দুজনে আবার ঢুকে যাচ্ছিল রেস্তরাঁয়। বিশ্বাস ঘাড় ঘুরিয়ে বলল–আচ্ছা ব্যানার্জি, বাই।
মনোরম হাতটা তুলল। তারপর পার্ক স্ট্রিট ধরে হাঁটতে লাগল পশ্চিমমুখো।
ময়দানের ধার ঘেঁষে দক্ষিণমুখো ট্রামগুলো দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি। এতক্ষণ লোকজন বৃষ্টির জন্য আটকে ছিল গাড়িবারান্দায়, দোকানঘরে, বাসস্টপের শেড-এ এখন সব সরষেদানার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে চারধারে। ট্রাম বন্ধ, বাসে তাই লাদাই ভিড়। হাতে পায়ে চুম্বকওয়ালা কলকাত্তাই লোকেরা বাসের গায়ে সেঁটে আছে অবলীলায়। বাসের গা থেকে অন্তত তিন হাত বেরিয়ে আছে মানুষের নশ্বর শরীর।
মনোরমের ঠিক এক্ষুনি কোথাও যাওয়ার নেই। যতক্ষণ বিয়ারের গন্ধ শরীরে আছে ততক্ষণ গড়িয়াহাটার কাছে মামার কাঠগোলায় ফেরা যাবে না। বৃষ্টির পর এসপ্লানেড এখন ভারী ঝলমলে, রঙিন শো-উইনডোতে দোকানের হাজার জিনিস, রঙিন পোশাকের মানুষ, রঙিন বিজ্ঞাপন। টেকনিকালার ছবির মতো চারদিকের চেহারা এখন ধুলোটে ভাবটা ধুয়ে যাওয়ার পর। কাজ না থাকলেও এসপ্লানেডে ঘুরলে সময় কেটে যায়।
রাস্তা পার হয়ে মেট্রোর উল্টোদিকে ট্যাক্সির চাতালে তখন উঠে-যাওয়া পসাবিরা দ্রুত ফুচকার ঝুড়ি, ভেলপুরির বাক্স, ছুরি কাঁচি কিংবা মনোহারি জিনিস সাজাচ্ছে। ট্রাম টার্মিনাসে দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁকা ট্রাম। তারই একটাতে উঠে একটুক্ষণ ঝুম হয়ে বসে থাকবে ভেবেছিল মনোরম। ফুটপাথ ছেড়ে ইট বাঁধানো চাতালটায় নামতে গিয়েও সে বাড়ানো পা টেনে নিল। সীতা না?
সীতাই। সোনা রঙের মুর্শিদাবাদি শাড়ি পরনে, ডান হাতে ধরা দু-একটা কাগজের প্যাকেট বুকে। চেপে সাবধানে হাঁটছে। বাঁ হাতে শাড়িটা একটু তুলে পা ফেলছে। মাথা নোয়ানো। পাতলা গড়ন, ছিপছিপে ছোট্ট সীতা। নরম মুখশ্রী, কাগজের মতো পাতলা ধারালো ছোট্ট নাক, লম্বাটে মুখখানা, ছোট্ট কপাল, চোখের তারা দুটি ঈষৎ তাম্ৰাভ, মাথার চুল বব করা। বেশ একটু দূরে সীতা, ওর মুখখানা সঠিক দেখতে পেল না মনোরম। কিন্তু দূর থেকে দেখেই সবটুকু সীতাকে মনে পড়ে গেল। ছয় সাত বছর ধরে সীতার সবটুকু দেখার কিছুই তো বাকি ছিল না। আশ্চর্য কার্যকারণ! একটু আগে বিয়ারের বোতল সামনে নিয়ে সে হোঁতকা বিশ্বাসটার কাছে সীতার কথা বলছিল।
একটা রগ মাথার মধ্যে ঝিনন করে চিড়িক দেয়। মনোমে গাছের মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখে, কী সুন্দর অপরূপ রোদে সীতা একটু ভেঙে নয়ে মহার্ঘ মানুষের মতো হেঁটে চলেছে। সব জায়গা থেকে হঠাৎ সূর্যরশ্মিগুলি থিয়েটারের আলোর মতো এসে ওকে উদ্ভাসিত করে। পিছনে মরা গাছ, মেঘলা আকাশ, এসপ্লানেড ইস্টের বাড়ির আকাশরেখা, চার দিকে ফড়ে, দালাল, দোকানির আনাগোনা। কিন্তু আবহের আলো এই ভিড়ে কেবলমাত্র সীতাকেই উদ্ভাসিত করে। সোনালি শাড়িটা আগাগোড়া সোনালি, কোথাও কোনও কাজ নেই, আঁচল নেই, সোনালি ব্লাউজ, পায়ে কালো সরু স্ট্রাপের চপ্পল সবটুকু ঝলসায় এই রোদে, কিংবা বোদই ঝলসে ওঠে ওকে পেয়ে? পেটে অঢেল বিয়ার, তাই ঠিক বুঝতে পারে না মনোরম। তলপেটটা জলে ভারী হয়ে টনটন করছে, একটা কেমন গরমি ভাপ বেরোচ্ছে শরীর থেকে, আকণ্ঠ তেষ্টা। ভিখিরি যেমন ঐশ্বর্যের দিকে তাকায়, তেমনি অপলক তাকিয়ে থাকে মনোরম। মনে হয় এই সীতাকে সে কখনও স্পর্শ করেনি।
কোথায় যাচ্ছে সীতা? কোথায় এসেছিল? বোধহয় বেহালার ট্রাম ধরতেই যাচ্ছে। ওদিকের ট্রাম চালু আছে কি? চালু থাকলেও এই ভিড়ে উঠতে পারবে তো সীতা? ভাবল একটু মনোরম।
সীতা ট্রাম লাইন বরাবর হেঁটে গেল। একটু দাঁড়াল, চেয়ে দেখল দু’ধারে। তারপর দুটো থেমে থাকা ট্রামের মাঝ দিয়ে সুন্দর পদক্ষেপের বিভঙ্গ তুলে ওপাশে চলে গেল। দৃশ্যের শেষে যেমন মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়, নেমে আসে পর্দা, তেমনই হয়ে গেল চারধার। কিছু আর দেখার রইল না।
মনোরম চলল চাতালটা পেরিয়ে গোলঘরের দিকে। তীব্র অ্যামোনিয়ার গন্ধের ভিতরে দাঁড়িয়ে পেচ্ছাপ করল। এবং বেরিয়ে আসার পর টের পেল, ভীষণ একা আর ক্লান্ত লাগছে। কোথাও একটু যাওয়া দরকার এক্ষুনি। কারও সঙ্গে কথা বলে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থাকা দরকার। সীতাকে দেখার ধাক্কাটা সে ঠিক সামলাতে পারছে না। সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না যে, সে সত্যিই সীতাকে দেখেছে। এমন আচমকা হঠাৎ কেন যে দেখল। দেখল, কিন্তু দেখা হওয়া একে বলে না।
আকাশ আজ খেলছে। দ্রুত গুটিয়ে নিল রোদের চাদর। বৃষ্টিটা চেপে আসবে। দু-চারটে চড়বড়ে ফোঁটা মনোরমের আশেপাশে যেন হেঁটে গেল। ততক্ষণে অবশ্য মনোরম লম্বা পা ফেলে জোহানসন অ্যান্ড রোর অফিস বাড়িটায় পৌঁছে গেছে।
পুরনো সাহেবি অফিস। বাড়িখানা সেই সাহেব আমলের গথিক ধরনের। শ্বেতপাথরের মতো সাদা রং, বৃষ্টিতে ভিজেও শুভ্রতা হারায়নি। সামনে খানিকটা সবুজ সযত্নরচিত জমি, শেকল দিয়ে ঘেরা। বাঁকা হয়ে ড্রাইভওয়ে ঢুকে গেছে। সার সার গাড়ি দাঁড়ানো। তার মধ্যে সমীরের সাদা গাড়িটা দেখল মনোরম। অফিসেই আছে।
চমৎকার কয়েকটা থামে ঘেরা পোর্টিকো পেরিয়ে রিসেপশনের মুখোমুখি হওয়ার আগে মনোরম আকাশটা দেখল। গির্জার ওপর ক্রশচিহ্ন, তার ওপাশে আকাশটা সাদা বৃষ্টির চাদরে ঢাকা। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। সীতা ট্রামে উঠেছে? না হলে ভিজবে। খুব ভিজবে।