- বইয়ের নামঃ দিন যায়
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. সীতাকে বহুকাল বাদে
০১.
সীতাকে বহুকাল বাদে দেখল মনোরম।
দেখল, কিন্তু দেখা-হওয়া একে বলে না। দুপুরে উপঝরণ বৃষ্টি গেছে। তারপর মেঘভাঙা রোদ উঠেছে। সমস্ত কলকাতা জলের আয়না হয়ে বেলা চারটের রোদকে ফেরত দিচ্ছে। ভবানীপুরের ট্রাম বন্ধ, চৌরঙ্গির মুখে জ্যাম। সবকিছু থেমে আছে, রোদ ঝলসাচ্ছে, ভ্যাপসা গরম। মনোরমের পেটে ঠাণ্ডা বিয়ার এখন দুর্গন্ধ ঘাম হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে। লক্ষৌয়ের কাজ করা মোটা পাঞ্জাবি আর বিনির টেরিকটন স্ট্রাইপ বেলবটম প্যান্টের ভিতর মনোরম নিজের শরীরে কয়েকটা জলধারা টের পাচ্ছে। গরম, পচা, লালচে ঘাম তার। সীতা রাগ করত।
বিয়ারটা খাওয়াল বিশ্বাস। নতুন কারবার খুলেছে বিশ্বাস। ভারী নিরাপদে কারবার, ক্যাপিট্যাল প্রায় নিল। কলকাতার বড় কোম্পানিগুলোর ক্যাশমেমো ব্লকসুদু ছাপিয়েছে, সিরিয়াল নম্বর-টম্বর সহ। ব্যবসাদার বা কন্ট্রাক্টররা আয়কর ফাঁকি দিতে বিস্তর পারচেজ দেখায়। সেইসব ভুয়ো পারচেজের জন্য এইসব ভুয়ো রসিদ। মাল যদি না কিনে থাক তবে কন্ট্যাক্ট বিশ্বাস। হি উইল ফিক্স এভরিথিং ফর ইউ। যত টাকার পারচেজই হোক রসিদ পাবে, এন্ট্রি দেখাতে পারবে। সব বড় বড় কোম্পানির পারচেজ ভাউচার। বিশ্বাস এক পারসেন্ট কি দু পারসেন্ট নেবে। তাতেই অঢেল, যদি ক্লায়েন্ট আসে ঠিকমতো।
কিন্তু কারবারটার অসুবিধে এই যে, বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় না। হাশ পাবলিসিটি। লোকে জানবে কী করে যে কলকাতার কোন গাড্ডায় বিশ্বাস বরাভয় উঁচিয়ে বসে আছে উদ্বিগ্ন আয়করদাতাদের জন্য? যে সব চেনা লোক কলকাতার বাজারে চালু আছে, তাদেরই বলে রাখছে সে। কমিশন দেবে।
–দিস ইজ দি জিস্ট ব্যানার্জি। বিশ্বাস বলল–এবার ইন্টারেস্টেড মক্কেলদের টিপসটা দেবেন।
মনোরম কলকাতার ঘুঘু। শুনে-টুনে মৃদু একটু হাসল, বলল–বিশ্বাস, এর চেয়ে চিট ফান্ডের ব্যবসা করুন। এটা পুরনো হয়ে গেছে। কলকাতায় অন্তত ত্রিশটা রসিদ কোম্পানিকে আমি চিনি।
বহুকাল আগে একটা ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়েছিল মনোরম। শরীরে কাটাছেঁড়াগুলো মিলিয়ে গেছে, ভাঙা হাড় জুড়ে গেছে। কেবল জিভটাই এখনও ঠিক হয়নি। দাঁত বসে গিয়ে জিভটা অর্ধেক নেমে গিয়েছিল। জোড়া লেগেছে বটে, কিন্তু কথা বলার সময়ে থরথর করে কাঁপে। কথাগুলো একটু এড়িয়ে এড়িয়ে যায়। কিন্তু তাতে আত্মবিশ্বাস এতটুকু কমেনি মনোরমের।
বিশাল থলথলে চেহারার বিশ্বাস উত্তেজনায় চেয়ারে নড়ে বসল। মোকাঘোর মজবুত চেয়ার তাতে একটু নড়বড় করে। প্রকাণ্ড গরম শ্বাস ফেলে বিশ্বাস বুকে মুগুরের মতো দুখানা হাতের কনুই দিয়ে ভর রাখল টেবিলের ওপর। বলল ব্যানার্জি, আমার তিন মাসের ব্যবসাতে কত লাভ হয়েছে জানেন?
কত?
বিশ্বাস শুধু মুখটা গম্ভীরতর করে অবহেলায় বলে–হু।
মনোরম বলল কিন্তু কম্পিটিশন তো বাড়ছে এ কারবারেও!
ট্যাক্স পেয়ার কি কমে যাচ্ছে? জোরি কমেছে? যতদিন এদেশে প্রাইভেট সেক্টরে ব্যবসা থাকবে, ততদিন আমারও ব্যবসা থাকবে। এর মধ্যেই আমার ক্লায়েন্ট তিনশো ছাড়িয়ে গেছে, দু-আড়াই লাখ টাকার রসিদ ইস্যু হয়েছে। অ্যান্ড উইদাউট মাচ পাবলিসিটি। আপনার স্বভাব হচ্ছে সব ব্যাপারের নৈরাশ্যের দিকটা দেখা। ভেরি ব্যাড।
বিশ্বাস ঠিক বলেনি। মনোরমের এটা স্বভাব নয়। নৈরাশ্যের দিকটা সে কখনও দেখে না।
বিশ্বাস বিয়ার খায় সরাসরি বোতল থেকে। বোতলের শেষ কয়েকটা ফোঁটা গলায় ঢেলে আবার নতুন বোতলের অর্ডার দিল। তারপর তেমনি মনোরমের মুখে ঝোড়ো লুবাতাসের মতো খাস ফেলে বলল-দেন?
মনোরম কিছুক্ষণ এক ঢোঁক বিয়ার মুখে নিয়ে তিতকুটে স্বাদটায় জখম জিভটা ডুবিয়ে রাখল। মুখের ভিতরে ঠিক যেন একটা জিওল মাছ নড়ছে। গিলে ফেলল বিয়ারটা। আস্তে করে বলল–কত কমিশন?
–আমার কমিশন থেকে টুয়েন্টিফাইভ পারসেন্ট দেব।
–আর একটু উঠুন।
–কত?
ফিফটি।
বিশ্বাস ভ্রূ তুলল না, বিস্ময় বা বিরক্তি দেখাল না। একটু হাসল কেবল। বিশ্বাস পঁয়তাল্লিশ পেরিয়েছে। তবু ওর দাঁতগুলো এখনও ঝকঝকে। নতুন বোতলটা তুলে নীরবে অর্ধেক শেষ করল। তারপর নিরাসক্ত গলায় বলল-ফিফটি! অ্যাঁ?
-ফিফটি।
ব্যানার্জি, আমি যেমন প্রফিট করি তেমন রিস্কটা আমারই। ইনকাম ট্যাক্স নিয়ে গভর্নমেন্ট কী রকম হুজ্জত করে আজকাল জানেন না? যদি ধরা পড়ি তো মোটা হাতে খাওয়াতে হবে নয়তো শ্বশুরাল ঘুরিয়ে আনবে। আমার প্রফিটের পারসেন্টেজ সবাই চায়, রিস্কের পারসেন্টেজ কেউ নেয় না। এটাই মুশকিল।
বিশ্বাস তেমন ঝোড়ো বাস ছাড়ে। ওর নাকের বড় বড় লোমের গুছি বের হয়ে আসে। গালের দাড়ি অসম্ভব কড়া, তাই রোজ কামালেও গালে দাড়ির গোড়া সব গোটার মতো ফুটে আছে। ঘন জ্ব। আকাশি রঙের বুশ শার্টের বুকের কাছ দিয়ে কালো রোমশ শরীর দেখা যায়। গলায় সোনার চেন-এ সাঁইবাবার ছবিওলা ছোট্ট লকেট।
মনোরম মুখে বিয়ার নিয়ে নড়ন্ত জিভটাকে ডুবিয়ে রাখে বিয়ারে। মুখের ভিতরে একটা চুকচুক শব্দ হতে থাকে। শালার জিভটা নড়ছে অবিকল ছোট্ট মাছের মতন।
রসিদের কারবারটা মনোরমের কাছে ছেলেমানুষির মতো লাগে। সে আস্তে করে বলল আজকাল ফলস রসিদ টিকছে না। স্পটে গিয়ে এনকোয়ারি হয়, কোম্পানি নিজেদের সিরিয়াল নম্বর দেখে বলে দেয় যে, রিয়্যাল পারচেজ হয়নি। তখন মর্কেলরা ঝোলে।