাংসময় একজনকেই পেয়েছিল মনোরম। সীতা। যতক্ষণ সিগারেট না শেষ হয়, ততক্ষণ রাস্তায় পায়চারি করে সে। কখনও দুটো-তিনটে সিগারেট ফুরিয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে মনোরম। কাল্পনিক কথা, এক কাল্পনিক স্ত্রীর সঙ্গে। মাঝে মাঝে হাঁটতে হাঁটতে থেমে যায়। কল্পনাটা এমনই সত্যের মতো জোরালো হয়ে ওঠে যে তার ইডিও-মোটর অ্যাকশন হতে থাকে। গভীর রাতে নির্জন পূর্ণদাস রোডে কেউ তার সেই মূকাভিনয় দেখে না। দেখলে তারা দেখত, একজন প্রেমিক কেমন তার শূন্যনির্মিত নায়িকার সঙ্গে অবিকল আসল মানুষের মতো প্রেম করে।
রাত গম্ভীর হলে সে তার ছয় বাই সাত খাটে গিয়ে শোয়। মস্ত খাট। বিছানাটা একটু স্যাঁতসেঁতে। ফুটপাথ থেকে দুটাকা জমা রেখে আট আনা ভাড়ায় আনা ডিটেকটিভ বই খুলে বসে। হাই ওঠে। জল। খায়। টেবিল ল্যাম্প নেবায়। শেষ সিগারেটটাকে পিষে মারে মেঝের ওপর। তারপর ঘুমোবার জন্য চোখ বোজে।
অমনি কল্পনায় ভিন্ন পৃথিবী জেগে উঠতে থাকে। শরীরের ভিতরে নিকষ কালো অন্ধকারে জ্বলে ওঠে নীল লাল স্বপ্নের আলো। অবিকল এক জনহীন প্রেক্ষাগৃহ। আসবাব টানাটানি করে কারা পর্দার ওপাশে মঞ্চে দৃশ্যপট সাজাচ্ছে। পরদা সরে যায়। দীর্ঘ পৈঠার মতো ইস্কুলবাড়ির কয়েক ধাপ সিঁড়ি। তাতে তিনশো ছেলে দাঁড়িয়ে গায়-জয় জগদীশ হরে…
শূন্য বিছানায় তার প্রসারিত হাতখানা পড়ে থাকে। কিছুই স্পর্শ করে না।
সকাল দশটা থেকে কাঠগোলা। মাঝখানে একটু লাঞ্চ ব্রেক। মামাবাড়ি থেকে ভাত আসে। মামা-ভাগ্নে খায়। খেতে খেতে মামা বলে-ঝুমু, ওয়াচ হিম।
আজকাল বাঙালির কথা মামা ভুলে যাচ্ছে। নেতাজির কথাও। নিরুদ্দেশ সেই মানুষটির জন্য আর অপেক্ষা করতে ভয় পায় মামা। ফার্স্ট স্ট্রোক হয়ে গেছে। বীরু থেকে যাচ্ছে বিপদসঙ্কুল পৃথিবীতে।
ফিস ফিস্ করে একটা লোক কানের কাছে বলে ব্যানার্জি না?
তখন বীরু তার গাড়িটা রেখে দ্রুতবেগে ঢুকে যাচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জে। অনুসরণ করতে করতে বাধা পেয়ে মনোরম থেমে ফিরে তাকায়। চিনতে পারে না। মস্ত একটা কাঠামোয় নড়বড় করে দুলেদুলে মাংস আর চামড়ায়। চোখের নীচে কালি। ক্লান্ত মানুষ একটা।
টেলিফোনে যেমন শোনা যায় মানুষের গলা, তেমনি, ফিসফিসিয়ে বলে–বিসোয়াস্ হিয়ার।