–আর কিছুদিন থাক ঝুমু। আমার জন্যই থাক।
–আমার বাড়িভাড়াটা এখনও বাকি পড়ে আছে মামা।
–আজই নিয়ে যাস। ভূপতিকে বলে রাখছি। থাকবি? কিছুদিন?
–দেখি। বিশ্বাসকে একটা খবর দিয়ে দিতে হবে। ওরও স্ট্রোক, খুব ভেঙে পড়েছে। সময় দিতে চাইছে না।
–ওই বিপদের ব্যবসাতে কেন যাবি ঝুমু?
–কিছু তো করতেই হবে মামা। ওপনিং কোথায়? বাজার তো দেখছ! তা ছাড়া বিপদই বা কী, সবাই করছে।
মামা খুব গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আস্তে করে বলে–তোর সঙ্গে তো তেমন সম্পর্ক ছিল না আমার। আজকাল আত্মীয়তার গিট তো আলগা হয়েই যাচ্ছে। কিন্তু এ কদিনে তোর ওপর আমার মায়া পড়ে গেছে ঝুমু। তুই চলে যাবি ভাবলে বুকটা কেমন করে। আমি কেবল তোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করলাম। তোর দিকটা ভাবিনি। ঝুমু, তোর জন্য কী করব বল তো?
কী করবে? আমার খুব অসময়ে তুমি আমার জন্য অনেক করেছ। ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল।
–স্ট্রোক-ফোক হলে ওই সেন্টিমেন্টটা খুব বেড়ে যায়, জানিস? ভীষণ বেড়ে যায়। স্ট্রোক হচ্ছে গাড়ি ছাড়বার ফাস্ট ওয়ার্নিং, তখনই মানুষ গাড়ির জানালা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বেশি করে আত্মীয়দের মুখ দেখে নেয়।
-চুপ করো। বিরক্ত হয়ে মনোরম উঠে যায়। কাঠগোলার পিছনে একটু পরিষ্কার জায়গায় গিয়ে সিগারেট ধরায়। করাতকলের মিষ্টি ঘসটানো শব্দটা আসে।
.
বর্ষা যায়। শরৎ যায়। শীত আসি-আসি করে। বিশ্বাস ফোনে তার ফিসফিস স্বরে বলে–ব্যানার্জি, আর কত সময় নেবেন? আমি আর পারছি না।
আর কটা দিন, বিশ্বাস। মনোরম বলে–আর একটু সময় দিন।
সময় কে কাকে দেয় মশাই! সময়ের কি ট্রানজাকশন হয়? সময় ফুরোয়। ব্যানার্জি, একটা ফাইনাল কিছু বলুন। অন্য লোক নিতে ভরসা হয় না। এ ব্যবসাতে ফেইথফুল তোক না হলে..আমি আর কত অপেক্ষা করব ব্যানার্জি? টেল সামথিং।
একটু, আর একটু…
.
আজকাল প্রায় একটা জিনিস লক্ষ করে মনোরম। বীরু মাঝে মাঝে তার ফিয়াট দাঁড় করায় ওষুধের দোকানের সামনে। কী যেন কিনে আনে, তারপর আবার গাড়ি ছাড়ে। প্রায় দিনই, প্রতিদিনই বীরু আজকাল কাটা করে।
কী কেনে ও? ঘুমের ওষুধ নয় তো!
মনোরম সতর্ক হতে থাকে। একদিন বীরু ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে গাড়ি ছাড়ল। মনোরম গাড়ি থেকে নেমে ঢুকল দোকানটায়।
একটু আগে যে লম্বা ছেলেটা এসেছিল, ও কিছু কিনল?
কাউন্টারের আধবুড়ো লোকটা কাগজ পড়ছিল। মুখ তুলে একটু বিস্ময়ভরে বলে।
কী?
–অনেকগুলো ট্রাংকুলাইজার, কয়েকটা ঘুমের ওষুধ, নিউরোসিসের জন্য কয়েক রকমের বড়ি।
প্রেসক্রিপশন?
–ছিল না। এ সব কিনতে আজকাল আর প্রেসক্রিপশন লাগে না। সবাই নিজের নিজের ডাক্তার।
অসুখটা কী?
লোকটা মাথা নাড়ল–কে জানে মশাই! জিজ্ঞেস করছেন কেন?
কারণ আছে। ও একটু ডিসব্যালান্সড।
লোকটা নিজের নাকটা মুঠোয় ধরে বলল–এ সব ড্রাগই আজকাল মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হচ্ছে। রোগটা বোধহয় পাগলামি। দেশে পাগল বাড়ছে।
মনোরম বেরিয়ে আসে। আকাশ ভরা রোদ। এখন হেমন্তকাল। কলকাতা এখন পাখির বুকের মতো কবোষ্ণ। গাড়ি চালিয়ে চালিয়ে তার কাঁধে ব্যথা, কোমর ধরে আছে, মাথা ভার। হেমন্তের সুন্দর আলোতে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় একটু হেঁটে বেড়াতে পারলে বেশ হত। কিন্তু জগদ্দল গাড়িটা রয়েছে সঙ্গে আর সামনে উধাও বীরু।
ক্লান্তভাবে আবার গাড়িতে ওঠে সে। ছাড়ে। ক্লান্তিহীন বীরু কি ধরা পড়ল বয়সের হাতে? নাকি অসুখ? কিংবা কর্মফল? ওষুধ কিনছে। পাগলামির ওষুধ, নার্ভের ওষুধ, ঘুমের ওষুধ! বড় অবাক কাণ্ড। মনোরমের ভ্রূ কুঁচকে যায়। চিন্তিতভাবে সে চেয়ে থাকে সামনের রাস্তায়। চলন্ত গাড়িটা গিলে ফেলছে রাস্তাকে।
.
রাতে খুব জ্যোৎস্না ফুটেছে আজ। সেটা টের পাওয়ার কথা নয়। বীরুর পিছু পিছু অনেক রাত পর্যন্ত ধাওয়া করে করে অবশেষে প্রায় রাত সাড়ে বারোটায় বীরুর গাড়ি ঢুকল রিচি রোডে। তখন লোডশেডিং। সেই অন্ধকারে হঠাৎ বানডাকা জ্যোৎস্না দেখতে পেল মনোরম।
অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বীরু গাড়ি দাঁড় করাল না আজ। একটু এগিয়ে গেল। বাঁ ধারে একটা মস্ত ফাঁকা পার্ক। হিম পড়েছে। কেউ কোথাও নেই। বীরু নামল। দুধের মতো সাদা পোশাক পরেছে বীরু। সাদা ঢিলে বুশশার্ট, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো। জ্যোৎস্নায় ওর লম্বা, সাদা অবয়বটা অপ্রাকৃত দেখায়।
গাড়ি ফেলে রেখে বীরু লম্বা পায়ে রেলিং ডিঙিয়ে পার্কে ঢুকল। খুব ধীরে হাঁটছে। মাঠের মাঝখানে চলে গেল। দাঁড়াল। আড়মোড়া ভাঙছে। স্লো-মোশন ছবির মতো নড়াচড়া করছে। জ্যোৎস্নায় এবং কুয়াশায় একটু আবছা। গাড়ির অন্ধকারে বসে মনোরম দেখতে থাকে। বীরু এক-পা এক-পা করে দৌড়ে ক্রিকেটের বোলারের মতো হাত ঘোরাল। ব্যাটসম্যানের মতো মারল বল। দু পায়ে একটি জটিল দ্রুত নাচ নেচেই থেমে যায়। ডিসকাস ছোঁড়ার ভঙ্গি করে। তারপর ধীরে, খুব ধীরে হাঁটে, ঠিক যেমন চাঁদের মাটিতে নীল আর্মস্ট্রং হেঁটেছিল। ঘুরে দাঁড়ায় আবার। স্পষ্ট দেখা যায় না, কিন্তু মনে হয় যেন চেয়ে আছে মনোরমের গাড়ির দিকেই। দেখছে।
মনোরম গাড়ির দরজা খুলে নামল। গরম জামা পরেনি, একটু শীত করে। রেলিংটা টপকায় মনোরম। হাঁটতে থাকে। কী জ্যোৎস্না, কী জ্যোৎস্না! নীলাভ হলুদ কুয়াশায় মাখা স্বপ্নের আলো। সেই আলোতে ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা অপরিচিত মানুষের মতো লম্বা সাদা অবয়ব বীরুর। স্থির দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে মহাকাশের সাদা পোশাক।