রিসেপশনের বাঙালি ছেলেটা চমৎকার ইংরেজিতে বলে–সমীর রয়? অ্যাকাউন্টস আপ ফার্স্ট ফ্লোর।
মনোরম মাথা নেড়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। শ্বেতপাথরের প্রাচীন এবং রাজসিক সিঁড়ি। বহুকাল ধরে পায়ে পায়ে ক্ষয়ে গিয়ে ধাপগুলো নৌকোর খোলের মতে দেবে গেছে একটু। তবু সুন্দর দোতলার মেঝেতে পা দিলে মেজেতে পারসিক কার্পেটের সূক্ষ্ম এবং রঙিন সুতোর মতো কারুকাজ দেখা যায়। কোথাও কোথাও গট (রেছে, তবু তেলতেল করছে পরিষ্কার। মেটা দেওয়ালের মাঝখানে নিঃশব্দ করিডোর, তাতে বদ্ধ বাতাসের গন্ধ। অফিসবাড়িটায় পা দিলেই একটা ওডউইলের অলক্ষ্য অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। গুডউইল। বিশ্বস্ততা এবং সুনাম।
একটা বড় হলঘরের একধারে টিকপ্লাইয়ে ঘেরা চেম্বার। সেখানে সমীর রায় বসে। সামনে প্রকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিল, তার ওধারে সমীর। মনোরমের ভায়রা ভাই। কিংবা ভূতপুর্ব ভায়রাভাই। লম্বা চেহারায় এখন একটু মেদ জমেছে, রংটা কালোই ছিল, এখন ইটচাপা ঘাসের মতো ফরসা হয়েছে। ভাল খায়-দাম, গাড়ি চড়ে বেড়ায়, গায়ে গলায় রোদ লাগে না। সরু টাই, চেয়ারের পিছনে কোট ঝুলছে। ঝুঁকে একটা কাগজ দেখছিল সমীর। চমৎকার একজোড়া মদরঙের ফ্রেমের চশমার ওপর ওর বড় কপাল, লালচে চুল, টিকোলো নাক, এবং গভীর খাঁজওলা থুতনিতে আভিজাত্য ফুটে আছে। সেই মুখশ্রীতে ওর চুয়াল্লিশ কি পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সটা ধরা যায় না। অনেক কম বলে মনে হয়।
মনোরমের কোনও কাজ নেই। ব্যস্ত সমীরের কাছে দু’দণ্ড বসা কি সম্ভব হবে! দু-চারটে কথা কি ও বলবে মনোরমের সাথে! একটু দ্বিধা ও অনিশ্চয়তায় ও টেবিলটার কাছাকাছি এল।
সমীর মুখ তুলে বলল-আরে, মনোরম! কী খবর?
তীক্ষ্ণ চোখে মনোরম সমীরের মুখখানা দেখে নিল। না, খুশি হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। চোখ দুটি সামান্য বিস্ফারিত হয়েই আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। যারা অভিজাত তাদের একটা সুশিক্ষা আছেই, মনোভাব তারা ঢেকে রাখতে পারে। বিস্ময় এবং বিরক্তিকে অনায়াসে চাপা দিয়ে সমীর হাসল।
-একটু এলাম। খুব ব্যস্ত নাকি? মনোরম বলে।
-একটু, বলে সমীর চেয়ারে হেলান দিয়ে আঙুলে মাথার চুল পাট করতে করতে বললসাড়ে চারটেয় কিক অফ। ভাবছিলাম তাড়াতাড়ি কাজটাজ চুকিয়ে একটু মাঠে যাব। বলে ঘড়ি দেখে সমীর বলে–ঠিক আছে, তুমি বোসো। খানিকক্ষণ সময় আছে।
বিয়ারটা এখনও পেটে, ঘাম বা পেচ্ছাপের সঙ্গে এখনও পুরোটা বেরিয়ে যায়নি। মনোরম চেয়ার টেনে বসে হিসেব করে নিচ্ছিল, এতবড় সেক্রেটারিয়েট টেবিলটা পার হয়ে সমীরের নাকে অ্যালকোহলের গন্ধটা যাচ্ছে কিনা। টেবিলের ওপর হেলাভরে পড়ে আছে এক প্যাকেট বেনসন আর হেজেস, ছোট্ট দেশলাই। মনোরম প্যাকেটটা টেনে সিগারেট ধরাল। সমীর লক্ষ না করার ভান করে নিচু হয়ে একটা ড্রয়ার টেনে কী একটু দেখতে লাগল কাগজপত্র।
দামি সিগারেট, কিন্তু বিয়ারের পেটে কোনও ভাল গন্ধ পাওয়া মুশকিল। মনোরম যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করল-গীতাদি ভাল?
-ভালই। একটা বাচ্চা হয়েছে জানো তো! ছেলে।
না।
–সাড়ে তিন কেজি। রুমি ভাই পেয়ে খুব খুশি। দিনরাত বেড়ালের মতো থাবা গেড়ে ভাইয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে বসে আছে।
বলে এবার সত্যিকারের খুশির হাসি হাসল সমীর। মেয়ে রুমির পর দশ বছর বাদে ওদের ছেলে হল। খুশি হওয়ারই কথা।
মনোরম যান্ত্রিক এবং অন্যমনস্ক গলায় বলে-কংগ্রাচুলেশনস।
সমীর মাথার চুলে মুদ্রাদোষবশত আঙুল চালাতে চালাতে বলে একটু বেশি বয়সে হল, ঠিকমতো মানুষ করে যেতে পারব কি না কে জানে!
সমীরের গলার স্বরটা ভারী এবং পরিষ্কার। একেই কি বা ভয়েস বলে? এত ভদ্র এবং মাজা গলা যেন মনে হয় খুব উঁচু থেকে আসছে। এত শিক্ষিত ও ভদ্র গলায় কখনও কোনও অশ্লীল কথা বলা যায় না। সমীর বোধহয় তার বউকেও কখনও কোনও অশ্লীল কথা বলেনি, যা সবাই বলে! সীতাকে অনেক অশ্লীল কথা শিখিয়েছিল মনোরম, সীতা শুনে দুহাতে মুখ ঢেকে হাসতে হাসতে বলত–মাগো! পরে দু’-একটা ওইসব খারাপ কথা সীতাও বলত। ঠিক সুরে বা উচ্চারণে বলতে পারত না। তখন মনোরম হাসত। এবং ঠিক উচ্চারণটা আর সুরটা শেখাত। সীতা শিখতে চাইত না। সমীর আর গীতা কি অন্তরঙ্গ প্রবল সব মুহূর্তে ওরকম কিছু বলে? বোধহয় না। ওদের রক্ত অনেক উঁচু জাতের।
মনোরম সমীরের নম্র এবং সুন্দর কমনীয় মুখটির দিকে চেয়ে থেকে বলল–মানুষ করবার ভার আপনার ওপর নয়। টাকার ওপর। একটা হেভি ইন্সিওরেন্স করিয়ে রাখুন।
সামান্য একটু গম্ভীর হয়ে গেল সমীর। কিন্তু কথাটা গায়ে মাখল না। ডজ করে বেরিয়ে গেল। বলল–তার অবশ্য দরকার হবে না। যা আছে…বলে একটু দ্বিধাভরে থেমে থাকল। এত ভদ্র সমীর যে, টাকার কথাটা মুখে আনতে পারল না। মনোরমেরই ভুল। সমীররা তিন পুরুষের বড়লোক। ওর এক ভাই আমেরিকার হিউসটনে আছে, বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা মাইনে পায়, অন্য ভাই ফিলম প্রোডিউসার। সমীর নিজে বিলেতফেরত অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সীতাদের পরিবারের উপযুক্ত জামাই। এ সব প্রায় ভুলেই গিয়েছিল মনোরম। প্রায় একবছর সীতাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। তেমনি চুলে আঙুল চালিয়ে সমীর বলে-তবে ছেলেকে মানুষ হতে দেখে যাওয়াটা বাপের একটা স্যাটিসফ্যাকশন।