মিলি দত্তের হঠাৎ ভাইয়ের দিকে সোজা এবং কঠিন চোখে চেয়ে যেন ঝলসে উঠল, দেনা তো ওর, আমার তো নয়। কিন্তু বাড়িটা আমার। আমি যদি ওর দেনা শোধ করতে না-চাই?
সোমনাথ এবার একটু হাসল, স্বামী-স্ত্রীর অ্যাসেট আলাদা বলেই কি আর পার পাওয়া যায়? ওটা হয় না। তবু আমি উকিল নিয়ে আসব, কথা বলে দেখো। দেনা যদি শোধ করতে না-চাও তাহলেও বিপদ আছে। জামাইবাবু চড়া সুদেই লোন নিয়েছিল। যত দেরি করবে তত সুদ বাড়বে। আমার ধারণা ক্রিমিন্যাল কেস করলে আদালত এবাড়ি ক্রোক করবে। পাওনাদাররা খুব সহজ পাত্র তো নয়।
তারা কারা তা জানিস?
সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, সব জানি না। একটা হাউসিং লোন সোসাইটি আছে। ব্যাংক আছে।
মিলি দত্ত সোয়েটারে ভুল ঘর তুলে যেতে যেতেই বলে, আমাকে আর কয়েকটা দিন ভাববার সময় দে। মনে হচ্ছে বাড়িটা বিক্রিই করতে হবে। কত কষ্ট করে করেছিল বাড়িটা। এটা গেলে আমাদের আর কিছুই থাকবে না।
শোনো ছাড়দি, আমাকে ভিলেন বলে ভাবছ না তো! একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে নিজের বাড়ি কীরকম সেন্টিমেন্টের জিনিস হয় তা কিন্তু আমি জানি। অন্য কোনও পথ খোলা নেই বলে বিক্রির কথা বলছি। ভিলেনের মতো শোনালেও আসলে আমি যা বলছি তা প্র্যাকটিক্যাল। তোমার বাড়ি তুমি বিক্রি করবে কিনা ভেবে দেখো ভালো করে। সময় যত খুশি নাও, কিন্তু সেটা যেন লিমিট ছাড়িয়ে না-যায়।
মিলি দত্ত কাঁটা আর উল রেখে দু-হাতে মুখ চাপা দিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর যেন আরও গুটিসুটি মেরে ছোটো হয়ে গিয়ে বলে, ছেলে-মেয়েদের বলি। ওদেরও তো একটা মতামত আছে।
ওদের মত একটাই হবে। ওরা এবাড়ি বিক্রি করা পছন্দ করবে না। যাক গে, তবু ওদেরও বলল। একজন ভালো উকিল ডেকে কথা বলো।
তুই রাগ করছিস না তো।
সোমনাথ হাসল, না ছোড়দি, রাগ করছি না। তোমার সেন্টিমেন্ট আমি বুঝতে পারি। শুধু ডিসিশনটা তাড়াতাড়ি নিতে বলছি।
সেদিন বিকেলেও ঝড়-জল সমানে চলল। ফোন ডেড। লোডশেডিং। মিলি দত্ত পাশের মুখার্জিবাড়ি থেকে একটা ফোন করল বিপ্লব দত্তর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তরণী সেনকে। অনেকদিন আগে তরণী বিপ্লবের বিজনেস প্ল্যানিং করে দিয়েছিল। তরণী এখন খুব নামজাদা ইনকাম ট্যাক্স প্র্যাকটিশনার এবং অডিটার। প্রায়ই হিল্লি-দিল্লি করে বেড়ায়। মিলির কাছে সব শুনে বলল, হ্যাঁ মিলি, এসব ক্ষেত্রে অ্যাসেট রেখে লাভ নেই। বিপ্লবটা যে আপনাদের ডুবিয়ে দিয়ে গেছে তা আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারি।
করুণ গলায় মিলি বলে, অ্যাসেট বলতে শুধুই তো বাড়িখানা। আর কিছুই তো আমাদের নেই।
তরণী সান্ত্বনার গলায় বলে, বুঝতে পারছি। তবে সল্টলেক-এ দোতলা বাড়ি, ভালো দাম পাবেন। সে টাকায় অন্য কোথাও একটা ছোটোখাটো ফ্ল্যাট হয়ে গিয়েও হাতে বেশ কিছু টাকা থাকবে। চান তো আমি সে ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
মিলি বুঝল, ওই সিদ্ধান্তই একমাত্র খোলা পথ। বাড়ি বিক্রি করা।
রাতে খাওয়ার পর বসবার ঘরে ছেলে-মেয়েদের মুখোমুখি হল মিলি, শোনো, তোমাদের বাবার অনেক ধারদেনা রয়েছে। আমাদের হাতেও ক্যাশ টাকা বিশেষ নেই। সবাই বলছে বাড়ি বিক্রি করে দিতে।
শুনে কেউ চমকাল না। মনে হয়, ওরা আড়াল থেকে কিছু আঁচ আগেই করেছে। তবে মুখগুলো খুব গম্ভীর আর থমথমে দেখাল। সঞ্চারির চোখে টলটল করছে জল। তিনজনের মধ্যে ওই সব চেয়ে নরম।
মিলির চোখে জল নেই বটে, কিন্তু তারও কান্না পাথর হয়ে আছে বুকের মধ্যে। শুকনো গলায় মিলি বলল, তোমাদের আগে থেকেই জানিয়ে রাখলাম। কষ্টের জন্য তৈরি হও।
হঠাৎ তিথি বলল, বাবা এই বাড়িতেই মারা গেছে।
মিলি অবাক হয়ে বলে, তাতে কী হল?
তিথি হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যেন জেগে উঠে বলল, কিছু নয়। জাস্ট সেন্টিমেন্ট।
মিলি অনুত্তেজিত গলায় বলে, আমাদের সেন্টিমেন্ট আর মানায় না। খুবই খারাপ অবস্থায় আমাদের রেখে গেছেন তোমাদের বাবা। এবাড়ি ছাড়তে আমারও যে কত কষ্ট হবে তা তোমরা বুঝতেই পারছ। কিন্তু উপায় কিছু নেই।
বিপ্লব দত্তের তিন ছেলে-মেয়ে কেমন যেন ঘাড় শক্ত করে, কাঠ হয়ে, গোঁজ হয়ে বসে রইল। কেউ কিছু বলল না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, প্রস্তাবটা তাদের মনঃপূত নয়।
মিলির ভিতরটা টনটন করছিল অনেকক্ষণ। ছেলে-মেয়েদের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ পিতৃহারা এই তিন অসহায় সন্তানের জন্য এবং কে জানে আর কোন কারণে হঠাৎ তার দু-চোখ ফেটে জল এল। বাড়ি। বাড়ি মানে কি শুধু ইট কাঠ পাথর? বাড়ি মানে সকলে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকা নয়? এবাড়ি কবেই তাদের আত্মীয় হয়ে গেছে। সঞ্চারি, বুক্কা, তিথি, বিপ্লব যেমন অনেকটা তেমনি। মিলি কাঁদতে লাগল। নিঃশব্দে উঠে চলে গেল তিন ছেলে-মেয়ে। তার অদ্ভুত অনাত্মীয় সন্তানেরা।
.
০৪.
বাড়ির হবু খদ্দেররা আসতে শুরু করল ঠিক তিন দিন বাদে। চনচনে শীত আর খরশান রোদ আর শনশনে উত্তুরে হাওয়া এক রবিবারের সকালকে যখন মোহগ্রস্ত করে তুলছে তখন সল্টলেকের এই নির্জনতর রাস্তায় বাড়ির সামনে একটি নতুন লাল মারুতি এসে থামল। নামল অবাঙালি এক স্বামী আর স্ত্রী। দু-জনেই কিছু মোটাসোটা। বয়স ত্রিশের কোঠায়। তাদের পোশাক আর চেহারা দুই-ই ঐশ্বর্যের আভা বিকিরণ করছিল। যথেষ্ট বিনয়ী, শিষ্টাচারসম্পন্ন, মৃদুভাষী এবং গম্ভীর স্বামী আর স্ত্রীকে ফটকের কাছে রিসিভ করল সোমনাথ। তার মুখে আপ্যায়নের অর্থহীন বিগলিত হাসি।