বীরু।
–এসো। ভাবছিলাম, তোমাকে ডাকব।
–তুই জানিস যে আমি তোর পিছু নিই?
আগে জানতাম না। কদিন হয় জানি। জেনেও প্রথম ভেবেছিলাম অচেনা কেউ চেজ করছে। তাই একটু চমকে গিয়েছিলাম। তারপর লক্ষ করলাম, তুমি।
–আমার দোষ নেই। মামার অর্ডার।
–বাবা কিছু জানতে চায়?
চায়।
আমাকে জিজ্ঞেস করলেই বলে দিতাম। এত কষ্ট করতে হত না তোমাকে।
কষ্ট কী? এটাই আমার চাকরি।
বুঝতে পারছি। তোমার জন্য কষ্ট হয়।
মামা যেদিন তোর সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হবে, সেদিন আমার এ চাকরিটা শেষ হবে। তখন হয়তো আমি কাঠগোলার ম্যানেজারি পাব। নয়তো একটা বাজে, বিপজ্জনক অসৎ ব্যবসাতে নেমে যাব। ও দুটো চাকরির চেয়ে এটা বোধ হয় একটু বেটার ছিল। তবে ক্লান্তিকর। তুই বড্ড স্পিডি।
বীরু তেমনি ধীর ভঙ্গিতে একটু হাঁটছে এদিক ওদিক। অদ্ভুত প্রাকৃতিক আলোতে ও হাঁটছে বলে মনে হয় না। যেন একটু জমাট, লম্বাটে একটা কুয়াশায় তৈরি ভৌতিক মূর্তি দুলে দুলে যাচ্ছে।
বাবা কোনওদিনই আমার সব জানতে পারবে না।
–সেটা মামা স্বীকার করে না। কিন্তু বোঝে। তাই আমাকে লাগিয়েছে মামা। তার বিশ্বাস, আমি তোমাকে বুঝব। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে আমি এখন পাক্কা জেমস বন্ড হয়ে গেছি।
বীরু হাসল। মসৃণ কামানো গালে জ্যোৎস্না ঝিকিয়ে ওঠে একটু।
–তুমি কী বুঝলে? শান্ত স্বরে জিগ্যেস করে বীরু।
–কিছু না।
–কী বুঝতে চাও?
–তুই ওষুধ কিনছিস কেন? ও সব ওষুধ প্রেসক্রিপশন ছাড়া খাওয়া খুব ডেঞ্জারাস।
আজকাল সব ওষুধের পোটেন্সি এত কমিয়ে দেয় ওরা যে কাজ হয় না।
ধীরে ধীরে হেঁটে বীরু একটু দুরে যায়। আবার দুলে দুলে কাছে আসে। মনোরমের ভয় হয়, বুঝি বীরু জ্যোৎস্না আর কুয়াশায় হঠাৎ মিলিয়ে যাবে।
বিয়ে করবি না বীরু?
—করব হয়তো কখনও।
–গৌরীকে করিস।
বীরু হাসল। বলল–তুমিই গৌরীর প্রেমে পড়ে গেছ।
-বোধহয়। তুই বলেছিলি কষ্ট হওয়াকেই ভালবাসা বলে। আমারও কষ্ট হয় ওই মেয়েটার জন্য।
–বিয়ে করে কী হবে?
–আমি তোর অনেক কিছু নকল করেছি বীরু। পোশাক, চুল, জুলফি, গাড়ির স্পিড। তোর পিছু নিয়ে নিয়ে তোর কাছে শিখেছি অনেক। কেবল তোর জুয়েলটিটা শিখতে পারছি না। তুই এ মেয়েটাকে ভাল না বেসে পারিস কী করে?
টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আকাশে তাকিয়ে থাকে বীরু। প্যান্টের পকেটে দুই হাত। একটুক্ষণ স্থির থাকে।
–আমি খুব নিষ্ঠুর?
–মনে হয়।
–ইদানীং আমি খুব নেশা করছি। গাঁজা, আফিং, এল-এস-ডি, কিছু বাকি নেই। কিছু হয় না তাতে।
–কেন করছিস?
টু ফরগেট সামথিং।
–কী?
–তুমি আমাকে নিষ্ঠুর বলছ? কেন? তুমি আমার কতটুকু জানো?
–কিছুই না। বীরু, আমার মনে হচ্ছে দিনে দিনে তুই আমার আরও অচেনা হয়ে যাচ্ছিস। এখনই তোকে আমার পৃথিবীর মানুষ বলে মনে হচ্ছে না, যেন বা তুই অন্য গ্রহের লোক। আমি তোর মতো হার্টলেস হতে চাই। আমাকে শিখিয়ে দে।
বীরু হাসে। যথারীতি কোমল জ্যোৎস্নার লাবণ্য ওর কেঠো মসৃণ গালে এক ফোঁটা মোমের মত ঝরে পড়ল। বলল-কেন হার্টলেস হতে চাও?
মনোরম বলে–আমরা কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম করলে পাগল হতাম। এখনও দ্যাখ, বউয়ের দুঃখ ভুলতে পারি না। তুই কত মেয়েকে ভুলে যাস, আমি একজনকেই পারি না।
–আমি একটা জিনিস ভুলতে পারছি না।
–কী?
যাদবপুর রেল স্টেশনে এক বান্ধবীকে তুলতে গিয়েছিলাম গাড়িতে, ট্রেনের দেরি ছিল, কথা বলছিলাম দুজনে। ভালবাসার কথা। নকল কথা সব। লাইক কসমেটিকস। ঘুরতে ঘুরতে স্টেশনের একদিকে শেড-এর তলায় গেছি, বান্ধবীটি হঠাৎ দুপা সরে এসে বলল-মাগো, ওটা কী? দেখলাম, একটা বাচ্চা ছেলে শুয়ে আছে ভিখিরিদের বিছানায়। এত রোগা যে ভাল করে না নজর করলে দেখাই। যায় না। ঠিক কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো দুখানা হাত নোংরা কাঁথার তূপ থেকে শূন্যে উঠে একটু নড়ছে, অবিকল সেইরকমই দুখানা পা। এত নির্জীব যে খুব ধীরে ধীরে একটু একটু নড়ে, আবার কাঁথায় লুকোয়। তার গায়ের চামড়া আশি-নব্বই বছরের বুড়োর মতো কোঁচকানো, দুলদুল করছে। হিউম্যান ফর্ম, কিন্তু কী করে বেঁচে আছে বোঝা মুশকিল। চমকে যাই যখন দেখি, তার উরুর ফাঁকে রয়েছে। পিউবিক হেয়ার, পুরুষাঙ্গ। বাচ্চা ছেলের তো পিউবিক হেয়ার থাকার কথা নয়। একটা উলোঙ্কুলো বুড়ি বসে উকুন মারছিল, সে নিজে থেকেই ডেকে বলল–ষোলোবছর বয়স বাবু, রোগে ভুগে ওই দশা। ছেলেবেলা থেকেই বাড়ন নেই।–কিছুই না ব্যাপারটা, কিন্তু সেই থেকে ভুলতে পারি না।
–কেন বীরু?
-কী জানি! কলকাতায় ভিখিরি-টিকিরি তো কত দেখেছি! কত কুঠে, আধমরা, ডিফর্মড। কিন্তু এটা কিছুতেই ভুলতে পারি না। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, চমকে উঠি। পিউবিক হেয়ার সমেত একটা বাচ্চা তার কাঁকড়ার মতো হাত পা নাড়ছে। ভীষণ ভয় করে। যত দিন যাচ্ছে, তত সেঁটে বসে যাচ্ছে ছবিটা মনের মধ্যে। কী যে করি!
মনোরম কী বলবে! চুপ করে থাকে।
বীরু মহাকাশচারীর মতোই চাঁদের মাটিতে হাঁটে। ভ্রূ কুঁচকে বলে–বুদ্ধদেব যেন কী কী দেখেছিল? বার্ধক্য, রোগ, মৃত্যু আর সন্ন্যাস, না?
–বোধহয়।
–পিউবিক হেয়ার সমেত বাচ্চা ছেলের ফর্ম দেখলে বুদ্ধদেব কী করত বলো তো?
কী জানি!
–পাগল হয়ে যেত। কিন্তু আমি কী করি? কী করি বলো তো?
–কী করবি?
–ভাবছি। আস্তে আস্তে অপ্রাকৃত চাঁদের আলোয় ঘুরে বেড়ায় সাদা দীর্ঘ অবয়ব। আস্তে করে বলে–নিষ্ঠুর নই, বুঝেছ? বাড়ি যাও।