কোন অজ্ঞাত কারণে ছুটির দিনে আজকাল তিন ভাই-বোন একজোট হয় তাদের মৃত বাবার ঘরে। সেখান থেকে তারা তিনটে রন্ধ্রপথে উদাস দৃষ্টিতে বাইরে চেয়ে থাকে। দুটো জানালায় দুই বোন, দরজায় বুক্কা।
বুক্কাই চাপা গলায় বলে উঠল, ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্ট!
শুনে ছুটে এল সঞ্চারি। তিথি ধীর পায়ে এসে কপাটের পাশে দাঁড়াল।
পুরুষটি বেশ লম্বা, পরনে হালকা ক্রিম রঙের সাফারি সুট। গায়ে একটু বেশি চর্বি থাকায় বোধহয় লোকটার শীতবোধ কম। এই শীতেও তাই গায়ে কোনো গরম জামা নেই। তবে সাফারি সুটটা গরম কাপড়ের হতেও পারে। ভুড়িটি যথেষ্ট নজরে পড়ার মতো। ভদ্রমহিলার গায়ে একখানা খুব সূক্ষ্ম সুতোর কাজ করা শাল, যার একটা আঁচল ধুলোয় লুটোচ্ছে। কেউই ব্যগ্র নয় বাড়ি দেখতে। ভঙ্গি কিছুটা ক্যাজুয়্যাল। বড়োলোকদের ঠিক এরকমই হওয়ার কথা। বিষয়বস্তু দেখে দেখে তাদের চোখ পাকা এবং উদাস।
বুক্কা বলল, ওরা নিশ্চয়ই বাড়িটা ঘুরে দেখবে!
সঞ্চারি বলে, দেখতেই তো এসেছে। পছন্দ হবে?
হবে না! কেমন বাড়ি আমাদের! দক্ষিণ খোলা, এত আলো বাতাস, কতগুলো ঘর, দুটো ব্যালকনি, বাগান! তার ওপর সার্ভেন্টস কোয়ার্টার।
বুক্কা শুধু গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলে, এভরিথিং এ ম্যান ক্যান ওয়ান্ট ফ্রম এ হাউস। কত দাম দেবে বল তো! ফিফটিন ল্যাকস?
কে জানে বাবা! অত টাকা জন্মেও দেখিনি। বাবার কাছে শুনেছি বাড়িটা করতে লাখ চারেক টাকা খরচ হয়েছিল।
তখন টাকার দাম বেশি ছিল। তাই খরচ হয়েছিল কম।
কোকিলটা কি তার শেষ ডাক ডাকছে? উৎকর্ণ হয়ে শুনছিল তিথি। খুব ডাকছে আজ। গলার রক্ত তুলে ডাকছে যেন।
হঠাৎ বুক্কা তার দিকে ফিরে বলে, মার ঠিক কত টাকা দরকার বল তো।
তিথি ঠোঁট উলটে বলে, কে জানে।
–আমার পিগি ব্যাংকে কিছু আছে। আর দুটো আংটি। আর টেনিস র্যাকেট। তোদের কী আছে? দিদিরও পিগি ব্যাংক আছে, ব্যাংকে একটা অ্যাকাউন্টও।
-হ্যাঁ। কেন?
–যদি সব আমরা মাকে দিয়ে দিই?
–তাহলেও হবে না। আমাদের দেনা কয়েক লাখ টাকার।
–ওঃ, কেউ যদি দিত, টাকাটা এমনিতেই।
—কে দেবে? আমাদের কেউ নেই।
সোমনাথের পিছু পিছু আগন্তুক হবু ক্রেতা সস্ত্রীক দোতলায় উঠে গেল।
মান্য অতিথিরা আসবে বলে আজ একটু সেজেগুজে তৈরি ছিল মিলি। পরনে সবুজ সিল্কের শাড়ি, চুল পরিপাটি খোঁপায় বাঁধা, মুখে সামান্য প্রসাধন। গায়ে একখানা সবুজ শাল জড়ানো। আগন্তুক পুরুষটি বোধহয় দেশে ও বিদেশে সুন্দরী মেয়ে অনেক দেখেছে, তবু এই ছোটোখাটো মহিলার প্রখর সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়ে একটু থমকাল। যেন প্রত্যাশিত ছিল না। মিলি বাংলাতেই বলে, এই আমাদের বাড়ি। অনেক কষ্ট করে করা। দেখুন যদি পছন্দ হয়।
মিলির গলায় কোনো উৎসাহ নেই, মুখে দীপ্তি নেই। বিষয়ী পুরুষটি তত সূক্ষ্ম বোধসম্পন্ন নয় যে এইসব লক্ষ ও অনুধাবন করবে। এই বাড়ির জড় শরীরে কতখানি ভালোবাসা আর মায়া ঢুকে আছে তা বুঝবার মতো বুঝদার কে-ই বা আছে?
বাসন্তী কফি নিয়ে এল, ঠিক যেমন শেখানো ছিল, ওরা সোফায় বসবার ঠিক দু-মিনিটের মাথায়।
লোকটা কম কথার মানুষ। কফির সুদৃশ্য চীনা ডৌলের পেয়ালাটির দিকে একবার মাত্র উদাস দৃষ্টিক্ষেপ করে বেশ নরম গলায় বলল, আই নো ইটস এ গুড হাউস। ইউ বিল্ট ইট ফর ইয়োরসেলফ।
বলে নিজের স্ত্রীর দিকে একবার তাকাল। তারপর একটু উদাস হয়ে গেল।
সোমনাথ তদগতভাবে লোকটির মুখপানে চেয়েছিল। বলল, ইটস রিয়েলি এ গুড হাউস। অল ফার্স্টক্লাস হ্যাণ্ডপিকড ফিটিংস।
দোকানদারেরা যেভাবে নিজের জিনিসের গুণ গায় সোমনাথের গলাটা অবিকল সেরকম শোনালো মিলির কানে। মনে মনে সে বিরক্ত হচ্ছে। অস্থির করছে তার বুকটা। অভিমানে ভরে যাচ্ছে সর্ব অঙ্গ। চোখে জল আসছে।
মহিলা উঠল। মুখে বিনয়ী হাসি। নাকে হিরের নাকছাবি সামান্য ঝিকিয়ে উঠল। বলল, আপনার বাড়িটা একটু ঘুরে দেখব?
মিলিকে জড়তা কাটিয়ে উঠতে হল।
মহিলা নিষ্ঠাবতী। পায়ের দামি চপ্পলজোড়া ছেড়ে রেখে বলল, আপনার ঠাকুরঘরটা কোথায়? আগে প্রণাম করব।
ঠাকুরঘর! মিলি অসহায়ভাবে চারদিকে একবার চেয়ে দেখে বলল, ঠাকুরঘর তো নেই!
মহিলা একটু যেন অবাক হয়ে বলে, ঠাকুরঘর নেই? আপনারা হিন্দু নন?
মিলি তাড়াতাড়ি বলে, হ্যাঁ, তবে ঠাকুরঘর তো করা হয়নি।
মহিলা হেসে বলে, নাস্তিক? বাঙালিরা খুব নাস্তিক হয়।
–না। আমরা ঠিক নাস্তিকও নই। আসলে ওসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
মহিলার মুখশ্রী থেকে বিনয়ের ভাবটা গেল না বটে, তবে যেন একটু হতাশার ভাব যুক্ত হল।
বাড়ি দেখানোর কোনো উৎসাহ ছিল না মিলির। নিঃশব্দে শুধু ঘর থেকে ঘরে, ব্যালকনিতে, ছাদে হেঁটে হেঁটে সঙ্গ দিল। কিছুই ব্যাখ্যা করল না, বাড়ির গুণকীর্তন করল না।
নীচের ঘরে এসে মহিলা বলে, এরা আপনার ছেলে-মেয়ে?
তিন গম্ভীর, বিষণ্ণ, শক্ত হয়ে থাকা কিশোর-কিশোরীর দিকে চেয়ে মিলি বলে, হ্যাঁ।
–আর এই ঘরেই তো–?
মিলি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
স্যাড।
ওপরের ঘরে এসে দেখা গেল, সোমনাথ নীচু স্বরে কিছু বলছে। লোকটা আনমনে অবহেলাভরে শুনছে। কফি ছোঁয়নি।
দিদিকে দেখে সোমনাথ উঠে এল। কানের কাছে মুখ এনে সামান্য উত্তেজিত গলায় ফিসফিস করে বলল, দশ লাখ অফার করেছে।
বাড়ি ভালো করে না দেখেই?